Friday, 13 January 2017

।। পরিকল্পনা ।।

সেদিন প্রথম আমি নীলুর ঘরে ঢুকলাম।  এতদিন ধরে নীলুর সঙ্গে আড্ডা মেরেছি ওদের বাড়িতে।  তবে কোনোদিন ওর নিজস্ব ঘরে ঢুকিনি। তার কারণ যে কোনো একটা মেয়ের প্রাইভেসি থাকে তার ঘরে।  সেটুকু মেনে সবসময়ে আমরা দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরেছি ওদের বসার ঘরে নয়তো ছাদে।  সেদিন ওদের বাড়িতে ঢুকেই যখন মিনু বৌদির মুখে শুনলাম যে নীলু জ্বরে পড়েছে , তখন ওর ঘরে আমাকে ঢুকতেই হলো মিনু বৌদির পিছু পিছু।

ঢুকে দেখি নীলুর ঘরটা বেশ সুন্দর সাজানো।  ঘরের আসবাবপত্র বলতে একটা বড় পুরোনো পালঙ্ক যার মাথার দিকে একটা ময়ূর করা আছে।  ময়ূরের মুখটা এমন করা যে দেখলেই মনে হবে বুঝি ময়ূরটা ঘাড় কত করে তোমার দিকে চেয়ে আছে।  ঘরে আছে একটা শোকেস , আলমারি আর একটা ছোট ড্রেসিং টেবিল।  তবে ঘরের শোকেস , আলমারির উপরে ড্রেসিং টেবিলে সব সাজানো বিভিন্ন দেশের পুতুল , সব কেমন যেন কার্টুন মার্ক চেহেরা।  দেখে মনে হলো সব বিদেশী পুতুল।  দেখার মতো জিনিস হলো ওর খাটে  গোটা কয়েক বিভিন্ন সাইজের টেডি বিয়ারের রূপের বালিশ।  দেখি এক বড় কালো টেডি বিয়ার আঁকড়ে ধরে নীলু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

পায়ের শব্দ শুনে নীলু চোখ মেলে চাইলো।  আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নীলু বলে , ' কাল রাত থেকে জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছি।  কিন্তু নীলুর বেশ সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল দেখে আমার কিছু সন্দেহ হয়।  কেউ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোলে আগেই মাথার চুল এলোমেলো হয়ে যায়।  তাই আমি হাত বাড়িয়ে নীলুর কপাল ছুঁয়ে দেখি টেম্পেরেচার মোটেই  নেই।  তাই আমি নীলুর কাঁথায় এক টান মেরে বলি , ' ওঠ , আর তোকে জ্বরের ন্যাকামি করতে হবেনা।  চাদরে টান  মেরে দেখি নীলু দিব্যি জিন্স আর টপ পরে শুয়ে আছে।  বিছানার পাশে রাখা আছে একটা ছোট প্লেটে কৎবেলের চাটনি।

নীলু তখন বলে , ' দিনে একবার যদি জ্বর আসে তবে ধরে নিতে হয় সারাদিন ধরে জ্বর আছে।  কাল রাতে জ্বর এসেছিলো , মানে এখনো জ্বর আছে , সে আমার কপাল ঠান্ডা হোক বা গরম হোক। 'নীলুর কথা শুনে আমার হাসি পায়।  তাই জিজ্ঞেস করি , ' জ্বর হলে কি কোনো বিশেষ প্রিভিলেজ পাস বুঝি ?' নীলু তখন আঙ্গুল দিয়ে দেখালো খাটের  পাশে রাখা ছোট টিপয় টেবিলটা।  তাতে দেখি একটা ট্রেতে , গোটা পাঁচ ছয় ছোট ছোট কাঁচের বোতল।  সব বিভিন্ন আচারে ঠাসা।  আমি এক একটা করে কাঁচের বোতল তুলে দেখি কোন কোন আচার আছে।  দেখি কুল , কামরাঙ্গা , আম , আমলকি , লেবু আর লংকার আচারের বোতল সাজানো।  আমি বলি , ' এই সামান্য আচারের জন্য তুই কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে  আছিস।  ‘

ঠিক তখনি ঘরে ঢোকে লক্ষীর মা , যে ওদের বাড়িতে কাজ করে।  দেখি লক্ষীর মা এক বালতি জল আর ঘর পৌঁছার কাপড় নিয়ে ঢুকেছে।  নীলুর কথা শুনেই বলে , '  নীলুদি  পড়ে  আছে কোথায়?  এইতো ছাদে ঘুরে ঘুরে কৎবেলের চাটনি খাচ্ছিলো।  আপনাকে আসতে দেখে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ' নীলু কপট রাগ দেখিয়ে লক্ষীর মাকে  বলে , ' শোনো পিসি , এতটা পাপ তোমার কপালে সইলে  হয়।  তোমাকে কি বুঝিয়ে বলতে হবে যে কৎবেলের চাটনি ঘুরে ঘুরেই খেতে হয় , তবে গিয়ে তার টেস্ট পাওয়া যায় জিভে আর টাকরাতে। ' আমি নীলুর থিওরি শুনে রীতি মতন হাঁ হয়ে গেছি।  তখন শুনি লক্ষীর মা আমাকে বলছে , ' দাদাবাবু , এবার একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলেন।  কতদিন আর দুজনে গুজুগুজু ফুসুফুসু করবেন।  এবার সংসারের বাঁধনে  দুজনা বাঁধা পড়ুন। ' লক্ষীর মায়ের মন্তব্য শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গেছি।  কি বলবো তার কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিনা।  তখন নীলু আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।  নীলু এবার লক্ষীর মাকে জিজ্ঞেস করে , ' আচ্ছা  পিসি তুমি যদি আবার জন্ম নাও , তুমি কি আবার বিয়ে করবে ?' দেখি ঘর মোছা বন্ধ করে লক্ষীর মা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে নীলুর দিকে।  কেমন একটা কান্না মেশানো গলায় উত্তর দেয় , ' এ জীবনে সেই ভুলটা করেছিলাম বলে দুবেলা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসারের হাল টানতে হয়।  লক্ষীর বাপটা নেশা ভাং করে পড়ে  থাকে।  সেই নেশার পয়সা আমাকেই দিতে হয়।  নয়তো সংসারে অশান্তি শুরু করে দেয়।  তুমি দিদি ঠিক বলেছো পরের জন্মে আমি আর বিয়ে করবোনা।  খেটে  খাবো , কিন্তু নিজের মতো করেই বাঁচবো। ‘

লক্ষীর মায়ের কথা শুনে আমরা দুজনেই চুপ মেরে যাই।  লক্ষীর মা ঘর পৌঁছা শেষ করে বেরিয়ে গেলো।  এবার নীলু জিজ্ঞেস করে , ' এ বিষয়ে তোমার মত  কি ?' আমি আর কি বলি এই প্রশ্নে।  তবু আমি চেষ্টা করে গুছিয়ে বলতে , ' কাল নাকি তোদের বাড়িতে আমার মা এসেছিলো।  তোর সঙ্গে নাকি অনেক আড্ডা মেরে গেছে। ' নীলু দেখি বিছানার চাদরের কোনটা এক হাতে মোচড়াতে মোচড়াতে বললো , ' মাসীমাত বলে গেলেন  , তুমি যতদিন পারো নিজের মতো থাকো।  যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিন ছাঁদনাতলায় তোমাদের দুজনকে বসিয়ে দেবো। ' আমি কিছু না বলে খালি বলি ,' হুম। ' হটাৎ নীলু বলে চলো ছাদে গিয়ে একটু রোদের  উত্তাপ নি। ' দুজনেই চুপচাপ ছাদে এসে দাঁড়াই।  শীতকালের রোদ বেশ মিষ্টি লাগছিলো।  এবার নীলু বলে , ' কথাটা ঠিক আমরা দুজনে নিজেদের মতন থাকার চেষ্টা করি।  যেদিন ইচ্ছে হবে টোপর পরে বসে পড়বো। সে নিয়ে একটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও করা যেতে পারে  ' আমি বলি , ' আমি এক বছরের পরিকল্পনায় রাজি আছি । ‘ নীলু খুব জোরে হেসে উঠে বলে , ' জো  হুকুম মেরি আকা।  ঠিক আছে তবে পরের শীতে না হয় রবি ঠাকুরের ভাষায় বলবো

"দু দিক হতে দুজনে যেন

         বহিয়া খরধারে

    আসিতেছিল দোঁহার পানে

    ব্যাকুলগতি ব্যগ্রপ্রাণে,

    সহসা এসে মিশিয়া গেল

         নিশীথপারাবারে।

    থামিয়া গেল অধীর স্রোত

         থামিল কলতান,

    মৌন এক মিলনরাশি

    তিমিরে সব ফেলিল গ্রাসি,

    প্রলয়তলে দোঁহার মাঝে

         দোঁহার অবসান।"
_________
© সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment