Monday, 9 January 2017

।। জাঙ্গলিক ।।

নব্বই থেকে কমিয়ে জিরো তে স্ট্যান্ড করে, স্যাট করে বাইকটা থেকে নেমে প্যান্টের চেন টা খুলে সবে একটা ছোট্ট সাইজের উইঢিপি টার্গেট করেছি৷ এমন সময়....
—হোওও৷ হখানে মুতিসনি৷ হখানে মুতিসনি৷
চমকে গিয়ে যে যার জায়গায় ফিরে এলাম৷ আমি বাইকে, আর....
এমন বাঁজাখাই চিৎকার শুনে ভাবলাম, যাহ্ শালা! এই ঘনজঙ্গলে টারজান না অরন্যদেব! কে নেমে এল৷ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি এই ভদ্রলোকটিকে৷ হাফধুতি আর সাদা জামা৷ হাতে একটি লাঠি আর ঢালাইএর জুতো পরে সাক্ষাত জঙ্গলের রাজা৷
মনে হেব্বি রাগ হল৷ কিন্তু এদিকে অবস্থা খারাপ৷ আমতা আমতা করে বললাম
—ইয়ে কাকা! হেব্বি চাপ৷ যে কোন মুহুর্তে...
—হই হোধাট্টায় কর৷ এদিকটাই করিসনি৷
তলপেট খালি হওয়ার সাথে ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কে অলস মস্তিষ্কে শয়তানি বুদ্ধি ভর করল৷ বেল্টটা আর একঘাট বাড়িয়ে কাকার কাছে গেলাম৷ সে ততক্ষনে রাস্তার ধারে মাটিতে বসে হাতে দোক্তা ডলছে৷ আমি যদিও এসব খাইনা, তবু আলাপ জমাবার ছলে বসলাম কাকার সামনে
—কাকা! জঙ্গলটা কি তোমাদের?
—ধুস্ শ্লা!
—তাহলে আমাকে পেচ্ছাব করতে বারন করলে যে?
—কুথাটায় মুতছিলি আগে দ্যাক! উইঢিপি এ মুত্তে নাই৷ তাছাড়া জংগলে চাদ্দিকে নানা অজিনিস কুজিনিস ঘুরে বেড়ায়৷ জন্মের নাম ভুলি দিবে এগ্বারে৷
গল্প জমে উঠেছে৷ তবে কাকা আমাকে বারন করে ঠিকই করেছে৷ উইঢিপিটা ভিজিয়ে দিলে অপদেবতারা আমার কি ক্ষতি করত জানিনা৷ তবে একটা ছোট্ট ইকোসিস্টেমের যে একটা ছোট্ট ক্ষতি হয়ে যেত, সেই এই বাই_লজি পড়া মাথায় ঢুকছে ততক্ষনে৷ কিন্তু কি করি৷ ফেসবুকের বহু গুরুদেব মানুষ এতদিনে আমার স্বরুপ জেনে গেছেন৷ দুচারলাইন আঙবাঙ লিখে ফেললেও আমি ছেলেটির যে কোন আইডেন্টিটি নেই, সেটা তেনারা সম্যক বোঝেন৷
সত্যিই নেই কাকা৷ মানুষ হতে পারিনি, তাই এই অনিষ্টকর চিন্তাভাবনা গুলোই প্রথম মাথায় আসে৷ ছোটবেলায় উড়ন্ত ফড়িং ধরে পিছনে সরু কাঠি ঢুকিয়ে ছেড়ে দিতাম, কখনও কখনও সুতো বেধে ছেড়ে দিতাম৷ বাবা বলত, এর জন্য নাকি নরকে গিয়ে শূলে চড়ানোর শাস্তি বিধান আছে৷ অবশ্য সেটা যদ্দিন না সেখানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছি তদ্দিন বুঝতে পারবোনা৷ এবং সেকথা মাথায় রেখেই মা ইহকালেই তার বিধান কম্মটি সেরে ফেলতেন৷ দুচারখানা কাঁচা কঞ্চি একেবারে হজম করার মত ক্ষমতা রপ্ত করে ফেলেছিলাম ততদিনে৷ একটুও চোখের জল বেরুতনা৷
স্কুল ছুটি আর ঘরে কিছু কাজকম্ম না থাকলে আমার পক্ষীরাজটাকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই হেথা সেথা বেরিয়ে পড়ি৷ বেশি ভাললাগে জঙ্গলের বুক চিরে যাওয়া কালো পিচ রাস্তা৷ ঘনজঙ্গলের মাঝ বরাবর বলে গাড়িঘোড়ার সংখ্যা খুবই কম৷ পায়ে হাঁটা লোক তো দুরের কথা, সাইকেল নিয়েও কাউকে চট করে দেখা যায়না৷ আর এরকম শুনশান ফাঁকা রাস্তায় একলা হেঁটে দেখেছি, অনুভব করেছি৷ আমি একা আসলে একা নই৷ আমার চারিদিকে অনেকেই থাকে৷ কেউ বড় গাছটার মগডালে৷ কেউ কাঁটাঝোপ টার আড়ালে৷ কেউ শুকনো পাতায়৷ কথা বলে৷ হেঁটে চলে৷ ফিস ফিস৷ খস খস৷ শব্দ শুনেছি আমি৷ জানি, নিশ্চিত এই ভদ্রলোকটি সেই তাদের কথাই বলছিলেন৷ আমি আবার খোঁচালাম
—কাকা, হাতি টাতি এসছে নাকি এবছর?
—আড়াবাড়ি দ্দিকটায় নেমচে৷ হেদিকটায় এসেনি হেখনো৷
—তাহলে আর জঙ্গলে কিসের ভয়৷ নাকি কাকা?
—জঙ্গলকে চিনিসনিরে বাপ৷ মদ্যি বনে ঢুকে দ্যাখ৷ এমন চোখে ধাঁদা লাগি দিবে নি! রাস্তা খুঁজে পাবিনি৷ দিন রাত একটা জায়গায় ঘুরবি৷ ঘুরে ঘুরে মরবি৷ ফাঁক কে এসার রাস্তা পাবিনি৷ দম আছ্যে! ঢুকে দেখ কিনা!
নাহ্ ৷ আমার অবশ্য দম ছিল না৷ জঙ্গল ভালবাসলেও, জঙ্গলের গভীরে গিয়ে একজায়গায় ঘুরে মরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলনা৷ তবে জঙ্গল যে একেবারেই চিনি না তা নয়! ছাতু(মাশরুম) তুলতে অনেক সময় গভীর জঙ্গলে ঢুকেছি৷ হাতির মুখে পড়েছি....
—কিরআ! ঢুগবি?
—চল ত কাকা৷ দেখি তমার জঙ্গল...
বাইককে রাস্তার সাইডে রেখে ঢুকলাম গভীর জঙ্গলে৷ অপরিচিত কাকা আমাকে জঙ্গলের সাথে নতুন করে পরিচয় করালো৷
একটা শুকনো বড় গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ কেউ যেন ইচ্ছে করে একসময়ের শক্তপোক্ত সবুজ গাছটায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল৷ গাছটার ওপরের ডাল থেকে একটা মোটা, পোড়া কালো দড়ি ঝুলছে!
—ধনার মিয়াটাকে গলা দড়ায় টেনে এনেছিল৷ এই গাছটায় গলায় দড়ি দেয়৷ দুদিন পরে ধনাকেউ গলাদড়ায় লিয়ে এসে এই গাছটায় টাঙায়... গাঁয়ের লোকে এই গাছটাকে পুড়াতে তবে গলাদড়া টা যায়৷ নাহলে আরও কতককে মাত্ত৷
চমকে উঠে পিছিয়ে এলাম! মনে হল দড়িটা যেন দুলছে৷ গাছটার পোড়া ডালটা যেন নড়ে উঠল৷ পিছিয়ে এলাম৷
—কিরা৷ ভয় পাঁইয়ে গেলি য্য্যা! চ উদিকটায়৷
টোপাকুলের গাছটা পাকা কুলে হলুদ হয়ে আছে৷ জঙ্গলের ভেতর বলে কারুর হাত পড়েনি৷ একমুঠো পকেটে নিয়ে, আরেকমুঠো হাতে নিয়ে চিবুতে চিবুতে কাকার পিছু নিলাম৷
কিছুটা এগিয়ে দেখি একটা শ্যাওড়া ঝোপের মাঝখানটা কিছুটা পরিস্কার করে, দুতিনটে পাথরের উপর সিঁদুর লেপা রয়েছে৷
—ইটা বড়ামবুড়ির থান৷ গড় কর৷ মনের ইচ্ছা পুন্ন হবেক৷
—কি যে বল কাকা৷ তমার ঠাকুর আমার চাহিদা পুরন কত্তে পারবে৷
—ঠাকুরের আশিব্বাদ পেলে সব পাবি রে৷ মদনের ছ্যানাটা এবছরে সরকারি কাজ পেল৷
—মদনার ছেলেকে যদি ঠাকুরে চাকরী দিল তাহলে মদনাকে জমি বিক্রি করে ন'লাখ টাকা খরচা করতে হল ক্যানে?
—চওধুরিদের বড় কত্তাও ত ন'লাক দিল৷ তার ছ্যানাটার হলনি ক্যানে?
চুপচাপ এগিয়ে চল্লাম কাকার পিছু পিছু
—কাকা হাতি আসেনি এবছর?
—চ! দেখাব চ৷
জঙ্গল ক্রমশ ফিকে হচ্ছে৷ একটা গাড়ির শব্দ পেলাম৷ তার মানে আমরা বাইরে বেরিয়ে আসছি৷ কাকাকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে এলাম আমি৷ তাহলে হাতি দেখতে পাবোনা..
—হুই দ্যাক!
জঙ্গলের ধারে পুকুরের পাড়ে একটা ভাঙ্গা ইঁটের বাড়ি! সামনে একটা ডিপটিউবওয়েল! আধভাঙ্গা ইলেকট্রিক পোষ্ট!
—এগুলো কি কাকা?
—গেল বছরের ঘটনা৷ হাতির পালটা জল খেতে এসছিল এই পুকুট্টায়৷ মা হাঁতিটা এগিয়ে ছিল৷ পিছনে দুটা বাচ্চা হাঁতি, তার পিছনে বাপটা৷ বড় রাস্তার ধার থেকে যে ইলেকটিকের তার টা এসছিল, সেটা দ্যাখেনি৷ মা হাতিটার পিটটায় তারটা লাগতেই চাদ্দিকে বিদ্যুত খেলে গেল৷ সে কি গঙানি! সে কি ভয়ঙ্কর ডাক, গজ্জন! পিছনের বাচ্চা দুটা ভয়ে পেয়ে মা'টাকে শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধত্তে যেয়ে শেষ হয়ে গেল৷ তিন তিনটা পেরান চোখের সামনে শেষ হয়ে গ্যাল!
—তুমি নিজে দেখেছিলে৷
—আমারই ত দোষ! আমারিই জমিতে জল দিয়ার লেগে কারেন্টা টেনেছিনুম৷ আমরা তিন বাপ ব্যাটায় ত সেরাতেও এই ঘট্টায় ছিনুম৷
—তারপর!
—হাতিঠাকুর অপরাদিকে ক্ষমা করেনি৷ চেরজেবনের জন্য মনে রেকে দ্যায়৷ পতিশোদ লিয়ে তবে শান্ত হয়৷আমাকেও ছাড়েনি! তিরিশটা হাতি সেদিনে ঘিরে ফেলল আমাদে তিন বাপ ব্যাটাকে!
—তারপর?
—তারপর আর কি! সব শেষ...
—মানে?!?!
পিছন ফিরে কাকার দিকে তাকালাম৷ কেউ কোথ্থাও নেই! চোখের সামনেটা কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল৷ চোখের সামনে তখন ভেসে উঠছে একটা পোড়া গাছ, কালো দড়ি, ভাঙ্গা ঘর.....আর তীব্র আর্তনাদ...
আমি চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেলাম৷ততক্ষনে আর একটা বাইক এসে থেমেছে আমার পাশে৷ সানগ্লাস টা কলারের পিছনে গেঁথে, প্যান্টের চেইন খুলে সেই উই ঢিপি টাকেই টার্গেট করল বছর পঁচিশের ছেলেটি!
—হোওও৷ হখানে মুতিসনি, হখানে মুতিসনি৷
নিজের গলাটা শুনে নিজেই চমকে উঠলাম আজ আমি!
___________
©দীপেন ভুঞ্যা

No comments:

Post a Comment