Wednesday, 4 January 2017

।। সিলিং ফ্যান ।।



১১ দিন পর রুমের বাইরে বের হয়ে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলাম। দীর্ঘদিন যারা একটা রুমের মধ্য আবদ্ধ থাকে তাদের গায়ের রঙ সাধারনত ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কুচকুচে কালো চামড়ার মানুষকেও কিছুটা ফর্সা ফর্সা লাগে। কোন এক অদ্ভুত কারণে এই থিওরী আমার ক্ষেত্রে কাজ করেনি। উল্টে আমার গায়ের রঙ আরো কালো হয়ে গেছে।

প্রচন্ড গরমে ঘামতে ঘামতে আমি যাচ্ছি গুলশান এক থেকে বনানীর দিকে। আমার শরীর থেকে ঘামের সাথে সাথে খানিকটা করে কালো রঙ চুইয়ে চুইয়ে রাস্তায় মিশে যাচ্ছে। রোদ চিরবির করা মধ্য দুপুরে হাটাহাটি করার মাঝে একটা মজার ব্যাপার আছে। এই সময় সব কিছু কেমন যেন ঝিম মেরে যায়। সূর্যের প্রবল তাপ এক ধরনের ঘোর তৈরী করে। মাথা ঝিমঝিম করে। নেশা নেশা লাগে। মধ্য দুপুর সময়টা নারীর মনের মতই রহস্যময়। অকারণে মন খারাপ হয়ে যায়। বিষণ্ণ মনের পোড়া গলিতে একলা ঘুঘু স্যাঁতস্যাঁতে গলায় ডাকাডাকি করে।

ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে স্যাঁতস্যাঁতে গলায় ঘুঘু ডাকার সম্ভবনা খুবই কম। ঘুঘুরা নির্জনতা প্রিয়। তবে মাঝে মাঝে কোকিলের ডাক শোনা যায়। ব্রেইন ডিফেক্ট কোকিল। ঢাকা শহরের ব্রেইন ডিফেক্ট কোকিলেরা বসন্ত ছাড়া আর সব ঋতুতেই করুন গলায় ডাকাডাকি করে। ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়।
মনের স্যাতঁস্যাঁতে ভাব কমাতে আমি পকেট থেকে মুঠোফোন বের করলাম। তানজিমাকে ফোন দেয়া যায়। মনের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব দূর করতে রুপবতী তরুনীদের হাসি কোরামিন ইঞ্জেকশনের মত কাজ করে। আমার বিদেশ ফেরত বান্ধবী তানজিমার বাসা বনানীতে। সমস্যা হলো তানজিমার ফোন নাম্বার আমার মুখস্ত নাই। তার বদলে নাতাশাকে ফোন দেয়া যায়। নাতাশার মুঠোফোন নাম্বার আমার ফোনে নাতাশা সেভ করে দিয়েছে।
আমি নাতাশাকে ফোন দিলাম।
- হ্যালো...
- হ্যালো নাতাশা, তুমি কি ব্যস্ত? ব্যস্ত না থাকলে একটা জরুরী বিষয়ে জানতে চাইতাম...
- ভাইয়া আমি ব্যস্ত না। আপনি বলুন...
- নাতাশা তোমাদের বাসায় কি ছাদ আছে?
- এইটা আপনার জরুরী বিষয়? আপনি এই কথা জানার জন্য ফোন দিয়েছেন?
- হুম...
- ছাদ থাকবেনা কেন? সবার বাসাতেই ছাদ থাকে...
- সবার বাসাতে থাকেনা। কারো কারো বাসাতে থাকে, তারা ভাগ্যবান। আমাদেরটাকে আমরা সবাই চাল বলি। টিনের চাল।
- হুট করে ছাদ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন কেন?
- ছাদ নিয়ে গবেষণা না। একজন উপহার হিসেবে আমাকে একটা সিলিং ফ্যান দিয়েছে। সেই ফ্যান দেখার মত। ফ্যানের তিনটার যায়গায় পাখার সংখ্যা ছয়টি। আমি ফ্যান ঝোলানোর মত জায়গা পাচ্ছি না। গরু মার্কা ব্রান্ডের টিনের চালা থেকে ছয় পাখার একটা ফ্যান ঝুলছে ব্যাপারটা হাস্যকর। চটি জুতায় ফিতা লাগানোর মত হাস্যকর।
- হাস্যকর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? আপনার তো সব কর্মকান্ডই হাস্যকর...
রুপবতি তরুনীদের কথায় অপমান বোধ করার কিছু নাই। আমার অপমান বোধ এমনিতেই কম। তা নাহলে এরকম অপমানে অন্য কারো লজ্জায় গায়ে ফোস্কা পরে যাওয়ার কথা।
- হাস্যকর হলেও কিছু করার উপায় নাই। আমার হয়েছে 'ভিক্ষা চাইনা, ফ্যান সামলাও' অবস্হা।
- আপনার কোন বন্ধুকে ছয় পাখার ফ্যানটা দিয়ে দিন...
- সেটা সম্ভব না...
- সম্ভব না কেন?
- বেকার মানুষের কোন বন্ধু থাকেনা। বেকার মানুষের বন্ধুরা সময়ের সাথে সাথে, একসময় চিনতাম কিংবা পাওনাদার এ পরিনত হয়...
- এক কাজ করুন, আপনার বিখ্যাত ফ্যান আমাকে দিয়ে দিন। আমার মাঝে মাঝে প্রচন্ড মন খারাপ হয়। মরে যেতে ইচ্ছে করে। কোন এক মন খারাপের রাতে আপনার বিখ্যাত ফ্যানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পরবো... আইডিয়াটা কেমন? সুন্দর না?
- অবশ্যই সুন্দর...। তবে ঝুলে পরার আগে ওড়না ঠিক মত গলায় বেঁধেছো কিনা পরীক্ষা করে দেখবে। পলিয়েস্টার কাপড় এ ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে। তা না হলে দেখা গেল ওড়না ফসকে গিয়ে পা ভেঙে ফেললে। ভাঙা পা নিয়ে বনানী কবরস্থানের জায়গায় তুমি পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছো। আত্মীয় স্বজন এককেজি আঙুর আর কলার কাঁদি নিয়ে তোমাকে দেখতে যাচ্ছে।
- ফাজলামি করছেন?
- হুম...
- আমার সঙ্গে ফাজলামি করবেন না... আমি আপনার প্রেমিকা না।
- অবশ্যই না। এতটা সৌভাগ্যবান আমি না। নাতাশা তুমি একটা চমৎকার মেয়ে। চমৎকার মেয়েদের প্রেমিকরা ভর দুপুরে বনানীর রাস্তায় ছয় পাখার ফ্যান হাতে ঘুরে বেড়ায় না। ফ্যান হাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো প্রেমিকদের জন্মই হয় চমৎকার মেয়েদের স্বাস্হ্যবান বাচ্চার মুখে মামা ডাক শোনার জন্য...
- মন খারাপ করেছেন?
- না
- না কেন? আপনার কি মন খারাপ হয়না?
- 'মন খারাপ 'মাথা ব্যাথা' এগুলো অভিজাত অসুখ, উচ্চবিত্তরা এই রোগে ভোগে বেশী। আমি গরীব মানুষ, গরীবের মাথা ব্যথা বা মন খারাপ হয়না। গরীবের হয় পেট ব্যাথা, পাতলা পায়খানা, রানের চিপায় চুলকানী।
____________
© মোহাম্মাদ সামি

No comments:

Post a Comment