Thursday, 26 January 2017

।। প্রজাতন্ত্র দিবস ।।


    সকাল বেলায় স্নান করে অমিতাভ তৈরি হয়ে নিল। দশ মিনিটের মধ্যে না বেরালে ঠিক সময়ে পৌঁছানো যাবে না। কথার খেলাপি হবে। যেটা তার একদম পছন্দ নয়। তাই স্ত্রীকে তাড়া দিতে লাগল,---" কই গো হল তোমার? আমাদেরকে কিন্তু এবার বেরাতে হবে। তাড়াতাড়ি এস।" কয়েক মিনিটের মধ্যে তার স্ত্রী লাল পাড় গরদের শাড়ী আর একপাশে লাল শাল নিয়ে খুব অভিজাত সজ্জায় বেরিয়ে এলেন। চার জায়গায় প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে  চীফ গেস্ট হিসাবে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত অমিতাভ মুখার্জী; ইস্টার্ন কোলফিল্ডের কোলিয়ারির জেনারেল ম্যানেজার। পতাকা উত্তোলন তাকেই করতে হয়।
     --------- চার জায়গায় অনুষ্ঠান সেরে ফিরতে ফিরতে বেলা এগারটা বাজল। ঘরে ফিরেই তাড়াতাড়ি চাট্টি খেয়ে ছুটল অফিস। অফিসে ঢুকেই শুনল একটা ওপেন কাস্টে ধ্বস নেমেছে। ছুটতে হল সঙ্গে সঙ্গে। গিয়ে যা দেখা গেল তাতে কারুর প্রাণহানি না হলেও অনেকখানি জায়গা ধ্বসে ঢুকে গেছে মাটিতে। কুলি বস্তির তিন-চারটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। একটা বাচ্চা সহ ছয়জন মানুষ আটকে রয়েছে ধ্বসের ওপারে। লোকাল অধিবাসীরা বেশ খানিকক্ষন ঘেরাও করে রাখল সব অফিসারদেরকে। পুলিশের হস্তক্ষেপে ঘেরাওমুক্ত হলেও অমিতাভ কিন্তু ঐ স্থান ত্যাগ করল না। তার উপস্থিতিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছিল উদ্ধারকাজ।
      মোটামুটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সন্ধ্যা সাতটা বাজল। ছয়জন ভিকটিমকেই উদ্ধার করা হয়েছে। এই এতক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থেকে পঞ্চান্ন বছরের ভারী শরীর যথেষ্ট ক্লান্ত। ঠান্ডাও লাগছে এবার খুব। পুলিশের সাথে কথা বলে জুনিয়রদেরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে এবার পা বাড়াল সে। অফিসের অ্যাম্বাসাডরটা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্লান্ত শরীরে ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগোতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল একটু দূরে কুলিবস্তির দিকে। আধো আলোর সামনে একটা ছায়ামূর্তি! পিঠে একটা আধভর্তি বস্তা নিয়ে এগিয়ে চলেছে বস্তির দিকে।এতটা দুর থেকে তাকে ঠিকমত দেখা না গেলেও শোনা যাচ্ছে তার গলার গান ------
  হর করম আপনা করেংগে
  অ্যা বতন তেরে লিয়ে ;
  দিল দিয়া হ্যা, জান ভি দেংগে
  অ্যা বতন তেরে লিয়ে -----------
     ক্ষণিকের জন্য পা দুটো থেমে গেল অমিতাভর! অপলক দৃষ্টিতে ছায়ামূর্তির চলে যাওয়ার পথে চেয়ে থাকতে থাকতে তার গান শুনতে লাগল। সম্বিত ফিরল ড্রাইভারের ডাকে,------------ "সাব, চলিয়ে ।"------
     রাস্তায় অ্যাম্বাসাডরের জানলার বাইরে তাকিয়ে অমিতাভর মনে হল ; প্রজাতন্ত্র দিবসটা সে আজই প্রথম পালন করল এই পঞ্চান্ন বছর বয়েসে ॥॥
____________________________________
© মমতা সিনহা

Thursday, 19 January 2017

।। দরকারী নয় তবুও বলছি শোনো ।।




জানো আমি এত কুত্সিত্ কেনো ?
দরকারী নয় , তবুও বলছি শোনো ----
ছোটো থেকেই বর্ণ সে শ্বেতচন্দন , 
দেখে গলে কত উচ্চ ঘরের নন্দন |
কোনো একজন অনুরাগী তারই মধ্যে
বড়ো ভালোবেসে চাইল হৃদয়ে বাঁধতে |
ভালো তো লাগেনি ' না ' বলে দিয়েছিলাম ,
উপহারে কিছু অ্যাসিড পেয়েছিলাম |
জানো আমি আজ একঘরে কেনো ?
দরকারী নয় তবুও বলছি শোনো -----
অফিস কাজেতে রাতে বেরোতাম প্রায় ,
সেদিন কটা ছেলে এসে ধরল চেপে আমায় |
লোকে বলে আমার পোশাকই এর জন্য দোষী ,
ধর্ষিতা আমি | ব্যাথা এতে এমন কি আর বেশি ?
কিছু জনে বলে --- ' আহা রে বেচারি ! ' ,
বেশি জনে বলে --- ' মেয়ে নষ্টা যে ভারি ' |
জানো আমি পথে স্বামী সংসারী কেনো ?
দরকারী নয় , তবুও বলছি শোনো -----
বাবার অর্থ অসমর্থ পণ দিতে রাশি রাশি ,
শ্বশুরবাড়ির অন্নধ্বংস করতাম বড়ো বেশি |
তার ওপরে তিনখানা মেয়ে , ছেলে নেই একটাও ,
কি করে আমাকে সঙ্গে রাখবে পতিদেব বলো তাও ?
নিজের বাড়িতে ছিলো ছোটবোন তখনও অবিবাহিত ,
মা-বাবা বলল তুই থাকলে ওর বিয়ে হবেনাতো !
জানো আমি আজকাল দেহ বেচি কেনো ?
দরকারী নয় , তবুও বলছি শোনো -----
প্রেমিক আমার সিনেমা দেখাতে নিয়ে চেপেছিল বাসে ,
জ্ঞান হতে আমি বেশ্যাপাড়ায় , চেনা নেই আশেপাশে |
রোজ রোজ আমি বিক্রিত হই , ছিঁড়ে খায় কতো জন্তু ,
আমি অভদ্র , যারা কাছে আসে ভদ্র তারাই কিন্তু |
তোমরা কারা গো , অন্যায় হলে হাতে বাতি নিয়ে প্রতিবাদে ?
হাঃ হাঃ | তোমরা তারাই , গোপনে শরীর কিনে নাও যারা প্রতিরাতে |

___________
@ সংযুক্তা ঘোষ

Sunday, 15 January 2017

অভিভাবক

*****উন্মাদীয় রবিবাসর*****

অভিভাবক
======

হাসপাতালের বিছানায় গর্ভ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে কোন মহিলা। খানিক পর একজন সেবিকা গজ ন্যাকরায় জড়িয়ে একটা জীবিত মাংসের পিণ্ডকে সেই মহিলার কোলে অর্পন করে দিয়ে বলেন- এই নিন আপনার সন্তান, আর সন্তানের উদ্দেশ্যে বলে দেয় – বাবু এবার মায়ের কাছে যাও।

এই শুরু অভিভাকত্বের।

জীবনে চলার পথে কাওকে না কাওকে বিশ্বাস করতেই হয়। অভিভাবক আসলে একটা পবিত্র বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের উপরেই টিকে থাকে এই সমগ্র পৃথিবী। যাবতীয় লেনদেন। প্রেম ভালবাসা ঘৃণা হোক বা বস্তুবাদ, নিদেনপক্ষে ভক্তি বাদও এই অভিভাবকত্বের চাদরেই মোড়া।

শিশুর মা শিশুকে পৃথিবী চিনতে শেখায়। আর শিশুটি বিশ্বাস করে তার প্রথম অভিভাবক, মায়ের কথাগুলো। হয়ত দ্বিতীয় আর কোন উপায়ও থাকেনা। সে তার পিতৃপরিচয় পায় সেই মায়ের সুত্রেই, সহোদর চেনে, তুতো চেনে, পরিবার চেনে, সমাজ চেনে। যাদেরকে সে আগামিদিনের অভিবাবক হিসাবে নির্দ্বিধায় মেনে নেবে। সবটাই সেই পবিত্র বিশ্বাস। এবং ততক্ষন পর্যন্ত মেনে নেয় যতক্ষননা সে নিজ বিচার বুদ্ধি বা তৃতীয় কোন ব্যাক্তি বা বস্তুর দ্বারা গ্রহনযোগ্য বিরুদ্ধ মত বুঝতে বা মানতে শিখছে। বিবর্তনতত্বের মৌলনীতি বা শক্তির সংরক্ষণশীলতা সুত্র কোনকিছুই যেমন অভিভাবকত্বের তত্বকে স্বাধীন রূপ দিতে পারেনি, তেমন সৃষ্টির আদি থেকে আবহমান কাল বেয়ে আজকের ডিজিটাল সভ্যতার যুগেও অভিভাকত্ব কখনই অভিভাবকহীন হয়নি। কারন সেই পবিত্র বিশ্বাস

অভিভাবক কাদের জন্য প্রযোজ্য? সেটা জানার আগে জানা প্রয়োজন অভিভাবক কারা! পালক, প্রতিপালক, তত্বাবধায়ক, রক্ষাকর্তা, শিক্ষক, রক্ষক, অছি, অনুগ্রাহক, সহায়ক, পৃষ্ঠপোষক, উৎসাহদাতা, নিয়োগকর্তা, প্রতিপোষক,  জিম্মাদার, নাথ এমনকি সমর্থকদেরও অভিভাবক বলা যেতে পেরে পরিস্থিতির ভেদে। সুতরাং এমন মহান শক্তিধর কে আছেন যিনি উপরের সকল পৃথক পৃথক শব্দগুলকে একত্রে অস্বিকার করবেন?

আবিধানিক অর্থ বলছেঃ সেই ব্যাক্তি বা বর্গকে অভিভাবক বলা যায়, যিনি কোন একজনের যাবতীয় বিষয়ে তদারকি করার জন্য আইনগতভাবে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত। সেটা অন্যকেও হতেও পারে আবার নিজের জন্যও প্রযোজ্য। মোদ্দাকথা যিনি সুরক্ষা প্রদান করতে পারেন তিনিই অভিভাবক।

অপরিপক্ক বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার অভাব, এবং সীমিত বিচার বুদ্ধি হওয়ার কারনেই আসলে অভিভাবকের প্রয়োজন হয়। যাতে দূর্বলতার সুযোগ কেও নিতে না পারে, এবং প্রাপ্য অধিকারকে সংরক্ষণ করতে পারেন। অনেক সময় নিজের সঠিক সিদ্ধান্তগুলোকে বাজিয়ে নেওয়ার জন্য তথা আত্মসন্তুষ্টির প্রমিতকরনের জন্য একজন পরামর্শদাতা বা প্রাথমিক পর্যালোচোনার জন্য যে ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আনুকুল্য গ্রহন করা হয়, সেটাও আসলে অভিভাবকত্বেরই একটা বিলক্ষন রূপমাত্র।

প্রানীকুলে অভিভাবকত্ব অতিপ্রয়োজনীয় হলেও, আমাদের আলোচ্য মনুবংশীয়দের নিয়ে। যাহারা জীবনীকালের অর্ধেকটা বা তার বেশি সময়কালধরে নিজেরা নিজেদের দেখাশোনা করতে পারেনা, যারা তাদের বিষয় সম্পদ, সামাজিক সমস্যা ও তার নিরাপত্তা, শিক্ষা, তথা প্রয়োজনবোধকে সুরক্ষা প্রদানে অক্ষম, তাদের জন্য অভিভাবক নিতান্তই প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় সত্য হল মানুষ জীনিগতভাবেই পরনির্ভরশীল, এমনকি ভাবনাতেও। তাই অভিভাবকত্বের প্রয়োজন কখনই ফুরিয়েও ফুরায়না। আর এই সরনিতে প্রথমেই আসে যে নাম গুলো সেগুলো হচ্ছে – নাবালক, নির্বোধ ও উন্মাদ। আজীবন এদের অভিভাবক প্রয়োজন, নচেৎ অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি হয়।

অভিভাবকত্ব মূলত চার প্রকারেই হয়ে থাকে। দেখা যাক একনজরেঃ-

জন্মগত সুত্রে প্রাপ্ত।
----------------
এই ধরনের উপরে অভিভাবকত্বে ব্যাক্তির কোন নিয়ন্ত্রন থাকেনা। ব্যাক্তির পছন্দ বা অপছন্দের উপরে নির্ভরশীলও হয়না। আইনত প্রাপ্তঃবয়স্ক হলেই ব্যাক্তি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে ঠিকিই, কিন্তু তবুও এই ধরনের অভিভাবকেরা জীবনের অনেকটা অধ্যয় জুড়ে বা প্রায় সারাটা জীবনই ছায়া প্রদান করে। অনেকের ক্ষেত্রে এই ছায়া রৌদ্র বৃষ্টি ঝঞ্ঝা ইত্যাদি থেকে অপত্যকে লালন করে, ব্যাক্তির দায়িত্ব পালন করেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এই ছায়া এমন আওতার বাঁধা সৃষ্টি করে যে, বাকি সারাটা জীবন রুগ্ন ফ্যাকাসে হয়ে দূর্বল জীবনযাপন করতে হয়, অথবা দ্রুতই জীবনসায়াহ্ন এসে উপস্থিত হতে পারে ব্যাক্তিজীবনে। একজন জন্মগত অভিভাবকের সদিচ্ছা আর সচেতনতার উপরে অধীনস্ত বা নির্ভরশীল মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ অনেকটা যে নির্ভরশীল সেটা বলাই বাহুল্য। মৃত্যু বা সম্পর্কের টানাপড়েনের ফলে নিকট অবিভাবকের সাথে ছেদ ঘটলে পরবর্তী নিকট আত্মীদের উপরে সেই অভিভাবকত্ব প্রতিসারিত হয়।

শিক্ষক
-------
শিক্ষক হল প্রানীর অন্যতম বড় অভিভাবক। সেই শিক্ষক পরিবারের কেও হতে পারে, বাইরের কেও হতেই পারে। শিক্ষা ছাড়া একজন নাবালক কখনও সাবালক হতে পারেনা, নির্বোধের বোধ জাগেনা, উন্মাদের চেতনা জাগ্রত হয়না, বিবেকের চৈতন্য হয়না। এজন্যই জন্মগতসুত্রে প্রাপ্ত অভিভাবকের থেকে শিক্ষকের গুরুত্ব কোন অংশেই কম কিছু নয়। ভালো আর মন্দের ফারাকটা জানার নামই জ্ঞান। বাক্যের সংযত ব্যাবহারের মধ্যেই সাবালকত্বের মুখ্যস্তর, জীবনের এই পর্বে উত্তীর্ণ হবার পর থেকেই ধীরে ধীরে অভিভাবক নির্ভরশীলতা হ্রস্বত্বর হতে থাকে পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপরে অভিভাবকত্বের অধিকার অর্জন করে। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কখনই শিক্ষক নামক অবিভাবকের রাহিত্য মেটেনা।

সমাজ তথা পরিবেশ
------------------      
প্রানী জগতের অধিকাংশ প্রজাতিই সামাজিক। আর মানুষ অন্যতম বড় সামাজিক প্রানী। সমাজকে ঘিরেই আমাদের বড় হওয়া। আলোর ঔজ্জ্বল্য , বাতাসের প্রবাহ, আকাশের অসীম অনন্ত, নদীর প্রবাহধারা, ঝর্নার পতন, সূর্যর তেজ, রাত্রির গহিনতা, অরণ্যের নিস্তব্দতা, ঝঞ্ঝার মত্ততা, পাহাড়ের দৃঢ়তা ইত্যাদি। প্রকৃতির থেকে বড় শিক্ষক আর দ্বিতীয়টি নেই, আর শিক্ষক যে অভিভাবক সেটা আগেই উল্লেখ করেছি। সুশীল সমাজের অভিভাবকত্বে আদর্শ মানব আর অপসমাজের অভিভাবকত্বে সমাজবিরোধীর জন্ম হয়।

দল তথা রাষ্ট্র
-----------
মানব জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সম্পুর্ন সামাজিক। কিন্তু এই সমাজ কোন একটিমাত্র দেহযষ্টি নয়, শত সহস্র আলাদা আলাদা অঙ্গসমাজের সমন্বয়ে গঠিত এই বৃহত্তর মানব সমাজ।  আর প্রতিটি সমাজের নির্দিষ্ট অভিভাবক রয়েছে। সেই অঙ্গ সমাজ গুলির নাম পাড়া- মহল্লা - রাজ্য- রাষ্ট্র- ধর্ম – রাজনৈতিক দল – পেশাদার পরিবার ইত্যাদি নানা নামের হতে পারে । প্রত্যেকের নিজস্ব অভিভাবক রয়েছে, যেগুলো আমাদের অধিকাংশ সংখ্যাগরিষ্ট মতাদর্শী বা শিক্ষায় শিক্ষিত সভ্যরা মিলে নির্বাচিত করেছি। পুরাকালে সামাজিক অভিভাবকত্বের বংশপরম্পরা চলত। যাদের মর্জিতে আমাদের তথা সেই এলাকার পশুপাখিদেরও নিয়তি নির্ধারিত হয়ে থাকে। গণতন্ত্রের অভিভাবক রাষ্ট্রনায়কদের পাশাপাশি, বিচারব্যাবস্থা ও গনমাধ্যমও রাষ্ট্রের অভিভাবক রূপে চিহ্নিত হয়। এই পরিসরে বিরোধীদেরও অভিভাবকত্ব করেন সেই পৃথক সমাজের ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী অভিভাবকগন। একজন সফল অভিভাবক তিনিই, যিনি বিরোধী বিশ্বাসকেও সযত্নে সংরক্ষণ করেন, তাকে প্রতিপালক করেন এবং প্রতিবাদ দেখানোর পরিসর প্রদান করেন। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরালে যোগ্যোতার নিরিখে পরিবর্তন হওয়াটাই দস্তুর। অনেক ক্ষেত্রেই জবরদস্তি অভিভাবকত্বের কর্তৃত্ব  দেখা যায়, ক্ষমতা আর সম্পত্তির অবৈধ লালসার এর মূল।

বিভিন্ন মনিষীদের জীবনীকে, সারাজীবনে কৃত কর্মকান্ডগুলির ভাল দিকগুলি ঠিকঠাক উপায়ে অনুধাবন করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারলে সেই মনিষীগনও জীবনে বড় অবিভাবকের ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীনতা নামক একটা বিশাল শব্দের জন্মই হয়েছে এই অভিভাবক শব্দটির কারনে। কারন অনৈতিক অভিভাবকত্ব না থাকলে স্বাধিনতার প্রশ্নই নেই। স্বেচ্ছাচার, লোভ, ঈর্ষা, ভোগ, লালসা, উন্নাসিকতা, প্রতিনিয়ত কারনে অকারণে দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার, আর প্রভুত্বের নেশার মত বিকৃত চরিত্রের লুম্পেন মানসিকতা পুষ্ট বৈশিষ্টগুলো যখন অভিভাবকত্বের সাথে মেশে তখন সেই অভিভাবকত্বকে পরাধীনতা বলা হয়। এই ধরনের অভিভাবকত্ব থেকে মুক্তি পেতেই বিপ্লবের জন্ম হয়।  

আমরা ভাবি, একটা সময়ের পর নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে উঠি আমরা। আসলেও কি সেটা ঘটে আমাদের জীবনে? তা হয়না মোটেই। আমাদের সামনে দুটো পৃথিবী পাশাপাশি থাকে। একটা বস্তুজগৎ অপরটি চেতনার জগত। একটা বিচার করি, সেই মুহুর্তে চোখে যা দেখছি তার পরিপ্রেক্ষিতে, অপরটি অবচেতন মনের ভাবনায়। বস্তুবাদের জগতে নিঃস্ব নিঃসঙ্গ হওয়া আক্ষরিক অর্থে সম্ভব হলেও ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে মানা মুশকিল। কারন জীবিত থাকলে প্রকৃতি সঙ্গ দেবেই, সেটা পক্ষে হোক বা বিপক্ষে। কিন্তু মানসজগতে ব্যাক্তি চুরান্ত একা, যদিনা তিনি কোন সৃজনশীল কর্মের সাথে নিজেকে অনুষঙ্গী করে রাখেন।

প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া মানেই পরিনতি বোধ এসেছে এমনটা ধরে নেওয়ার কারন থাকেনা, সেটা প্রাপ্তমনস্কতা ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াশীলতার চাতুর্যতার উপরে নির্ভর করে। প্রাপ্ত মনষ্ক হবার প্রাথমিক শর্তই হল সমাজশিক্ষায় পারদর্শীতার প্রকাশ, আর সেটার ব্যাবহারিক প্রয়োগের নিমিত্ত ভালো আর মন্দের পার্থক্য নিরুপন। ঠিক এই সময়ই চরিত্রে, স্বকিয়তা বোধ বা স্বাধীনচেতা মানসিকতা গুলি প্রকট হয়। উত্তারিধার সুত্রে কর্তৃত্বকারি অধিকাংশ অভিভাবক গন শারিরীক বা মানসিক কারনেই কর্তৃত্ব খুইয়ে ফেলেন, উলটে নিজেকেই তাদের অভিভাবক প্রতিভাত হতে হয়। আরভমাণ বিচারে ইহা একটি সঙ্কটের কাল নিঃসন্দেহে।

একজন শিশু, সে নিতান্তই দূর্বল শরীরের ও বোধহীন। একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকের প্রথম কাজই থাকে তার শৈশবকালকে অতিক্রম করিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য অভিভাবকদের সাথে পরিচিতি ঘটিয়ে দেওয়া। একজন ভাল কৃষক ভিন্ন ভিন্ন চাষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পরিচর্যা গ্রহন করেন উত্তম ফসলের জন্য। আলুর জন্য দাঁড়া কাটা জমি, পেঁয়াজের জন্য ফাঁপালো জমি। ধান গাছ যেমন আগে বড় হয়ে নেয় পরে ফুল ফল ধরে, ফল পাকার সাথে সাথেই জীবন প্রক্রিয়া শেষ হয়  তামনই লঙ্কা গাছের চারা শিশুকাল থেকেই ফুলে ফলে বড় হতে থাকে, কিন্তু ভালো ফসল পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। শুরুর দিকের লঙ্কা ছিড়লেই গোটা চাষ প্রক্রিয়াই ধাক্কা খায় ফলনে। মানব জীবন ফসলের মত এতো স্বল্প সময়ের নয়, তাই এক্ষেত্রে ভালো বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন দূরদৃষ্টিশালী অভিভাবকের প্রয়োজন, যিনি শিশুকে তার গুনের উপর, তার সহজাত চারিত্রিক প্রবৃত্তিগুলোকে অনুধাবন করে, সেই অনুযায়ী তার পরিচর্যা করবেন।

এই সব আবিধানিক আর প্রতিশব্দের বাইরেও একটা অভিভাকত্ব তৈরি হয়, যেটা ভরসা থেকে অভিভাবকত্বে পর্যবাসিত হয়। এটা কোন চিরাচরিত বিশ্বাস থেকে নয়, এটা আসে অন্তর থেকে। যখন দুটো মনের দেওয়া নেওয়া চলে। আমার সকলকিছুতে তোমার অধিকার, তুমি বিনে আমি কিচ্ছু নই- কথাটি বলার সাথে সাথেই নিজের স্বত্তাকে যখন সমর্পন করি, তার সাথে সাথে অভিভাবকত্বের অদৃশ্য লাগামটাও তুলে দিই। আমার আমিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রিয় মানুষটির ভাবনাই আমার ভাবনা হয়ে যায়।

অনেকেই তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর মধ্যে নিজের অভিভাবক খুঁজে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। এ আসলে এক মানসিক তৃপ্তি। যেমনটা ধার্মিক মানুষের দল ঈশ্বরের অভিভাবকত্বে সব ভালমন্দটা ছেরে দিয়ে খোশ মেজাজে জীবন উপভোগ করেন। এটা যতটা না পরাধীনতা তার থেকেও বেশি প্রেম, ভরসা, প্রত্যয় বা আস্থার আতুরাশ্রম।

কিছু মানুষ থাকেন, যারা অতি অল্পবয়সেই অভিভাবক হারিয়ে ফেলেন। নিজের জিম্মা নিজেকেই বইতে হয়, উপরন্তু পরিবার বা বৃহত্তর পরিবার তথা সমাজিক দায়ও ঘাড়ে এসে চেপে বসে। এই পরিস্থিতিগুলো অপরিণত ব্যাক্তিকে চকিতে অনেকটা বড় করে তোলে। পরে যখন সত্যিকারের সময় আসে অভিভাবকত্ব করার, শ্রান্ত মননে তখন সেই কর্মে আর আনন্দ বা শ্বাস নেওয়ার বাসনা অবশিষ্ট থাকেনা ব্যাক্তির কাছে। এমতাবস্থায় সামাজিক প্রথা মেনে বা না মেনে যদি তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী জুটে যায় তাকে আক্ষরিক অর্থে অভিভাবক মেনে নিলেও, নিজে কর্তৃত্ব করার মানসিকতা ছেরে বেড়িয়ে আসতে পারা যায়না।

এই পরিস্থিতিগুলো বড় ভয়াবহ সমাজের ক্ষেত্রে। এই ধরনের মানুষগুলো না পারেন অভিভাবক ছাড়া থাকতে, তারা ভাবেন কেন কেও আমায় শাষন করেনা, কেন আমায় কেও যেচে ভালমন্দের জ্ঞান দেয়না। পরক্ষনে একটা অন্য সমাজ থেকে আসা অপর ব্যাক্তি সেই অভাবকে প্রেম ভালবাসা মিশ্রিত অভিভাবকত্ব দিয়ে পূর্ন করার চেষ্টা করলে, স্বাধীনতায় অনৈতিক হস্তক্ষেপ বলে ধরে নেয়। এভাবেই তার পাশ থেকে প্রিয়জনেরা দূরে সরে যায়, এবং পুনরায় একা হয়ে যায় সেই অবচেতন মনের জগতে। শুরু হয় অবচেতন মনে দ্বন্দ। যেটা মুখে বলছি সেটার আর ব্যাবহারিক প্রয়োগ হয়ে ওঠেনা। যার জন্য অনেকসময়েই অধিক স্বাধীন ব্যাক্তিবর্গ অকৃতদার বা একাকি জীবন যাপন করেন। যেখানে তাকে সাথ দেওয়ার জন্য কেও অবশিষ্ট থাকেনা। অথচ চারিপাশে কত শত লোক প্রকৃতি সমাজ।

অভিভাবক কথাটি শুধুমাত্র পাচটি অক্ষরের মিলিত একটি শব্দরূপ নয়। অভিভাবক আসলে একটি সভ্যতা। যার পৃষ্ঠপোষকতাতে জীবন যৌবন, শিল্প সাহিত্য কৃষ্টি সংস্কৃতি, সম্পর্ক , বিপ্লব এবং ভবিষ্যৎ জড়িয়ে। অভিভাবকত্ব কে মর্যাদা দেওয়া উচিৎ সম্মানজনক পরিসর রেখে, যেখানে থামতে জানাটা জরুরী, আর ফিরত আসার পথটা অটুট থাকে। তার উপরেই নির্ভর করে সম্পর্কের অমরত্ব।

©উন্মাদ হার্মাদ

একটি সম্পূর্ন উন্মাদীয় ভাবনার ফসল
****************************************
(নিজ দায়িত্বে পাঠ করিয়া মর্ম্নদ্ধার করিবেন, কারন ইহার বানানবিধি উন্মাদীয়)
—————————————————————————————

।। চোখ ।।

এক
আজ দিনটা বেশ ভাল। মোটামুটি ফাঁকা বাস। জানালার ধারের সীট পেয়ে মন খুশি খুশি। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখদুটো বন্ধ হয়ে এসেছে। হঠাৎ করে চটকা ভেঙে যায় তার। ওড়নাটা ভাল করে জড়িয়ে নেয়।

দুই
দুপুর বেলা। বাস স্টপ থেকে বাড়ি বেশ খানিকটা। একটু তাড়াতাড়িই পা চালায় সে। কিছুটা আসার পর কেমন যেন শিরশির করে উঠে গা। ভীতু চোখে পেছনে ফিরে তাকায়। নাঃ, কেউ কোথাও নেই। ফাঁকা রাস্তা। ওড়নাটা টেনে নেয় বুক পর্যন্ত। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে। "হ্যালো, মা।"

তিন
রাস্তার ধুলো ধোঁয়ায় গোটা গা যেন কিচকিচ করছিল। এতক্ষণে শান্তি। শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে সাবানের ফেনার সোহাগে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে দিতে বেরিয়ে আসে, আহ্। তারপর একবার দেখে নেয় দরজার ছিটকিনি আর উপরের ঘুলঘুলিটার দিকে।

চার
বাড়ীতে কেউ নেই। একা একা বসেই কার্টুন দেখছে আর হেসে কুটোপাটি। টম আর জেরি। বেশ আরাম করেই বসেছে। সামনের টুলের ওপর পা দুটো মেলে দেওয়া। পাঁচতলা বাড়ির জানালা দিয়ে বিকেলের রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে পায়ের ওপর। জানালার দিকে চোখ যায়। গুটিয়ে যাওয়া নাইটিটা টেনে দেয় পা পর্যন্ত।

পাঁচ
বেশ গরম। শোবার ঘরের দরজা আটকে আলো নেভায়। গরম লাগছে। নাইটিটা খুলে ফেললে কেমন হয়, ভাবতে থাকে।
ভাবতেই থাকে...

__________
© শোভন বাগ

।। তুই ।।

আয় তোরে তুইলা বুকে মধ্যেখানে পুইষা রাখি
কলিজার কয়লা দিয়া বুকের পোড়া পাতিল মাজি,
আয় তোর বাঁকা টিপের কপাল ছুঁয়ে অংক শিখি
তোর গালে তিলের ফাঁশে অষ্ট প্রহর আটক থাকি

তুই আমার নকশিকাঁথা, আমিরে তোর সুঁই
সুঁইয়ের গুতা দিয়া আমায় মারিস না রে তুই।

আয় তোর হাতে কাঁচের ভাংগা চুড়ির গল্প শুনী
দুই চোঁখের কাজল দিয়া এক'শ রাতের স্বপ্ন লেখি
আয় তোর চোঁখের ঝিলে ডুব দিয়া আইজ আর না উঠি
বিনিময়ে বেহিসাবি আকাশ আমার উড়াইস ঘুরি।

তুই আমার নকশিকাঁথা, আমিরে তোর সুঁই
সুঁইয়ের গুতা দিয়া আমায় মারিস না রে তুই।

রেখে গেলি আদর বেলার হাতের ভাঙ্গা কাঁচের চুড়ি
সেই আগুনে একলা একা আমিরে আইজ একাই আমি পুড়ি
বুকে আজ দুই আকাশের একটায় খুব ভীষন ফাঁকি
হারালে স্বপ্ন পাখি আকাশ খুলে কারে ডাকি?

তুই যে আমার নকশিকাঁথা, আমিরে তোর সুঁই
সুঁইয়ের গুতা দিয়া আমায় মারিস না রে তুই।
_____________
© মোহাম্মাদ সামি

।। কোথাও ভালোবাসা নেই ।।

আকাশ আমাকে ভালোবাসা দেবে বলেছিল
সারাদিন আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকি
পাখিকেই শুধু সে ভালোবাসা দেয়;
ডানা নেই বলেই কি
আমি ভালোবাসা পাবো না।

সমুদ্র আমাকে ভালোবাসা দেবে বলেছিল
সারাদিন সমুদ্রের তীরে গিয়ে বসে থাকি
মৎস্যকেই শুধু সে ভালোবাসা দেয়;
জলের ভেতর ভেঁসে বেড়াতে পারি না
বলেই কি, আমি ভালোবাসা পাবো না।

নারী আমাকে ভালোবাসা দেবে বলেছিল
সারাদিন নারীর কাছে গিয়ে বসে থাকি
প্রাচুর্য্যকেই শুধু সে ভালোবাসা দেয়;
বিত্ত নেই বলেই কি
আমি ভালোবাসা পাবো না।
_____________
© জিসান জিবরান

।। রুম নম্বর 148 ।।

 গ্যাংটকে পা দিয়েই বুঝলাম এই পিক সিজিনে হোটেল বুক না করে এসে পড়াটা বোকামো হয়েছে। কিন্তু এসে যখন পড়েইছি উপায় একটা হবেই। আমি একা মানুষ।  মাথা গোঁজার জন্য চারটে দেয়াল আর একটা ছাদের অভাব হবে না।

যে উদ্যম নিয়ে হোটেল খোঁজা শুরু করেছিলাম তাতে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়লো যখন প্রায় বিকেল পর্যন্ত একটিও থাকার জায়গা পেলামনা।  আর বড়োজোর দু ঘন্টা আলো থাকবে। পাহাড়ে সন্ধ্যেটা ঝুপ করে নামে আর তারপরেই শুনসান হয়ে যায় রাস্তা ঘাট।  এ অভিজ্ঞতা আমার আছে।  তাই হোটেল বা নিদেন পক্ষ্যে একটা সরাইখানা পেলেও বর্তে যাই।

পিঠের রুকস্যাক  নামিয়ে কি করবো ভাবছি এমন সময় এক বেঁটে মতো লোক এসে বললো , " বাবু হোটেল লাগবে?" আমি যেন এই দেবদূতের অপেক্ষাতেই ছিলাম। তাও একটু রঙ দেখিয়ে বললাম , "ভাড়া কত ? কোন জায়গায় হোটেল?"

লোকটা যেন আমার কথা শুনতে পায়নি এমন ভান করে , আমার ব্যাগটা পিঠে নিয়ে আমায় বললো , "আসুন।" আমিও ওকে অনুসরণ করে চললাম মন্ত্র মুগ্ধের মতো।

পাহাড়ি চড়াইয়ে তিন চার বাঁক বেঁকে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম  ।  গেটের বাইরে একটা শত ছিন্ন শাল গায়ে জড়িয়ে বসে আছে একজন লোক।  বয়েস ভালোই হবে।  বহুদিনের না কাটা দাড়ি আর চুল একসাথে হাত মিলিয়ে জটার স্মৃষ্টি করেছে। তাকে পাশ কাটিয়ে আমায় নিয়ে হোটেল-এ ঢুকলো সেই আগন্তুকটি। হোটেলের মালিক সম্বোধন করে বললেন , " এসো নিখিলেশ " | যাক লোকটার নাম জানা গেলো।

বুঝলাম ইনি একজন দালাল। হোটেলের থেকে কমিশন খান। যাগ্গে  ওদের ব্যাপার ওরা বুঝবে। আমার থাকার জায়গা পেলেই হলো |

ভাগ্য দেবী  বোধহয়  আমার সাথে একটু পরিহাসের খেলায় মেতে ছিলেন।  হোটেল মালিক মুরারি বাবু আক্ষেপের সাথে জানালেন  যে ঘর ছিল কিন্তু আধ ঘন্টা আগে  এক দম্পতিকে  দিয়ে দিয়েছেন।

বাইরে তখন পাহাড়ের আড়ালে সূর্যদেব অদৃশ্য হয়েছেন।  জমাট অন্ধকার যেন গ্রাস করেছে এই বিশাল হিমালয়কে।

আমি বললাম , " খুব বিপদে পড়েছি। যদি আজ রাতটা এই রিসেপশনেই কাটাতে দেন তো বড়ো উপকার হয়।  ভাড়াও নয় দিয়ে দেবো।

মুরারি বাবু হেসে বললেন , "না দাদা। সেটা ঠিক হবেনা।  "

আমি কাতর  ভাবে বললাম , " যেকোনো  ঘর দিন।  আমি মানিয়ে নেবো।"

একটু চুপ করে মুরারি বাবু বললেন , " একটা ঘর অবশ্যি আছে | কিন্তু সেখানে থাকতে পারবেন কি ?"

আমি স্বস্তির হাসি হেসে বললাম, "পারবোনা মানে ? নিশ্চই পারবো ! যত খারাপ ঘর-ই হোক না কেন, রাস্তায় থাকার চেয়ে তো ভালো। "

মুরারি বাবু ভ্রুকুটি করে বললেন ,"ঘর খারাপ নয়।  সত্যি বলতে কি এই সান রাইজ হোটেলের সবচেয়ে ভালো ঘর "

আমি অবাক হয়ে বললাম, "তাহলে. ......"

আমার কথা মাঝখানে কেটে মুরারি বাবু বললেন , " ওই ঘরে বছর পাঁচেক আগে এক ইংরেজ সাহেব গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে ওই ঘরে কেউ থাকেনা। প্রচলিত ধারনা আছে , এখনো রাতে সাহেব ওই ঘরে শুতে আসেন আর অন্য কেউ থাকাটা উনি পছন্দ করেননা। "

আমি একটা বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম , " আপনি চিন্তা করবেনা। সাহেব ভূত এলে সারা রাত পোকার খেলে কাটিয়ে দেব। আপনি ঘরটা আমায় দিয়ে দিন। "

ভদ্রলোক বেশি কথা না বাড়িয়ে , রেজিস্টারে নাম ধাম লিখিয়ে 148 নম্বর ঘরের চাবি দিয়ে দিলেন।

পিরামিড ধাঁচের হোটেল। যত ফ্লোর বাড়ছে তত ঘরের সংখ্যা কম আর চার তলায় ওই একটাই ঘর। চাবি ঘোরাতেই দরজা খুলে গেলো। রোজ সকালে পরিষ্কার করা হয়। তাই এতো বছর কেউ না থাকলেও ধুলো জমেনি। আলো জ্বালাই ছিলো। খাটের ওপরে সিলিং থেকে ঝোলানো একবাতির ঝাড়।

ঘরের মাঝখানে খাট আর তার পাশে একটা টেবিল। তাতে একটা গ্লাস রাখা। সাথে জল ছিল। গ্লাসটা ধুয়ে তাতে জল ভরে রেখে দিলাম। এখন রাত আটটা। ডিনার সেরে একটু বাইরে পায়চারি করলাম। ঘরে যখন ঢুকলাম তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে নটা।

লেপটা গায়ে টেনে শুয়ে পড়লাম। অস্বীকার করবোনা , যে অসীম সাহস ঘর নেবার সময় দেখিয়ে ছিলাম তাতে যেন একটু ফাটল ধরেছে। একজন অচেনা কারো উপস্থিতির অনুভূতি বার বার আমায় ঘিরে ধরছে।

দুর্বল মনকে বশে আনতে একটা ঘুমের বড়ি খেয়ে নিলাম  আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাত কটা হবে জানিনা , একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেলো। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন বলে দিলো কিছু একটা গোলমাল আসন্ন। আর তার পূর্বাভাস যেন ঘরের আবহাওয়ার মধ্যেই আছে।
যে আলোটা সিধে ওপর থেকে খাটের ওপর ঝুলছিলো আর যেটা আমি ইচ্ছে করেই নেভাইনি, তার মধ্যে এক অপার্থিব অস্থিরতা লক্ষ্য করলাম। সেই আলো এখন আর স্থির নেই। কেউ তাকে দোলাচ্ছে আর সারা ঘরময় আলোর খেলা চলছে।  জানলা বন্ধ , হাওয়া নেই। তবে কি করে দুলছে ওই আলো? তার গতি বাড়ছে। পাগলা হাতির মাথার মতো এদিক ওদিক হতে শুরু হয়েছে।

আমি ভয়ে হাত বাড়ালাম টেবিলে রাখা জলের গ্লাসের দিকে। কিন্তু একি ? কোনো এক অদ্ভুত জাদুবলে সেই গ্লাস কাঁপা কাঁপা পায়ে যেন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার সেই অসংলগ্ন চলার ভঙ্গির জন্য জল ছলকে বাইরে পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটলো। আমার পায়ে মৃদু টান অনুভব করলাম।  খাটের মধ্যে কেউ যেন প্রাণ সঞ্চার করে দিয়েছে আর সে চাইছে আমায় ফেলে দিতে। আর তাই সে যেন নিজেকে ঝাঁকিয়ে আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমি অন্য কারো জায়গা দখল করেছি ; যেটা সে ঘরের আলো , গেলাস বা খাট  কেউই মেনে নিতে পারছেনা আর এই পুরো ঘটনার পেছনে আছে অদৃশ্য এক শক্তি, যে এই ঘরেই উপস্থিত। সে আমার উপস্থিতি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছেনা আর তাই এই তান্ডব তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ।

এক লাফে নেমে পড়লাম খাট থেকে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এসেছে।  এই ঠান্ডায়-ও সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নির্বোধের মতো চিৎকার করে উঠলাম , "কে ? কে ওখানে ?" উত্তরে যেটা পেলাম সেটা আমার হৃদ্স্পন্দনকে দ্বিগুন করে দিলো। আমি স্পষ্ট শুনলাম একটা কান ফাটা অট্টহাসি যেটা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।  আমি জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান যখন ফিরলো তখন সকাল হয়ে গেছে।  ঘরে সূর্যের আলো ঝলমল করছে। উঠে বসলাম। সমস্ত ঘর লন্ড ভন্ড। যেন কাল রাতে কেউ প্রলয় নৃত্য করেছে।  আর না। মনে মনে স্থির করলাম ঘরটা ছাড়বো। এর  চেয়ে রাস্তাও বেটার।

ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নেমে দেখি ম্যানেজার চা খাচ্ছে।  আমায় দেখে একটা হালকা হাসি হেসে বললেন , "ধন্যি আপনার ঘুম মশাই! কাল রাতে পুরো গ্যাংটক শহর জেগে গেলো কিন্তু আপনার টুঁ শব্দটি নেই ?

আমি একটু অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বললাম , "কি হয়েছিল কাল রাতে? "

ম্যানেজার চোখ কপালে তুলে বললেন , " সেকি মশাই ! অমন ভূমিকম্প হলো টের পেলেন না ? একবার নয়।  পর পর তিনবার ! শেষেরটা ছিলো সব চেয়ে জোরে।  রিখটার স্কেলে রিডিং ছিল সিক্স পয়েন্ট টু। "

আমি একটা বোদ্ধা ভাব এনে বললাম , "জানিতো।  ওই সব সময় না বেরোনোই ভালো।
আচ্ছা ওভাবে হাসছিলো কে কাল রাতে ?"

এর উত্তরো দিলেন ম্যানেজার মুরারি বাবু। একটা আড়মোড়া কেটে বললেন, "ওটা জগাই।  ওই জটাধরি পাগলটা।  গেটের সামনেই থাকে। সবাই ভয়ে দৌড়োচ্ছিলো দেখে ওর নাকি হাসি পেয়েছিলো "

আমি আর কথা এগোলাম না।  চাবিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম , "একটু ঘুরে আসি "

ম্যানেজার বললেন , " তাড়াতাড়ি আসুন। একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো আর তারপর আপনাকে একটা কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ রুম দিয়ে দেব দোতলায়। আজি খালি হল ।
   ________
© সৌরভ দত্ত

।। মিলনের উষ্ণতা ।।

পিতলের বাটিটা বেশ জোরেই লাগলো নাটুর মাথায় ৷ সঙ্গে সঙ্গে মাগো বলে মাথার পিছনে হাত দিয়ে বারান্দায় বসে পড়লো নাটু I হাতটা মুখের সামনে এনে একবার দেখলো, রক্ত বেরোচ্ছে নাকি ! হাত রক্তশূণ্য দেখে যেন একটু স্বস্তি পেল সে ৷ কিন্তু যন্ত্রণা কমে নি একেবারেই ৷ মাথার পিছনটা ফুলে আলু হয়ে গেছে ৷ বিড়বিড় করে গাল পাড়লো সে- " শালী... হারামজাদী ! দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে..." ৷ কিন্তু রান্না ঘরে গিয়ে মিঠুর জ্বলন্ত চোখ আর হাতে আঁশ বটিটা দেখে আবার বারান্দায় এসে বসে পড়লো সে | বেশি চিল্লামেল্লি করে লাভ নেই | আশেপাশের লোক জানতে পারলে তার ইজ্জত ধুলোয় মিশে যাবে ৷ বউয়ের হাতে মার খেয়েছে শুনলে লোকে যত না হাসবে তার থেকে তার গায়ে থুথু দেবে বেশি ! তার থেকে চেপে যাওয়াই ভালো ! পরে মাগীকে দেখে নেবে ৷ একদলা থুথু ফেললো সে |

ঘটনার সূত্রপাত অাজ বিকেল চারটেয় ৷ ভ্যান রিকসা চালিয়ে ঐ সময়েই ফেরে নাটু | সঙ্গে থাকে আগুনের মতো খিদে | তখন মনে হয় পারলে পুরো পৃথিবীটাই পেটে পুরে সে... | মিঠু বাবুদের বাড়ি থেকে কাজ সেরে ফেরে ঐ সময় | ওকে কতবার বলেছে একটু আগে ফিরে রান্না চাপাতে I কিন্ত কে শোনে কার কথা? আজ বাড়ি ফিরে যখন নাটু দেখলো মিঠু সবে ভাত চড়িয়েছে রক্ত চড়ে গেলো মাথায় ৷
_"কিরে , তোর বাবুর বাড়ি কোন আদিখ্যেতা করছিলি শুনি? "
-"পিরিত করছিলাম গো... পিরিত" |
আর স্থির থাকতে পারলো না নাটু I চুলের মুঠি ধরে পিঠে বসিয়ে দিলো এক রামকিল... !
-" দাঁড়া, তোর পিরিত করা বার কচ্ছি..." ৷ হাতের কাছে যে কটা হাঁড়ি বাসন ছিল তুলে নিলো সে লহমায় ৷
মিঠু জানতো এরপর কি হবে... থালাবাসনগুলো নাটু গিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে পাশের এঁদো পুকুরে ৷ তারপর মিঠুকে গিয়ে তুলে আনতে হবে সেগুলো ৷ তাই আজ আর সে দেরি করলো না | বারান্দা থেকে নামার আগেই নিখুঁত টিপে ছুঁড়ে মারলো বাটিটা | আগে কতবার সে একটিপে আম পেড়েছে... | টিপ-টা তার আগের মতোই আছে দেখে মনে একটু খুশী জাগলো |

থালা বাসনগুলি বারান্দা থেকে তুলে নিয়ে এসে এবার রান্না বসিয়ে দিলো | বিশেষ কিছু না... পুঁই ডাঁটা দিয়ে  মাছের মাথা আর বেগুন আলুর তরকারি | আড় চোখে একবার দেখে নিলো নাটুকে | এখনো একই জায়গায় বসে আছে আর বিড় বিড় করে গাল পাড়ছে | নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠলো মিঠুর | এক বছর আগে বিয়ে হয়েছে ওদের I প্রেম করে বিয়ে | লোকটার একটা ভালো গুণ হলো মদ ছোঁয়না একেবারে | তবে রেগে গেলে মার দেয় খুব | আবার রাতে বিছানাতে মিঠুর সব ক্ষত সারিয়ে দেয় একেবারে | ভালবাসতেও পারে লোকটা !
একবাটি মুড়ি আর  দুটো কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ নাটুর পাশে ঠকাস করে রেখে দিয়ে আসলো মিঠু | আজ পাল্টা মার খেয়ে মুখ একেবারে আমসি হয়ে গেছে ! ফিক করে হেসে ফেললো মিঠু |

বউয়ের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে কি করে এর শোধ নেওয়া যায় তাই ভাবতে লাগলো মুড়ি চিবাতে চিবাতে ...।

রাত দশটা ৷ খেয়েদেয়ে উঠলো দুজনে | এর মধ্যে মাথার ফোলাটা কমেছে নাটুর | ব্যাথাটাও | মিঠু এসে বরফ লাগিয়ে দিয়েছে একটু আগে ৷ একটা চুমুও দিয়েছে | তাই নাটুর মনটা একেবারে হাল্কা হয়ে এসেছে | মিঠু এখন বাসনগুলো মাজছে ৷ চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে দু টো মিঠা পান কিনে আনলো নাটু I

আলোটা কিছুক্ষণ হলো নিভিয়ে দিয়েছে মিঠু | ঘরে এখন শুধু দুটি শরীরের মিলনের উষ্ণতা | সঙ্গে মিঠা পানের আসমানী সুবাস...
______________
© ফিরোজ আখতার

।। প্রিয় নারীর সাথে দু চার কথা ।।

জেগে আছ?
নিভছে সব বাড়ির আলো একে একে -
শামুকের মত উঁকি মেরে গুটিয়ে গেছে কিছু
অন্ধকার ছুঁয়ে ফেলা ল্যাম্পপোষ্টের নীচে।
নীল জোনাকি জ্বলছে কিছু এদিক ওদিক
সরে যাওয়া পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে
চাঁদ দেখছে নগ্ন শরীর -
একপাশে খুলে নেওয়া রাত পোশাক
অন্যপাশে রমনক্লান্ত তুমি -
কুঁচকানো চাদরে লেখা হল যে রাতকথা,
সে কি ছিল কবিতা নাকি শুধুই নিয়মমাফিক?
তুমি কি এখনো জেগে আছ প্রিয় নারী আমার
তুমি কি রয়েছ জেগে?

শুনতে পাচ্ছ?
তোমার ঘড়িতে সকাল হল,
বেশ জানি, টানটান করে নিচ্ছ রাতের চাদর -
ক্রমশ সরব হচ্ছে সংসার, কলঘরে এসেছে জল।
শুনছ, কোথায় আমার টাকার ব্যাগ?
মা, আমার টিফিন হল?
বৌদি কী কী কাচব বল -
তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর অফিস স্কুলের সময় হল।
আরো কতশত শব্দ পেরিয়ে আসবে তোমার ঘুম-দুপুর
আরো কত শব্দ দাঁড়িয়ে থাকবে বিকেল হবার প্রতীক্ষায় -
এতকিছুর মাঝে তুমি কি শুনতে পাও আর
শুনতে কি পাও তুমি?
কতবার বলেছি ভালবাসি তোমায়
শুনতে পাচ্ছ, প্রিয় নারী?

বাড়ি আছ?
শুনছ, বাড়ি আছ?
শুনছেন, কেউ কি বাড়িতে নেই? জানেন কিছু?
কেমন যেন কুয়াশা কুয়াশা হয়ে আসে স্মৃতি
আচ্ছা, এটাই কি সেই বাড়ি?
ওটাই কি সেই বারান্দা, যেখানে কাটত তোমার আমার মগ্ন দুপুর?
ওই চানঘরেই কি আমায় ভেবে তুমি???
তোমার জন্যে এনেছি প্রিয় ফুল, আমার একান্ত  উঠোন থেকে
এনেছি আমার লেখার খাতা, ওর সব শব্দেরা তোমায় ভেবে
সঙ্গী কলসে অমৃত নেই, নাভিকুন্ড আছে রাখা -
বাড়ি আছ প্রিয় নারী আমার, তুমি কি বাড়ি আছ?
___________
© শোভন বাগ

Saturday, 14 January 2017

।। বই কেনা ।।

বুক ফেয়ারের প্রাঙ্গনে ঢুকেই নীলু জিজ্ঞেস করে , ' বই কিনতে গেলে কি মুখ গম্ভীর করে চলতে হয় ? ' আমি বলি , ' কেন কি হয়েছে ?' নীলু বলে , ' মেলা সে বইর  হোক বা গাই বাছুরের হোক , তার প্রথম শর্ত স্ফূর্তি করা।  মুখ গম্ভীর করে থাকলে কি  আর মনে স্ফূর্তি আসে। ' বুঝতে পারলাম নীলু কথাগুলি আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে।  আসলে মেলায় ঢুকেই আমার ক্ষিধে পেয়েছে।  অফিস থেকে সোজা এসেছি মেলা প্রাঙ্গনে।  এই সন্ধ্যার মুখে ক্ষিদে পাওয়াটা স্বাভাবিক।  আমি এদিক ওদিক দেখছিলাম খাওয়ার স্টলগুলি কোনদিকে।  তাই হয়তো ক্ষিদের চোটে মুখের জিওগ্রাফি পাল্টে গিয়ে থাকবে।  তাই আমি হেসে জবাব দি , ' পেটে  ক্ষিদে নিয়ে চললে , মনে স্ফূর্তি আসবে কথা থেকে। ' আমার কথা শুনেই নীলু হন হন করে চললো ফুড স্টলের দিকে।  দুদিন আগে ও ওর বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলো , তাই ঠিক জানে কোনদিকে খাবারের স্টল।

একটা দোকানে পাতা বেঞ্চিতে বসে সবে চিকেন রোল শেষ করেছি , দেখি নীলুর কলেজ ফ্রেন্ড অসীমা এসে হাজির।  নীলুকে দেখে অসীমার প্রথম প্রশ্ন , ' দেখি তুই কি বই কিনলি ?' নীলু বলে , ' আমি তো বই কিনতে আসিনি। ' অসীমা অবাক হয়ে বলে , ' তবে কি খালি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে সময় কাটানোর জন্য এসেছিস ?' নীলু বলে , ' অরে বাবা , মেলায় কেউ যায় পাঁপড় ভাজা খেতে , আবার কেউ যায় রুটি সেঁকার জালি কিনতে। কাজেই তুই যা ভাবছিস খুব বেশি ভুল নাও হতে পারে। ' এতক্ষন পরে অসীমার   চোখ পড়লো আমার দিকে।  নীলুর কথায় বুঝি ও আস্বস্ত হয়েছিল যে নীলু অবশেষে নিজের বয়ফ্রেন্ড খুঁজে পেয়েছে। আমার দিকে হ্যান্ড শেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলে ,' আমার বন্ধুর সঙ্গে ঘোরাঘুরি কবে শেষ হচ্ছে ?' অসীমা অবশ্য আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই এগিয়ে যায়।  আমি ওকে যেতে দেখে হেসে ফেলি।  নীলু বলে , ' যাক পেটে কিছু পড়ার পর গোমড়া মুখে কিছু হাসি দেখা দিলো।  চলো এবার দেখে আসি আর কত গোমড়া মুখ মেলায় ঘোরাঘুরি করছে। '

একটু যেতেই সামনে দেখি একটা ছোট স্টল।  স্টলে  ঢুকে দেখি কেবল বিভিন্ন পূরাণের বইতে দোকানটা ঠাসা।  সব ভগবানের নামে  একটা করে পুরাণ ।  প্রতিটা পূরাণের আবার পূর্ণাঙ্গ এডিসন থেকে নিয়ে পকেট এডিসন পর্যন্ত বিভিন্ন সাইজের বই।  দেখি একটা সুন্দর মেয়ে , নীলুর বয়সী হবে , পরনে সুন্দর সালোয়ার কামিজ , এক মনে খুব সিরিয়াস ভাবে  একটা বিষ্ণু পুরান খুলে দেখে যাচ্ছে। বইটার পাতা উল্টাচ্ছে আর নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে চলেছে। বোঝা যাচ্ছে কোনো কারণে বইটা দেখে বেশি খুশি হয়নি।  নীলু চট  করে নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট ডাইরি আর পেন নিয়ে হাজির মেয়েটার সামনে।  গিয়ে বলে , ' আমি ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার।  মেলা নিয়ে একটা আর্টিকল লিখছি। ' মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে ,' বলুন , কি জানতে চান। ' নীলু বেশ খোলাখুলি জিজ্ঞেস করে , ' আপনি কি পুরাণ  তত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন ?' এবার দেখি মেয়েটি ,হেসে ফেললো।  হাসতে হাসতে বলে ,' আমার হবু শাশুড়ির মন জেতার চেষ্টায় আমার অবস্থা  আমসত্ব হয়ে গেছে। ' জানা গেলো মেয়েটির হবু শাশুড়ি বিধবা মানুষ।  দুবেলা পুরাণ পাঠ  করেন। তাঁর খুব ইচ্ছে যে বিয়ের পর ছেলের বৌকে রোজ পুরাণ পাঠ শোনাবেন।  তাই মেয়েটা এসেছে কটা পূরণের বই কিনতে যাতে বুঝে উঠতে পারে পুরাণ  কি জিনিষ।  নীলু মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে যে বইগুলো কিনে বাড়িতে নিয়ে পড়ার সময় পাবে কি।  এবার দেখি মেয়েটা বেশ জোরে জোরে হেসে উঠে বলে , ' সময়ের অভাব নেই , অভাব খালি ধৈর্য্যের।  তবে মাথার কাছে রেখে ঘুমোলে  , যদি কিছুটা রেডিয়েশনে ঢোকে। ' দোকান থেকে বেরিয়ে নীলু মন্তব্য করে , ' মেয়েটা বেজায় রসিক বটে। '

এরপরে আমরা গেলাম আনন্দ পাবলিশার্সের দোকানে।  দোকান বেশ গমগম করছে।  অধিকাংশ লোকেই নিজেদের পছন্দের বইর  লিস্ট নিয়ে এসেছে।  সেই লিস্ট দেখে অর্ডার দিয়ে বই কিনে নিচ্ছে।  বই ঘেঁটে দেখে বাছাই করার লোক অনেক কম।  দেখি এক কোনায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা , বয়স ষাট , পঁয়ষট্টি হবে  সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল নিয়ে খুব গম্ভীর ভাবে পড়ে  যাচ্ছেন।  নীলু গিয়ে আবার ফ্রিলান্স রিপোর্টারের পরিচয় দিয়ে , ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করে , ' এতো গম্ভীর ভাবে কি পড়ছেন ?' মহিলা বই থেকে চোখ না তুলে বলেন - আবোল তাবোল। '  নীলু এবার জিজ্ঞেস করে ,' বইটা কি খুব সিরিয়াস বই ? ' এবার ভদ্রমহিলা বই থেকে মুখ তুলে , চশমাটাকে একটু নাকের উপর ঠেলে বললেন , ' আপনি কি সেই "বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই" ?  নীলু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় ,' আমি "বিদ্‌ঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভূত" . মহিলা এক লহমায় সূচিপত্র দেখে , একগাল   খুশির হাসি মিশিয়ে আবোল তাবোলের "কিম্ভুত " ছড়া পড়তে শুরু করেদিলেন

"বিদ্‌ঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভূত,
সারাদিন ধ'রে তার শুনি শুধু খুঁতখুঁত ৷
মাঠপারে ঘাটপারে কেঁদে মরে খালি সে,
ঘ্যান্‌ ঘ্যান্ আব্‌দারে ঘন ঘন নালিশে ৷"

তারপরে জানলাম মহিলা দুপুর বেলা নিজের তিন বছরের নাতনিকে সামলান। ছেলে আর ছেলের বৌ দুজনেই চাকরি করেন।  নাতনিকে ব্যস্ত রাখার জন্য আবোল তাবোল কিনতে এসেছেন। ছেলে , ছেলের বৌ আর নাতনি গেছে চা খেতে।  সেই ফাঁকে ওঁর এই বই দেখা। স্টল থেকে বেরিয়ে নীলু মন্তব্য করে ,' ভদ্রমহিলা রসে  পুরো টইটম্বুর। ‘

