প্রায় বিশ বছর আগের গল্প। গ্রামের সিধুদের পূর্বপুরুষরা জমিদার ছিল। বর্তমানে জমিদারির জৌলুস হারালেও রংচটা অর্ধ-ভগ্ন পেল্লাই দালানবাড়ি আর দোনলা বন্দুকটি তার নিরব সাক্ষ্য বহন করছে। আমরা সব ক্লাস ফোর ফাইভের ছেলের দল জানতাম সেকথা। তাই স্কুলে এবং গ্রামের খেলাধুলার আখড়ায় কোন ছেলে সিধুকে ঘাঁটাতে সাহস করত না। ওদের বাড়িতে বন্দুক আছে,অতএব ও যখন তখন ফটাস করে চালিয়ে যে দেবেনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাকি ছেলেদের ভয়ের এই ফায়দাটা তুলত সিধু। দাদাগিরি চালাত। প্রবল অনীহা সত্বেও ওর প্রমানহীন সাহসিকতার গাঁজাখুরি গল্প একবাক্যে সবাইকে মানতে হত। কিন্ত সামনে সমীহ করলেও আড়ালে আবডালে সিধুকে 'ল্যাকপ্যাকে', 'তালপাতার সেপাই', 'গোবরা হনু' ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত করত ছেলেরা।
একবার সিধুর মামা শম্ভু তাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। ভয়ানক গোঁফ সহযোগে শম্ভুবাবুর শরীরটি ছিল বেশ জুৎসই। মানুষটির অদ্ভুত শখ ছিল; শিকার। ফন্দি এঁটে টোটা তিনি সঙ্গে নিয়েই এসেছিলেন। আজ বিকেলে শিকারে বেরোবেন সিধুদের বন্দুক হাতে। খবরটা সকাল বেলাতেই আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল ছোটো ছোটো ছেলে পিলেদের মধ্যে। গুলি ছোঁড়াটা সচক্ষে দেখার প্রবল উন্মাদনা দেখা দিল।ফলস্বরূপ অনেকে স্কুল কামাই করল। প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিকেলে শম্ভু মামা বন্দুক হাতে বেরোলেন। তার পিছে উমেদারি ভাগ্না সিধু। রোগা সিধু বারবার ফস্কে যাওয়া প্যান্ট বাগায় একহাতে আর এক হাতে আমাদেরকে ইশারায় পিছু নিতে বলছে। ভাবখানা এমন যেন আজ ও নিজেই একটা বিরত্ব দেখাবে। আমরাও জনা দশেক ছেলে পিছু নিয়ে পৌছে গেলাম গ্রাম ছাড়িয়ে ধানের জমিতে। অগ্রহায়ন মাস। ধান সব উঠে গেছে গোলায়। পড়ে থাকা স্যাঁতস্যাঁতে জমিতে গ্যাঁড়া গুগলি খেতে নামে সারস পাখি। শম্ভু মামা যে সেগুলিই টার্গেট বানিয়েছে তা হাবুল, বিশু, মানিক, সুশিল সবাই ফিসফিসিয়ে একমত। শম্ভু মামা এতক্ষনে আমাদের উপস্থিতি টের পেলেন এবং খানিক বিরক্তি প্রকাশ করে চুপ থাকতে উপদেশ দিলেন। আরো কিছুক্ষন অপেক্ষার পর দেখা গেল তিনটি সারস। পড়ন্ত বিকেলের কোমল রশ্মিচ্ছটায় ধবল সারসগুলো লম্বা লিকলিকে পা নিয়ে নামল একটা ক্ষেতের মাঝামাঝি। আমরা আছি আল দ্বারা বিভাজিত দুটি ক্ষেতের পর। শম্ভু মামা টোটা বন্দুকে পুরে নিল এবং হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে থাকল। দেখাদেখি আমরাও ওনার পিছন পিছন হাম হাম গুড়ি গুড়ি। আল পেরিয়ে পরের ক্ষেতে যেতেই আমাদেরকে হতাশ করে একটা সারস শ্বেত-বিষ্ঠা বিসর্জনপূর্বক ডানা মেলে পগারপার। আরো একটি তার সঙ্গ নিল। রইল পড়ে এক। আমরা তখন চরম আশঙ্কা আর উত্তেজনায় ফুটছি। এদিকে শম্ভু মামা গুড়গুড়ি জারি রেখেছেন। আমরাও ঠেলা ঠেলি গুঁতাগুঁতি করে এমবুশ পজিশনে। চরম মুহুর্তের প্রতিক্ষায় আলের আড়ালে আমরা সবাই। একটু তফাতে শম্ভু মামা বন্দুক বাগিয়ে আল থেকে উঁকি মেরে শ্যেন নজরে সারসটিকে গুলি ছোঁড়ার অপেক্ষায়। নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রনে না রাখতে পেরে আমরাও আল ধরে আধা দাঁড়িয়ে উঁকি মারছি। সিধু যে আমাদের থেকে আলাদা এটা দেখানোর জন্য একাই একটু তফাতে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ চারদিকের নিস্তব্দ্ধতা ছারখার করে 'গুড়ুম' শব্দে যেইনা গুলি ছুঁড়েছে শম্ভুমামা, ওমনি চমকে, পিছনে ভর করে, ভাগ্না সিধু গেল পড়ে। ঠিক যেন বন্দুকের ব্যাকপুশটা ওরই লাগল। আর ব্যাটা পড়েছে একবারেই কাঁচা পায়খানার উপর। একতাল পায়খানা প্যান্টের পিছনে নিয়ে উঠে দাড়াল সিধু। সারস মরল কি টার্গেট মিস হল সে নিয়ে মাথাব্যথা কারো নেই। সিধু যে আপনা হতেই জব্দ হয়েছে এই আনন্দে সবাই তখন হাততালি,শিস এবং অনাবিল হাসিতে মত্ত। আর গোবেচারা সিধু তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পরক্ষনেই শম্ভুমামার গগনবিদারী হুংকারে সবাই পড়ি মরি করে দৌড় লাগালাম।
অবশ্য রাত্রে মামার আদেশে বাধ্য হয়ে সিধু আমাদেরকে ডেকে নিয়ে গেল ওদের বাড়ি। সারসের মাংস খেতে।
বি:দ্র: ঘটনাটি বাস্তবে মিল পেলে নেহাত কাকতালীয় বলেই গন্য হবে।
____________
© রঞ্জিত চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment