আমার শীতকালের শুরুটা একটু অন্যভাবে হয়! আর শীতকাল টা কাটে আরেকটু অন্য ভাবে৷
ফুলকপি বা বাঁধাকপি মোটামুটিভাবে সারাবছরই পাওয়া যায় এখানে৷ আর একটু খোঁজখবর করে খরচ করলে, সবুজ মটরশুঁটিও মেলে৷ সে অর্থে এগুলো দিয়ে আমি শীত বুঝিনা৷ আমার শীত অন্যরকম, যেটা সোয়েটার জ্যাকেট মাফলারের গন্ডীতে আবব্ধ থাকেনা৷
আমার শীতকালে আমাদের বাড়ির একটা রুম ফাঁকা রাখতে হয়৷ প্রতিবছর ঠিক এরকম সময়টাতেই পূর্বমেদিনীপুরের কাঁথির দিক থেকে বেশ কয়েকজন বৈষ্ণব মানুষ আসেন৷ তারমধ্যে কিছুজন বয়স্ক, মধ্যবয়স্ক এবং জোয়ান৷ আমাদের বাড়ির একটা রুমেই অতিথি হয়ে থাকেন বেশ কিছুদিন৷ ওদের জন্য আলাদা করে হাঁড়ি, কড়া, রান্নাখাওয়ার সব বাসনপত্র দিয়ে দিতে হয়৷ ওনারা আমাদের দেওয়া বা রান্না করা কোন খাবার ছুঁয়ে দেখেননা৷ প্রতিদিন সকালবেলা হলেই খোল করতাল নিয়ে ভিক্ষায়(?) বেরিয়ে যান পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে৷ আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধের সময় থলি ভর্তি সদ্য তোলা কাঁচা আলু আর চাল নিয়ে ফেরেন৷ নিজেরাই রান্না করেন, খেয়ে দেয়ে আবার পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি নেন৷
কোন কোন দিন সন্ধেবেলায় আমাদের দালানে হরিনাম সংকীর্তনের আসর বসে৷ আপাদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে, উচ্চস্বরে শ্রীরাধাকৃষ্ণের নামে প্রতিটা সন্ধে মোহময় হয়ে ওঠে, আবিষ্ট হয়ে যেতে হয়৷ আর রাত গভীর হলে, গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালায় সোনামুগের ডাল আর বেগুনভাজা অমৃতের স্বাদ নিয়ে আসে৷ তারপর একদিন হঠাৎ করে ওনারা চলে যান, আবার পরের বছর ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷
আমার শীতকালের ভোরগুলো খুব ব্যাস্ততার৷ গ্রামের খেজুরগাছ গুলোর তলায় ভিড় হয় খুব এসময়৷ গাছ থেকে নামিয়ে আনা টাটকা খেজুর রসের স্বাদ থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায়না৷ আর আমাদের নিজেদের গাছের খেজুররস টা সবথেকে বেশি মিষ্টি হয়৷ টিনের টিফিনকৌটো ভর্তি করে বাড়ি ফিরি৷ আর একটু বেলা বাড়লে রস ছেড়ে খেজুরগুড়ের সন্ধানে বের হতে হয়৷ সকাল থেকে গ্রামের প্রতিটি গাছে গাছে ঘুরে যে রস জমা হয়, সেটা একটা বড় লোহার কড়াইএ তখন টগবগ করে ফুটতে থাকে৷ খড়ের জ্বাল হু হু করে ফোটাতে থাকে খেজুর রস টাকে, যেন গলিত তরল সোনা৷ আর সে মুহুর্তে উনুনের চারপাশে যে কি আবেশ করা গন্ধ ম ম করে, সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব না৷
আমার শীতকালের বিকেলটা অন্যরকম৷ গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে জঙ্গলের গায়ে ততক্ষনে মোষের পাল এসে পৌঁছে গেছে৷ প্রতিবছর এই সময় বেশ কয়েকটি যাযাবরের দল আসে, সঙ্গে তাদের কয়েক'শ মোষ৷ সারা দিন জঙ্গলে মোষ চরিয়ে, সন্ধেবেলায় জঙ্গলের প্রান্তে অস্থায়ী ছাউনিতে ফেরে তারা৷ তারপর বড় বড় বালতি নিয়ে, নিমেষে অদ্ভুত কৌশলে হাতের দুতিনটে আঙুলকে কাজে লাগিয়ে মোষের দুধ ভর্তি করে ফেলে৷ একটার পর একটা বড় ড্রাম ভর্তি হয়ে যায়৷ খুব কম দামে আমরা টাটকা, নির্ভেজাল মোষের দুধ নিয়ে বাড়ি ফিরি৷ তারপর সেটাকে গরম করে ফুটিয়ে, তাতে পিঠে সেদ্ধ করে এক অমৃততুল্য স্বাদের ভাগিদার হই৷
সন্ধে বেলা ততক্ষনে টুসুগানের আসর বসিয়ে ফেলে জোৎস্না কাকিমাদের পাড়ায়৷ সারা রাত টুসুঠাকুরকে জাগিয়ে, নিজেরা জেগে থাকে৷ সারা রাত পালা করে খালি গলায় গান হয়৷ কখনও আবার সবাই একসাথে গলা মিলিয়ে৷ আমরা লেপের তলায় দিব্যি সেসব সুর শুনতে পাই৷ একনিমেষে চিনে বলে দিতে পারি কোনটা কার গলা৷
আমার শীতের রাতগুলো কাটে খুব সন্তর্পনে৷ হঠাৎ করেই শুনতে পাই গোটা গ্রামকে ঘিরে একটা হো হো আওয়াজ৷ লেপের তলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসি, হাতে মশাল আর সার্চলাইট নিয়ে এক নিমেষে ছুটে যাই গ্রামের প্রান্তে মাঠ বরাবর৷ তখন সেখানে শ'য়ে শ'য়ে মানুষ৷ চিৎকার, কোলাহল, মশাল, সার্চলাইট আর বুম্ বুম্ বাজি ফাটার আওয়াজ৷ জোৎস্না রাতের আলোয় তখন চল্লিশ পঞ্চাশটা হাতির দল, গরীবমানুষের ফসল নষ্ট করতে করতে এগিয়ে চলেছে৷ হাতি যা নষ্ট করে, হাতি তাড়ানোর নাম করে আসা মানুষগুলোর পা'য়ে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়৷ একটা সময় হাতি জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করে, আমরাও লেপের তলায়৷ বাকি রাতটুকু আর ঘুম আসেনা, একটা নষ্ট সকালের আতঙ্কে৷
আমার শীতকালটা কষ্ট পায় নিধু কাকার ঘরে৷ প্রবল ঠান্ডায় কাবু নিধুকাকা, ঘর গরম করতে ঘরের ভেতরেই আগুন জ্বালিয়ে ফেলে৷ ঘরভর্তি কার্বনডাইঅক্সাইডের সাথে পাল্লা দিয়ে বিড়ির ধোঁয়া নিধুকাকার বুকে আগুন হয়ে ওঠে৷ খুক্ খুক্ কাশির দমকায় নিধুকাকার শরীর গরম হয়৷
___________
©দীপেন ভূঞ্যা
No comments:
Post a Comment