আমি যখন হাইস্কুলে পড়তাম, আমার কোন গৃহশিক্ষক বা শিক্ষিকা ছিলেন না। আমার ভাই-বোন কারোরই ছিল না। বাবা- মা ছিলেন আমাদের পড়াতেন। পরীক্ষায় আমরা ভালো নম্বর পেতাম।কিন্তু মাধ্যমিকের বেশ কয়েকমাস আগে বাবা ঠিক করলেন, আমাকে কোচিংক্লাসে ভর্তি করবেন বাংলা পড়ার জন্য।আমার বাংলা ব্যাকরণে কিছু সমস্যা হচ্ছিল।বাংলা এবং ইংরাজি আমার খুব সোজা লাগত, তাই নিয়ম করে কিছুতেই এই দু’টো সাবজেক্ট পড়তাম না।মা বারবার বলতেন, কিন্তু কোন কাজ হতো না। হাইস্কুলে থাকতেই অবশ্য আমি বিশ্ব সাহিত্যের অনেক অনেক বিখ্যাত বই পড়ে ফেলেছি।আমাদের বাড়িতে অনেক অনেক গল্প, কবিতা, নাটকের বই ছিল।যাইহোক আমাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরের এক বাংলা শিক্ষক বাবুদার কোচিংক্লাসে আমি সপ্তাহে দুইদিন সকালে পড়তে যাব ঠিক হল ।সকাল সাতটায় যেতে হবে। তখন বর্ষাকালের শেষের দিক চলছে ।
প্রথম দিন বাবার সাথে পনেরমিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম। দেখলাম অনেক ছাত্রছাত্রী রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। ঠিক সাতটায় স্যর এসে বারান্দার কোলাপ্সিবল্ গেটের তালা খুললেন।
সবাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেল।বাবা বাড়ি চলে গেলেন ।আমি আস্তে আস্তে ঢুকছি ।তিনতলা একটি ফ্ল্যাটবাড়ির গ্রাউন্ডফ্লোরে বাবুদা থাকেন। সামনে ছোট বারান্দা পার হয়ে মাঝারি সাইজের একটি ঘর, সেখানেই উনি পড়ান।আমি বারান্দা পার হয়ে ঢুকতে গিয়েই বিপত্তি, বারান্দার দড়িতে মেয়েদের অনেক জামাকাপড় বিশ্রীভাবে মেলে রাখা ছিল-আমার মাথায় লেগে নিচে পড়ে গেল।আমি অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটা লম্বা ছিলাম, আমার মাথাতে বেঁধে যাবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু বাকি ছাত্রছাত্রীদের হাসি আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগলো।
পুরীতে শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দিরেও এই রকম হয়েছিল।মন্দিরের গর্ভগৃহে পাণ্ডারা ছোট লাঠি দিয়ে ভক্তদের মাথায় মেরে আশীর্বাদ বিতরণ এবং ভিড় নিয়ন্ত্রন করেন। ছয়টা বারির মধ্যে পাঁচটাই আমার মাথায় পড়েছিল।যাদের কম উচ্চতা তারা অনেক ক্ষেত্রে অনেক অস্বস্তি এড়াতে পারেন ।যেই বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তারা এখনো এই নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করে । আসলে শির ঝোঁকানো আমার রক্তে নেই, তাই আমার সবসময় সমস্যা হয়। কিন্তু আমি একদম খেয়াল করিনা, এটাও আমার বড় দোষ । রাস্তাঘাটে বেরিয়ে ছোটবেলায় কতবার যে আমি ম্যাও-পটী, ঘউ - পটী,হাম্বা- পটী (এভাবেই বলতাম ছোটবেলায়) পাড়িয়ে বাড়ি এসেছি, তার ইয়ত্তা নেই।আমার সর্বংসহা মা আমার এই জ্বালাতনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন।বাড়ি ফেরার পর প্রায়দিন আমাকে প্রথমে সাবান দিয়ে, তারপর ডেটল জলে চান করাতেন এবং আমার চটি/জুতো ভালো করে ধুয়ে দিতেন। দেখে শুনে রাস্তাঘাটে চলার জন্য মা আমাকে রোজ বলতেন, কিন্তু আমি আমার নিজের মত চলতে পছন্দ করি।অনেক বড় হয়েও মাঝেমাঝেই এইরকম হতো ।স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে যখন কলিংবেল বাজাতাম, মা এক মুখ হাসি নিয়ে দরজা খুলতেন। তারপর প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন-“ জুতো মোজা ধুতে হবে?” আমি কোন কথা না বলে কখনো কুকুরের ডাক অনুকরণ করতাম, মা বুঝে যেতেন কুকুরের পটী পাড়িয়ে এসেছি। কখনো ম্যাও ম্যাও করতাম, মা বুঝে যেতেন বিড়ালের পটী পাড়িয়ে এসেছি।ওই বয়সেই আমার অদ্ভুত এক ক্ষমতা জন্মেছিল, জুতোর নিচে লেগে থাকা পটী দেখেই এটি কোন প্রাণীর অবদান বুঝতে পারতাম। মার ফর্সা মুখটা দেখতাম কালো হয়ে যেত । বলাবাহুল্য আমার ছোটবেলায় একবার পাড়ার কালিপূজার বিসর্জনের শোভাযাত্রায় হাতি এসেছিল।পরদিন আমাদের রাস্তায় হাতির পটী দেখছিলাম, কিন্তু আমি সতর্ক হয়ে যাই। কারন হাতির “বৃংহণ” আমার প্র্যাকটিস ছিল না, আমি মার সামনে করতে পারতাম না। মাঝে মাঝে আমি মার প্রশ্নের উত্তরে একদম চুপ হয়ে যেতাম, মা বুঝে যেতেন আমি রাস্তায় মানুষের পটীতে পা দিয়ে ফেলেছি। তখন তো ‘স্বচ্ছ ভারত’ বা ‘নির্মল বাংলা’অভিযান চালু হয়নি ! আমাদের ছোট শহরে তখন প্রচুর বস্তি ছিল, অধিকাংশই বাংলাদেশি উদ্বাস্তু । তখন সুলভ শৌচাগার আমাদের শহরে ছিল না।
যাইহোক যেইদিন ভালোভাবে বাড়ি ফিরতাম, মাকে আমার জুতোমোজা ধুতে হতো না, সেইদিন মা আমাকে অনেক অনেক আদর করতেন। বলতেন-“ডোডো এবার বড় হয়ে গেছে, কয়েক বছর পরেই চাকরি করবে, বিয়ে দেব...।”
“বিয়ে-ফিয়ে আমি করব না ।”আমি বলতাম।
“না – না বাবা, আমি কি সারাজীবন তোদের সেবা করব ?” মা দুঃখ পেয়ে বলতেন।
যাইহোক কোচিং ক্লাসেঘরে সবাই গিয়ে বসে আছে, আমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছি আছি-কি করব বুঝতে পারছি না। বাড়িতে ঘরের কোন কাজ করতাম না। তাছাড়া সবার সামনে মহিলাদের জামাকাপড় মেলতে আমার সম্মানে লেগেছিল বোধ হয়। অন্য কেউ হলে তাড়াতাড়ি সরে যেত, কিন্তু ওসব আমার স্বভাবে নেই। দুটো মেয়েকে ডাকলাম, নিচে পড়ে থাকা জামাকাপড় দড়িতে ভাল করে মেলে দেবার জন্য। কেউ এল না। প্রথম দিন পড়তে এসেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম ।
ছেলেরা ও মেয়েরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে খিল্ খিল্ হাসছে ।আমি আগেই জানতাম, আমার সমবয়সী মেয়েরা অনেকেই হিংসুটে । কিন্তু সেইদিন জানলাম কেউ কেউ থাকে যারা আমার মায়ের মতই সর্বংসহা।যারা নিজেরা কষ্ট স্বীকার করে সবাইকে ভাল রাখে ।
তখনো বাবুদা পড়ানো শুরু করেননি। একটি মেয়ে বসে ছিল, সে এসে সব জামা কাপড় তুলে দড়িতে মেলে রাখল ।তারপর মৃদুস্বরে বললো-“ পরদিন থেকে মাথা নিচু করে ঢুকবে ।ঠিক আছে?”ফর্সা ছোট খাটো চেহারা মেয়েটির ,টানা টানা চোখদুটিতে সরলতার ছাপ স্পষ্ট ।
আমি কোন উত্তর করলাম না। বাবুদা প্রথম দিনই আমার বাংলা ভাষা জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আমার অনেক প্রশংসা করলেন। কিন্তু আগেই বলেছি- শির ঝোঁকানো আমার রক্তে নেই। বর্ষাকাল চলে গেল, কিন্তু বাড়িতে পড়ার ঘরে ঢোকার বারান্দাতে আধ-ভেজা জামাকাপড় মেলা থাকতো আর প্রতিদিন আমার মাথা লেগে পড়ে যেত । ।শুধু আমার নয়, অনেকের গায়েই লাগত। কেউ কিছু বলত না। কোন কোন দিন দড়িতে মেলা জামা কাপড়ের লম্বা ফিতে আমার গায়ে মাথায় জড়িয়ে যেত।আমার নতুন বান্ধবী পরম যত্নে সব দড়িতে গুছিয়ে রাখত। এই করে বন্ধুত্ব বাড়ল, কিন্তু আগেই বলেছি-আমি আমার মত। কারো কথা আমি তখন ভাবতাম না। সবসময় আমার পড়াশুনা নিয়েই ভাবতাম।মাস কয়েক গেল, স্যর আমাকে ওনার পাশে নিয়ে বসাতেন। আমার বামদিকে বাবুদা আর ডানদিকে আমার নতুন বান্ধবী বসতো। আমি সব সময় চুপ থাকতাম। কিন্তু স্যরের সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতাম।
একদিন আমার নতুন বান্ধবীর (নামটা উহ্য রাখলাম)মা ওকে নিতে আসেননি, মেয়েটি আমাকে বলল- “চল আমরা একসাথে বাড়ি যাই ।” আমি কিছু না বলে ওকে অনুসরণ করলাম। মেয়েটির বাড়ি আমি চিনতাম না। রাস্তায় বেরিয়ে দেখি-ওর মা আগেই দাড়িয়ে আছেন। রাগী মুখে নিজের মেয়েকে বললেন-“ তুই যে বললি, স্যর আজ অনেক পরে ছাড়বেন...!!” মেয়েটি আমার সামনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
আর কিছুদিন কাটল , তখন শীতকাল এসে গেছে। আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি ।একদিন সকালে আমরা দু’জন ছাড়া কেউ পড়তে আসেনি। তখনো বাবুদা পড়ানো শুরু করেননি।
মেয়েটি আমাকে আস্তে আস্তে বলল, “আচ্ছা , তোমাদের বাড়ি কে রান্না করেন?”
আমি বললাম, “আমার মা ।”
“আমাকে তোমাদের বাড়ীতে নিয়ে যাবে? সব রান্না করে দেব। কাজকর্ম করে দেব ।। ভয় নেই,এখন না, অনেক পরে। তুমি তখন ভাল চাকরী করবে।” মেয়েটি বলল।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর বোকার মতো বললাম- “ না তা হবে না, আমি আমার মার রান্নাই খাব। তুমি অন্য বাড়িতে চেষ্টা করো......।”.
