বুক ফেয়ারের প্রাঙ্গনে ঢুকেই নীলু জিজ্ঞেস করে , ' বই কিনতে গেলে কি মুখ গম্ভীর করে চলতে হয় ? ' আমি বলি , ' কেন কি হয়েছে ?' নীলু বলে , ' মেলা সে বইর হোক বা গাই বাছুরের হোক , তার প্রথম শর্ত স্ফূর্তি করা। মুখ গম্ভীর করে থাকলে কি আর মনে স্ফূর্তি আসে। ' বুঝতে পারলাম নীলু কথাগুলি আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। আসলে মেলায় ঢুকেই আমার ক্ষিধে পেয়েছে। অফিস থেকে সোজা এসেছি মেলা প্রাঙ্গনে। এই সন্ধ্যার মুখে ক্ষিদে পাওয়াটা স্বাভাবিক। আমি এদিক ওদিক দেখছিলাম খাওয়ার স্টলগুলি কোনদিকে। তাই হয়তো ক্ষিদের চোটে মুখের জিওগ্রাফি পাল্টে গিয়ে থাকবে। তাই আমি হেসে জবাব দি , ' পেটে ক্ষিদে নিয়ে চললে , মনে স্ফূর্তি আসবে কথা থেকে। ' আমার কথা শুনেই নীলু হন হন করে চললো ফুড স্টলের দিকে। দুদিন আগে ও ওর বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলো , তাই ঠিক জানে কোনদিকে খাবারের স্টল।
একটা দোকানে পাতা বেঞ্চিতে বসে সবে চিকেন রোল শেষ করেছি , দেখি নীলুর কলেজ ফ্রেন্ড অসীমা এসে হাজির। নীলুকে দেখে অসীমার প্রথম প্রশ্ন , ' দেখি তুই কি বই কিনলি ?' নীলু বলে , ' আমি তো বই কিনতে আসিনি। ' অসীমা অবাক হয়ে বলে , ' তবে কি খালি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে সময় কাটানোর জন্য এসেছিস ?' নীলু বলে , ' অরে বাবা , মেলায় কেউ যায় পাঁপড় ভাজা খেতে , আবার কেউ যায় রুটি সেঁকার জালি কিনতে। কাজেই তুই যা ভাবছিস খুব বেশি ভুল নাও হতে পারে। ' এতক্ষন পরে অসীমার চোখ পড়লো আমার দিকে। নীলুর কথায় বুঝি ও আস্বস্ত হয়েছিল যে নীলু অবশেষে নিজের বয়ফ্রেন্ড খুঁজে পেয়েছে। আমার দিকে হ্যান্ড শেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলে ,' আমার বন্ধুর সঙ্গে ঘোরাঘুরি কবে শেষ হচ্ছে ?' অসীমা অবশ্য আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই এগিয়ে যায়। আমি ওকে যেতে দেখে হেসে ফেলি। নীলু বলে , ' যাক পেটে কিছু পড়ার পর গোমড়া মুখে কিছু হাসি দেখা দিলো। চলো এবার দেখে আসি আর কত গোমড়া মুখ মেলায় ঘোরাঘুরি করছে। '
একটু যেতেই সামনে দেখি একটা ছোট স্টল। স্টলে ঢুকে দেখি কেবল বিভিন্ন পূরাণের বইতে দোকানটা ঠাসা। সব ভগবানের নামে একটা করে পুরাণ । প্রতিটা পূরাণের আবার পূর্ণাঙ্গ এডিসন থেকে নিয়ে পকেট এডিসন পর্যন্ত বিভিন্ন সাইজের বই। দেখি একটা সুন্দর মেয়ে , নীলুর বয়সী হবে , পরনে সুন্দর সালোয়ার কামিজ , এক মনে খুব সিরিয়াস ভাবে একটা বিষ্ণু পুরান খুলে দেখে যাচ্ছে। বইটার পাতা উল্টাচ্ছে আর নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে চলেছে। বোঝা যাচ্ছে কোনো কারণে বইটা দেখে বেশি খুশি হয়নি। নীলু চট করে নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট ডাইরি আর পেন নিয়ে হাজির মেয়েটার সামনে। গিয়ে বলে , ' আমি ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার। মেলা নিয়ে একটা আর্টিকল লিখছি। ' মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে ,' বলুন , কি জানতে চান। ' নীলু বেশ খোলাখুলি জিজ্ঞেস করে , ' আপনি কি পুরাণ তত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন ?' এবার দেখি মেয়েটি ,হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বলে ,' আমার হবু শাশুড়ির মন জেতার চেষ্টায় আমার অবস্থা আমসত্ব হয়ে গেছে। ' জানা গেলো মেয়েটির হবু শাশুড়ি বিধবা মানুষ। দুবেলা পুরাণ পাঠ করেন। তাঁর খুব ইচ্ছে যে বিয়ের পর ছেলের বৌকে রোজ পুরাণ পাঠ শোনাবেন। তাই মেয়েটা এসেছে কটা পূরণের বই কিনতে যাতে বুঝে উঠতে পারে পুরাণ কি জিনিষ। নীলু মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে যে বইগুলো কিনে বাড়িতে নিয়ে পড়ার সময় পাবে কি। এবার দেখি মেয়েটা বেশ জোরে জোরে হেসে উঠে বলে , ' সময়ের অভাব নেই , অভাব খালি ধৈর্য্যের। তবে মাথার কাছে রেখে ঘুমোলে , যদি কিছুটা রেডিয়েশনে ঢোকে। ' দোকান থেকে বেরিয়ে নীলু মন্তব্য করে , ' মেয়েটা বেজায় রসিক বটে। '
এরপরে আমরা গেলাম আনন্দ পাবলিশার্সের দোকানে। দোকান বেশ গমগম করছে। অধিকাংশ লোকেই নিজেদের পছন্দের বইর লিস্ট নিয়ে এসেছে। সেই লিস্ট দেখে অর্ডার দিয়ে বই কিনে নিচ্ছে। বই ঘেঁটে দেখে বাছাই করার লোক অনেক কম। দেখি এক কোনায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা , বয়স ষাট , পঁয়ষট্টি হবে সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল নিয়ে খুব গম্ভীর ভাবে পড়ে যাচ্ছেন। নীলু গিয়ে আবার ফ্রিলান্স রিপোর্টারের পরিচয় দিয়ে , ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করে , ' এতো গম্ভীর ভাবে কি পড়ছেন ?' মহিলা বই থেকে চোখ না তুলে বলেন - আবোল তাবোল। ' নীলু এবার জিজ্ঞেস করে ,' বইটা কি খুব সিরিয়াস বই ? ' এবার ভদ্রমহিলা বই থেকে মুখ তুলে , চশমাটাকে একটু নাকের উপর ঠেলে বললেন , ' আপনি কি সেই "বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই" ? নীলু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় ,' আমি "বিদ্ঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভূত" . মহিলা এক লহমায় সূচিপত্র দেখে , একগাল খুশির হাসি মিশিয়ে আবোল তাবোলের "কিম্ভুত " ছড়া পড়তে শুরু করেদিলেন
"বিদ্ঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভূত,
সারাদিন ধ'রে তার শুনি শুধু খুঁতখুঁত ৷
মাঠপারে ঘাটপারে কেঁদে মরে খালি সে,
ঘ্যান্ ঘ্যান্ আব্দারে ঘন ঘন নালিশে ৷"
তারপরে জানলাম মহিলা দুপুর বেলা নিজের তিন বছরের নাতনিকে সামলান। ছেলে আর ছেলের বৌ দুজনেই চাকরি করেন। নাতনিকে ব্যস্ত রাখার জন্য আবোল তাবোল কিনতে এসেছেন। ছেলে , ছেলের বৌ আর নাতনি গেছে চা খেতে। সেই ফাঁকে ওঁর এই বই দেখা। স্টল থেকে বেরিয়ে নীলু মন্তব্য করে ,' ভদ্রমহিলা রসে পুরো টইটম্বুর। ‘
এরপরে আমরা গেলাম অক্সফোর্ডের দোকানে। সার সার ইংরেজির বই। লোকজন অনেকেই বই ঘেঁটে পছন্দ করছে। বেশির ভাগ কোনো লিস্ট নিয়ে আসেনি। দেখি এক সাহেব মার্কা লোক , মুখে ফ্রেঞ্চ কাট , পরনে গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট , একমনে ফ্রেডরিক ফোরসিথের "ওডেসা ফাইল" পড়ে যাচ্ছেন। ' নীলু আবার আগের মতন নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করে ইংরেজিতে , ' আপনি কি থ্রিলার পড়তে ভালোবাসেন। ' দেখি সেই সাহেব মার্কা লোক হাসতে হাসতে দিব্যি বাংলায় বলেন , ' ধুর আমি কোনোদিন সাহেবের গু মাড়াইনা। আমার দৌড় সবে নীললোহিত আর কালকূট পেরিয়ে শীর্ষেন্দুতে আটকে পড়েছে। তারপর আর এগোতে চাইনা। ' নীলু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে , ' তবে আপনি এতো মন দিয়ে ওডেসা ফাইলের মতন থ্রিলার পড়ছেন কেন ? ' তখন জানা গেলো ভদ্রলোকের বৌ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সারা দিনরাত নার্সের সেবাতেই সময় কাটে। তিনি আবার ইংরেজি থ্রিলার পড়তে পাগল। তাঁর জন্য এই ভদ্রলোককে বই কিনে আনতে হয়। সেই বই বাছাইর জন্য যতটুকু পড়া দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
স্টল থেকে বেরিয়ে নীলু বলে , ' চলো এবার বাড়ি ফিরে যাই। ' আমি বলি , ' তুই যে একটা বইর লিস্ট নিয়ে এসেছিলি কেনার জন্য সেটার কি হবে। ' নীলু আকাশপানে চেয়ে বলে , 'তিনটে দোকানে তিনটে মানুষ দেখে যে সুখ পেলাম তা কি আর বই পড়ে পাওয়া যায়। ' কেন কি জানি নীলুর কথা শুনে আমার মুখ থেকে ফোঁস করে বেরিয়ে এলো কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার অংশ
"ব্যাপার কী, আর গল্প কি নেই?
রাস্তাটা যে অনেক বাকি।
চোখ তুলে কালপুরুষ দেখেই
ফুরিয়ে গেল সব কথা কি?"
_________© সনৎ মিশ্র
No comments:
Post a Comment