Friday, 13 January 2017

।। আলো ।।

       তমনাশের শরীরটা কদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না ।বুকের ব্যথাটাও বেড়েছে।থেকে থেকে কাশির ঝোঁকে শরীরটা তার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। একটানা কাশির ধকল সামলে একটু দম নিয়ে তমনাশ ডাকে --আলো ,ও আলো ,কোথায় গেলে?
   এইতো ,আসছি -বলে তমনাশের স্ত্রী আলো গরম তেলের বাটি এনে স্বামীর  বুকে তেল মালিশ করতে বসে। একথা সেকথা বলতে বলতে আলো বলে হ্যাঁ গো? আজ এক মাস ছাব্বিশ দিন হলো তুমি বাড়িতে বসে।তা তোমাদের জুট মিল কবে খুলবে?
      তমনাশ গরম তেল মালিশের আরামটুকু চোখ বুজে উপভোগ করে শুধু ,মুখে কিছু বলে না।
    আলো বলে কিগো? কিছু বলছ না কেন?
    তমনাশ মিটমিট করে চেয়ে একটা উপুর নিঃশ্বাস ছেড়ে  বিষন্ন বদনে বলে কিজানি ! কবে খুলবে।আর খুললেই বা কি হবে?এই শরীরে শ্রমিকের কাজ  করতে পারব?
  -----তাহলে সংসার চলবে কি করে?মুদির দোকানে ধার।বিল বাকি  থাকায় ইলেকট্রিক কেটে দিয়ে গেছে।আজ কানের সোনা বিক্রি করে তোমার ওষুধ এনেছি।তাছাড়া মেয়েটাও মাথায় মাথায় বড় হয়ে উঠছে।এ ভাবে আর কতদিন চলবে?
   কিজানি আলো !, তমনাশ হাতে ভর দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বিছানার উপর উঠে বসে বলে - আমার জামাটা দাও দেখি আলো,শ্রমিক-মালিক মিটিংটার কি হল একটু  শুনে আসি।
--এই অসুস্হ শরীরে যাবে ?তাছাড়া ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে,ভিজলে ঠাণ্ডা লেগে বুকের ব্যথাটা আরো বাড়বে।
    তমনাশ জামা পরতে পরতে বলে --আরে না না,কিচ্ছু হবে না ।তার পর ঠোঁটের কোনে কষ্ট করে হাসি টেনে এনে জিজ্ঞাসা করে --তুমি আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা কর ,না?  সব ঠিক হয়ে যাবে আলো ,সব ঠিক হয়ে যাবে--বলে একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে মেয়ের ছাতাটা নিয়ে তমনাশ ধীর পায়ে বাড়ি থেকে  বেড়িয়ে যায়।
    আলো  স্বামীর যাত্রা পথের দিকে চেয়ে কপালে করজোড় করে বলে ঠাকুর, মানুষটাকে তাড়াতাড়ি সুস্হ করে দাও ঠাকুর।
   
---- এমন সময় তমনাশের মেয়ে তমসা ছুটতে ছুটতে এসে  ডেকেবলে  --মা,মা,পাশের বাড়ির কাকিরা খেঁজুর গুড় কিনছে ,কি সুন্দর গন্ধ।এই দেখো আমার হাতে কফোঁটা দিয়েছিল,কিনবে মা?
---না ,থাক,পরে কিনব।
তমসা অভিমান মেশা কণ্ঠে বলে ---ফার্স্ট জানুয়ারীতে বললে পরে কেক কিনে দেবে আর দিলে না।এখনও বলছ পরে কিনবে।আর কবে কিনবে?খেঁজুর গুড় দিয়ে পিঠে খাব না?
     আলো  তমসার গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বলে --খালি খাওয়া আর খাওয়া ! এত বড় মেয়ে বোঝে না কিছুই।বাবার শরীর খারাপ,কারখানা বন্ধ।তারপর তমসার চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে টেনে এনে  আলো বলে --'খা ,আমার মাথাটা  চিবিয়ে চিবিয়ে খা, বলে মা -মেয়ে গলাগলি করে কাঁদতে থাকে।
----নাগো মা, না,অমন কথা বলো না ।আমি আর কোন দিনও বলব না।বাবা সুস্হ না হওয়া পর্যন্ত,কারখানা না  খোলা পর্যন্ত আমি আর কিচ্ছু চাইবো না-- বলে তমসা আলোর কোমড় ধরে কাঁদতে কাঁদতে বসে পরে।
    রাত নটার সময় তমনাশ অন্ধকার ঘরে ফিরে  হেঁকে বলে কৈ,আলো কোথায়?ভাল খবর আছে।
   আলো   আটামাখা হাতে অন্যহাতে ধরা  কুপির আগুন আড়াল করে রান্না ঘর থেকে ছুটে এসে সোৎসাহে বলে কি খবর গো? কারখানা খুলেছে?কবে থেকে কাজে যোগ দিচ্ছো?
  তমনাশ গম্ভীর ভাবে বলে আমি কাজে যোগ দেব না ,তুমি যোগ দেবে।
----তার মানে?
    মানে,   এম.এম .কে প্রাইভেট কোম্পানীতে নাইট শিফটে একটাই ফিমেল পোষ্ট ফাঁকা ছিল। কাজ বিশেষ কিছু নেই।মাইনে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার।এই নাও  এপয়েন্টমেন্ট লেটার আর একমাসের এডভান্স ।আর হ্যাঁ ,বস তোমার কজে খুশি হলে মাসে আরো টেন পার্সেন্ট একস্ট্রা।
    কথা শেষ হবার আগেই আলোর হাত থেকে কুপিটা  পরে যায়।আলোর মুখ অন্ধকারে ঢেকে যায়।   ঘরের মধ্যে আলোহীন  নৈঃশব্দ বিরাজ করে।তমনাশ ও আলো মুখো মুখি দাঁড়িয়েও  একে অপরের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকিছু শুনতে পায় না ।
______
© তাপস

No comments:

Post a Comment