আমার বয়স এখন তিরানব্বই। যার কথা লিখছি তিনি আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদার নিজের দাদা। নদীয়ার ফুলিয়ায় বিখ্যাত জমিদার ঁবিরজামোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ঐ নাম কজন আর মনে রেখেছে!শুধু আমাদের পরিবার নয় গোটা ফুলিয়াই আজও অত পুরণো জমিদারকে মনে রেখেছে, ভালোবেসে বটঠাউদ্দা বলে। ওঁর খনন করা বটঠাউদ্দার দিঘি , প্রতিষ্ঠা করা বটঠাউদ্দার রাধামোহন মন্দির এসব এখনও চোখে দেখা যায়। বাংলার প্রথম দিককার বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ওঁর প্রতিষ্ঠিত ফুলিয়া রাধামোহন বিদ্যালয় অন্যতম এবং আজও স্বমহিমায় বিরাজমান।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঠগী-দৌরাত্ম্য দমনকারী স্লীমান সাহেবের(উইলিয়াম হেনরী স্লীমান ১৭৮৮-১৮৫৬) নাম অমর হয়ে থাকবে। ঠগীরা হচ্ছে সাধারণ তীর্থযাত্রীদের ছদ্মবেশে মানুষের বিশেষ করে তীর্থযাত্রীদের ভীড়ে মিশে থাকা ডাকাতের দল। পুরুষ স্ত্রী মিলিয়ে এক এক দলে পাঁচ থেকে দশজন সাধারণতঃ থাকত। নিজেদের দল থেকে যেসব তীর্থযাত্রী আলাদা হয়ে পড়ত বা সংখ্যায় একজন দুজন যাতায়াত করত এরা তাদেরকেই বেছে নিয়ে প্রথমে তাদেরকে খাইয়ে দাইয়ে ভালো ব্যবহার করে তাদের আস্থা অর্জন করত। তারপর যাতায়াতের পথেই কোন নির্জন স্থানে তাকে নৃশংস ভাবে খুন করে তার লাশটা গায়েব করে দিত। এদের নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় কথা আদান-প্রদান হত। যেমন “তামুক লাও” মানে এবার লক্ষ্যের মাথার পিছনে আঘাত করে খুন কর। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ- মধ্যপ্রদেশ(একত্রে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ)জুড়ে এদের ভয়ংকর অত্যাচার ছিল। স্লীমান সাহেব দীর্ঘ তিরিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ঠগী-দৌরাত্ম্য নির্মূল করে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
এই ঠগীরা এমনিতে বড় বড় জমিদারদের জমিদারীতে ভালোমানুষ প্রজা সেজে থাকত। লুঠতরাজ করে আয় ভালোই হত আর তাছাড়া জমিদারের সুনজরে থাকার জন্য এরা সময় মত খাজনা দিত। তাছাড়া কোনো কোনো ডাকাত জমিদার ডাকাতির কাজে বা প্রতিবেশী জমিদারের জমিজমা লুঠতরাজের কাজে এদের কাজে লাগাত। ফলে এদের শায়েস্তা করা স্লীমান সাহেবের মত জাদরেল সেনাধ্যক্ষের পক্ষেও দূঃসাধ্য ছিল। স্লীমান সাহেব কৌশলগত কারণে অনেক বড় বড় জমিদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান। আমাদের বটঠাউদ্দা বিরজামোহনের সঙ্গেও ওঁর দীঘদিনের বন্ধুত্ব ছিল। কালিঘাট,নবদ্বীপে অনেক তীর্থযাত্রীর যাতায়াত ছিল। ফলে এদের যাতায়াতের পথে ঠগীদের অত্যাচার লেগেই থাকত। আর এদের দমনের কাজে স্লীমান সাহেব এলেই সদলবল বটঠাউদ্দার আতিথ্য গ্রহন করতেন।
একবার যুক্তপ্রদেশ থেকে আগতরদশবারজনের একটি ঠগী পরিবার ফুলিয়াতে ঁবিরজামোহনের জমিদারিতে বসবাস শুরু করে। ঁবিরজামোহন এদের পরিচয় জানতে পেরে নিজের জমিদারি থেকে শুধু উৎখাত করেই খান্ত হন নি বন্ধু স্লীমানকে দিয়ে এদের গ্রেফতার করান। দশজন গ্রেফতার হয়ে যাবজ্জীবনের আসামী হয়,একজন পালাতে গিয়ে পিঠে স্লীমান সাহেবের গুলি খেয়ে মারা যায়। একজন অবশ্য পালাতে পারে। স্লীমান সাহেব যেমন বীরপুরুষ ছিলেন তাঁর সরকারী সুরক্ষাও ছিল। ঁবিরজামোহনের ছিল না। রোজ ঘুম থেকে উঠে গঙ্গার পার ধরে ঘোড়ার পিঠে প্রাতঃভ্রমন তাঁর প্রিয় নেশা ছিল। পালিয়ে যেতে পেরেছিল যে ঠগীটি সে এটারই সুযোগ নেয়।
একদিন প্রাতঃভ্রমন সেরে গঙ্গার পার ধরে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে ঠগীটির ধারালো বল্লম তাঁর হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। প্রচলিত কাহিনী হচ্ছে শরীরে ও মনে এই বিরাট পুরুষটি ঐ অবস্থায় তাঁর প্রিয় বন্ধু স্লীমান সাহেবের কাছে ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে যান। তিনি তখন মোকামায় অবস্থান করছিলেন। বন্ধুকে তিনি বাঁচাতে পারেন নি কিন্তু ঠগীটাকে খুঁজে বার করে ফাঁসিতে লটকানোর বন্দোবস্ত করতে পেরেছিলেন। আরো রটনা আছে এই ব্রাহ্মন জমিদারটি এভাবে খুন হয়ে যাওয়ার ব্রহ্মদৈত্য হয়ে আজও তাঁর জমিদারি এলাকাতেই বিশেষকরে রাধামোহন মন্দিরের আশেপাশেই রয়ে গেছেন। কারোর খারাপ করেন না বা কাউকে ভয়ও দেখান না।
তবে এত এত বছর কেটে গেছে মন্দিরে এত সোনাদানা তেমন সুরক্ষিত অবস্থায় না থেকেও কোনো বড় কেন ছোটো চুরিও হয় নি। এটাও চালু কাহিনী যে রাতবিরেতে চুরি করতে এসে মন্দিরের সামনে দেখেছে এক বিশাল পুরুষ মন্দিরের ঢোকার দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন সাহেবদের মত ধবধবে গায়ের রঙ, খালি গায়ে সাদা পৈতা ঝকঝক করছে,ন্যাড়া মাথায় পিছনে বিরাট টিকি আর পিঠ বুক বিদ্ধ করে আছে এক বিরাট বল্লম। চোরেরা চুরি করার বদলে পালিয়ে বেঁচেছে। এসবই কি গল্প? জমিদারি প্রথা ত’ কবেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা তার উত্তরপুরুষরা যতদিন গিয়েছে ততই সাদামাটা হয়ে গেছি চেহারায় চরিত্রে। আমরা জেঠতুতো,খুড়তুতো ভাইবোনেরা আমাদের পুরনো দালান অর্থাৎ পারিবারিক পুরণো জমিদার বাড়িতে রাতে বারোয়ারি পালঙ্কে শুয়ে ঘুমনোর আগে হৈ হৈ চেচামেচি করতাম।
আ । একসময় দালানের ছাদে কার চলাচলের খড়মের শব্দ ঠকঠক করে বাজত। মা ঠাকুরমা বলতেন ,“বটঠাউদ্দা সন্ধ্যাআহ্নিক সেরে বেরিয়েছেন। ওঁকে বিরক্ত করিস নি। শিগগির ঘুমিয়ে পড়।”এসব কতটা সত্যি আমি জানি না।কোনোদিন কিছু দেখি নি। তবে মনের গভীরে সত্য বলেই বিশ্বাস করি। পরের দিন আমার নাতির ঘরের পুতি তার এই কাচা বয়সের একটা অভিজ্ঞতা বলবে।
শেষ পর্ব।
আমার নাম রূপমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় দু বছর আগে নদীয়ার ফুলিয়া রাধামোহন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। এক নম্বরের জন্য প্রথম হতে পারি নি। এবার উচ্চ মাধ্যমিক এবং জয়েণ্ট এণ্ট্রানসে প্রথম হতে পারলে সেই দুঃখ ভূলতে পারব। আই আই টি পেলে ত’ কথাই নেই। আমার বাবার ঠাকুরদা তিরানব্বই বছরের বৃদ্ধ গোপীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে আমাদের প্রাক্তন জমিদার বংশের কাহিনী বিশেষতঃ আমাদের বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ ঁবিরজামোহন যিনি আজও বটঠাউদ্দা বলে এতদঞ্চলে সমধিক প্রসিদ্ধ তাঁর কাহিনীও শুনেছেন। সবই গল্পকথা হয়ে গেলেও পারিবারিক মেধা এবং সুপুরুষ চেহারা আজ এত এত বছর পরেও আমাদের জিনেই বোধহয় রয়ে গেছে। আমার বাবা হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষ্ণনগর কলেজের কেমিষ্ট্রির অধ্যাপক।