Monday, 9 January 2017

।। নীলুর প্রথম প্রেম ।।

হাতি বাগানের বাজারের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীলু দাঁড়িয়ে পড়ে বলে , ' দেখো পথের পাঁচালির  অপু লেডিস ব্যাগ বিক্রি করছে। ' আমার চোখে পথের পাঁচালির অপু বড় হয়ে সৌমিত্র চ্যাটার্জি হয়ে গিয়েছে।  সৌমিত্র লেডিস ব্যাগ বিক্রি করছে কল্পনাও করতে পারিনা।  তবু নীলুর কথায় ঘুরে দেখি রাস্তার ধারের লেডিস ব্যাগ বিক্রির দোকানে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দেখতে অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার ছোট্ট অপুর মতন দেখতে।  বছর বারো পনেরো বয়স হবে , চুলগুলো এলোমেলো , দুচোখে একটা বিস্ময়ের ঘোর দেখতে পাচ্ছি। ' নীলু বলে , 'দেখছো কি চলো ভালো করে দেখে আসি। ' আমিও তাই নীলুর সঙ্গে ওই দোকানে ঢুকে পড়ি।  দেখি দোকানে এক মা আর তার টিন এজ মেয়ে একটা ব্যাগ বাছাই করে দরদাম করছে।  

ছেলেটার বলা দামের অর্ধেক  দাম দিতে চাইছে।  ছেলেটা কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা।  খালি বলে ,' কম দামে বেচলে বাবা মারবে। ' সব শুনে বুঝলাম ছেলেটার বাবাই দোকান সামলায়।  কোনো কাজে কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেছে।  তাই দোকানের জিম্মা ছেলেটার কাঁধে।  দোকানে ঢুকেই নীলু ব্যাগ বাছাই করতে লেগে যায়।  একটা করে ব্যাগ দেখে আর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে , ' বল দেখি এই রং আমাকে মানাবে। ' নীলু  যে রঙের ব্যাগ দেখায় সবেতেই ছেলেটা  মাথা নেড়ে জানায় যে রংটা নীলুকে মানাবে।  

নীলু প্রতিবারে ছেলেটার উত্তর একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে অন্য রঙের ব্যাগ বাছতে লেগে যায়।  ওই মা মেয়ে দরদাম মাঝ পথে আটকে রেখে নীলুর ব্যাগ বাছাই দেখতে থাকে।  শেষমেশ নীলু একটা হালকা নীল রঙের ব্যাগ পছন্দ করে দাম জানতে চায়।  ছেলেটা যে দাম বললো , নীলু কোনো দরাদরি না করে পুরো দামটা মিটিয়ে দেয়।  দোকান থেকে বেরিয়ে আসছি , শুনতে পেলাম দোকানে দাঁড়ানো মা মেয়েকে বলছে  , ' যত্ত সব বড় লোকের চালিয়াতি ।  বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই নেই।  দর করলে অর্ধেক দামে যেটা পাওয়া যায় , তার পুরো দাম দিয়ে ফুটানি দেখাতে  চায় এই সব চালিয়াতি মেয়েরা।  ' নীলু সব শুনেছে।  তাই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে , ' আমার যে বুদ্ধি শুদ্ধি নেই সেটা আমি বহুদিন জানি।  আর একবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। '

আমি রাস্তায় নেমে বলি , ' তুইতো যাই কিনিস তাতেই দরদাম করিস।  আজকে কোনো দরদাম না করে কিনে ফেললি কেন ?' নীলু উত্তর দেয় , ' ওই মিষ্টি ছেলেটাকে দেখে , আমার আবার পথের পাঁচালি দেখা আর পড়ার ইচ্ছে জেগে উঠলো।  এই ইচ্ছে হওয়ারতো একটা দাম আছে।  সেই দাম মেটানোর জন্য আজ কোনো দরদাম করলামনা।  বিভূতিভূষণের অপুর সঙ্গে আজ কোনো দরদাম করতে মন চায়নি। '

এ কথা বলার পর নীলু অনেক ক্ষণ চুপচাপ।  শ্যামবাজার থেকে বাসে  উঠে বসেছি দুজনে পাশাপাশি।  নীলু এবার প্রশ্ন করে আচ্ছা  বলতো , ' মানুষের বুদ্ধি টা  বড় না অনুভূতিটা বড় ?' নীলুর এই দার্শনিক মার্কা  প্রশ্ন আমাকে একটু ভাবিয়ে তোলে। আমি একটু ভেবে বলি , ' সব নির্ভর করে লোকের উপর।  লোকটা যদি যুক্তিবাদী হয় তবে তারকাছে বুদ্ধিটা বড় হয়ে দাঁড়ায়।  আর যাদের অনুভূতি খুব প্রখর , তাদের সব ইচ্ছে অনুভূতি নির্ভর হয়। ' নীলু আবার চুপ মেরে যায়।  ঠিক গড়িয়াহাটের মোড়ে এসে বলে , ' চলো  দেখে আসি বুদ্ধি বড় না অনুভূতি বড়। ' আমি নীলুর এই হেয়াঁলি ভরা কথার কোনো মানে খুঁজে পাইনা , তবুও নীলুর সঙ্গে আমিও বাস থেকে নেমে পড়ি।

বালিগঞ্জ প্লেসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নীলু বলে , ' চলো তোমাকে আমি দেখাবো আমার প্রথম প্রেমিক   প্রেমিক গ্রেগরি পেককে। ' নীলুর মুখে শুনলাম যে ওর প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ে ম্যাকেনাস গোল্ড সিনেমা দেখে গ্রেগরি পেকের প্রেমে পড়ে  যায়।  ওই সিনেমা দেখার কয়েকমাস পরে নীলু ওর বাবার সঙ্গে এয়ারপোর্টে যায়।  সেদিন এয়ারপোর্টে ওদের সব আত্মীয় স্বজন এসেছিলো ওদের দূর সম্পর্কের সুমনদাকে সি অফ করতে।  সেদিন নাকি সুমনদা তাঁর মেয়ে  আর স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকায় চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছিলো।  সেখানে গিয়ে নীলু আবিষ্কার করে যে ওর সুমনদার চেহেরার সঙ্গে গ্রেগরি পেকের ভীষণ মিল। সেই থেকে নাকি নীলু সুমনদার প্রেমে পড়ে  যায়।  সুমনদার সঙ্গে একদিনের দেখা তার প্রথম প্রেম।

তারপর নীলু যত বড় হয়েছে গ্রেগরি পেকের সিনেমা  ওকে নিয়ে যায় এক নেশার ঘোরে। সুমনদার খোঁজ পেতে নীলু বার বার দেখে গ্রেগরি  পেকের সেই বিখ্যাত সিনেমা রোমান হলিডে , গানস অফ নোভারণ , মবি ডিক ইত্যাদি।  এমনকি যে নীলু রহস্যের , আতঙ্কের সিনেমা দেখেনা , সে ও  সেই বেশ আতঙ্কের সিনেমা দি ওমেন    দেখেছে।  বড় হয়ে নীলু  আরো দুবার ম্যাকেনাস গোল্ড দেখেছে।  শেষবার দেখা অবশ্য আমার সঙ্গে লাইটহাউস সিনেমাতে।  সেদিন কিন্তু আমাকে মোটেই জানায়নি ওর গ্রেগরি পেক সিনেমা দেখার কারণ।

বালিগঞ্জ প্লেসের ভিতরে এক গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে নীলু বলে , ' এই গলির ভিতরে নিরালা গেস্ট হাউস।  সুমনদা কলকাতা এসে ওই গেস্ট হাউসে উঠেছে।  বুঝতে পারলাম নীলু চলেছে ওর প্রথম প্রেমিককে  দেখতে।  গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকান।  নীলুর ইচ্ছে হলো চা খেতে।  দোকানে কোনো খরিদ্দার নেই।  এক বৃদ্ধা দোকান চালাচ্ছেন। আমরা দুজনে ঢুকে ভিতরে রাখা  বেঞ্চিতে বসলাম।  বৃদ্ধা দু কাপ চা করে সামনের টেবিলে রাখলেন।  আমি খালি জিজ্ঞাসা করলাম , ' চা ভালো হবেতো। ' বৃদ্ধা একটা ফোকলা পাটির হাসি দিয়ে বললে , ' দাঁড়াও বাছা , চা টা আর একটু ভালো করে দি। ' দেখি বৃদ্ধা একটা কফির কৌটো থেকে  সামান্য পরিমান কফি নিয়ে দুজনের কাপে গুলি দিলেন।  চা খেয়ে দেখি সত্যি খুব ভালো লাগছে।

চা খেতে খেতে নীলুর মুখ থেকে শুনলাম , আমেরিকা গিয়ে সুমনদা চাকরিতে খুব উন্নতি করে।  তবে সেখানে বছর দুয়েক আগে ধরা পড়ে ওঁর চেয়ালে  ক্যান্সার হয়েছে।  তারপর নিচের চেঁয়ালটাকে বাদ  দিয়ে একটা আর্টিফিসিয়াল চেয়াল লাগানো হয়েছে। সুমনদার  আয়ু নাকি আর কয়েক বছর মাত্র।  তাই এতো বছর পরে একলাই  দেশে এসে ওই নিরালা গেস্ট হাউসে উঠেছেন।  নীলুদের সব আত্মীয় স্বজন খবর পেয়ে একে একে  এসে দেখা করে গেছেন।  গতকাল নাকি নীলুর বাবা মা এসে ঘুরে গেছেন।  তাদের মুখে শোনা যে সুমনদার চেহেরা ভেঙে গেছে।  মুখের চেহেরাও বেশ পালটে গেছে।  ক্যান্সার চিকিৎসায় মাথার চুল অনেক কমে গেছে।  কাল নীলুর বাবাকে বলেছিলেন নীলু যেন এসে দেখা করে।

চা শেষ করে আমি গলিতে ঢুকে নিরালা গেস্ট হাউসের দিকে পা বাড়িয়েছি।  নীলু পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরে বলে , ' থাকে গিয়ে লাভ নেই।  চলো ফিরে যাই। ' আমি একটু অবাক হয়ে বলি , ' এতদূর এসে ফিরবি কেন ?' নীলু বলে এতক্ষন আমি কেবল আমার অনুভূতির চাপে  সুমনদার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।  বুদ্ধির বিচারে বুঝতে পারলাম , আমার সেই গ্রেগরি পেকের মতন চেহারার সুমনদাকে না দেখতে পেলে আমার এতো দিনের ভালোবাসার প্রথম প্রেমিকের  সব ধুয়ে মুছে যাবে।  ফিরে চলো।  আমি আমার প্রথম প্রেমিকের  শেষ দেখতে চাইনা।

নীলুর কথায় আমি মনে মনে শুনতে পাই বিষ্ণু দের  কবিতা

"সে কবে গেয়েছি আমি তোমার কীর্তনে
কৃতার্থ দোহার |
পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে ;
স্মৃতি আছে তার |
রৌদ্র-জলে সেই-স্মৃতি মরে না, আয়ু যে
দুরন্ত লোহার |
শুধু লেগে আছে মনে ব্যথার স্নায়ুতে
মর্চের বাহার ||”
_________
© সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment