মানুষ দিনের বেলা ভূত দেখে জ্ঞান হারায় জানি। কিন্তু ভর সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনে নীলুকে দেখে আমার চোখ ওল্টানোর মতন অবস্থা হবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি । সেদিন ছিল রবিবার। বিকেল সাড়ে পাঁচটার স্টিল এক্সপ্রেস ধরে আমার জামশেদপুর অফিসের কাজে যাওয়ার প্ল্যান। তিনদিনের কাজ টাটা স্টিলে। বেলা পাঁচটার সময়ে হাতে ব্রিফ কেস ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে পৌঁছলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা স্টিল এক্সপ্রেসের AC চেয়ার কার কম্পার্টমেন্টের সামনে। গিয়ে দেখি ট্রেনে দরজার কাছে সাঁটানো রিজার্ভেশন চার্ট মন দিয়ে দেখছে নীলু। আমি একটু থতমত খেয়ে বলি , ' কিরে তুই এখানে কেন ?' নীলু বেশ গম্ভীর ভাবে বলে , ' ক্রিমিনালকে ফলো করা সত্যসন্ধানীর কাজ। ' নীলুর এই ধাঁধালো উত্তর শুনে বলি , ' আমিতো জানি সিনেমায় নায়কেরা নায়িকার পিছনে দৌড়োয়। আজ দেখছি নায়িকা তাড়া করে বেড়াচ্ছে নায়ককে। ' নীলু তার হাতে ধরা ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে , ' দেখছো কি। নায়িকার হাতের ব্যাগটা ধরে অন্ততঃ নিজের এটিকেটটা বজায় রাখো।' তখন জানলাম যে আমি জামশেদপুর যাচ্ছি শুনে , নীলু চলেছে জামশেদপুরে ওর ছোট মামার বাড়ি। ও ওখানে তিনদিন থেকে আমার সঙ্গে ফিরবে। সেই হিসাবে নীলু ওর দিলুদাকে দিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে রেখেছে। ট্রেনে উঠে নীলু আগে আগে গটগট করে গিয়ে ওর রিজার্ভড সিটে বসলো। মুখোমুখি দুই আর দুই চার জনের জায়গা ওটা। নীলু জানালার ধারের সিটে বসে রীতিমত হুকুম করলো , ' ব্যাগ দুটো বাঙ্কে রেখে পাশে এসে বসো। ' আমি একটু আমতা আমতা করে বলি, ' আমার সিট্ অন্য জায়গায়। ' নীলু বলে এখানেই বসো। আমি ম্যানেজ করবো। কাজেই আমি নীলুর পাশে বসে পড়ি। একটু পরেই দেখি রীতিমতো সুটবুট পড়া অফিসের বড় কর্তা টাইপের চেহারার একজন লোক নীলুর পাশের সিটের দাবিদার হয়ে হাজির। দেখি নীলু দিব্যি গুলি ঝাড়ছে , ' আমরা হাসব্যান্ড ওয়াইফ যাচ্ছি। দুজনের এক জায়গায় সিট পাইনি। আপনি যদি আমার হাসব্যান্ডের জায়গায় বসেন তবে আমরা নিজেদের মধ্যে একটু সুখদুঃখের গল্প করতে করতে রাস্তা পার করে নেবো। ' নীলু পুরো কথাটাই আমেরিকান এক্সেন্ট লাগিয়ে একটু নাকি স্বরে ইংরেজিতে গড়গড় করে বলে গেলো। ভদ্রলোক একবার নীলুকে দেখেন একবার আমাকে দেখেন। তারপর চুপচাপ চলে গেলেন আমার জায়গায় বসতে। আমি নীলুর মিথ্যা কথায় যতটা না চমকেছি , তার চেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছি নীলুর সবার সামনে আমাকে দিব্যি হাসব্যান্ড বলে চালিয়ে দেওয়াতে। নীলুর মুখে শোনা হাসব্যান্ড আমার সারা বুকে একটা মোচড় দিয়ে গেলো।
ঠিক সাড়ে পাঁচটায় ট্রেন ছাড়লো। নীলু ওর অভ্যেস মতন হাত জোড় করে , চোখ বন্ধ করে গায়ত্রী মন্ত্র জপ সেরে নিলো। তখন আমার খেয়াল পড়লো আমাদের দুজনের সামনে মুখোমুখি বসা এক মাঝ বয়সী দম্পতি। ভদ্র মহিলার চেহেরা রীতিমতো গিন্নিবান্নি টাইপের। দেখে মনে হবে এই বুঝি শাড়ির আঁচলে বাঁধা আলমারির চাবি কাঁধে ফেলে , পানের বাটা নিয়ে বসবেন পান সাজাতে। স্বামী স্ত্রী দুজনেরই গোলগাল চেহারা। দুজনের মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে রয়েছে। নীলু চটপট প্রশ্ন করে জেনে নিলো দুজনের নাম। অমর মিত্র আর স্নিগ্ধা , থাকেন জামশেদপুরে। স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করেন। কলকাতায় ছেলে আর ছেলের বৌর সঙ্গে দিন পনেরোর ছুটি কাটিয়ে ফিরছেন। নীলুর মুখে বাংলা শুনেই স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বলেন , ' ওমা তোমরা বাঙালি। তোমার ইংরেজি শুনে, আমিতো তোমাদের দুজনকে অবাঙালি ভাবছিলাম।' এবার স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে , ' ও মেয়ে তোমরা চললে কোথায় ?' নীলু দিব্যি আমাকে দেখিয়ে বলে , ' তিনদিনের জন্য যাচ্ছি ওঁর মামাশ্বশুরের বাড়িতে , জামশেদপুরে। ' নীলুর মুখে ওঁর , মামাশ্বশুরের বাড়ি শুনে আমি কেমন যেন এক লজ্জায় সিঁটিয়ে গিয়ে হাতে ধরা গল্পের বইতে মুখ গুঁজে রইলাম। বেশ বুঝতে পারলাম এবার রাস্তায় নীলু আমাকে মুরগি বানাবে।
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বলেন , ' ওঁর মামাশ্বশুর মানেতো তোমার মামার বাড়ি। ' নীলু বলে, ' হ্যাঁ তাইতো। তবে নতুন জামাই পেলে তার পরিচয়টা বেশি ইম্পরট্যান্ট হয়। তাই বলেছিলাম যে ওঁর মামাশ্বশ্রের বাড়ি যাচ্ছি। ' নীলুর কথায় অমর মিত্র আর স্নিগ্ধা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলেন। এবার স্নিগ্ধার প্রশ্ন , ' ও মেয়ে তুমি হাতে শাঁখা নোয়া পরোনি , কপালে সিঁদুরের চিহ্ন নেই কেন ?' আমি ভাবলাম নীলুর মিথ্যা বলা এবার ধরা পড়লো বলে। কিন্তু শুনি নীলু দিব্যি বলে চলেছে , ' আমাদের লাভ ম্যারেজ। ওঁরা ধর্মে ক্রিশ্চান . তাই আমি ওঁর ধর্মকে সম্মান দিয়ে চলি। ওদের বাড়ির রীতি মেনে শাঁখা , নোয়া , সিঁদুর সব ছেড়ে দিয়েছি। ' নীলুর গুলি তাপ্পি শুনে আমার তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা।
তারপর সারা রাস্তা নীলু স্নিগ্ধার সঙ্গে ওর কল্পনার সংসারের গল্প করে যেতে লাগলো। নীলু নাকি রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে সকাল আটটার মধ্যে সব রান্না বান্না সেরে আমাকে টিফিন দিয়ে অফিসে পাঠায়। তারপর নিজে স্কুলে পড়াতে যায়। স্কুল থেকে ফিরে আবার সংসারের কাজ নিয়ে দের রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে । আমি বই পড়ার নামে অবাক হয়ে নীলুর কল্পনার চিত্রনাট্য শুনে যাচ্ছি। তখন দেখি স্নিগ্ধা ঝুঁকে পড়ে নীলুকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছে , ' এবার কোলে একটা খোকা আনো। দেখবে ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যাবে। ' নীলু দেখি তেমনি ফিসফিস করে বলে , ' আমিতো চাই। কিন্তু বছর তিনেক পরে ওর বিদেশে পোস্টিং হবে। তখন ওর খোকা গড়ার প্ল্যান। আমি সব শুনে নিজের সিট থেকে গড়িয়ে পরে যাই আর কি। সারাটা রাস্তা নীলু আমাকে হ্যাঁগো , ওগো করে সম্বোধন করে গেলো। এই করতে করতে রাত সাড়ে নয়টায় ট্রেন ঢুকলো টাটানগর স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে দেখি নীলুর ছোটমামা আর মাইমা প্ল্যাট ফর্মে হাজির। ওরা দুজনে আমাকে চেনে। নীলুদের বাড়িতে দেখেছে। তবে আমাকে নীলুর সঙ্গে নামতে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায়। আমাদের পিছন পিছন ট্রেন থেকে নেমেছেন অমর মিত্র আর স্নিগ্ধা। অমর মিত্র মনে হয় নীলুর ছোট মামাকে চেনেন। চেনাটা স্বাভাবিক , কারণ দুজনেই স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করেন। শুনি স্নিগ্ধা নীলুর ছোট মামাকে বলছেন , ' সারা রাস্তা আপনার ভাগ্নি আর জামাইর সঙ্গে গল্প করতে করতে এলাম। আপনাদের জামাই ভাগ্য খুব ভালো। এমন শান্তশিষ্ট জামাই পেয়েতো আপনার ভাগ্নি খুব খুশি।
স্নিগ্ধার মুখে ভাগ্নি , জামাই শব্দগুলি যেন গুলির মতন কানের পাশ দিয়ে ছুটছে। আমার চোখ কান মুখ লাল হয়ে গেছে। এদিকে নীলু আমার হাতে একটা চিমটি কেটে বসে আছে যাতে আমি মুখ না খুলি। নীলুর মামা বুঝতে পারছেন কোথাও কিছু গন্ডগোল হয়েছে। তাই একটু দেঁতো হাসি দিয়ে অবস্থার সামাল দিচ্ছেন। অমর মিত্র আর স্নিগ্ধা বিদায় নিলেন। আমি ও এবার নীলুর মামা মাইমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের দিকে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছি। তখন শুনি নীলুর ছোট মামা বলছেন , ' মামাশ্বশুরের বাড়ি থাকতে হোটেল কেন ? আমাদের সঙ্গে তিনদিন কাটিয়ে আমাদের আর নীলুকে ধন্য করো। '
গাড়িতে উঠেই আমি নীলুকে জিজ্ঞেস করি , ' এতো কথা থাকতে তুই এই স্বামী স্ত্রীর গল্প ফাঁদলি কেন ? ' নীলু দিব্যি হাসতে হাসতে বলে , ' জীবনে মনে রাখার মতন কিছু গল্প তৈরী করে রাখতে আমার বেশ লাগে। কিছু না হলে অন্তত বুড়ো বয়সে নাতি নাতনিদের গল্প শোনাতে পারবো। ' সব শুনে নীলুর ছোট মামা ড্রাইভারকে বললেন , ' চলো সোজা ব্ল্যাক ফরেস্ট ওয়াইন শপে । এই মজার গল্পটা সেলিব্রেট করতে শ্যাম্পেনের বোতল খুলতেই হবে। ' সেই দেখা আমার প্রথম শ্যাম্পেনের বোতল খোলার ফেনার বুজগুড়ি। নীলু অবশ্য শ্যাম্পেনের গ্লাস ঠোঁটে ঠেকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভাবে বলেছিলো
"যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাবো ।"
সেদিন নীলুর কথা শুনে নীলুর মামা, মাইমা আমার সাথে এতো জোরে হেসে উঠেছিলো যে নীলুর হাতে ধরা শ্যাম্পেনের গ্লাস ছলকে উঠেছিল।
________
@সনৎ মিশ্র
No comments:
Post a Comment