বাবার কাছেই কেমিষ্ট্রি পড়ি। মা ইংরেজির শিক্ষক। মা ইংরাজি বাংলা পড়ান। কিন্তু ফিজিক্স আর অঙ্ক পড়তে আমায় সেই রানাঘাটে বিখ্যাত অধ্যাপক অপরেশ মৈত্রর বাড়িতে ছুটতে হয়। উনি আমাকে আর রূপক নামে মাধ্যমিকে অষ্টম হওয়া একটি ছেলেকে সন্ধ্যা আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আলাদা করে পড়ান শনিবার মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার। ঐ তিনদিন আমার বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা কোনোদিন বারোটাও বেজে যায়। কিন্তু অত ভালো স্যার এদিকে কেন কলকাতায়ই বা কজন পাওয়া যায়। ইদানীং অবশ্য মাস কয়েক হল আই এস সি বোর্ডের আর একজন মানে একটি মেয়ে আমাদের ব্যাচে জয়েন করেছে। মেয়েটির আইআইটি না হলে জয়েণ্ট টার্গেট। বেশ মেধাবী । আমি একজন ভালো কম্পিটিটর পেয়েছি ত’ বটেই তা ছাড়াও আমি একটি অভাবিত সুবিধা পেয়ে গিয়েছি। মেয়েটি অর্থাৎ লীলা ভিলাল্লার বাবা অনেকদিন থেকেই তাঁতের ব্যবসা করেন। ওঁরা মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়ায় থাকতেন। এখন ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ফুলিয়াতেই সপরিবার আস্তানা গেড়েছেন। আমাদের রাধামোহন মন্দিরের সীমানার আগে অনেকটা জায়গা আজকাল ফাঁকা,জঙ্গল হয়ে আছে। তার আগে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলিয়ার মূল বসতি । ওখানেই লীলার বাবা জমিসহ বসতবাড়ি কিনেছেন। ঝাবুয়ার গ্রামের বাড়িতে লোক রেখে এসেছেন। মাঝেসাঝে যান। আমরা মানে আমি আর লীলা একসঙ্গেই ফিরি। বুঝতে পারি মূলতঃ আমার ভরসাতেই লীলা অতদূর থেকে অতরাতে পড়ে ফেরে। আমি ফেরার সময় ওকে ওদের গলির মুখে ছেড়ে ফাঁকা জংলা জায়গাটা পেরিয়ে রাধামোহন মন্দির বায়ে ছেড়ে আমার বাবার করা নতুন বাড়িতে ঢুকি। আমাদের বংশের আর কোনো শরিক নেই। বটঠাউদ্দার অত বিখ্যাত জমিদার বংশের আমিই এখন পর্যন্ত প্রদীপের শেষ সলতে। হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। লীলা অপরূপ সুন্দরী না হলেও পুওর ম্যান’স সোনাক্ষি সিনহা। আমার মা বাবা জানলে আমায় বাড়ি থেকে বার করে দেবে। আমার সঙ্গে লীলার একটা গোপন বোঝাপড়া একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। আমরা দুজনেই বড় হয়ে দুজনকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। একদিন এসে আমাদের পুরণো জমিদার বাড়ি,পূর্ব পুরুষদের অয়েলপেণ্টিং সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। বিশেষ করে বটঠাউদ্দারটা। মনে হল বটঠাউদ্দার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে বোধহয় স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনে থাকবে। আমাদের রাধামোহন মন্দিরও বাইরে থেকে দেখেছে। তখন দেবারতি চলছিল। ওর পরিবার আমাদের মত বৈষ্ণব ব্রাহ্মন নয়। ভক্তির ঠাকুরের আরতি দেখা নিষেধ। ওদের পরিবার প্রবল শাক্ত। একমাত্র শক্তির দেবী রক্তিমা মাইকে ছাড়া আর কারো পূজা করে না। এসব নিয়ে আমরা দুজনেই ভাবি না। এসব দুজনের বিয়ের পথে কোন বাধা হতে আমরা দুজনেই দেবো না। লীলাদের বাড়ি খুব রক্ষনশীল। তাই লীলা আমায় এখন না যেতে বলেছে। বলেছে সময় হলে ও নিজেই আমার হাত ধরে নিয়ে যাবে। ————————————————————————————আজ সকাল থেকেই টিপটিপ করে বৃষটি পড়ছে। তাও পড়তে এসেছি। রূপক আর লীলাও এসেছে। স্যার আজকে লাইটের ডাবল লেন্স পড়াচ্ছেন। অনেক রাত হল।বৃষ্টি বেড়েছে । কাল পূর্ণিমা ছিল। চাঁদের আলোয় বৃষ্টির ফোটাগুলো আরও বড় দেখাচ্ছে। লীলাকে ওদের বাড়ির গলির মুখে ছেড়ে পা বাড়িয়েছি। পিছনে একটা বিশ্রী বিড়ালের ডাকে ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা মিশমিশে কালো বিড়াল আক্রমনাত্মক ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। কেমন গা টা শিরশির করে উঠল। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আমার ভিতরের অনুভূতি বলছে সেটা ভালো নয় আমার পক্ষে। রাধামোহন মন্দির চত্বরে পৌঁছুলেই আমি নিরাপদ আমি জানি। কিন্তু তার আগের ঐ জংলা ফাঁকা জায়গাটা? হ্যা ঠিকই। বিড়ালটা কখন পিছন থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি । ফ্যাসফ্যাস করে ফুঁসছে। যে কোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। কিন্তু বিড়াল কোথায় এ ত’ আমারই স্বপ্নের ভবিষ্যত জীবনসঙ্গী আমার মানসী লীলা । চাঁদের আলোতে চিনতে কোনো ভূল হয় নি। চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মতই জ্বলজ্বল করছে,হা মুখের দাঁতগুলো বিড়ালের দাঁতের মতই তীক্ষ্ণ ,বাঁকা। একি পিশাচী ভয়ংকর চেহারা। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল,“শোন্ মরার আগে জেনে যা। তোর কাছে আমার তোর রক্তমাংস পাওনা আছে। তোদের ঐ ভণ্ড বামুন বংশের পিশাচটা ঐ বিরজামোহন না কি নাম ঐ স্লীমান ম্লেচ্ছটার সাহায্য নিয়ে আমাদের ভীলাল্লা বংশকে শেষ করে গেছে। যাদের জেল হয়েছিল তাঁরাও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একে একে মারা গেছে। ঐ লোকটার একটা জীবন গেছে আর আমাদের বারো বারোটা জীবন। থাকতে থাকতে আজ শুধু একটা মেয়ে আমিতে এত বড় বীর বংশটা ঠেকেছে। তোদের বংশে আর তোদের পুরনো জমিদারি এলাকার তোরা আজও ঐ লোকটার কীর্তি নিয়ে গর্ব করিস আর আমাদের বংশে তোদের আর ঐ আঁশটে ফিরিঙ্গী স্লীমানকে নির্বংশ করে প্রতিশোধ নেওয়ার আগুন আজও ধিকিি ধকি জ্বলছে। আমি স্লীমানের বংশকে শেষ করতে পেরেছি আর তোকে আজ খেলেই আমার বংশের রক্তিমাদেবীর আরাধনা সফল হবে। শোন ভাল করে শোন উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা আর রক্তিমাদেবীর আশির্বাদে আজ আমি লীলা ভীলাল্লা গোটা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ডাকিনীদের একজন। কাল সকালে তোর নাড়িভুঁড়িগুলো আধখাওয়া অবস্থায় জঙ্গলে পাওয়া যাবে সবাই ভাববে হায়না বা নেকড়ের কাজ। এখন পায়ে পােয় এগিয়ে আয়।””দাড়াও! ভয় নেই। ঐ ডাকিনী তোমায় ছুঁতেও পারবে না। তুমি ওর পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে মন্দিরের চত্বর দিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র আবৃত্তি করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ কর। শুধু পিছন ফিরে তাকিও না । ”আমি জলদগম্ভীর স্বরে ঠিক দৈববাণীর মত শুনতে পেলাম। আমি যেন নিজের মত অফুরন্ত শক্তি অনুভব করলাম। মৃত্যু ভয় আর নেই। পায়েপায়ে মন্দিরেরআঙিনায় প্রবেশ করার ঠিক আগে আবার শুনতে পেলাম,“শোন রে পিশাচী!তুই এত বড় ডাকিনী আর এটা জানতি না ব্রহ্মদৈত্যরা ব্রহ্মেরই অংশবিশেষ?আমার প্রিয় প্রজাদের তোদের ঠগীবংশের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়েই আমি খুন হয়েছিলাম। আমি রক্ষা করি,কাউকে মারি না। তোকেও প্রাণে মারব না। তুই ঠগী বংশের মেয়ে হলেও ওই বংশপ্রদীপের শেষ সলতে। আমার এলাকা আর রূপমোহনকে হত্যার পরিকল্পনা ছেড়ে চলে যা।”বটঠাউদ্দার গলা আবার শুনতে পেলাম। ”————————————~——~~~~~~~~————— লীলার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই যেন উবে গেল। বটঠাউদ্দাকে চোখে সেদিন দেখিনি তবে তাঁর এক অন্যরকম উপস্থিতি সব সময়ই অনুভব করি। বুঝি ফুলিয়ার মানুষ কেন তাকে আজও দেবতা বলে পূজো করে। পরে জেনেছি যে ঠগী বংশকে তিনি উচ্ছেদ করেছিলেন তারা মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়ার ভীলাল্লা সম্প্রদায়েরই ছিল লীলার মত এবং রক্তিমা দেবীরই উপাসক ছিল। লীলা যে গলিতে ওরা থাকে বলে ঢুকত সেখানেই ওদের ঠগী পূর্বপুরুষরা বসতি গেড়েছিল। এতকিছু জেনেও লীলাকে কি আমি আজও ভালোবাসি?
