Sunday, 15 January 2017

।। রুম নম্বর 148 ।।

 গ্যাংটকে পা দিয়েই বুঝলাম এই পিক সিজিনে হোটেল বুক না করে এসে পড়াটা বোকামো হয়েছে। কিন্তু এসে যখন পড়েইছি উপায় একটা হবেই। আমি একা মানুষ।  মাথা গোঁজার জন্য চারটে দেয়াল আর একটা ছাদের অভাব হবে না।

যে উদ্যম নিয়ে হোটেল খোঁজা শুরু করেছিলাম তাতে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়লো যখন প্রায় বিকেল পর্যন্ত একটিও থাকার জায়গা পেলামনা।  আর বড়োজোর দু ঘন্টা আলো থাকবে। পাহাড়ে সন্ধ্যেটা ঝুপ করে নামে আর তারপরেই শুনসান হয়ে যায় রাস্তা ঘাট।  এ অভিজ্ঞতা আমার আছে।  তাই হোটেল বা নিদেন পক্ষ্যে একটা সরাইখানা পেলেও বর্তে যাই।

পিঠের রুকস্যাক  নামিয়ে কি করবো ভাবছি এমন সময় এক বেঁটে মতো লোক এসে বললো , " বাবু হোটেল লাগবে?" আমি যেন এই দেবদূতের অপেক্ষাতেই ছিলাম। তাও একটু রঙ দেখিয়ে বললাম , "ভাড়া কত ? কোন জায়গায় হোটেল?"

লোকটা যেন আমার কথা শুনতে পায়নি এমন ভান করে , আমার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে আমায় বললো , "আসুন।" আমিও ওকে অনুসরণ করে চললাম মন্ত্র মুগ্ধের মতো।

পাহাড়ি চড়াইয়ে তিন চার বাঁক বেঁকে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম  ।  গেটের বাইরে একটা শত ছিন্ন শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছে একজন লোক।  বয়েস ভালোই হবে।  বহুদিনের না কাটা দাড়ি আর চুল একসাথে হাত মিলিয়ে জটার স্মৃষ্টি করেছে। তাকে পাশ কাটিয়ে আমায় নিয়ে হোটেল-এ ঢুকলো সেই আগন্তুকটি। হোটেলের মালিক সম্বোধন করে বললেন , " এসো নিখিলেশ " | যাক লোকটার নাম জানা গেলো।

বুঝলাম ইনি একজন দালাল। হোটেলের থেকে কমিশন খান। যাগ্গে  ওদের ব্যাপার ওরা বুঝবে। আমার থাকার জায়গা পেলেই হলো |

ভাগ্য দেবী  বোধহয়  আমার সাথে একটু পরিহাসের খেলায় মেতে ছিলেন।  হোটেল মালিক মুরারি বাবু আক্ষেপের সাথে জানালেন  যে ঘর ছিল কিন্তু আধ ঘন্টা আগে  এক দম্পতিকে  দিয়ে দিয়েছেন।

বাইরে তখন পাহাড়ের আড়ালে সূর্যদেব অদৃশ্য হয়েছেন।  জমাট অন্ধকার যেন গ্রাস করেছে এই বিশাল হিমালয়কে।

আমি বললাম , " খুব বিপদে পড়েছি। যদি আজ রাতটা এই রিসেপশনেই কাটাতে দেন তো বড়ো উপকার হয়।  ভাড়াও নয় দিয়ে দেবো।

মুরারি বাবু হেসে বললেন , "না দাদা। সেটা ঠিক হবেনা।  "

আমি কাতর  ভাবে বললাম , " যেকোনো  ঘর দিন।  আমি মানিয়ে নেবো।"

একটু চুপ করে মুরারি বাবু বললেন , " একটা ঘর অবশ্যি আছে | কিন্তু সেখানে থাকতে পারবেন কি ?"

আমি স্বস্তির হাসি হেসে বললাম, "পারবোনা মানে ? নিশ্চই পারবো ! যত খারাপ ঘর-ই হোক না কেন, রাস্তায় থাকার চেয়ে তো ভালো। "

মুরারি বাবু ভ্রুকুটি করে বললেন ,"ঘর খারাপ নয়।  সত্যি বলতে কি এই সান রাইজ হোটেলের সবচেয়ে ভালো ঘর "

আমি অবাক হয়ে বললাম, "তাহলে. ......"

আমার কথা মাঝখানে কেটে মুরারি বাবু বললেন , " ওই ঘরে বছর পাঁচেক আগে এক ইংরেজ সাহেব গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে ওই ঘরে কেউ থাকেনা। প্রচলিত ধারনা আছে , এখনো রাতে সাহেব ওই ঘরে শুতে আসেন আর অন্য কেউ থাকাটা উনি পছন্দ করেননা। "

আমি একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম , " আপনি চিন্তা করবেনা। সাহেব ভূত এলে সারা রাত পোকার খেলে কাটিয়ে দেব। আপনি ঘরটা আমায় দিয়ে দিন। "

ভদ্রলোক বেশি কথা না বাড়িয়ে , রেজিস্টারে নাম ধাম লিখিয়ে 148 নম্বর ঘরের চাবি দিয়ে দিলেন।

পিরামিড ধাঁচের হোটেল। যত ফ্লোর বাড়ছে তত ঘরের সংখ্যা কম আর চার তলায় ওই একটাই ঘর। চাবি ঘোরাতেই দরজা খুলে গেলো। রোজ সকালে পরিষ্কার করা হয়। তাই এতো বছর কেউ না থাকলেও ধুলো জমেনি। আলো জ্বালাই ছিলো। খাটের ওপরে সিলিং থেকে ঝোলানো একবাতির ঝাড়।

