মেয়ে ঝিলিকে কোচিং ক্লাস থেকে ফেরত আনতে আনতে আটটা বেজে গেলো। গাড়িটা গ্যারেজে পার্ক করে ঘড়ি দেখে সুদেষ্ণা। ঝিলির বায়না আজব। ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে ঝিলি স্কুল থেকে ফিরেই জলখাবার খেয়ে দৌড়ায় কোচিং ক্লাসে। যাবার সময়ে অটোতে যায়। বাড়ির থেকে মোটে ছটা বাস স্টপ পরেই ওদের কোচিং সেন্টার। ঝিলির আবদার ফেরার সময়ে মা যেন গাড়ি নিয়ে ওকে ফেরত আনতে যায়। আর সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে সুদেষ্ণা যা একটু সময় পায় ফেসবুকে বসার। কিন্তু ওই অধ ঘন্টা মতন। তারপর ওকে উঠে যেতে হয় মেয়েকে আনার জন্য। ওই আধ ঘন্টায় যে টুকু পারে লিখে পোস্ট করে দেয় সুদেষ্ণা। তারপর ঝিলিকে নিয়ে ফিরে লেগে যায় রাতের খাবার বানাতে। বাড়িতে মানুষ বলতে ওরা দুজন। আজ প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেলো ওর স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে। অবশ্য তাই নিয়ে সুদেষ্ণার কোনো মন খারাপ হয় না। ডিভোর্স নিয়েছিল একটু শান্তিতে যাতে থাকতে পারে তার জন্য।
আজ সন্ধ্যাবেলা মেয়েকে আনতে যাবার আগে তাড়াহুড়ো করে নিজের একটা ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসাবে পোস্ট করেছিল। শুরু থেকে ওর প্রোফাইল পিকচার ছিলো একটা বাজ পাখী। ঝিলি ওকে রোজ বলতো প্রোফাইল পিকচারে নিজের ছবি দেওয়ার জন্য। তাই আগের দিন রাতে ঝিলি ওর মোবাইলে সুদেষ্ণার একটা ছবি তুলে সুদেষ্ণার ল্যাপটপে আপলোড করে বলেছিল "কাল যেন তোমার ছবিটা ফেসবুকে পাল্টানো দেখি"। সুদেষ্ণার ল্যাপটপে সব সময়ে ফেসবুক খোলা থাকে। তাই ঝিলি মাঝে মাঝে মায়ের ফেসবুক ঘেঁটে দেখে। তাই আজ মেয়েকে কোচিং থেকে আনতে যাবার আগে ফেসবুকে প্রোফাইলে বাজ পাখিটাকে সরিয়ে নিজের ছবি সেঁটে দিয়েছিলো সুদেষ্ণা।
তাই গ্যারেজে গাড়ি রেখে উপরে ঘরে আসতে আসতে একটা কৌতুহল মাথায় রইলো। ফেসবুকে তার প্রায় শ তিনেক বন্ধু আছে। তার মধ্যে খুব কম চেনা। বেশির ভাগ নিজের যেচে ফ্রেন্ডশিপ চাওয়া বন্ধু। বিভিন্ন বয়সের ছেলে ও মেয়ে বন্ধু। আসলে সুদেষ্ণা পড়তে ভালবাসে। তাই যার লেখা কোনো পোস্ট ভালো লেগেছে তাকেই রিকুএস্ট করেছে ফ্রেন্ডশিপের জন্য। সেখানে ছেলে না মেয়ে বা বয়স কোনো কিছুই সে ভাবেনি। তাদের লেখাগুলো পড়া ও সাথে সাথে টুক টাক মন্তব্য করাই তার আনন্দ। মাঝে মধ্যে অবশ্য নিজের দু একটা লাইনের চিন্তা ভাবনাও পোস্ট করে। তাতে বন্ধুদের কি মন্তব্য আসে তাই নিয়ে পরম আগ্রহে ল্যাপটপ খুলে বসাটাও সুদেষ্ণার ভালো লাগে। তাই আজ জানার ভিশন ইচ্ছে যে ওর ছবি যে সব বন্ধুরা কোনদিন দেখেনি আজ তারা কি মন্তব্য দেয়। তাই তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ খুলে বসে পড়ে সুদেষ্ণা।
প্রায় গোটা পঞ্চাশেক লাইক আর গোটা কুড়ি কমেন্ট পড়েছে ওর ছবিতে। একমনে বন্ধুদের দু এক শব্দের মধ্যে লেখা ওর ছবির প্রশংসা পড়তে পড়তে একটা কমেন্টে এসে আটকে পড়ে। কমেন্ট করেছে অনির্বান। অনির্বান সুন্দর গল্প লেখে। ওর প্রফাইলে পোস্ট করা ছবি দেখে আন্দাজ করতে পারে কোনো ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে মাঝ বয়সী অনির্বান। তবে ওর পোস্ট করা ছবিগুলি সব কোথাও বেড়াতে গিয়ে তোলা নেচার ফটোগ্রাফ নয়তো বিভিন্ন বেশে নিজের ছবি । ওর ছবিতে কোনো মহিলার বা ছোট ছেলে মেয়ের ছবি নেই। ওর প্রফাইলে রিলেসনশিপ জায়গায় কিছু লেখা নেই। যাই হোক এতটুকুই জানে অনির্বানের বিষয়ে।
অনির্বান ওর কমেন্টে কেবল সুনীল গাঙ্গুলির লেখা নিজের আড়ালে কবিতাটি ছেপে দিয়েছে
"সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
মানুষ দেখে না
সে খোঁজে ভ্রমর বিংবা
দিগন্তের মেঘের সংসার
আবার বিরক্ত হয়
কতকাল দেখে না আকাশ
কতকাল নদী বা ঝরনায় আর
দেখে না নিজের মুখ
আবর্জনা, আসবাবে বন্দী হয়ে যায়
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে
রমনীর কাছে গিয়ে
বারবার হয়েছে কাঙাল
যেমন বাতাসে থাকে সুগন্ধের ঋণ
বহু বছরের স্মৃতি আবার কখন মুছে যায়
অসম্ভব অভিমান খুন করে পরমা নারীকে
অথবা সে অস্ত্র তোলে নিজেরই বুকের দিকে
ঠিক যেন জন্মান্ধ তখন
সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে।। "
কবিতাটি পড়তে পড়তে কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় সুদেষ্ণা। টের পায়না কখন যে ঝিলি এসে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপে অনির্বানের কমেন্ট পড়ছে। সুদেষ্ণা হুঁশ ফিরে পায় ঝিলির কথায়
"Mom now you must try to get your boy friend in Facebook."
_________© সনৎ মিশ্র
No comments:
Post a Comment