____________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী
ভারতবর্ষের ইতিহাসে ঠগী-দৌরাত্ম্য দমনকারী স্লীমান সাহেবের(উইলিয়াম হেনরী স্লীমান ১৭৮৮-১৮৫৬) নাম অমর হয়ে থাকবে। ঠগীরা হচ্ছে সাধারণ তীর্থযাত্রীদের ছদ্মবেশে মানুষের বিশেষ করে তীর্থযাত্রীদের ভীড়ে মিশে থাকা ডাকাতের দল। পুরুষ স্ত্রী মিলিয়ে এক এক দলে পাঁচ থেকে দশজন সাধারণতঃ থাকত। নিজেদের দল থেকে যেসব তীর্থযাত্রী আলাদা হয়ে পড়ত বা সংখ্যায় একজন দুজন যাতায়াত করত এরা তাদেরকেই বেছে নিয়ে প্রথমে তাদেরকে খাইয়ে দাইয়ে ভালো ব্যবহার করে তাদের আস্থা অর্জন করত। তারপর যাতায়াতের পথেই কোন নির্জন স্থানে তাকে নৃশংস ভাবে খুন করে তার লাশটা গায়েব করে দিত। এদের নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় কথা আদান-প্রদান হত। যেমন “তামুক লাও” মানে এবার লক্ষ্যের মাথার পিছনে আঘাত করে খুন কর। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ- মধ্যপ্রদেশ(একত্রে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ)জুড়ে এদের ভয়ংকর অত্যাচার ছিল। স্লীমান সাহেব দীর্ঘ তিরিশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ঠগী-দৌরাত্ম্য নির্মূল করে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
এই ঠগীরা এমনিতে বড় বড় জমিদারদের জমিদারীতে ভালোমানুষ প্রজা সেজে থাকত। লুঠতরাজ করে আয় ভালোই হত আর তাছাড়া জমিদারের সুনজরে থাকার জন্য এরা সময় মত খাজনা দিত। তাছাড়া কোনো কোনো ডাকাত জমিদার ডাকাতির কাজে বা প্রতিবেশী জমিদারের জমিজমা লুঠতরাজের কাজে এদের কাজে লাগাত। ফলে এদের শায়েস্তা করা স্লীমান সাহেবের মত জাদরেল সেনাধ্যক্ষের পক্ষেও দূঃসাধ্য ছিল। স্লীমান সাহেব কৌশলগত কারণে অনেক বড় বড় জমিদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান। আমাদের বটঠাউদ্দা বিরজামোহনের সঙ্গেও ওঁর দীঘদিনের বন্ধুত্ব ছিল। কালিঘাট,নবদ্বীপে অনেক তীর্থযাত্রীর যাতায়াত ছিল। ফলে এদের যাতায়াতের পথে ঠগীদের অত্যাচার লেগেই থাকত। আর এদের দমনের কাজে স্লীমান সাহেব এলেই সদলবল বটঠাউদ্দার আতিথ্য গ্রহন করতেন।
একবার যুক্তপ্রদেশ থেকে আগতরদশবারজনের একটি ঠগী পরিবার ফুলিয়াতে ঁবিরজামোহনের জমিদারিতে বসবাস শুরু করে। ঁবিরজামোহন এদের পরিচয় জানতে পেরে নিজের জমিদারি থেকে শুধু উৎখাত করেই খান্ত হন নি বন্ধু স্লীমানকে দিয়ে এদের গ্রেফতার করান। দশজন গ্রেফতার হয়ে যাবজ্জীবনের আসামী হয়,একজন পালাতে গিয়ে পিঠে স্লীমান সাহেবের গুলি খেয়ে মারা যায়। একজন অবশ্য পালাতে পারে। স্লীমান সাহেব যেমন বীরপুরুষ ছিলেন তাঁর সরকারী সুরক্ষাও ছিল। ঁবিরজামোহনের ছিল না। রোজ ঘুম থেকে উঠে গঙ্গার পার ধরে ঘোড়ার পিঠে প্রাতঃভ্রমন তাঁর প্রিয় নেশা ছিল। পালিয়ে যেতে পেরেছিল যে ঠগীটি সে এটারই সুযোগ নেয়।
একদিন প্রাতঃভ্রমন সেরে গঙ্গার পার ধরে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে ঠগীটির ধারালো বল্লম তাঁর হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। প্রচলিত কাহিনী হচ্ছে শরীরে ও মনে এই বিরাট পুরুষটি ঐ অবস্থায় তাঁর প্রিয় বন্ধু স্লীমান সাহেবের কাছে ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে যান। তিনি তখন মোকামায় অবস্থান করছিলেন। বন্ধুকে তিনি বাঁচাতে পারেন নি কিন্তু ঠগীটাকে খুঁজে বার করে ফাঁসিতে লটকানোর বন্দোবস্ত করতে পেরেছিলেন। আরো রটনা আছে এই ব্রাহ্মন জমিদারটি এভাবে খুন হয়ে যাওয়ার ব্রহ্মদৈত্য হয়ে আজও তাঁর জমিদারি এলাকাতেই বিশেষকরে রাধামোহন মন্দিরের আশেপাশেই রয়ে গেছেন। কারোর খারাপ করেন না বা কাউকে ভয়ও দেখান না।
তবে এত এত বছর কেটে গেছে মন্দিরে এত সোনাদানা তেমন সুরক্ষিত অবস্থায় না থেকেও কোনো বড় কেন ছোটো চুরিও হয় নি। এটাও চালু কাহিনী যে রাতবিরেতে চুরি করতে এসে মন্দিরের সামনে দেখেছে এক বিশাল পুরুষ মন্দিরের ঢোকার দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন সাহেবদের মত ধবধবে গায়ের রঙ, খালি গায়ে সাদা পৈতা ঝকঝক করছে,ন্যাড়া মাথায় পিছনে বিরাট টিকি আর পিঠ বুক বিদ্ধ করে আছে এক বিরাট বল্লম। চোরেরা চুরি করার বদলে পালিয়ে বেঁচেছে। এসবই কি গল্প? জমিদারি প্রথা ত’ কবেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা তার উত্তরপুরুষরা যতদিন গিয়েছে ততই সাদামাটা হয়ে গেছি চেহারায় চরিত্রে। আমরা জেঠতুতো,খুড়তুতো ভাইবোনেরা আমাদের পুরনো দালান অর্থাৎ পারিবারিক পুরণো জমিদার বাড়িতে রাতে বারোয়ারি পালঙ্কে শুয়ে ঘুমনোর আগে হৈ হৈ চেচামেচি করতাম।
আ । একসময় দালানের ছাদে কার চলাচলের খড়মের শব্দ ঠকঠক করে বাজত। মা ঠাকুরমা বলতেন ,“বটঠাউদ্দা সন্ধ্যাআহ্নিক সেরে বেরিয়েছেন। ওঁকে বিরক্ত করিস নি। শিগগির ঘুমিয়ে পড়।”এসব কতটা সত্যি আমি জানি না।কোনোদিন কিছু দেখি নি। তবে মনের গভীরে সত্য বলেই বিশ্বাস করি। পরের দিন আমার নাতির ঘরের পুতি তার এই কাচা বয়সের একটা অভিজ্ঞতা বলবে।
শেষ পর্ব।
আমার নাম রূপমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় দু বছর আগে নদীয়ার ফুলিয়া রাধামোহন বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। এক নম্বরের জন্য প্রথম হতে পারি নি। এবার উচ্চ মাধ্যমিক এবং জয়েণ্ট এণ্ট্রানসে প্রথম হতে পারলে সেই দুঃখ ভূলতে পারব। আই আই টি পেলে ত’ কথাই নেই। আমার বাবার ঠাকুরদা তিরানব্বই বছরের বৃদ্ধ গোপীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে আমাদের প্রাক্তন জমিদার বংশের কাহিনী বিশেষতঃ আমাদের বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ ঁবিরজামোহন যিনি আজও বটঠাউদ্দা বলে এতদঞ্চলে সমধিক প্রসিদ্ধ তাঁর কাহিনীও শুনেছেন। সবই গল্পকথা হয়ে গেলেও পারিবারিক মেধা এবং সুপুরুষ চেহারা আজ এত এত বছর পরেও আমাদের জিনেই বোধহয় রয়ে গেছে। আমার বাবা হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষ্ণনগর কলেজের কেমিষ্ট্রির অধ্যাপক।বাবার কাছেই কেমিষ্ট্রি পড়ি। মা ইংরেজির শিক্ষক। মা ইংরাজি বাংলা পড়ান। কিন্তু ফিজিক্স আর অঙ্ক পড়তে আমায় সেই রানাঘাটে বিখ্যাত অধ্যাপক অপরেশ মৈত্রর বাড়িতে ছুটতে হয়। উনি আমাকে আর রূপক নামে মাধ্যমিকে অষ্টম হওয়া একটি ছেলেকে সন্ধ্যা আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আলাদা করে পড়ান শনিবার মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার। ঐ তিনদিন আমার বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা কোনোদিন বারোটাও বেজে যায়। কিন্তু অত ভালো স্যার এদিকে কেন কলকাতায়ই বা কজন পাওয়া যায়। ইদানীং অবশ্য মাস কয়েক হল আই এস সি বোর্ডের আর একজন মানে একটি মেয়ে আমাদের ব্যাচে জয়েন করেছে। মেয়েটির আইআইটি না হলে জয়েণ্ট টার্গেট। বেশ মেধাবী । আমি একজন ভালো কম্পিটিটর পেয়েছি ত’ বটেই তা ছাড়াও আমি একটি অভাবিত সুবিধা পেয়ে গিয়েছি। মেয়েটি অর্থাৎ লীলা ভিলাল্লার বাবা অনেকদিন থেকেই তাঁতের ব্যবসা করেন। ওঁরা মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়ায় থাকতেন। এখন ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ফুলিয়াতেই সপরিবার আস্তানা গেড়েছেন। আমাদের রাধামোহন মন্দিরের সীমানার আগে অনেকটা জায়গা আজকাল ফাঁকা,জঙ্গল হয়ে আছে। তার আগে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলিয়ার মূল বসতি । ওখানেই লীলার বাবা জমিসহ বসতবাড়ি কিনেছেন। ঝাবুয়ার গ্রামের বাড়িতে লোক রেখে এসেছেন। মাঝেসাঝে যান। আমরা মানে আমি আর লীলা একসঙ্গেই ফিরি। বুঝতে পারি মূলতঃ আমার ভরসাতেই লীলা অতদূর থেকে অতরাতে পড়ে ফেরে। আমি ফেরার সময় ওকে ওদের গলির মুখে ছেড়ে ফাঁকা জংলা জায়গাটা পেরিয়ে রাধামোহন মন্দির বায়ে ছেড়ে আমার বাবার করা নতুন বাড়িতে ঢুকি। আমাদের বংশের আর কোনো শরিক নেই। বটঠাউদ্দার অত বিখ্যাত জমিদার বংশের আমিই এখন পর্যন্ত প্রদীপের শেষ সলতে। হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। লীলা অপরূপ সুন্দরী না হলেও পুওর ম্যান’স সোনাক্ষি সিনহা। আমার মা বাবা জানলে আমায় বাড়ি থেকে বার করে দেবে। আমার সঙ্গে লীলার একটা গোপন বোঝাপড়া একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। আমরা দুজনেই বড় হয়ে দুজনকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। একদিন এসে আমাদের পুরণো জমিদার বাড়ি,পূর্ব পুরুষদের অয়েলপেণ্টিং সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। বিশেষ করে বটঠাউদ্দারটা। মনে হল বটঠাউদ্দার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে বোধহয় স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনে থাকবে। আমাদের রাধামোহন মন্দিরও বাইরে থেকে দেখেছে। তখন দেবারতি চলছিল। ওর পরিবার আমাদের মত বৈষ্ণব ব্রাহ্মন নয়। ভক্তির ঠাকুরের আরতি দেখা নিষেধ। ওদের পরিবার প্রবল শাক্ত। একমাত্র শক্তির দেবী রক্তিমা মাইকে ছাড়া আর কারো পূজা করে না। এসব নিয়ে আমরা দুজনেই ভাবি না। এসব দুজনের বিয়ের পথে কোন বাধা হতে আমরা দুজনেই দেবো না। লীলাদের বাড়ি খুব রক্ষনশীল। তাই লীলা আমায় এখন না যেতে বলেছে। বলেছে সময় হলে ও নিজেই আমার হাত ধরে নিয়ে যাবে। ————————————————————————————আজ সকাল থেকেই টিপটিপ করে বৃষটি পড়ছে। তাও পড়তে এসেছি। রূপক আর লীলাও এসেছে। স্যার আজকে লাইটের ডাবল লেন্স পড়াচ্ছেন। অনেক রাত হল।বৃষ্টি বেড়েছে । কাল পূর্ণিমা ছিল। চাঁদের আলোয় বৃষ্টির ফোটাগুলো আরও বড় দেখাচ্ছে। লীলাকে ওদের বাড়ির গলির মুখে ছেড়ে পা বাড়িয়েছি। পিছনে একটা বিশ্রী বিড়ালের ডাকে ফিরে তাকিয়ে দেখি একটা মিশমিশে কালো বিড়াল আক্রমনাত্মক ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। কেমন গা টা শিরশির করে উঠল। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আমার ভিতরের অনুভূতি বলছে সেটা ভালো নয় আমার পক্ষে। রাধামোহন মন্দির চত্বরে পৌঁছুলেই আমি নিরাপদ আমি জানি। কিন্তু তার আগের ঐ জংলা ফাঁকা জায়গাটা? হ্যা ঠিকই। বিড়ালটা কখন পিছন থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মুখোমুখি । ফ্যাসফ্যাস করে ফুঁসছে। যে কোন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। কিন্তু বিড়াল কোথায় এ ত’ আমারই স্বপ্নের ভবিষ্যত জীবনসঙ্গী আমার মানসী লীলা । চাঁদের আলোতে চিনতে কোনো ভূল হয় নি। চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মতই জ্বলজ্বল করছে,হা মুখের দাঁতগুলো বিড়ালের দাঁতের মতই তীক্ষ্ণ ,বাঁকা। একি পিশাচী ভয়ংকর চেহারা। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠল,“শোন্ মরার আগে জেনে যা। তোর কাছে আমার তোর রক্তমাংস পাওনা আছে। তোদের ঐ ভণ্ড বামুন বংশের পিশাচটা ঐ বিরজামোহন না কি নাম ঐ স্লীমান ম্লেচ্ছটার সাহায্য নিয়ে আমাদের ভীলাল্লা বংশকে শেষ করে গেছে। যাদের জেল হয়েছিল তাঁরাও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একে একে মারা গেছে। ঐ লোকটার একটা জীবন গেছে আর আমাদের বারো বারোটা জীবন। থাকতে থাকতে আজ শুধু একটা মেয়ে আমিতে এত বড় বীর বংশটা ঠেকেছে। তোদের বংশে আর তোদের পুরনো জমিদারি এলাকার তোরা আজও ঐ লোকটার কীর্তি নিয়ে গর্ব করিস আর আমাদের বংশে তোদের আর ঐ আঁশটে ফিরিঙ্গী স্লীমানকে নির্বংশ করে প্রতিশোধ নেওয়ার আগুন আজও ধিকিি ধকি জ্বলছে। আমি স্লীমানের বংশকে শেষ করতে পেরেছি আর তোকে আজ খেলেই আমার বংশের রক্তিমাদেবীর আরাধনা সফল হবে। শোন ভাল করে শোন উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা আর রক্তিমাদেবীর আশির্বাদে আজ আমি লীলা ভীলাল্লা গোটা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ডাকিনীদের একজন। কাল সকালে তোর নাড়িভুঁড়িগুলো আধখাওয়া অবস্থায় জঙ্গলে পাওয়া যাবে সবাই ভাববে হায়না বা নেকড়ের কাজ। এখন পায়ে পােয় এগিয়ে আয়।””দাড়াও! ভয় নেই। ঐ ডাকিনী তোমায় ছুঁতেও পারবে না। তুমি ওর পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে মন্দিরের চত্বর দিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র আবৃত্তি করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ কর। শুধু পিছন ফিরে তাকিও না । ”আমি জলদগম্ভীর স্বরে ঠিক দৈববাণীর মত শুনতে পেলাম। আমি যেন নিজের মত অফুরন্ত শক্তি অনুভব করলাম। মৃত্যু ভয় আর নেই। পায়েপায়ে মন্দিরেরআঙিনায় প্রবেশ করার ঠিক আগে আবার শুনতে পেলাম,“শোন রে পিশাচী!তুই এত বড় ডাকিনী আর এটা জানতি না ব্রহ্মদৈত্যরা ব্রহ্মেরই অংশবিশেষ?আমার প্রিয় প্রজাদের তোদের ঠগীবংশের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়েই আমি খুন হয়েছিলাম। আমি রক্ষা করি,কাউকে মারি না। তোকেও প্রাণে মারব না। তুই ঠগী বংশের মেয়ে হলেও ওই বংশপ্রদীপের শেষ সলতে। আমার এলাকা আর রূপমোহনকে হত্যার পরিকল্পনা ছেড়ে চলে যা।”বটঠাউদ্দার গলা আবার শুনতে পেলাম। ”————————————~——~~~~~~~~————— লীলার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই যেন উবে গেল। বটঠাউদ্দাকে চোখে সেদিন দেখিনি তবে তাঁর এক অন্যরকম উপস্থিতি সব সময়ই অনুভব করি। বুঝি ফুলিয়ার মানুষ কেন তাকে আজও দেবতা বলে পূজো করে। পরে জেনেছি যে ঠগী বংশকে তিনি উচ্ছেদ করেছিলেন তারা মধ্যপ্রদেশের ঝাবুয়ার ভীলাল্লা সম্প্রদায়েরই ছিল লীলার মত এবং রক্তিমা দেবীরই উপাসক ছিল। লীলা যে গলিতে ওরা থাকে বলে ঢুকত সেখানেই ওদের ঠগী পূর্বপুরুষরা বসতি গেড়েছিল। এতকিছু জেনেও লীলাকে কি আমি আজও ভালোবাসি?
____________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী
No comments:
Post a Comment