ঘরের মাঝখানে খাট আর তার পাশে একটা টেবিল। তাতে একটা গ্লাস রাখা। সাথে জল ছিল। গ্লাসটা ধুয়ে তাতে জল ভরে রেখে দিলাম। এখন রাত আটটা। ডিনার সেরে একটু বাইরে পায়চারি করলাম। ঘরে যখন ঢুকলাম তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে নটা।

লেপটা গায়ে টেনে শুয়ে পড়লাম। অস্বীকার করবোনা , যে অসীম সাহস ঘর নেবার সময় দেখিয়ে ছিলাম তাতে যেন একটু ফাটল ধরেছে। একজন অচেনা কারো উপস্থিতির অনুভূতি বার বার আমায় ঘিরে ধরছে।

দুর্বল মনকে বশে আনতে একটা ঘুমের বড়ি খেয়ে নিলাম  আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাত কটা হবে জানিনা , একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেলো। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলে দিলো কিছু একটা গোলমাল আসন্ন। আর তার পূর্বাভাস যেন ঘরের আবহাওয়ার মধ্যেই আছে।
যে আলোটা সিধে ওপর থেকে খাটের ওপর ঝুলছিলো আর যেটা আমি ইচ্ছে করেই নেভাইনি, তার মধ্যে এক অপার্থিব অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। সেই আলো এখন আর স্থির নেই। কেউ তাকে দোলাচ্ছে আর সারা ঘরময় আলোর খেলা চলছে।  জানলা বন্ধ , হাওয়া নেই। তবে কি করে দুলছে ওই আলো? তার গতি বাড়ছে। পাগলা হাতির মাথার মতো এদিক ওদিক হতে শুরু হয়েছে।

আমি ভয়ে হাত বাড়ালাম টেবিলে রাখা জলের গ্লাসের দিকে। কিন্তু একি ? কোনো এক অদ্ভুত জাদুবলে সেই গ্লাস কাঁপা কাঁপা পায়ে যেন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার সেই অসংলগ্ন চলার ভঙ্গির জন্য জল ছলকে বাইরে পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। আমার পায়ে মৃদু টান অনুভব করলাম।  খাটের মধ্যে কেউ যেন প্রাণ সঞ্চার করে দিয়েছে আর সে চাইছে আমায় ফেলে দিতে। আর তাই সে যেন নিজেকে ঝাঁকিয়ে আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমি অন্য কারো জায়গা দখল করেছি ; যেটা সে ঘরের আলো , গেলাস বা খাট  কেউই মেনে নিতে পারছেনা আর এই পুরো ঘটনার পেছনে আছে অদৃশ্য এক শক্তি, যে এই ঘরেই উপস্থিত। সে আমার উপস্থিতি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছেনা আর তাই এই তান্ডব তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ।

এক লাফে নেমে পড়লাম খাট থেকে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এসেছে।  এই ঠান্ডায়-ও সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নির্বোধের মতো চিৎকার করে উঠলাম , "কে ? কে ওখানে ?" উত্তরে যেটা পেলাম সেটা আমার হৃদ্স্পন্দনকে দ্বিগুন করে দিলো। আমি স্পষ্ট শুনলাম একটা কান ফাটা অট্টহাসি যেটা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।  আমি জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান যখন ফিরলো তখন সকাল হয়ে গেছে।  ঘরে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। উঠে বসলাম। সমস্ত ঘর লন্ড ভন্ড। যেন কাল রাতে কেউ প্রলয় নৃত্য করেছে।  আর না। মনে মনে স্থির করলাম ঘরটা ছাড়বো। এর  চেয়ে রাস্তাও বেটার।

ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নেমে দেখি ম্যানেজার চা খাচ্ছে।  আমায় দেখে একটা হালকা হাসি হেসে বললেন , "ধন্যি আপনার ঘুম মশাই! কাল রাতে পুরো গ্যাংটক শহর জেগে গেলো কিন্তু আপনার টুঁ শব্দটি নেই ?

আমি একটু অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বললাম , "কি হয়েছিল কাল রাতে? "

ম্যানেজার চোখ কপালে তুলে বললেন , " সেকি মশাই ! অমন ভূমিকম্প হলো টের পেলেন না ? একবার নয়।  পর পর তিনবার ! শেষেরটা ছিলো সব চেয়ে জোরে।  রিখটার স্কেলে রিডিং ছিল সিক্স পয়েন্ট টু। "

আমি একটা বোদ্ধা ভাব এনে বললাম , "জানিতো।  ওই সব সময় না বেরোনোই ভালো।
আচ্ছা ওভাবে হাসছিলো কে কাল রাতে ?"

এর উত্তরো দিলেন ম্যানেজার মুরারি বাবু। একটা আড়মোড়া কেটে বললেন, "ওটা জগাই।  ওই জটাধরি পাগলটা।  গেটের সামনেই থাকে। সবাই ভয়ে দৌড়োচ্ছিলো দেখে ওর নাকি হাসি পেয়েছিলো "

আমি আর কথা এগোলাম না।  চাবিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম , "একটু ঘুরে আসি "

ম্যানেজার বললেন , " তাড়াতাড়ি আসুন। একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো আর তারপর আপনাকে একটা কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ রুম দিয়ে দেব দোতলায়। আজি খালি হল ।
   ________
© সৌরভ দত্ত

No comments:

Post a Comment