“অন্য বাড়িতে তো অন্য ছেলে থাকবে,তুমি তো থাকবে না। তাছাড়া কাকিমা তো বুড়ো হয়ে যাবেন । রান্না-বান্না, ঘরের কাজ কে করবে?”
“আমার মা আমার জন্য বউ আনবেন, সে করবে ।”
আমি স্বাভাবিক ভাবে উত্তর করলাম।
“তাহলে কাকিমাকে বলবে,খুব দেখে শুনে তোমার বিয়ে দিতে।তোমার বউ কখনো যেন তোমাকে না বকে। শুনলে আমার খুব খুব দুঃখ হবে..।”বান্ধবী বলল ।
আমি-“বউরা বকে? রাগারাগি করে? কেন?”
জানিনা। জানো আমার বাবা ঠিক তোমার মতো ।একদম সাধাসিধে, ভাল মানুষ ।নিজের মতো থাকতে ভালবাসে।মা তাই সব সময় বকে আর গালি দেয় বাবাকে ।”
“তাহলে তো খুব সমস্যা। আচ্ছা, তুমি সব সময় আমার পাশে এসে বসো কেন?”আমি প্রশ্ন করি।
“জানিনা ।”
মেয়েটি একদম চুপ।
আস্তে আস্তে পরীক্ষা এসে গেল। সবাই রাত জেগে পড়ত, তাই সকালে অনেকেই পড়তে আসত না। মেয়েটি কয়েকদিন পর থেকে আর পড়তে আসত না।আমার মাথায় লেগে এখনো জামাকাপড় পড়ে যায়। নিজেই জামা কাপড় দড়িতে মেলে রাখি। খুব রাগ হয়। বাবুদা সেদিন বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমাকে বাংলার শব্দভাণ্ডারের আগন্তুক শব্দ বা বিদেশি শব্দের উদাহরণ দিতে বললেন । আমি অনেক উদাহরণ দিলাম । উনি কোন্ টা কোন্ ভাষা থেকে আগত শব্দ বোঝাচ্ছেন । এরপর বাংলা ভাষায় আগত পর্তুগীজ শব্দ নিয়ে আলোচনা শুরু হল। বাবুদা আমাকে কয়েকটি উদাহরণ বলতে বললেই, আমি পরপর বলে ফেললাম পরপর – বারাণ্দা , সায়া, ফিতে । কিছু ভেবে বলিনি।বাবুদা গম্ভীর মুখে বললেন-ঠিক আছে । কিন্তু ছেলে মেয়েরা সবাই হেসে উঠল।উনি আস্তে আস্তে বললেন , “ কয়েকটি তুর্কীশব্দ ও তোমরা জেনে রাখ-বিবি, দারোগা..।” সবাই আবার খিল্ খিল্ করে হেসে উঠলো ।সেদিন পড়া শেষে বাড়ি যাবার সময় শুনলাম, স্যর উত্তেজিত গলায় কিছু বলছেন ওনার স্ত্রীকে ।ভাল বুঝতে পারলাম না।দু’জনের কোন বিষয়ে মতান্তর হচ্ছে বুঝলাম।আরও অবাক কাণ্ড। পরদিন থেকে বাবুদার বারান্দায় আর আধ ভেজা জামা কাপড় মেলা থাকতো না। আমি মাথা নত করার হাত থেকে বাঁচলাম। মাধ্যমিক পরীক্ষাতে সব বিষয়ের মত বাংলাতেও ভাল নম্বর পেলাম।
পরীক্ষার অনেক পরে একদিন ঠিকানা যোগাড় করে মেয়েটির ভাড়াবাড়িতে গেলাম, শুনলাম-ও নাকি বাবা-মার সাথে দিল্লী চলে গেছে। ওর বাবার বদলীর চাকুরী ।উনি দিল্লিতে বদলী হয়ে গেছেন। ওই বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে।আমাদের আর দেখা হয়নি।
..................
© রমেন দে
No comments:
Post a Comment