এরপরে আমরা গেলাম অক্সফোর্ডের দোকানে।  সার সার ইংরেজির বই।  লোকজন অনেকেই বই ঘেঁটে পছন্দ করছে।  বেশির ভাগ কোনো লিস্ট নিয়ে আসেনি। দেখি এক সাহেব মার্কা  লোক , মুখে ফ্রেঞ্চ কাট , পরনে গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট , একমনে ফ্রেডরিক ফোরসিথের "ওডেসা ফাইল" পড়ে  যাচ্ছেন। ' নীলু আবার আগের মতন নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করে ইংরেজিতে , ' আপনি কি থ্রিলার পড়তে ভালোবাসেন। ' দেখি সেই সাহেব মার্কা লোক হাসতে হাসতে দিব্যি বাংলায় বলেন , ' ধুর আমি কোনোদিন সাহেবের গু মাড়াইনা।  আমার দৌড় সবে নীললোহিত আর কালকূট পেরিয়ে শীর্ষেন্দুতে আটকে পড়েছে।  তারপর আর এগোতে চাইনা। ' নীলু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে , ' তবে আপনি এতো মন দিয়ে ওডেসা ফাইলের মতন থ্রিলার পড়ছেন কেন ? ' তখন জানা গেলো ভদ্রলোকের বৌ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে  আছেন।  সারা দিনরাত নার্সের সেবাতেই সময় কাটে।  তিনি আবার ইংরেজি থ্রিলার পড়তে পাগল।  তাঁর জন্য এই ভদ্রলোককে বই কিনে আনতে হয়।  সেই বই বাছাইর জন্য যতটুকু পড়া দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

 স্টল থেকে বেরিয়ে নীলু বলে , ' চলো এবার বাড়ি ফিরে  যাই। ' আমি বলি , ' তুই যে একটা বইর লিস্ট নিয়ে এসেছিলি কেনার জন্য সেটার কি হবে। ' নীলু আকাশপানে চেয়ে বলে , 'তিনটে দোকানে তিনটে মানুষ দেখে যে সুখ পেলাম তা কি আর বই পড়ে পাওয়া যায়। ' কেন কি জানি নীলুর কথা শুনে আমার মুখ থেকে ফোঁস করে বেরিয়ে এলো কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার অংশ

"ব্যাপার কী, আর গল্প কি নেই?
রাস্তাটা যে অনেক বাকি।
চোখ তুলে কালপুরুষ দেখেই
ফুরিয়ে গেল সব কথা কি?"
_________
© সনৎ মিশ্র

।। কল্পিত ।।

এমন একটা দুপুর পেলে কেমন হয়...
যখন একপাল্লা জানলায়,প্রেমটা জমে বৃষ্টির সাথে,
যখন একপাতা কবিতায়,চানাচুর ভাজা মিশে যায়..
যখন ঝড়ো হাওয়ায়,কেঁপে ওঠে শিহরিত মন,
আর দোতালার ঘরটায়,অভিমান আঁকড়ে রাখত আমায়।
খিচুড়ি মাখা দুপুরটা এক পশলায় ভিজতো অবিরাম,
দূরের ভেজা শালিকেরা আশ্রয় নিতো,বটগাছটায়...
আমি একা জানলায়,বসে থাকতাম প্রহরের পর প্রহর।

এমন একটা রাত্রি পেলে কেমন হয়...
যখন বালুকায় জোছনারা লুটোপুটি খেত..
যখন লাইটহাউসের পেছনে,জমাট বাঁধতো অন্ধকার,,,
যখন জলের তালে তালে,শামুকেরা আল্পনা দিত..
আর জুতো-মোজা হাতে,উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতাম।
কয়েকটা পোড়াকাঠে আবার বারুদ জ্বলে উঠতো...
বালির কনাগুলো লেগেথাকতো পায়ের তলায়,
বেডরুমেও  বয়ে আনতো টাটকা বালুকা-স্মৃতি।

এমন একটা সকাল পেলে কেমন হয়....
যখন পুরু কুয়াশায় সবুজেরা ঢাকা থাকতো..
যখন খেজুরের শরীর থেকে কলসিবন্দী হত মিষ্টতা...
যখন সোয়েটার টেনে উষ্ণতা খুঁজতো শরীরেরা,
আমি লেপের তলায় স্বপ্ন সাজাতাম,তোকে নিয়ে...।
এক কাপ চা আর টপ বিস্কিটের কম্বোটা আবার জমতো,,
এমনি করেই ফাঁকি দিত,হাজারো শীত-গ্রীষ্ম..
আমি একা সাত রং-এ কল্পনা আঁকতাম,
আর এঁকেই যেতাম..........
______
© পবিত্র

।। অগ্নিপরীক্ষা ।।

এই তো কদিন আগে
গোধুলি লগন রক্তিম ছিলো ফাগে
অপরূপা, রূপে তাকেও করেছে ম্লান
বাতাসে শুধুই টাটকা ফুলের ঘ্রান
তনু মন সবি সোঁপেছিল অচেনাকে
অগ্নি সাক্ষি রেখে
ভালোবাসা করে শরীরেতে কষাঘাত
ক্লান্ত সানাই কেঁদে চলে সারারাত
এইতো কদিন আগে
গোধুলি লগন রক্তিম ছিলো ফাগে
ভীরু মন নিয়ে এগিয়েছি পায়ে পায়ে
শুনেছি, নাকি আগুন দিয়েছে গায়ে
কে যেন বললো, যান না, কিসের ভয়
সীতার অগ্নিপরীক্ষা তো আজও হয়।
_____________
© কুণাল ভট্টাচার্য্য

।। কথোপকথন ও কুয়াশা ।।

- ও , তুমি ছাদে?
- হ্যাঁ, কিছু বলছো?
- বলছিলাম, খাবে না? বাবার খাওয়া হয়ে গেলো। তোমাকে খুঁজছিল?
- এত তাড়াতাড়ি? সবে তো নটা
- ভুলে গেছ নাকি গ্রামের বাড়িতে আছো। এখানে সাড়ে আটটায় খেয়ে শুয়ে পড়ে সবাই।
- না মনে আছে। কালীপূজোর ব্যাস্ততায় রোজ দেরি করে হচ্ছিল বলে খেয়াল ছিল না।
- খেয়াল তো খেয়ায় ভেসে অবন্তিকার কাছে।
- অফ।ঘুরিয়ে কথা বলা কি রিসেন্টলি শিখেছ ?
- না বছর ২ হল।
- সৌম্যের কাছে?
- তোমার কাছে।
- সৌম্যের ফোন আসেনি কয়েক দিন?
- তুমি কিকরে জানলে আসেনি?
- না। আড়ালে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে শুনিনি
- আমি তোমার সামনেই কথা বলি। তোমার মতো আমাকে ব্যলকনিতে যেতে হয় না।
- হ্যাঁ। একই অফিসের লোক। অফিস আওয়ারটা যথেষ্ট তোমার কাছে।
- রাত দেড়টার সময় অফিস পার্টি থেকে ফিরি না আমি আর কাউকে বাড়ি পৌছাতেও যাই না।
- আমিও কাউকে রান্নার রেসিপি ফোনে বলি না। কারুর জন্যে টিফিন বক্সে করে পটলের দোলমা নিয়ে যাই না।
- বানাতে জানবে তবে তো নিয়ে যাবে। চায়ে ক চামচ চিনি দেয় সেটা এখনো বলে দিতে হয়।
- ও হ্যাঁ, ভালো মনে করিয়েছো। বাড়ির যা যা জিনিস লাগত মাসে ওটার একটা লিস্ট করে দিয়েছো তো?
- হ্যাঁ। তোমার ড্রয়ারে রাখা আছে।এতক্ষণ হয়ে গেল অবন্তিকা একবার খোঁজ নিল না যে?
- ফোনটা অফ করা আছে।
- কেন? রাতে তো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বা ফ্রয়েডের থিওরি আলোচনা করতে হবে না?
- রেসিপির খোঁজ নাও গিয়ে। নাহলে আবার ডিমের ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়লে তুমি তো খাবে না।
- শেষ বারের মতো এই বাড়িতে। ঝগড়াটা না করলেই নয়?
- আচ্ছা ।
- বাড়িতে বলেছো?
- না। তুমি?
- না।
- কবে বলবে?
- তোমার আগে বলার কথা ছিল।
- মোটেও এরম কথা ছিল না। কথা ছিল তুমি আমার বাড়িতে বলবে আমি তোমার বাড়ি তে
- তো তুমি বাবাকে বললে? সারাদিন ত দেখছি বাবা বউমা বউমা করেই যাচ্ছে। বলে দাও সময় বুঝে
- পারছি না।
- কেন? আমাকে তো হঠাৎই জানালে। বাবাকেও নিশ্চয় পারবে।
- জানি না।
- হুম ।
- মনে আছে ছয় বছর আগে যখন তুমি আমাকে প্রথম দেখাতে আনো, এই কালীপূজোর সময়ই
- হ্যাঁ, বাজি ধরাতে গয়ে ওড়নায় আগুন লেগে গ্যেছিল।
- তোমার বাবা এক ধমকানি দিয়েছিল। রাতে খেতে বসার সময় আমার পাশেএসে বসেছিল। শুধু একটা কথা বলেছিলও। মা লেগেছে নাকি? সেই মুহূর্তে কিভাবে জানি না এই বাড়ির সব চেয়ে আপন জন হয়ে গ্যেছিল।
- হঠাৎ?
- না , আমি আজ বলতে গিয়েছিলাম, আমাকে জিজ্ঞ্যসা করলেন, তর চোখ গুলো শুকনো লাগছে কেন? থেকে যা কয়েক দিন। আমি পারলাম না বলতে।
- দিয়ে ছাদে এসে কাঁদতে শুরু করলে?
- তুমি...তুমি কি করে জানলে?
- আমি আজ বিকেল থেকেই আছি। তুমি খেয়াল কর নি।
- বলতে ত হয়?
- কেন? লজ্জা লাগে নাকি আমার সামনে কাঁদতে?
- হুম
- এক সময় তো একটু জোরে হাওয়া দিলেই কেঁদে দিতে।
- সে সময় তো একজন হাওয়াটা বন্ধ করার জন্যে একজন উঠে পড়ে লেগে যেত।
- সৌম্য লেগে পড়ে না বুঝি?
- চুপ কর
- কিন্তু , দেখ বলতে তো হবেই। ডিভোর্সের কাগজ গুলো তো ভাইফোঁটার পরই চলে আসবে।
- হুম। তুমি শুরু কর। মাকে বল
- পুচকির তো নভেম্বরে বিয়ে। আমি তো আর বিয়ে টা দেখতে পারব না
- এত যখন চিন্তা তড়িঘড়ি ডিভোর্সের ফাইল করার কি দরকার ছিল?
- আমি আগে বলেছিলাম না তুমি?
- বলার কারণ ছিল। সেটা তুমিও জানো। আর বেশি বকো না। তুমি কথা টা শুনে রাতে অবন্তিকাকে কি বলেছিলে রাতে ভুলে গেছো?
- তুমি আমার কথা শুনছিলে?
- বেশ করেছি। ডিভোর্স হওয়ার আগে তুমি বর আমার।
- এই অভ্যাস গুলোর জন্যে.........
- আজ পূর্ণিমা?
- তাই ত মনে হচ্ছে আকাশ দেখে। মা ভালো বলতে পারবে
- বাবুঘাটের ধারে বসে তুমি প্রথম............সেদিনও পূর্ণিমা ছিল। শীতকাল।
- হুম। পূর্ণিমার আলো আর কুয়াশা বিভ্রম তৈরি করে।
- আজ আর কেন করে না?
- চোখ বন্ধ করে আছি বলে।
- খুলতে কি পারি না কিছুক্ষণের জন্যে অন্তত?
- পারি। কিন্তু একজন খুলবে একজন বন্ধ রাখবে সেটা ত হয় না?
- এক সাথেই খুলি। অন্তত চেষ্টা একবার করে দেখি।
- অনেক দেরি হয়ে যায় নি।
- চুল পাকেনি তোমার ।অবন্তিকা বিয়ে করবে নিশ্চয়ই।
- সৌম্যর নিশ্চয় কোন তাড়াহুড়ো নেই।
- না। তাহলে এইবার গিয়ে আর ডিভোর্সের ফাইল গুলো দেখব না। যদি চোখ খুলেও বিভ্রম না তৈরি হয় পরের বছর সিওর।
- আচ্ছা।
- আরে তোমার সাথে গল্প করতে করতে ভুলেই গেছি বাবার ঔসূধের সময় হয়ে গেলো।
- হ্যাঁ যাও।
- যাও না, তুমিও খাবে এসো। আরএই ছেলে মেয়ে গুলোর জ্বালায় দুদণ্ড দাঁড়াব তার উপায় নেই।
- তো ওদের মা দের বল সামলাতে তুমি কেন আগ বাড়িয়ে করতে যাচ্ছও।
- আজব তো। বাচ্চা গুলো আমার কাছ ছাড়া খাবে না আর তুমি বলছ আমি ওদের ছেড়ে দেবো। মেলা বাজে না বকে এসো।
- হ্যাঁ যাচ্ছি
- অমনি ফস করে সিগারেটটা ধরালে। নেভাও। সাড়ে ৯ টা বাজে
__________
© পাপাই রায়

।। জানালা ।।

প্রতিটা ট্রেনের জানালাই স্মৃতির গুঁড়ো মাখানো..
কি যেন গায়ে লেগে যায়,
হারানো  কিসের গন্ধ নিয়ে
কারা যেন চেনা গলায় ডাকে।
ট্রেনে উঠে সবাই জানালার দিকেই তাকায়
গুছিয়ে বসে কেমন যেন হাঁ করে গেলে
ছুটে চলা গাছপালা,  ধান ওঠা ন্যাড়া মাঠ,
আর কোনোদিন দেখা না হওয়া পুকুর
আরো কত কি!!!
সেই সব  স্থবির চারপাশ
যখন সাথে সাথে ছোঁটে
অনেকটা অবাক আর ভালোলাগা
কোথায় যেন হারানো কিছু ছুঁয়ে যায়
কারা যেন নি:শব্দে পাশে এসে বসে।
তারপর একসময় ট্রেন থামে, কোনো অচেনা স্টেশন
দৌড়ে এসে হাঁপায়।
জানালায় উঁকি মেরে দেখে
কাকে যেন খোঁজে।
জানালার পাশে বসা কে যেন
তখন চোখ জোর করে বুজে
পাছে কোনো চেনা মুখ দাঁড়ায়
ক্লান্ত তাকায়।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার
তারপর আবার শুরু
প্ল্যাটফর্ম, বাঁধানো বেঞ্চ,
ওয়েটিং রুম, লোকজন
সব কেমন ঝাপসা লাগে, পিছোয়..
আবার সব  নতুন করে হারাই।
_______
© রৌণক

।। নলেনগুড়ের পায়েস ।।

গিলবার্ট কোম্পানির তৈরি অমন একপিস জাঁদরেল গ্র্যান্ডফাদার ক্লক কোনো সদাগরী আপিসের কেরানির হাতে আসবার কথাই নয়! পার্ক স্ট্রিটের রাসেল এক্সচেঞ্জ থেকে সিধা নিউ আলিপুরের কোনো খানদানী ড্রয়িংরুমে শোভা পাওয়াটাই ও'ঘড়ির পক্ষে দস্তুর। তবুও যে ঠাকুর্দা সনাতন আঢ্যি চমৎকার দাঁওখানা মারতে পেরেছিলেন, সে নেহাৎ ইন দ্যা ইয়ার নাইন্টিন ফিফটি তাঁর গুড লাকটা ভালো চলছিল বলে!
   ভাড়াবাড়িটার ঘুপচি ঘরে দিনমানেও আলো ঢোকে না। হারুর মা চলতে-ফিরতে হরদম ঘড়িতে হোঁচট খায়। নেপালবাবু নিজেও খান, কিন্তু প্রাণ থাকতে গ্র্যান্ডফাদারের শেষ স্মৃতিচিহ্নটি তিনি একচুলও সরাবেন না। ঠাকুর্দা ঘড়ির দশা এখন ঠাকুর্দারই শেষ বয়সের মত। এখানে-সেখানে উইপোকাদের মৌরসিপাট্টা, পুরনো পালিশের চটা উঠে উঠে কেসটার গায়ে বিচিত্র সব মহাদেশের মানচিত্র- তা হলেই বা! ওই গুমগুমে ঘন্টাধ্বনি তো এতটুকুও টসকায়নি! শুনলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।
   এবাড়িতে শীতের সকালগুলো আড়মোড়া ভাঙে বেশ বাঁধাধরা গতে। চানঘরের দরজাটা বেজায়  অবাধ্য, কিছুতেই খিল আঁটতে চায় না। ঠিক সাতটায় ঘড়িটার প্রথম ঢং আর বেয়াড়া খিলটাকে বশে আনতে আনতে নেপালবাবুর প্রথম 'শালা' উচ্চারণ- এই দুইয়ের সমাপতন এবাড়ির রুটিন। তারপর শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে নেপালবাবু ঠিক আরও ছ'বার সম্বন্ধীকে স্মরণ করেন, প্রতিবার ঘড়ির ঢং-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ভিজে শরীরে শীতের কামড়টা যত জাঁকিয়ে বসে, গলার পর্দায় কাঁপনও তত পাল্লা দিয়ে বাড়ে।
   শেষ 'শালা'টা মুখ থেকে বেরোনোর আগেই কিন্তু  নেপালবাবুকে উত্তরের বক্স জানালাটা খুলে ফেলতে হবে, কারণ টবের তুলসীনারায়ণের এখন   জলগ্রহণের সময়। আদুর গায়ে মাঘের কনকনে হাওয়ার মুখে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো কষ্টকর, তাই 'তুলসী, তুলসী তুমি নারায়ণ'-এর পর বাকিটা তাঁকে 'হুঁ হুঁ' করে সংক্ষেপে সারতে হবে।  বাড়ির লাগোয়া বাজারের একমাত্র নালাটি তাঁর এই জানলার ঠিক পাশে, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকেই হালকা হবার তাগিদে এখানে আসতে হয়। তাই কষ্টসহিষ্ণু নেপালবাবু যদিও বা কদাচিৎ 'তোমার শিরে ঢালি জল' অবধি অগ্রসর হন, নাকে দুর্গন্ধ ঢোকামাত্র "এই শালা, এটা বারোয়ারি পেচ্ছাপখানা পেয়েছিস? হারামজাদা, তোর বাড়ির দেয়ালে মুতে আসব, দেখবি?" ইত্যাদি বলে চেঁচাতে একরকম বাধ্য হবেন।
   কিন্তু এত কিছুর পরেও কি শান্তি আছে? বাসি ক্যালেন্ডারে মা লক্ষ্মী কখন থেকে একখানি ধুপের অপেক্ষায় বসে আছেন। তা ধুপ ধরাতে গিয়ে হাতের দেশলাই যদি হাওয়ায় নিভেই যায়, নেপালবাবুকেও তো 'ধ্যাশ্শালা' বলতেই হবে! শেষটায় চারবারের চেষ্টায় ধুপ জ্বললে, নেপাল আঢ্যি সেই ধুপ বনবন করে বারকতক মা লক্ষ্মীর সামনে ঘুরিয়ে, ক্যালেন্ডারে মায়ের পায়ের কাছটা খাবলে একবার প্রণাম ঠুকে নেবেন। খাবলানোর চোটে হয়তো বৈশাখের কয়েকটা দিন ছিঁড়ে হাতেই চলে আসবে!
   তা সেসব নিতান্তই আর পাঁচটা দিনের ব্যাপার। আজ দিনটা অন্যরকম।
   আজ বাজারে যাবার মুখে বাড়িওয়ালীর ছেলে সত্যর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সত্য দাঁত মাজার ব্রাশ মুখের ভেতর চিবোতে চিবোতে বলল, "কাকাআউ, ঙাঁ অলছিল... এ আঁসের আড়াটা, অডি এট্টু আড়াটাড়ি..." অন্যদিন হলে নির্ঘাত নেপালবাবু চোখ পাকিয়ে, মুখে ফেনা তুলে তর্ক জুড়ে দিতেন, "ভাড়া! কীসের ভাড়া হে! বলি, দু'বেলা পাম্প চলে না কেন? সিঁড়ির আলো জ্বলে না কেন? কল থেকে জল না পড়ে ছাদ ফুটো হয়ে পড়ছে, আবার ভাড়া! হুঃ!" আজ কিন্তু সেসব কিছুই বললেন না। বরং কন্ঠে মধু ঢেলে বললেন, "বাবা সত্য! আজ তো সবে দোসরা। পেনশনটা তুলতে দাও, তারপর নাহয়...  আহা! তোমাকে কি তাগাদা দিতে হয়েছে কখনও? তোমার বাবা বেঁচে থাকতে কিন্তু..."
   সত্যর পরলোকগত পিতার স্মৃতিচারণ অসমাপ্তই থেকে গেল, দোতলার জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে সত্যর মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, "মিঠে কথায় ভুলিসনি, সতে! তোর বাপকেও অমনধারা কথার ফাঁদে ফেলেই অক্ত চুষে খেয়েছে!" সর্বৈব মিথ্যা! এলেবেলে একটা দিনে এমন ভয়ানক অনৃতভাষণ শুনলে নেপালবাবুর শিখার কাছটা কি দপ করে জ্বলে উঠত না? কিন্তু, আজকের দিনটা তো আর... আজ নেপালবাবু একটা পীড়িত হাসি হেসে শুধু বললেন, "বৌদি, গরীব ভাইটার কথাও একটু ভেবে দেখুন! আসছে হপ্তায়... কথা দিচ্ছি..."
   হারুর মা ঠিক এইসময়টায় কাজে আসে। সদর দরজার সামনে মনিবের সঙ্গে তার নিত্য ঠোকাঠুকি হয়। আজও নেপালবাবুকে তার নিয়মমাফিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হল। "এবেলা কী রান্না হবে?" গতকাল অবধি নেপালবাবু এই প্রশ্নের উত্তরে মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছেন, "আমার পিন্ডি!" আজ টাকটা বারকতক চুলকে, কী যেন একটু ভেবে নিয়ে বললেন, "দুপ্পুরটা একটু হালকা দেওয়াই ভালো, নইলে আবার... ভাতে-ভাত যা হোক করে দে না!"
   ওই যে বললাম, আজ দিনটা একটু ব্যতিক্রমী। ভাগ্যিস সতে বেটা টের পায়নি! নেপালবাবুর পকেটে আজ কড়কড়ে টাকা। আজ দুধ আসবে, একটু বেশি করেই আসবে, আর আসবে গোবিন্দভোগ চাল। আর...আর, ফেরার পথে মুদির দোকানে একটিবার ঢুঁ মারতে হবে। উমদা কাজু-কিশমিস চাই, সঙ্গে চাই পাটালি, ভালো খেজুর গুড়ের পাটালি।
    আজ নেপালবাবু পায়েস রাঁধবেন। নলেনগুড়ের পায়েস। ছেলেবেলায় শোনা একটা গান গুনগুন করে ভাঁজতে গিয়ে নেপালবাবু টের পেলেন, মুখের ভেতরটা লালায় ভরে যাচ্ছে:

"আযা পিয়া, তোহে পেয়ার দুঁ/ গোরি বাঁইয়া..."

-বেশি লাগবে না? কী বলিস! আরে, পরমান্ন বলে কথা!
-"তা'বলে অ্যাত্ত!" বিস্ময়ে হারুর মায়ের হাঁ বন্ধ হতে চায় না।
-নয়তো কী? দু'কেজি দুধে একমুঠো চাল। সরেস গোবিন্দভোগ। এই হচ্ছে হিসেব, বুঝলি?
-কই, বিশ্বেসদের বুড়িটা সেবার পায়েস দিয়ে গেল... সেই যে গো, মনে নেই? আরে, নাতিটার বাট্টে না কী যেন ছিল... তা, তিনি তো...
-থাম দিকিনি, থাম! ওটা পায়েস হয়েছিল? দুধ একদিকে, চাল একদিকে, আর চিনি আর একদিকে। যেন কারো সঙ্গে কারোর মুখ দেখাদেখি নেই! ওই সাদা ফ্যাটফ্যাটে দুধ-ভাতের নাম পায়েস? ছোঃ!
   ডানহাতে হাতাটা নাড়তে নাড়তেই বাঁ-হাতখানা নেড়ে নেপালবাবু বিশদে বোঝাতে শুরু করেন, "চালটা যখন সেদ্ধ হয়ে আসবে... টিপে দেখে নিতে হয়, বুঝলি? তখন পাটালিগুলো ছেড়ে দিয়ে দুধটাকে ফুটতে দে। যত ফুটবে, তত ঘন হবে। শেষটায় যখন লালচে হয়ে আসবে, দেখবি বুজকুরি কাটছে... তখন আঁচ বন্ধ করে ঢাকনা দিয়ে দাও, ব্যস! খালি নামানোর সময় এট্টু কাজু-কিশমিস ছড়িয়ে দিলেই..." নেপালবাবু জিভের জল সামলান।
   অশ্বথ্ব গাছটার মগডালে একটা পেটকাটি ঘুড়ি আটকা পড়েছে। উত্তুরে বাতাসে বল পেয়ে, ঘুড়িটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাঁধন কাটিয়ে পালানোর। আওয়াজ হচ্ছে লাগাতার... ফরফর...ফরফর... জানলা দিয়ে একমনে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন বলেই হারুর মায়ের কথাটা তাঁর ঠিক কানে গেল না।
-কে আসবে বললি?
-ঝুমুদিদি গো! বাচ্চাদুটোরে ইস্কুল থেকে নেবার পথে হয়ে যাবে বলল।
   অশথ্ব গাছের মাথা থেকে মনটা মাটিতে ফিরে আসতে খানিকক্ষণ সময় নেয়। আচমকা হোঁচট খেয়ে কোঁৎ পাড়ার মত থেমে থেমে প্রশ্নটা করলেন নেপালবাবু, "ঝুমু...আসবে! এখানে! মানে, আজ? আজই? মানে, তুই...তুই জানলি কীকরে?" ।
-ওই দেকো! আপনেরে ফোন করে পায়নি বলেই তো, আমায় খপরটা দেতে বলল... বাবু, আমার হারুটার জন্যি এট্টু পায়েস নে যাবো? ও বাবু?"

একসঙ্গে হাজার হাজার ছুঁচ শরীরে বিঁধলে কেমন যেন অবশ-অবশ লাগে। তখন ঠান্ডা হাওয়ার ঠকঠকানিও আর টের পাওয়া যায় না, খোলা জানলার সামনে বসে থাকতে থাকতেই একটু ঢুল এসে যায়। আট নম্বর বিড়িটা দু'আঙুলের ফাঁকে ফুরিয়ে যেতে যেতে ছ্যাঁকা দিয়ে গেল। ঘুম জড়ানো গলায় একটিবার "উরিশ্শালা!" বলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন নেপালবাবু।
   বাতিটা জ্বালানো হয়নি। ঘর অন্ধকার পেয়ে পায়ের কাছটা ছেঁকে ধরেছে মশায়। "ধুশ্শালা!" নেপালবাবু পায়ের গোছটা চুলকে নিলেন। রাত কত হল? বাইরেটাও কেমন থমথমে, কেবল অশ্বথ্ব গাছটা থেকে এখনও শব্দ আসছে: ফরফর... ফরফর... ধুশ্শালা!
   ঘরময় তুলোর ওড়াউড়ি। নাতিদুটো দাদুর বালিশ নিয়ে কৌরব-পান্ডব খেলেছে। তারপর যুদ্ধবাজের বুভুক্ষা নিয়েই পায়েস সাবড়েছে, পাক্কা দু'বাটি। তাদের মাও বাদ যায়নি। আরও এক। চক্ষুলজ্জার খাতিরে জামাইয়ের জন্যও টিফিন কৌটো ভরে দিতে হয়েছে। বাকিটা নিয়ে গেছে হারুর মা। পায়েস খেয়ে হারূ কাল সকালে দাদুকে পেন্নাম করতে আসবে।
 
   ফরফর... ফরফর...
"ধুশ্শালা!" ঘুড়িটার মরিয়া প্রচেষ্টায় এবার তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন নেপালবাবু। উঠে জানলাটা বন্ধ করতে যাবেন, পিছনে একটা 'ঠুং' শুনে তাঁর কান খাড়া হয়ে ওঠে।
   একজোড়া দুর্বল পা একটা ক্ষয়াটে শরীরকে বয়ে এনেছে ঘরের ভেতর। পায়ের আওয়াজে ক্লান্তির ছাপ ঢেকে দিচ্ছে হাপরের মত শ্বাস টানার শব্দ। রোগা মানুষটার লম্বা ছায়া পড়েছে মেঝেতে। আর তার হাত থেকে যে জিনিসটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা হয়েছে এইমাত্র, অন্ধকারেও সেটার দুলতে দুলতে স্থির হওয়াটা দেখতে পেলেন নেপালবাবু। সেটা আর কিছুই নয়, তাঁর পায়েসের হাঁড়ি!
-কী গো? তুমি... এত রাত্তিরে! শরীরটা আবার খারাপ হল নাকি? রোসো, ডাক্তারকে একটা... ধুশ্শালা! ফোনটা আবার কোথায়...
-আহ! থামবে তুমি? অত ব্যস্ত হবার কিছু হয়নি।
-তবে?
   কনকলতার চোখজোড়া কোনদিনই ঠিক পটলচেরা নয়। তবে, শরীরটা রোগা বলেই বোধহয় চোখদুটো এখন বড়বড় দেখায়। সেই বড়বড় চোখদুটো কিছুক্ষণ নেপালবাবুর মুখের ওপর স্থির হয়ে রইল। "খেয়ে নাও।"
-খেয়ে নেব? কী খেয়ে নেব?
-কেন? সারাটাবেলা হাত পুড়িয়ে যা রাঁধলে! শুয়ে থাকি বলে কি খবর পাইনা ভেবেছ? মেয়েরা যখন খাচ্ছিল, বিষনজরে দেখছিলে তো! নাও, যেটুকু আছে, খেয়ে উদ্ধার করো দেখি!
-যাহ্! কী যে বল... ও পায়েস... ও আমি কীকরে খাবো?
-কেন?
-গেল মাসে সুগারের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কী ধমকটাই না দিলে! আবার পায়েস খেয়েছি শুনলে... ওরে বাবা! না না, রক্ষে করো!
   দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে মানুষটার কীর্তিকলাপ দেখে দেখে, কনকলতা এখন বিস্মিত হতেও ভুলে গেছেন। তবুও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলেন, "তবে, অত খেটেখুটে রাঁধলে কেন?"
নেপালবাবু একটা বোকাটে হাসি হাসেন। তারপর আমতা আমতা করে বলেন, "তোমার মনে আছে? ঝুমু তখন খুব ছোটো... রাঙাপিসিমাদের কুলতলির বাড়িতে খাঁটি গুড় আসত। পিসিমা পায়েসটা করতেনও চমৎকার! তুমি সেবার খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলে।"
-হুঁ...
-বাপরে বাপ! এক জামবাটি পায়েস একাই মেরে দিলে।
-যাহ্! মোটেই না।
-"হে হে।" হাঁড়িটার গায়ে পায়েসের চাঁচিটুকু লেগে রয়েছে। নেপালবাবু সেটুকু যত্ন করে তুলে বৌয়ের মুখের সামনে ধরলেন। "নাও, খেয়ে নাও। লক্ষীটি।"
   বুড়োবুড়ি পাশাপাশি বসে পড়েন। খানিকক্ষণ চুপচাপ, শুধু বাইরে থেকে আওয়াজ আসে, ফরফর... ফরফর...
-ডাক্তারের সাথে কাল কী কথা হল গো?
স্বামীকে নতমুখে চুপ করে থাকতে দেখে কনকলতা বলে ওঠেন, "দেখো, ডাক্তার যদি হাল ছেড়ে দিয়েই থাকে, আর ওসব ওষুধপত্তর-হাসপাতালের হ্যাঙ্গাম কেন? এই তো বেশ আছি! না বাপু, আর ওই রে নিতে যেতে পারবো না।"
   নেপালবাবুর মুখে ব্যথাতুর নীরবতা। কনকলতা আবার বলেন, "সমু এমাসে টাকা পাঠায়নি, না?"
উত্তর নেই। নিস্তব্ধ ঘরে কেবল কনকলতার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
-শোনো, যেকটা দিন আছি, আমার সামনে অমন গোমড়া মুখ করে থেকো না বাপু! একটু হাসো তো! কী হল?
   সেই বোকাটে হাসিটা হাসতে গিয়ে নেপালবাবুর দু'চোখে জল টলটল করে ওঠে।
-উফ! আচ্ছা, শোনো! এই, শোনোনা... কাল একটু দই-পটল করবে?
   কনকলতার ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। এবার নেপালবাবুও সত্যিকারের হাসি হেসে ফেলেন। "তোমার মনে আছে? সেবার ভাগলপুরের জেঠুমণিদের বাড়িতে..."
   দুই বুড়োবুড়ির মাঝে একটা ঝুঁঝকো আঁধার এতক্ষণ গুমরে মরছিল। এবার কোথা থেকে একফালি মরা চাঁদের জ্যোৎস্না এসে জোটে। ঠিক নলেনগুড়ের পায়েসের মত তার রঙ।
   আর ঠিক সেই মুহূর্তে, একটা দমকা বাতাস পেয়ে, অশ্বথ্ব গাছের ডাল ছাড়িয়ে পেটকাটি ঘুড়িটা কোথায় যেন উড়ে চলে যায়।

________
© সাম্য দত্ত

।। সায়নের চোখে ।।

পাঁচ বছরের সায়ন
অবাক চোখে দেখছে-
দেখছে তার মাকে,
দেখছে ঝাপসা কাঁচের মধ্যে দিয়ে,
দেখছে পানশালার খিড়কি দিয়ে !

পাঁচ বছরের সায়ন
বিহ্বল চোখে দেখছে-
ঘুরে ঘুরে নাচছে তার মা,
চকমকির মতো ঠিকরে বেরোচ্ছে
রামধনু রঙীন যৌবন ছটা !

পাঁচ বছরের সায়ন
কান খাড়া করে শুনছে-
কি সুন্দর গাইছে তার মা,
কি সুন্দর নাচছে তার মা,
নাচছে-গাইছে আর গাইছে-নাচছে !

পাঁচ বছরের সায়ন
রাগের চোখে দেখছে-
চারপাশে কতলোক হাততালি দিচ্ছে,
কতলোক বিচ্ছিরি করে হাসছে,
বাজে লোক যতসব !

পাঁচ বছরের সায়ন
অসুস্থ দেহে দেখছে-
তার নাকি খুব কঠিন অসুখ,
কি যেন নাম রোগটার-
ওহ্ হ্যাঁ, থ্যালাসেমিয়া |
______________
© ফিরোজ আখতার

।। কালো বিড়াল ।।

আমি এক বহুজাতিক সংস্থার বড় সাহেব। ব্যাচেলার। কোন বদ নেশা নেই। কাজ মানে অফিসের কাজই জীবন বানিয়েছি।বাড়িতে শুধু কফি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে। সকাল নটায় অফিসে এসে বসি রাত দশটায় ডিনার সেরে বাড়ি ফিরি। বাড়িতে এসে আর কোন কাজ না। গরম জলে স্নান সেরে শুয়ে  ম্যাগাজিন দেখতে  দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি।        
 কাল দুপুর দুটোয়  বোর্ড মিটিং। রাত দশটা প্রায় বাজে। দুজন পিএকে ছেড়ে দিয়ে খাবার  আনিয়ে খাস পিওনকেও ছেড়ে দিলাম। রিপোর্ট আরও একবার স্ক্রুটিনি করলাম। বাকিটা কাল সকালে এসে মিটিংয়ের আগেই সেরে ফেলা যাবে।
এতক্ষনে অনুভব হলো দারুণ খিদে পেয়েছে। অ্যান্টিচেম্বারে খাবার খুলে গোগ্রাসে রাক্ষসের মত মাছ দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছি। কে আর দেখতে যাচ্ছে বড় সাহেবকে। অফিস তো ফাঁকা।
এইসময় কোথা থেকে যে একটা কালো বিড়াল এসে একদম পাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কোনোদিনই তো আমার এই ঝকঝকে অফিসের আনাচেকানাচেও কোন কালো বিড়াল আছে টের পাই  নি। আমার মাছের টুকরোটাকে মুখে নিয়ে বলতে  গেলে পাতের উপর বসেই আরামে দু চোখ বুজে  চিবিয়ে খাচ্ছে।  আর রাগ সামলাতে না পেরে হাতের সামনে একটা  ছোট কিন্তু মোটা লাঠি দিয়ে ওর মাথায় সজোরে মারলাম। আঘাতটা বোধহয় একটু জোরেই হয়ে গিয়েছিল। খাবার প্লেটের উপরই বিড়ালটা নেতিয়ে পড়লো।  মরে গেছে। থ্যাতলানো মাথার নীচে ওর ঘেটিটা ধরে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।        
  বাড়িতে এসে স্নান করে প্রায় অভূক্ত অবস্থায় শুয়ে একটু পরই ঘুমে গলে গেলাম।
 কিসের অস্বস্তি যন্ত্রণাও!  ঘুম ভেঙে গিয়ে গলায় হাত দিতেই মনে হলো রক্ত বেরোচ্ছে।
আলো জ্বেলে তাড়াতাড়ি গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতে আমার মুখের বদলে থ্যাতলানো মাথা, কালো বিড়ালটার মুখ দেখতে পেলাম। আতঙ্কে আলো  নিভিয়ে বিছানায় ফিরে আসতে গিয়ে দেখি অন্ধকারে বিছানার উপর দুটো চোখ জ্বলছে। বুঝলাম কালো বিড়ালটা অন্ধকারে বিছানায় ওত পেতে আছে আমার রক্ত চাটার জন্য।
___________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী

।। নিরন্ন মানুষের জন্য ।।

চে গুয়েভারা, আমি তোমারই আদর্শে
বেড়ে উঠতে চাই।
শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে
আমিও ছুটে যেতে চাই
পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে
আরেক গোলার্ধে;

অসহায় শোষিত মানুষকে
অধিকার সচেতন করার অপরাধে
যদি আমাকে
তোমার মতো বলিভিয়ার জংগলে
স্বৈরশাসকের গুলির আঘাতে
ছিন্ন ভিন্ন লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হয়

কিংবা
গ্রীক পুরাণের প্রমিথিউসের মতো
আমাকে যদি
সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় শৃংখলিত করা হয়
জিউসের ঈগল যদি উদয়াস্ত
আমার হৃৎপিন্ড
তীক্ষ্ন ঠোঁটে ঠুকরে খায়

চে, তুমি দেখে নিয়ো
তবু আমি প্রতিটি শতাব্দীতে জন্ম নেবো
নিরন্ন মানুষকে ভালোবাসার জন্য।
______________
© জিসান জিবরান

।। কিছু ক্ষত আজও রঙীন ।।

অজস্র সূঁচ বিঁধিয়ে স্মৃতির কোলাজ
মনের থেকে রক্ত ঝরে না
সময়ের ব্যান্ডেজে ক্ষত ঢাকার চেষ্টা
সাথে থাকে ভাঙা গিটার

নিঃসাড় আঙুলের ফাঁকে বোবা কলম
নিষ্প্রান কালির আঁচড়
ভাষা হতে চায় নির্লিপ্ততার
অতিযান্ত্রিকতার উদাসীন সমীহ

নিকোটিনের ধোঁয়ায় মেঘের মাঝে
একটা অবয়বের আউটলাইন
অসময়ের বৃষ্টি চোখের জলের
সব ধুয়ে দেয় নীল ক্যানভাসে

ফের ইচ্ছে করে ঘুরে দাঁড়াই
পায়ের নীচে চোরাঘূর্ণির টান
প্যারালাইজইড শরীরে যন্ত্রণার চুপকথা
রক্তের বোহেমিয়ানা কমে ফ্রিজারে
_____
©সুব্রত

Friday, 13 January 2017

।। যাপনচিত্র ।।

বেঁচেবর্তে থাকি বিশ্বাসের তাঁবু খাটিয়ে
বেদুইন গল্প লিখি ছেড়া কাঁথায়
নিখোঁজ  ঈশ্বর খুঁজি তুলসীতলায়
প্রতিদিন ঘাম আর রোদের মাঝে
হাপিত্যেস গড়াগড়ি দেওয়া স্বপ্ন
ভাঙ্গতেভাঙ্গতে বুলডোজার ছোটে
আসলে স্বপ্নেরা বাঁশবনেই  থেকে যায়
আর আমরা একে অপরকে বাঁশ দিই
পাহাড় জমে প্রতিশ্রুতির
এক একটা রক্তমাখা পথ ধরে
 সরকার আসে...সরকার যায়...
____________
© সৌতিক হাতি

।। পরিকল্পনা ।।

সেদিন প্রথম আমি নীলুর ঘরে ঢুকলাম।  এতদিন ধরে নীলুর সঙ্গে আড্ডা মেরেছি ওদের বাড়িতে।  তবে কোনোদিন ওর নিজস্ব ঘরে ঢুকিনি। তার কারণ যে কোনো একটা মেয়ের প্রাইভেসি থাকে তার ঘরে।  সেটুকু মেনে সবসময়ে আমরা দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মেরেছি ওদের বসার ঘরে নয়তো ছাদে।  সেদিন ওদের বাড়িতে ঢুকেই যখন মিনু বৌদির মুখে শুনলাম যে নীলু জ্বরে পড়েছে , তখন ওর ঘরে আমাকে ঢুকতেই হলো মিনু বৌদির পিছু পিছু।

ঢুকে দেখি নীলুর ঘরটা বেশ সুন্দর সাজানো।  ঘরের আসবাবপত্র বলতে একটা বড় পুরোনো পালঙ্ক যার মাথার দিকে একটা ময়ূর করা আছে।  ময়ূরের মুখটা এমন করা যে দেখলেই মনে হবে বুঝি ময়ূরটা ঘাড় কত করে তোমার দিকে চেয়ে আছে।  ঘরে আছে একটা শোকেস , আলমারি আর একটা ছোট ড্রেসিং টেবিল।  তবে ঘরের শোকেস , আলমারির উপরে ড্রেসিং টেবিলে সব সাজানো বিভিন্ন দেশের পুতুল , সব কেমন যেন কার্টুন মার্ক চেহেরা।  দেখে মনে হলো সব বিদেশী পুতুল।  দেখার মতো জিনিস হলো ওর খাটে  গোটা কয়েক বিভিন্ন সাইজের টেডি বিয়ারের রূপের বালিশ।  দেখি এক বড় কালো টেডি বিয়ার আঁকড়ে ধরে নীলু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

পায়ের শব্দ শুনে নীলু চোখ মেলে চাইলো।  আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নীলু বলে , ' কাল রাত থেকে জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছি।  কিন্তু নীলুর বেশ সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল দেখে আমার কিছু সন্দেহ হয়।  কেউ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোলে আগেই মাথার চুল এলোমেলো হয়ে যায়।  তাই আমি হাত বাড়িয়ে নীলুর কপাল ছুঁয়ে দেখি টেম্পেরেচার মোটেই  নেই।  তাই আমি নীলুর কাঁথায় এক টান মেরে বলি , ' ওঠ , আর তোকে জ্বরের ন্যাকামি করতে হবেনা।  চাদরে টান  মেরে দেখি নীলু দিব্যি জিন্স আর টপ পরে শুয়ে আছে।  বিছানার পাশে রাখা আছে একটা ছোট প্লেটে কৎবেলের চাটনি।

নীলু তখন বলে , ' দিনে একবার যদি জ্বর আসে তবে ধরে নিতে হয় সারাদিন ধরে জ্বর আছে।  কাল রাতে জ্বর এসেছিলো , মানে এখনো জ্বর আছে , সে আমার কপাল ঠান্ডা হোক বা গরম হোক। 'নীলুর কথা শুনে আমার হাসি পায়।  তাই জিজ্ঞেস করি , ' জ্বর হলে কি কোনো বিশেষ প্রিভিলেজ পাস বুঝি ?' নীলু তখন আঙ্গুল দিয়ে দেখালো খাটের  পাশে রাখা ছোট টিপয় টেবিলটা।  তাতে দেখি একটা ট্রেতে , গোটা পাঁচ ছয় ছোট ছোট কাঁচের বোতল।  সব বিভিন্ন আচারে ঠাসা।  আমি এক একটা করে কাঁচের বোতল তুলে দেখি কোন কোন আচার আছে।  দেখি কুল , কামরাঙ্গা , আম , আমলকি , লেবু আর লংকার আচারের বোতল সাজানো।  আমি বলি , ' এই সামান্য আচারের জন্য তুই কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে  আছিস।  ‘

ঠিক তখনি ঘরে ঢোকে লক্ষীর মা , যে ওদের বাড়িতে কাজ করে।  দেখি লক্ষীর মা এক বালতি জল আর ঘর পৌঁছার কাপড় নিয়ে ঢুকেছে।  নীলুর কথা শুনেই বলে , '  নীলুদি  পড়ে  আছে কোথায়?  এইতো ছাদে ঘুরে ঘুরে কৎবেলের চাটনি খাচ্ছিলো।  আপনাকে আসতে দেখে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ' নীলু কপট রাগ দেখিয়ে লক্ষীর মাকে  বলে , ' শোনো পিসি , এতটা পাপ তোমার কপালে সইলে  হয়।  তোমাকে কি বুঝিয়ে বলতে হবে যে কৎবেলের চাটনি ঘুরে ঘুরেই খেতে হয় , তবে গিয়ে তার টেস্ট পাওয়া যায় জিভে আর টাকরাতে। ' আমি নীলুর থিওরি শুনে রীতি মতন হাঁ হয়ে গেছি।  তখন শুনি লক্ষীর মা আমাকে বলছে , ' দাদাবাবু , এবার একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলেন।  কতদিন আর দুজনে গুজুগুজু ফুসুফুসু করবেন।  এবার সংসারের বাঁধনে  দুজনা বাঁধা পড়ুন। ' লক্ষীর মায়ের মন্তব্য শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গেছি।  কি বলবো তার কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিনা।  তখন নীলু আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।  নীলু এবার লক্ষীর মাকে জিজ্ঞেস করে , ' আচ্ছা  পিসি তুমি যদি আবার জন্ম নাও , তুমি কি আবার বিয়ে করবে ?' দেখি ঘর মোছা বন্ধ করে লক্ষীর মা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে নীলুর দিকে।  কেমন একটা কান্না মেশানো গলায় উত্তর দেয় , ' এ জীবনে সেই ভুলটা করেছিলাম বলে দুবেলা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসারের হাল টানতে হয়।  লক্ষীর বাপটা নেশা ভাং করে পড়ে  থাকে।  সেই নেশার পয়সা আমাকেই দিতে হয়।  নয়তো সংসারে অশান্তি শুরু করে দেয়।  তুমি দিদি ঠিক বলেছো পরের জন্মে আমি আর বিয়ে করবোনা।  খেটে  খাবো , কিন্তু নিজের মতো করেই বাঁচবো। ‘

লক্ষীর মায়ের কথা শুনে আমরা দুজনেই চুপ মেরে যাই।  লক্ষীর মা ঘর পৌঁছা শেষ করে বেরিয়ে গেলো।  এবার নীলু জিজ্ঞেস করে , ' এ বিষয়ে তোমার মত  কি ?' আমি আর কি বলি এই প্রশ্নে।  তবু আমি চেষ্টা করে গুছিয়ে বলতে , ' কাল নাকি তোদের বাড়িতে আমার মা এসেছিলো।  তোর সঙ্গে নাকি অনেক আড্ডা মেরে গেছে। ' নীলু দেখি বিছানার চাদরের কোনটা এক হাতে মোচড়াতে মোচড়াতে বললো , ' মাসীমাত বলে গেলেন  , তুমি যতদিন পারো নিজের মতো থাকো।  যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিন ছাঁদনাতলায় তোমাদের দুজনকে বসিয়ে দেবো। ' আমি কিছু না বলে খালি বলি ,' হুম। ' হটাৎ নীলু বলে চলো ছাদে গিয়ে একটু রোদের  উত্তাপ নি। ' দুজনেই চুপচাপ ছাদে এসে দাঁড়াই।  শীতকালের রোদ বেশ মিষ্টি লাগছিলো।  এবার নীলু বলে , ' কথাটা ঠিক আমরা দুজনে নিজেদের মতন থাকার চেষ্টা করি।  যেদিন ইচ্ছে হবে টোপর পরে বসে পড়বো। সে নিয়ে একটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও করা যেতে পারে  ' আমি বলি , ' আমি এক বছরের পরিকল্পনায় রাজি আছি । ‘ নীলু খুব জোরে হেসে উঠে বলে , ' জো  হুকুম মেরি আকা।  ঠিক আছে তবে পরের শীতে না হয় রবি ঠাকুরের ভাষায় বলবো

"দু দিক হতে দুজনে যেন

         বহিয়া খরধারে

    আসিতেছিল দোঁহার পানে

    ব্যাকুলগতি ব্যগ্রপ্রাণে,

    সহসা এসে মিশিয়া গেল

         নিশীথপারাবারে।

    থামিয়া গেল অধীর স্রোত

         থামিল কলতান,

    মৌন এক মিলনরাশি

    তিমিরে সব ফেলিল গ্রাসি,

    প্রলয়তলে দোঁহার মাঝে

         দোঁহার অবসান।"
_________
© সনৎ মিশ্র

।। মধ্যবিত্ত ।।

দুই পা ফেলে চার পা পিছিয়ে
এসেছি বরাবর,
বীরত্ব থেকে শতহাত দুরে থেকেছি
আজীবন,
রাস্তায় যুবতী মেয়ের শ্লীলতাহানি দেখে
পথ বদলিয়েছি বারংবার,
নিজেকে মধ্যবিত্ত বলে সান্ত্বনা দিয়েছি
অষ্টপ্রহর.

ট্রেনে বাসে অযাচিত অপমান,
অপিসে বসের নোংরা বিশেষণ,
বাড়িওয়ালার মৃদু সুরে গালি,
মাসকাবরি দোকানদারের তাগাদা
সয়েছি হাসিমুখে,
নিজেকে মধ্যবিত্ত বলে সান্তনা দিয়েছি
অষ্টপ্রহর.

তোমার পছন্দ করা দামি শাড়ি
কিনতে না পারার যন্ত্রণা,
আমার ছেড়া অপিস ব্যাগ নিয়ে
সহকর্মীদের হাসাহাসি,
কিংবা মাস শেষের বিয়ের আমন্ত্রণে
শরীর খারাপের তোমার আমার অভিনয়
ধরা পড়ে ও না পড়ার অভিনয়
সয়েছি হাসিমুখে,
নিজেকে মধ্যবিত্ত বলে সান্ত্বনা
আজীবন.

আজ লাল বেনারসি তে সেজে
সানাই এর করুণ সুরে
তুই যখন ভরা চোখের জলে
ভিজিয়ে দিচ্ছিস আমার পাঞ্জাবীটা,
না পাঞ্জাবী নয় আমার হৃদয়,
তোকে বুকে জড়িয়ে ফিরে গেছি
তোর ছোট্ট বেলায়,
তুই নয় রে আমার জীবন কে
পাঠিয়ে দিচ্ছি পতি গৃহে,
তখন আমি মধ্যবিত্ত নয়
আমি হিমালয় আর তুই
আমার কন্যা পার্বতী.
এই প্রথম এই প্রথম বার
আমি হেরে ও জিতে যাচ্ছি
মধ্যবিত্ত শব্দটার কাছে
_____________
© মতিউল ইসলাম

।। আলো ।।

       তমনাশের শরীরটা কদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না ।বুকের ব্যথাটাও বেড়েছে।থেকে থেকে কাশির ঝোঁকে শরীরটা তার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। একটানা কাশির ধকল সামলে একটু দম নিয়ে তমনাশ ডাকে --আলো ,ও আলো ,কোথায় গেলে?
   এইতো ,আসছি -বলে তমনাশের স্ত্রী আলো গরম তেলের বাটি এনে স্বামীর  বুকে তেল মালিশ করতে বসে। একথা সেকথা বলতে বলতে আলো বলে হ্যাঁ গো? আজ এক মাস ছাব্বিশ দিন হলো তুমি বাড়িতে বসে।তা তোমাদের জুট মিল কবে খুলবে?
      তমনাশ গরম তেল মালিশের আরামটুকু চোখ বুজে উপভোগ করে শুধু ,মুখে কিছু বলে না।
    আলো বলে কিগো? কিছু বলছ না কেন?
    তমনাশ মিটমিট করে চেয়ে একটা উপুর নিঃশ্বাস ছেড়ে  বিষন্ন বদনে বলে কিজানি ! কবে খুলবে।আর খুললেই বা কি হবে?এই শরীরে শ্রমিকের কাজ  করতে পারব?
  -----তাহলে সংসার চলবে কি করে?মুদির দোকানে ধার।বিল বাকি  থাকায় ইলেকট্রিক কেটে দিয়ে গেছে।আজ কানের সোনা বিক্রি করে তোমার ওষুধ এনেছি।তাছাড়া মেয়েটাও মাথায় মাথায় বড় হয়ে উঠছে।এ ভাবে আর কতদিন চলবে?
   কিজানি আলো !, তমনাশ হাতে ভর দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বিছানার উপর উঠে বসে বলে - আমার জামাটা দাও দেখি আলো,শ্রমিক-মালিক মিটিংটার কি হল একটু  শুনে আসি।
--এই অসুস্হ শরীরে যাবে ?তাছাড়া ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে,ভিজলে ঠাণ্ডা লেগে বুকের ব্যথাটা আরো বাড়বে।
    তমনাশ জামা পরতে পরতে বলে --আরে না না,কিচ্ছু হবে না ।তার পর ঠোঁটের কোনে কষ্ট করে হাসি টেনে এনে জিজ্ঞাসা করে --তুমি আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা কর ,না?  সব ঠিক হয়ে যাবে আলো ,সব ঠিক হয়ে যাবে--বলে একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে মেয়ের ছাতাটা নিয়ে তমনাশ ধীর পায়ে বাড়ি থেকে  বেড়িয়ে যায়।
    আলো  স্বামীর যাত্রা পথের দিকে চেয়ে কপালে করজোড় করে বলে ঠাকুর, মানুষটাকে তাড়াতাড়ি সুস্হ করে দাও ঠাকুর।
   
---- এমন সময় তমনাশের মেয়ে তমসা ছুটতে ছুটতে এসে  ডেকেবলে  --মা,মা,পাশের বাড়ির কাকিরা খেঁজুর গুড় কিনছে ,কি সুন্দর গন্ধ।এই দেখো আমার হাতে কফোঁটা দিয়েছিল,কিনবে মা?
---না ,থাক,পরে কিনব।
তমসা অভিমান মেশা কণ্ঠে বলে ---ফার্স্ট জানুয়ারীতে বললে পরে কেক কিনে দেবে আর দিলে না।এখনও বলছ পরে কিনবে।আর কবে কিনবে?খেঁজুর গুড় দিয়ে পিঠে খাব না?
     আলো  তমসার গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বলে --খালি খাওয়া আর খাওয়া ! এত বড় মেয়ে বোঝে না কিছুই।বাবার শরীর খারাপ,কারখানা বন্ধ।তারপর তমসার চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে টেনে এনে  আলো বলে --'খা ,আমার মাথাটা  চিবিয়ে চিবিয়ে খা, বলে মা -মেয়ে গলাগলি করে কাঁদতে থাকে।
----নাগো মা, না,অমন কথা বলো না ।আমি আর কোন দিনও বলব না।বাবা সুস্হ না হওয়া পর্যন্ত,কারখানা না  খোলা পর্যন্ত আমি আর কিচ্ছু চাইবো না-- বলে তমসা আলোর কোমড় ধরে কাঁদতে কাঁদতে বসে পরে।
    রাত নটার সময় তমনাশ অন্ধকার ঘরে ফিরে  হেঁকে বলে কৈ,আলো কোথায়?ভাল খবর আছে।
   আলো   আটামাখা হাতে অন্যহাতে ধরা  কুপির আগুন আড়াল করে রান্না ঘর থেকে ছুটে এসে সোৎসাহে বলে কি খবর গো? কারখানা খুলেছে?কবে থেকে কাজে যোগ দিচ্ছো?
  তমনাশ গম্ভীর ভাবে বলে আমি কাজে যোগ দেব না ,তুমি যোগ দেবে।
----তার মানে?
    মানে,   এম.এম .কে প্রাইভেট কোম্পানীতে নাইট শিফটে একটাই ফিমেল পোষ্ট ফাঁকা ছিল। কাজ বিশেষ কিছু নেই।মাইনে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার।এই নাও  এপয়েন্টমেন্ট লেটার আর একমাসের এডভান্স ।আর হ্যাঁ ,বস তোমার কজে খুশি হলে মাসে আরো টেন পার্সেন্ট একস্ট্রা।
    কথা শেষ হবার আগেই আলোর হাত থেকে কুপিটা  পরে যায়।আলোর মুখ অন্ধকারে ঢেকে যায়।   ঘরের মধ্যে আলোহীন  নৈঃশব্দ বিরাজ করে।তমনাশ ও আলো মুখো মুখি দাঁড়িয়েও  একে অপরের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকিছু শুনতে পায় না ।
______
© তাপস

।। কবির দায় ভার ।।

কবির কাঁধে দিয়েছো তুলে ,
জগতের দায় ভার -
সহজ করে লিখতে হবে ,
নিয়ম মেনে চলতে হবে -
হবে না এপার ওপার !

যুগের ভাষা মনের মতো হবে চলন সই,
শব্দ চলবে তালে তালে ,স্বাধীনতার অভাব বড়ই ।

কাব্য হবে ভব্য সভ্য সহজে পরিপাক ,
সমাজের গায়ে নানা রকম লাখো ক্ষত থাক ।

কবির কলম দায়বদ্ধ আছে কতো ঋণ সমাজ পতি মুক্ত অতি দায় নেয় কি কোন দিন !

নিয়ম নীতি তাদের বেলায় খাটে কি
আর ,
কবি কাধে দিয়েছো তুলে সমাজের দায় ভার !

পাল্টে গেছে এই দুনিয়া ,
পাল্টায়নি তো মন -
মনের মাঝে জেগে আছে ,
আঁধার গহীন বন !
____________
© শৈবাল সরকার

।। সব কিছু কবিতা নয় ।।

সেদিন ভোরে দরজা খুলে বেরোবার পর নীলিমা প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল রানী মাসিমার সঙ্গে। তাকে দেখে চমকে উঠে ছিলেন তিনি। ঠোটের পাশটা কেটে গিয়ে একটু ফুলে রয়েছে। থুতনিতেও বেশ কালশিটে। হাঁটার গতি একটু খুঁড়িয়ে ব্যথাতুর।

" আহা রে মেয়ে।  শ্বশুর ভাসুরের সামনে যাবার আগে মুখখানা একটু আড়াল রাখিস...কি হাল করেছে বাছার.....এভাবে কেউ.... একটু ও মায়া নেই গা...সারাটা রাত একটু ও ঘুমোতে দেয়নি বুঝি?"

চোখ দুটি পাথর মেয়েটির। গতকাল তার ফুলশয্যার রাত ছিল। তার সেই অনেকদিনের স্বপ্ন সাজানো রাত। কত কিছুই তো ভেবে রেখেছিল সে বন্ধুদের কাছে নানা গল্পকথা শুনে।

তার বান্ধবী মিতা বলেছিল, সে আর তার বর নাকি সারারাত গান, কবিতা আর অনেক গল্প করেছিল। সাথে কিছু উষ্ণতাও ছিল বৈকি তবে তা  নাকি ভারি মধুর। এছাড়া অনুপমা, শ্রীপর্ণা,সুমেধা, আত্রেয়ী সবার সবার কাছে শুনে শুনে মনে হয়েছিল এই রাত টা বুঝি ভারি সুন্দর আর স্বপ্নমুখর। তবে তার বেলাতেই কেন?  কেন এসব উল্টোপাল্টা?

কালকের ওই  রাতের কথা ভাবলে এখনো গা কেঁপে উঠছে তার। ভাবছে  কি ভাবে সে আজ রাতে আবার  মুখোমুখি হবে ওই ছেলেটির। কিভাবে খেলবে শরীরের খেলা? কিভাবে করবে সংসার তার সাথে? কিভাবে ভালবাসবে তাকে সারাজীবন?  কিভাবে?  সে কি বলে দেবে সব কথা বাইরের সবাইকে? সেটা প্রকাশ করে দেওয়া কি সাহসিকতা? নাকি ঢেকে রাখাই গৌরবের? এই বৈবাহিক ধর্ষন কি  আদৌ শাস্তিযোগ্য?

কই আজ সারাদিন তার মুখে, গলায় এত কালশিটে দেখেও কেউ তো প্রতিবাদ করলো না তার হয়ে?

যা হয় হোক অষ্টমঙ্গলায় বাড়ি গিয়ে মা কে সব বলে দেবে সে। আর ফিরবে না এখানে। এই কটাদিন না হয় দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দেবে।.........................

.......আজ আবার শ্বশুরবাড়ি  ফিরছে নীলিমা। মা কে বলেছিল সব কথা। দেখিয়েছিল গা খুলে তার ভালোবাসার যত ক্ষত।

  মা ব ল্ল, ওসব একটু আধটু হয়।  সব সয়ে যাবে আস্তে আস্তে। একবার বিয়ে হলে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয় মা।

ট্রেণ দাঁড়ালো কি যেন একটা জংশন ষ্টেশানে।

 "তুমি  কিছু খাবে?"তার সামনে সেই অনিন্দ্যসুন্দর কান্তি পুরুষ।  এখন কতো সাবলীল, স্বচ্ছন্দ, সুন্দর আর মায়াময়। কে বলবে যে এই ছেলেটিই রাতের বেলা কি ভীষণ হিংস্র হয়ে ওঠে।

"একটু জল খাব শুধু"। বলে নীলিমা।

সত্যি সয়ে যাবে বোধ হয় একদিন সবকিছু। তাতে কি আছে আস্তে আস্তে না হয় সইয়ে নেবে সবকিছু। কতো কিছু ই তো মেনে নিতে শিখতে হয় মেয়েদের। কি ছেলেমানুষিই না সে করতে যাচ্ছিল সবার সামনে এসব বলে দেবার প্ল্যান ক রে?  ছি: ছি: কি ভাবতো সবাই তার স্বামী কে। তার সব কিছু ঢেকে রাখাই তো তার কর্তব্য।  এমনি করেই একদিন ঠিক মমত্ববোধ তৈরি  হয়ে যাবে দুজনার মধ্যে একসাথে কাটাতে কাটাতে।

ধুর!!! প্রেম বলে আবার কিছু আছে নাকি?  সেও ভারি অবুঝ আর ছেলেমানুষ।  হয়তো ওসব একেবারেই অলীক কল্পনা। সবাই রঙ চড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে তাকে। কিংবা ভারি দুর্লভ আর দুষ্প্রাপ্য কিছু। ওসব সবার ভাগ্যে  কি আর জোটে ?

কিভাবে যেন সময় টা পেরিয়ে তারা গন্তব্যে পৌঁছে যায়। বাঙ্ক থেকে সুটকেশটা নামিয়ে ছেলেটি বলে, "এসে গেছি।।"

নীলিমা নীরবে ছেলেটির পিছুপিছু এগিয়ে চলে।।।।।
____________
© তনিমা হাজরা

।। হলুদ মৃত্তিকার গন্ধ ও মৃতসার কালের ঘোড়া ।।

এখানে প্রাগৈতিহাসিক নৌকায় চড়ে আসে হলুদ মৃত্তিকার গন্ধ,
এখানে নৃতাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ভুলে নীবিড় কাঁচঘরে জীবন করেছে আজীবন মৃত্যুর সাথে সন্ধি;
এখানে মৃত্যুই জীবনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বি...

তবুও মৃত্যুর রিপ্লিকা হাতে আদিম উল্লাসে- এখানে চলে জীবনের উৎসব...
কাদামাটি ফুঁড়ে ঘুরে দাঁড়ায় হেমো স্যাপিয়েন্সের ভেলভেট হাড়।
দাঁড় টেনে ক্লান্ত আমাদের জীবনের মানিক মাঝি-
হাঁপাতে হাঁপাতে সে কংক্রিট চোয়ালে হাসে ক্লীবিয় হাসি...

অন্ধকারে নাচে ডাইনোসরদের বীভৎস কঙ্কাল,
মধুলোটে মধুলেহী মরসুমী মৌয়াল।
তবুও সরিষার হলুদ বনে আনমনে হলুদাভ কাদার
ঐশ্বরীক গন্ধ শোঁকে মৃতসার- কালের ঘোড়া।
সমান্তরাল সেইসব মেঠোপথে সারিসারি হেঁটেছিলো-
এইসব জীবন আর মৃত্যুর টলমলে গাড়ী,
অন্তঃহীন কালের যাত্রায় খুব পাশাপাশি...
______________
© মোশ্ রাফি মুকুল

।। অবুঝ প্রেম ।।

ষাট বছরের বতীন সরকার আজ বিছানায়;ভীষনই অসুস্থ। অসুস্থ সে তার প্রিয়তমার জন্য;৪৪বছর যাকে মনেপ্রানে শুধুই ভালোবেসে গেছে,আপন করে গেছে.....সমাজকে তোয়াক্কা না করে;বাবা মার অনুশাসনকে পরোয়া না করে।এমনকি স্ত্রীকেও উপেক্ষা করে শুধুই অনন্ত প্রেমের নেশায় বিভোর হয়েছিল যাকে ঘিরে-সে আজ তার জীবন থেকে চলে যাচ্ছে;বলা ভাল তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।বিছানায় শুয়ে বিরহী বতীনের স্মৃতিতে উঁকি দেয় তাদের প্রথম সাক্ষাৎ-
পনেরটি বসন্ত পার করে সেদিন সে ষোড়শর্ষীয় যুবক।শরীর মনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল।হৃদয়ের চারপাশে বহু আকাঙ্ক্ষা ঘুরে বেড়াচ্ছিল অবলীলায়।সেরকম এক সন্ধ্যায় তার সাথে বতীনের প্রথম আলাপ।

অনিকেতের জন্মদিনের পার্টি ছিল সেদিন।বন্ধুদের সাথেয় এসেছিল সে।বুকেতে ভয় কাটিয়ে সা্হসের সাথে আপন করেছিল তাকে।এর আগে বহুবার বতীন দেখেছে তাকে-বহু পুরনো বহু পরিচিত  সে।পাড়ার মোড়ে যখন বতীন আড্ডায় ব্যস্ত বা স্কুল গেটের পাশে বা কফিহাউসের সামনে বা বাসস্ট্যাণ্ডে সর্বত্রছিল তার আনাগোনা।তার মোহময় উজ্জ্বলতা উদ্বেলিত করেছিল বতীনকে।তাই পার্টিতে তাকে আপন করতে পেরে বতীন আজ রোমাঞ্চিত-হর্ষিত।

দিন যায়; মাস যায় ;বছর অতিবাহিত হয় তাদের সম্পর্কও মধুর থেকে মধুরময় হয়ে ওঠে।জীবনের প্রতিটি ধাপে সে বতীনের পাশে থেকে বৈতরণী পার করেছে।সেদিন বি.এ পরীক্ষায় ভূগোলে মার্কস কম হওয়ায় কতটা ভেঙে পড়েছিল বতীন।কিন্তু সে এসে তার বিহরতা কাটিয়েছিল।পাড়ার ম্যাচে যেদিন সর্বোচ্চ রান করেছিল কতইনা আনন্দে মেতেছিল তারা বা সেদিন যখন বন্ধু সায়ন হঠাৎ মারা যায়;কিভাবে মেন্টাল সাপোর্ট  দিয়েছিল বতীনকে। আর সেই দিনটা, যেদিন মা প্রথম জানতে পেরেছিল  তাদের সম্পর্কটা-কতই না বকেছিল কিন্তু পরে বুঝিয়েছিল।কিন্তু পারেনি বতীন তাকে ছাড়তে;বরং ভালবাসা  আরো গভীর হয়ে উঠেছিল।বতীন যেদিন বিয়ে করতে রাজী হয়নি কি অদ্ভুত  ভাবে সে তাকে বিয়ের পিড়ির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।আর সেই দিনটা যেদিন বতীন প্রথম বাবা হল-এক অদ্ভুত  আনন্দে আলিঙ্গন করেছিল তাকে।জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে তাদের প্রেম হয়ে উঠেছিল অনাবিল।

এভাবে সমাজকে তোয়াক্কা না করে;স্ত্রীকে অবজ্ঞা করে বতীন শুধু তাকেই আপন করেছে।লুকিয়ে লুকিয়ে তার সাথে আলাপচারিতার আনন্দ;গোপন প্রেম রোমাঞ্চিত করত বতীনকে।আজও ভুলতে পারেনা হৃদয় মন তোলপাড় করা তাদের প্রথম চুম্বন।

কিন্তু আজ কোনভাবেই এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় নইলে মৃত্যু অবধারিত।তাকে ছাড়া এ জীবনের দাম কী?তার বিরহে বাঁচা.....সে তো মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণাদায়ক।সব জেনেও বতীন মৃত্যুকে বরণ  করতে রাজী তবু তাকে নয়। এমনই এক সন্ধ্যায় যখন বতীন তার সাথে গভীর আলাপে মগ্ন;তার ছেলে অতনু দেখে ফেলে তাদের।ভয়ে লজ্জায় মুছরে যায় বতীন।কিন্তু আর না;আজ অতনু তাদের বিচ্ছেদ ঘটাবেয়।কারন সে বাবাকে হারাতে চায়না।তাই তাকে জোর করে টেনেএনে ঘারধাক্কা দেয় রাস্তায়।ঘরের ভিতর থেকে বতীন দেখে সে রাস্তায় মুখ থুবরে পরে আছে।এক অব্যক্ত কান্না অশ্রু হয়ে ঝড়তে থাকে বতীনের চোখ থেকে।যেন কেও তার হৃদয় উপরে নিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে বতীনের দিকে
তার গায়ে জ্বলজ্বল  করছে.......স্মোকিং ইজ ইনজিরিয়র টু হেলথ।
_______
© ব্রততী 

।। বিবেকানন্দের হাসি ।।

       সকাল সাতটা দশ । ঘুম থেকে উঠে খানিক আড়মোড়া ভাঙলো কাল্টু ৷ জিভটা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ৷ ঢেঁকুরের সঙ্গে কিছুটা পিত্তি মেশানো তেতো জল উঠে এলো মুখে | বিকৃত মুখে সেটা জানলা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলো সে ! পাশের টেবিলে রাখা প্রায় খালি হয়ে আসা মদের বোতলটা কাত করে পুরো ঢেলে দিলো গলায় ৷ রেল কলোনীর বস্তির মা তুলে একটা অশ্রাব্য গাল পাড়লো | এই বস্তিতেই সে আছে আজ বছর পাঁচেক ৷ তড়াক করে খাট থেকে নেবে দড়িতে ঝোলানো গামছাটা তুলে নিলো | আজ সকালে একটা ছোট কাজ আছে | একটা বুড়ো মাস্টারকে একটু শায়েস্তা করতে হবে ৷ বেশি কিছু না, একটা হাত আর একটা পা ভাঙতে হবে | সেই পুরোনো বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটে কেস | বুড়ো মাস্টারটা কিছুতেই নাকি ঘর ছাড়ছে না। রাতে সে দশ হাজার টাকা পেয়েছে  মিতুলদার কাছ থেকে | মাস্টারের বাড়ির মালিক হলো মিতুলদা | মিতুল নন্দী | কাজ হয়ে গেলে আরও দশ হাজার দেবে বলেছে |  শালা... লাখ লাখ টাকার মালিক শয়তানটা !

      আজ বেশ সকাল সকালই উঠেছেন মানববাবু | মনটা আজ বেশ ফুরফুরে | আজ ১২ই জানুয়ারী, স্বামী  বিবেকানন্দের জন্মদিন ৷ স্কুলে থাকাকালীন প্রতিবছরই তিনি এই দিনটায় ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতেন | আজ মাস ছয় হলো তিনি রিটায়ার করেছেন ৷ ছাত্রদের কথা খুব মনে পড়েছ আজ | বাজার করে একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসবেন ঠিক করলেন ৷ বেশি দূর নয় ... ঘণ্টাখানেকের রাস্তা | পাশে নীতা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ৷ তার রিটায়ারমেন্টের পর নীতার ঘুমটা বেড়ে গেছে আগের থেকে | স্কুলে যাওয়ার নেই বলে সকালে উঠে রান্নাবান্নার তাড়াও নেই | নিঃসন্তান দম্পতি ওরা ৷ বউয়ের মায়ামাখা মুখের দিকে চেয়ে হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মানববাবু  | সকালের চা টা তিনিই করেন বরাবর | অালতো একটা আড়মোড়া ভেঙে মশারী তুলে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন তিনি |

      বিনোদ আজ পাঁচ বছর হলো গ্র্যাজুয়েশন করে ঘরে বসে আসে | ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়েছিলো সে | রেজাল্ট ও খারাপ করেনি | ৫২%  নম্বর পেয়েছিল সে গ্র্যাজুয়েশনে ৷ নিয়মিত সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে ৷ কিন্তু পাশ করতে পারছে না | প্রিলিম পাশ করেছিল দুটোয়, কিন্তু মেন এ গিয়ে আটকে গেছে ৷ প্রাইভেট চাকরিরও চেষ্টা করেছিল দু একটা কিন্তু কোনটা টেই সে ২ মাসের  বেশি টিকটে পারে নি । আজ সকালে রাকেশের সাথে দেখা করবে বলেছে ও | ক্লাবের মাঠে বিবেকানন্দের মূর্তির পাশে সকাল আটটায় থাকবে বলেছে রাকেশ | লোকাল কাউন্সিলার বিজয়দা ওদের একটা জায়গায় রেফার করবেন বলেছেন... | ছোটখাট যা পাওয়া যায় তাই-ই করবে সে মনস্থির করে নিয়েছে | নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো !  সকাল নটায় সময় দিয়েছেন বিজয়দা | একটু তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো | আজ আবার অনেক জায়গায় নানা অনুষ্ঠান... I কোথাও বেরিয়ে গেলেই কেলো হয়ে যাবে | কলঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ নেই | মা বোধহয় রান্নাঘরে | কেরানীর চাকরি করা  বাবা বাজারে গেছে বোধহয় ৷ কলঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো বিনোদ |

       বাজার যাবার পথেই পড়ে ক্লাবের মাঠটা | চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা ৷ মাঝখানে একটা বিবেকানন্দের আবক্ষ মূর্তি | আজ মূর্তিটাকে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে ৷ মালা আর ফুল দিয়ে সবাই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে গেছেন একটু আগেই মনে হচেছ | খুব ভালো লাগছে | মাঠে লোকজন নেই তেমন | শুধু একটু দুরে বছর পঁচিশের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে নীল সোয়েটার গায়ে দিয়ে | মানববাবু বিবেকানন্দের মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন টান টান শরীরে | একদৃষ্টে চেয়ে আছেন তিনি মূর্তিটার দিকে | গতকাল মিতুল বাবুর সাথে ঝামেলাটা মনে পড়ে গেলো | অনেক দিন ধরে তাদের বাড়ির মালিক মিতুল বাবু তাদের তুলে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন | কাল উনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন না উঠলে তাদের দেখে নেবেন ! এই বুড়ো বয়েসে এত দিনের প্রিয় বাড়িটা ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন তাই ভাবতে লাগলেন এক মনে |

       পায়ে হঠাৎ একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করলেন মানববাবু | পড়ে যেতে যেতে দেখলেন নীল সোয়েটার পড়া ছেলেটি বিহ্বল দৃষ্টি তে চেয়ে আছে তার দিকে ৷ মাথার পিছনে বেশ জোরেই লাগলো | ওঠার চেষ্টা করতেই লোকটা মুখ দিয়ে একটা অদ্ভূত শব্দ করে ডান হাতটা তার মুচড়ে ধরলো পেছন দিকে | চোখে অন্ধকার দেখালেন মাস্টারমশাই | হাতটা তার ভেঙে যাবে বলে মনে হচ্ছে | পিঠে সজোরে একটা লাথি এসে পড়লো | ধনুকের মতো বেঁকে গেলেন তিনি | লোকটার হাতে একটা বাঁশ | বাশঁটা তুলে ধরেছে লোকটা তার কোমর লক্ষ্য করে ৷ চোখ বুজিয়ে ফেললেন ...মনে পড়ে গেলো নীতার মায়ামাখা মুখখানি ! কিন্তু কই... মারলো না তো লোকটা | চোখ চাইতেই  দেখলেন এক অদ্ভূত দৃশ্য | লোকটার হাত থেকে বাশঁটা খসে পড়েছে ৷ দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরেছে সে | রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখটা খুনীটার | আর পিছনে একটা থান ইট হাতে দাঁড়িয়ে সেই নীল সোয়েটার | ধপাস করে কাটা কলাগাছের মতো মুখ থুবড়ে পড়লো খুনীটা |
- " রাজেস... স্যার কে তোল‌ !"
পিছন থেকে সমবয়সী আর একটা ছেলে এসে তোলার চেষ্টা করলো তাঁকে | ইট-টা ফেলে দিয়ে বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য হাত লাগালো বিনোদ |
-" তাড়াতাড়ি কর ! শয়তানটার জ্ঞান ফেরার আগেই পালাতে হবে..." !
দুই নরেনের কাঁধে ভর করে যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন মানববাবু, একবার পিছন ফিরে তাকালেন বিবেকানন্দের মূর্তিটার দিকে ৷ স্পষ্ট দেখতে পেলেন মূর্তিটা মৃদু মৃদু হাসছে... ঠোঁটের কোণ দিয়ে ঝরে পড়ছে যেন নিখাদ পরিতৃপ্তি ...
______________
© ফিরোজ আখতার

Monday, 9 January 2017

।। আফ্রোদিতি, রেহাই দাও এবার ।।

আফ্রোদিতি, তুমি আর কতোকাল ঘোরাবে
মিথ্যে প্রলোভনে;
আমি নার্সিসাস নই, ইকোকে করিনি প্রত্যাখ্যান।

অথচ তুমি কি নিষ্ঠুর !
মেতেছো আমাকে নিয়ে হৃদয়হীন খেলায়।
ভগ্ন হৃদয় কোনোরকম
দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই; আবার
ভাঙো মন যেন মূল্যহীন।

আমি পারছি না আর
আফ্রোদিতি, রেহাই দাও এবার।
_____________
© জিসান জিবরান

।। ঢালাই মেশিন ।।

ছেলেটা মুক্তি খুঁজছিলো
না তুমি যা ভাবছো তা নয়
চিন্তার মুক্তি..
হাজার হাজার বছর ধরে বুকে জমানো
ছটফটানি থেকে মুক্তি।
ঢালাই মেশিন যেমন
চুন, সুড়কি, বালি, সিমেন্ট সব এক এক করে
মিশিয়ে ঘেটে ঘ করে
ঠিক তেমনি ছেলেটাও
তার সেইসব না বলা অনুভূতি গুলো
জড়ো করতে লাগলো।
একটা থম মারা সন্ধ্যা, কিছুটা বিষণ্ণ রাত,
দু একটা তারার অশ্রুপাত,
বুনো ঝোপের বুকে জমে থাকা অন্ধকার,
মাকড়শা জালে জমা ভোরের শিশির,
জোনাকির দীর্ঘশ্বাস, দূর থেকে ভেসে আসা
সেই কবেকার সব মনে পড়ানো  সুর,
হারিয়ে যাওয়া সেই সব আবছায়া মুখ
সব এক করে জড়ো করে
আপনমনে মিশিয়ে চললো।
অবশেষে জন্ম নিল
অনুভূতির জমাট মশলার নির্যাস।
ছেলেটা তা দিয়ে চোখধাঁধানো অট্টালিকা বানালো,
বেশ জমজমাট গৃহপ্রবেশের আয়োজন করেছিলো..
আমি গেছিলাম সেদিন
গিয়ে দেখলাম পাগলাটা
বাড়ির নাম দিয়েছে, " স্মৃতি"।
______
©রৌণক

।। কুহেলী ।।

(১)

ধরা যাক ছেলেটির নাম নেই।

মেয়েটির নাম আপনাদের বলছি না যদি আপনারা চিনে ফেলেন!

তারা দুজনে চাকরী করে এক অফিসে, যদিও ডিপার্টমেন্ট আলাদা। পদমর্যদায় মেয়েটি সিনিয়ার। তবে দুজনের বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় তাদের প্রায় রোজ দেখা হতো।
যাতায়াতের পথে, অটোর লাইনে, মেট্রো রেলের কামড়ায় তাদের সাক্ষাৎ হতো। তাছাড়া common cafeteria তে লাঞ্চ আওয়ারেও অনেক সময়.....

যাই হোক, মেয়েটি ছেলেটির থেকে বয়েসেও সিনিয়ার ( মেয়েদের বয়স জানতে নেই বলে ছেলেটি কোনদিন জানতে পারেনি সঠিক পার্থক্যটা ঠিক কত) এবং বিবাহিতা। একটি সন্তানও আছে। এবং তার গর্ব  ছিলো যে সে তার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার জন্য  নিজের ঘর বাড়ি সব ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছিলো। মেয়েটির আর্থিক সাচ্ছল্য ছিলো, কিন্তু ছেলে ইস্কুলে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে একা থাকতে চাইতো না বলেই সে এই চাকরী নিয়েছিলো।

অনেক সময় এমন হয়েছে যে সে আর ছেলেটি এক অটোয় চড়েছে বা এক সাথে লাঞ্চ করতে বেড়িয়েছে। টাকা পয়সা সেই মেয়েটিই খরচ করতো.... ছেলেটিকে খরচ করতে দিতো না।
ছেলেটি মেয়েটিকে সিনিয়ার দিদি বলেই মেনে নিয়েছিলো। তার সেই পাতানো "দিদি" টিকে সে অনেক ব্যক্তিগত কথাও বলতো। এর ফলে সেই মেয়েটি তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতো।

ছেলেটি এবং মেয়েটির বন্ধুত্ব বেশ চলছিলো। সেটা মুঠোফোনের এই সহজলভ্যতার ঠিক পূর্বযুগ। মেয়েটির একটা বেশ সুদৃশ্য মুঠোফোন ছিলো। ছেলেটি একদিন লাঞ্চ ব্রেকের সময় তার দিদি-বন্ধুকে লজ্জার মাথা খেয়ে বললেই ফেললো, " দিদি, আমি একটা মোবাইল নেব ভাবছি, কিন্তু ওই ব্যাপারে আমি প্রায় কিছুই জানিনা। আপনি আমায় একটু এই ব্যাপারে সাহায্য করবেন? "

" ও মা, মোবাইল নেবে?  কোন কোম্পানীর নেবে?  এখন এন্টেনা ছাড়া যেগুলি বেরিয়েছে, সেই রকম একটা নাও। ওগুলোই বেশ ট্রেন্ডি।"

" হ্যা, কিন্তু আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানিনা...."

" আরে, আমি ঠিক গাইড করবো তোমাকে, চিন্তা করো না।"

শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো যে এক শণিবার ছুটির পর ধর্মতলার ময়দান ক্যান্টিনে বসে মোগলাই পরোটা দিয়ে টিফিন করতে করতে মুঠোফোন সংক্রান্ত টিউটোরিয়াল ক্লাস হবে।

নির্ধারিত সময় দুজনে উপস্থিত হলেন ময়দান ক্যান্টিনে।

বিশাল বড়ো আকৃতির পেডেস্টাল ফ্যানটার সামনে দুজনে বসে কড়া মোগলাই এর ফরমাস দিয়ে শুরু হলো টিউটোরিয়াল ক্লাস।

দুজনেই মাথা নীচু করে মুঠোফোনের স্ক্রীনে চোখ রেখে বসলেন।
ছাত্রের চোখে  নতুন জিনিশ শেখার আগ্রহ........ শিক্ষিকা....
বলা হয় স্ত্রী চরিত্র দেবতারাও বুঝতে পারেন না। ছেলেটিও বুঝতে পারেনি সে কোন দিকে চালিত হচ্ছে।

তার চোখের পর্দায় খালি একটা গোলাপী ফর্সা হাতের তালুর উপর রাখা ছাই রঙ এর মুঠোফোনের সবুজ স্ক্রীন।
স্ক্রীনের উপর ফুটে ওঠা লেখা গুলো ধীরে ধীরে মগজে তুলে নিচ্ছিল ছেলেটা, বাধ সাধলো ক্যান্টীনের ছোকরা চাকরটা।
"দুটো কড়া মোগলাই।" বাঁজখাই গললার চীৎকারে চমক ভাঙে তার।
হাত বাড়িয়ে প্লেট দুটো টেনে নিতে নিতে চোখ গেলো ডান পাশে বসা তার দিদি-বন্ধুর দিকে।
আগে খেয়াল করেনি, অন্যদিনের সালোয়ার এর বদলে মেয়েটির পরণে একটা গোলাপী শাড়ি। হাল্কা মেহগণীর ছোয়া লাগানো কোকড়া চুল পাখার হাওয়ায় ইতস্তত উড়ছে। ফর্সা, খুব ফর্সা গোলাপী পান পাতা মুখের বাদামী চোখগুলি এক দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে। ঠোঁটের হাল্কা গোলাপী মোম রঙ একটু আধটু উঠে যাওয়ার কারণে তাদের আকর্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ছেলেটি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। কিন্তু কোন এক অজানা আকর্ষক ক্ষমতা তার চোখদুটো টেনে নিয়ে যায় মেয়েটির দেহের অনাবৃত অংশের দিকে। না চাইলেও চোখ চলে যায় লম্বা সোনার চেনের আগায় ঝোলা ছোট্ট লকেটটির দিকে......

(২)

সোনার লকেটখানার অর্ধেকটা লুকিয়ে ছিল মেয়েটির দেহের ভাজে। সেই স্থানের পানে কোন পুরুষের দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকা অশোভনীয়। কিন্তু ছেলেটির চোখ ঠিক সেই স্থানেই আটকে গিয়েছিল। এবং  এমন ভাবে আটকে গিয়েছিলো যে সে আর বাকি সব কিছু ভুলে গিয়েছিলো।
সম্বিত ফিরে পেলো মেয়েটির প্রশ্নে, " কি দেখছো অমন করে? "
" দিদি, আপনাকে শাড়ি পরে খুব ভালো লাগে। আপনি কেন যে সালোয়ার পরেন? "
"শাড়ি সামলে কোলকাতার রাস্তায় চলা ফেরা খুব ঝামেলার। তাই পরি না। তোমার ভালো লেগেছে? "
" মার্ভেলাস.... জামাইবাবু এটা কিনে দিয়েছেন বুঝি? "
" তোমার জামাইবাবুর কি আর সময় আছে?  তিনি তো ব্যাবসার কাজে হিল্লি দিল্লী করেই ব্যস্ত। আমি কি পরলাম, না পরলাম সে নিয়ে তার কোন হুশ নেই। আমি নিজেই কিনেছি। সুন্দর হয়েছে? "
"অপূর্ব.... আপনার ফর্সা রঙে আরো ভালো লাগছে।"
" আরে, আজ তো এটা পরাই হতো না। ম্যাচিং ব্লাউজ পাচ্ছিলাম না....  অতি কষ্টে এটা খুজে পেলাম। তাও টাইট.... দেখো কেমন চেপে বসে আছে..... "

ছেলেটি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো।

মোগলাই পরোটার প্লেট শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা। মেট্রো রেলে একসাথে বেশ খানিকটা যাওয়া যেত, অন্য দিনের মতো, কিন্তু ছেলেটির ইচ্ছে করলো না। সে একটু ইতস্তত করে বললো, " দিদি, আমায় আজ একটু চাঁদনী  ঘুরে যেতে হবে, আপনি এগিয়ে যান, আমি পরের মেট্রো ধরবো।"

 এই বলেই, উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ছেলেটি রাস্তা পেড়িয়ে এগিয়ে গেলো গ্রান্ড হোটেলের দিকে।
 রাস্তা পেড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মত এগিয়ে গেলো  ধর্মতলা স্ট্রীটের  দিকে। একটা বিশাল শপিং কমপ্লেক্স বানানো হচ্ছে বলে মোড়ের বাড়িটা বাঁশ আর তেরপলের আড়ালে। সেই বিল্ডিং এর শিড়িগুলো মানুষের বসার জায়গা.... অফিস ফেরতা অনেকেই বসে চা-সিগারেট এ কিছু সময় ব্যয় করে। ছেলেটি সেই শিড়িতে বসে পকেট থেকে চ্যান্সেলারের প্যাকেটটা বের করলো।

সিগারেটে পর পর কয়েকটা দ্রুত টান দেওয়ার পর ছেলেটি চোখ বন্ধ করে সেদিন বিকেলের ঘটনাবলি ভাবতে লাগলো।
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তার মনে ভেসে আসছিলো সেই গোলাপী আঁটো সাঁটো পোশাকে মোড়া তার "দিদি- বন্ধু"র দেহাংশ..... এক অদ্ভুত অজানা আনন্দে তার মন ভরে উঠছিলো। এবং প্রাথমিক লজ্জা, জড়তা কাটিয়ে উঠে সে এখন সেই "দৃশ্য" গুলি উপভোগ করতে শুরু করলো।

মনের মধ্যে যা recorded, সেই দৃশ্যগুলি বারবার rewind করতে লাগলো যাতে ভুলে না যায়.....
 এবং প্রতি বার তার কল্পনায় সে সাহসী হয়ে উঠতে লাগলো...
একটু একটু করে.....

যথারীতি সোমবার এলো। অটোর লাইনে সে অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই দাড়ালো। ইচ্ছে ছিলো তার "দিদি-বন্ধু"র সাথে যাওয়ার। কিন্তু পর পর বেশ কয়েকটা অটো ছেড়ে দেওয়ার পরও তার দেখা মিললো না।
অফিসে পৌছে তার কাজে মন বসছিলো না। ঘন ঘন জল পান আর toilet এ যাওয়ার মাঝে তার মন জুড়ে ছিলো লাঞ্চ ব্রেকে তার "দিদি-বন্ধু".... পাছে কিছু ভুল করে ফেলে তাই সে খুব জরুরী কোন ফাইলে হাত দিচ্ছিল না। প্রধানত সে তার ডেস্কের কাগজপত্র উদ্দেশ্যহীন ভাবে নাড়া চাড়া করছিলো সময় কাটানোর জন্য।

অবশেষে লাঞ্চ ব্রেক এবং ক্যাফেটেরিয়া।

কিন্তু সেখানেও তাকে হতাশ হতে হলো। তার "দিদি-বন্ধু" কে সে সেখানেও খুজে পেলো না।
বুক ঠুকে সে হাজির হলো সেই মেয়েটির অফিসে... যদি কাজের চাপে...  কিন্তু না, সেখানে খবর পেলো যে তার "দিদি-বন্ধু" সেদিন আসেনি।

শুধু সেইদিন না। পর পর তিনদিন ছেলেটি হতাশ হলো।

 প্রাথমিক হতাশার পর চিন্তা হতে শুরু করলো। কেন তার "দিদি-বন্ধু" কামাই করছে?  শরীর খারাপ?  ছেলে অসুস্থ?  বরের সাথে বাইরে বেড়াতে গেছে?  চাকরী ছেড়ে দিয়েছে?

আগেই বলেছি ছেলেটির মুঠোফোন ছিলো না। মেয়েটির মুঠোফোন থাকলেও সেটার সাথে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা জ্ঞান ছেলেটির ছিলো না।

মেয়েটির বাড়ি ছেলেটির পাড়ায় নয়। তবে কাছা কাছি। কিন্তু সঠিক ঠিকানা না জানার কারণে সে তার বাড়িও যেতে পারছিলো না।

মোদ্দা কথা ছেলেটির মন জুড়ে সেই মেয়েটি.... বিরাজ করছিলো। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, প্রেম....  তার চেয়েও বড় একটা আকর্ষণ ছেলেটিকে বাধ্য করছিলো মেয়েটির সম্পর্কে চিন্তা করতে, স্বপ্ন দেখতে..... এক অজানা খিদে তার মন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো।
সেই খিদের সাথে সে তার ২৪ বছর বয়সে আগে কখনো পরিচিত হয়নি।
সেই খিদে তাকে বাধ্য করছিলো তার এতদিনকার "দিদি-বন্ধু" কে শুধু "বন্ধু" ভাবতে।

(৩)

মেয়েটির দর্শন পেতে ছেলেটিকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। প্রায় দশ দিন পর হঠাৎ ছেলেটি আবিস্কার করে যে মেট্রোরেলের কামড়ার এক কোণে সে দাঁড়িয়ে আছে। কামড়ায় হাল্কা ভীর ছিলো, তবুও ছেলেটি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলো।

কাছে গিয়ে পৌছতেই মেয়েটি তার দিকে ফিরে তাকায়।
ছেলেটি সেই দৃষ্টির সামনে গুটিয়ে যায়। এতদিন ধরে সে যা যা বলবে বলে ঠিক করেছিলো, সব কেমন যেন সেই কটা চোখের মোহময়ী চাউনিতে গুলিয়ে যায়। নিজের অজান্তেই ছেলেটির গলা দিয়ে অস্পষ্ট জড়ানো কিছু শব্দ বেড়িয়ে আসে।

"তুমি কি আমায় এখনো দিদি ডাকবে?" মেয়েটি দ্বিধহীন ভাবে জিজ্ঞেস করে।

সঠিক উত্তর কি হতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতে তাদের নির্দিষ্ট স্টেশান এসে যায় এবং ছেলেটি নেশাগ্রস্তের মতো মেয়েটির পিছু পিছু ট্রেন থেকে নেমে যায়।
একটা ঘোড়ের মধ্যে দিয়ে ছেলেটি মেয়েটির পিছু পিছু রাস্তায় বেড়িয়ে আসে।
বাকি পথ ছেলেটি কিছু আর বলার সুযোগ পায়না।
নিজের অফিসের দিকে যেতে যেতে মেয়েটি ছেলেটির দিকে ফিরে বলে, " ছুটির পর কথা আছে। এক সাথে ফিরবো। আগে আগে পালিও না কিন্তু! "

উত্তরে ছেলেটির  মুখ দিয়ে শুধু একটা বোবা শব্দ বের হয়।

সারাদিন কাজের ব্যস্ততার মধ্যে ছেলেটি  সকালে শোনা শব্দগুলি বিশ্লেষণ করতে থাকে।

একটা মেয়ে, তার থেকে বয়সে বড়ো, বিবাহিতা, এক সন্তানের জননী, কিছুদিন আগেই তাকে নিজের দেহ সৌষ্ঠব দেখার আহ্বান করেছিলো, আজ তাকে বলছে যে এতদিনের "দিদি" ডাক তাকে ছাড়তে হবে।

এর অর্থ কি হতে পারে?

মেয়েটি কি তাকে ভালোবাসে?  কিন্তু এই ভালোবাসার অর্থ কি?  তার দিক থেকেই বা এই ভালোবাসার প্রতিদানে কি কিছু করা সম্ভব?  তাছাড়া যে সামাজিক প্রেক্ষিতে সে বড়ো হয়েছে, সেখানে এধরনের সম্পর্ক ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। তবে...... হ্যা, তবে আজ যদি সে মেয়েটির ডাকে সাড়া দেয়, তাহলে ক্ষতি কিছু আছে কি?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ছুটির সময় হয়ে গেছিলো ছেলেটি খেয়াল করেনি। অফিস থেকে বেড়োতেই দেখে যে মেয়েটি লিফটের সামনে অপেক্ষা করে আছে।

সিঁদুর রঙা শিফনের শাড়িতে তার রূপ যেন শেষ বিকেলের সূর্যকেও ম্লান করে দিচ্ছে। গোলাপী ফর্সা গালদুটি কাশ্মীরের আপেলকে হার মানিয়ে দেবে যেন। শরীরের গঠন হাল্কা চর্বির প্রলেপ পেয়ে যেন আরো আকর্ষনীয় হয়ে  উঠেছে.....  আর তার চোখ!!

ছেলেটি সেই কটা চোখের মায়াজালে হারিয়ে যেতে যেতে এগোতে লাগলো। সেই গোলাপী ঠোটের ফাঁকে মুক্তোর মত সাদা দাঁতের হাসির আকর্ষন তাকে যেন হাতছানি দিতে লাগলো এক অজানা দুনীয়ার পানে। মেয়েটির গোলাপী গালের টোলের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে ছেলেটি লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো।

লিফটের ঠাসা ভিড়ে দুজনে কোন মতে এটে গেলো। লিফট চালু হওয়ার পর ছেলেটি দুটো জিনিশ আবিস্কার করলো।
 প্রথমত লিফটটা নীচে নামার বদলে উপরে উঠছে, অর্থাৎ তাদের ফোর্থ ফ্লোর থেকে টুয়েল্ফথ ফ্লোর অবধি উঠতে হবে এবং তার পর নীচে নামতে হবে এবং তাতে প্রায়  তিরিশ  মিনিট সময় লাগবে।
দ্বিতীয়ত, মেয়েটি তার শরীরের সাথে একবারে সেঁটে দাড়িয়েছে।

তার ফলে আগামী আধ ঘন্টা তার শরীরটা আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকছে না......

ছেলেটি চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চিপে এই অত্যাচার সহ্য করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলো.....

লিফটটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌছনো মাত্র ছেলেটি ছিটকে বেড়িয়ে গেলো..... বিল্ডিং এর বাইরে বেরিয়ে সে বুক ভরে শ্বাস নিলো। এতক্ষণের  বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে তার স্বস্তি হলো। এ যেন  বাঘিনীর খাঁচায় দীর্ঘ তিরিশটা মিনিট কাটানো।

প্রতি সেকেন্ড এক একটা ঘন্টার থেকেও লম্বা....  তার ওপর সেই বাঘিনীর জিহ্বা এবং থাবার আক্রমণ......

 প্রাণ হাতে করে কাটানো তিরিশ মিনিট যেন এক ধাক্কায় ছেলেটির বয়স বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিলো।

বিল্ডিং থেকে বেড়িয়েই ছেলেটি কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোয়া গিলে একটু ধাতস্থ হয়েই সে সংকল্প নেয় যে চাকরিটা পাল্টাতে হবে.....


(সমাপ্ত)
______________
© অভিজিৎ মুখার্জী