Wednesday, 7 December 2016

।। গেছো দাদার যাত্রা কাহিনী- পানিত্রাসের পথে ।।


চন্দ্রবিন্দু থাকলে হয়ত বলত-

- পিকনিক করবেন! তা পানিত্রাস গেলেই পারো
আপনি বলতেই পারেন সুকুমারী ঢঙে, যাব বলতেই তো আর যাওয়া যায়না।
চন্দ্রবিন্দুর জবাব হত কলকেতা- হাওড়া ষ্টেশন- উলুবেড়ে- দেউলটি ব্যাস ।

আপনি বলতেন কি করে যেতে হয় তুমি জানো?

চন্দ্রবিন্দুর জবাব- উহুঁ সে আমার কর্ম নয় । আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তাহলে সে ঠিক বলতে পারত । আর কেনা জানে গেছ দাদার একটা ঠিকানা উলুবেড়েও বটে।

গেছোদাদার মত আমাদেরও সকলেরই আজকাল সময়ের প্রচুর দাম। তাই আমিই খানিকটা গেছো দাদার ভূমিকায়, মতিহারি বা রামকেষ্টপুরে গিয়ে সময় নষ্ট না করে, সোজা উলুবেড়ে পেড়িয়ে খানিকটা আবোলতাবোল লিখে ফেললাম অনেক হাঙ্গামা করে। বিশ্বাস নাহয় পড়েই দেখুন-

হাতে মাত্র ২০ টা দিন বাকি পিকনিকের, শীতটাও গাঙ্গেয় বঙ্গে আজথেকেই অনুভুত হচ্ছে। এতো গুলো মানুষ আসবেন আমাদের উপরে অকপট ভরসা করে। বন্ধু, বান্ধবী আত্মীয় পরিজন সকলকে সাথে নিয়ে। অতএব আমাদের একটা গুরুদায়িত্ব থেকেই যায়। আয়োজনের সিংহভাগ দায়িত্বটাই অবশ্য আমাদের সুব্রতর ভরষাযোগ্য কাঁধে অর্পন করে আমরা বাকিরা সম্পূর্ন চিন্তামুক্ত ফুরফুরে। কিন্তু তারপরেও একটিবার স্পটটা যেন চর্মচক্ষুতে না দেখলেই হচ্ছিলনা।

যেমনটি ভাবা ঠিক তেমনটি অবশ্য শুরু হলনা।

অফিস আদালতের কাজ সেরে হাঁটা জুড়লাম শিপিং এর লঞ্চঘাটে, ঘড়িতে তখন বেলা ১ টা দশ। কুয়াশার কারণে বহু দুরপাল্লার ট্রেন বাতিলের দরুন স্টেশনে থিকথিকে ভিড়। বহু মানুষ বড় ঘড়ির নীচে অপেক্ষারত। আমাদের সদস্যদের জন্যও ওই বড় ঘড়ির নীচে অপেক্ষার ব্যবস্থা করলে ভালই হয়। যাতে এক একটা ছোট ছোট দল করে, ওই একঘন্টার জার্নিকে গল্পগুজবে অর্ধেক করতে, ট্রেনে একসাথে যেতেই পারেন দেউলটি।

টিকিট কেটে স্টেশনে ঢুকেই দেখি ১৩ নং প্ল্যাটফর্মে একটা পঁয়ত্রিশের মেদিনীপুর লোকাল ছাড়ার ঘোষণা বিলবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু তখন অলরেডি ঘড়িতে একটা বিয়াল্লিস, বাকি অপেক্ষারত যাত্রীদের জন্য দুর্ভাগ্য হলেও, আমার জন্য সৌভাগ্যের কারণ হল, প্ল্যাটফর্মে তখনও ট্রেন ঢোকেইনি। ট্রেন ঢুকলো ঠিক দুপর একটা পঞ্চাশে, ততক্ষনে ১৪ নং প্লাটফর্মে একটা পঞ্চান্নর পাঁশকুড়া লোকালেরও খবর হয়ে গেছে। যাই হোক দুটো বাজতে তিন মিনিট বাকি থাকতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। প্রসঙ্গত হাওড়া থেকে দেউলটি যাবার ট্রেনগুলো ৯ থেকে ১৪ নং প্ল্যাটফর্মের মধ্য থেকেই ছাড়ে। প্রচুর লোকাল ট্রেন থাকে। একটিবার চেক করে নিতেই পারেন এই ঠিকানাতে-

http://indiarailinfo.com/search/howrah-hwh-to-deulti-dte/1/0/5981

অফিস টাইমে হাওড়ামুখী ডাউন ট্রেনে ভিড় থাকে আর সন্ধ্যাবেলা হাওড়া থেকে ছেড়ে যাওয়া আপ ট্রেনগুলোতে। আমার যাত্রা পথ সেই নিরিখে উল্টোদিকের উল্টো সময়ের। তাই মোটামুটিভাবে ফাঁকাই ছিল ট্রেন, সিট পেতে অসুবিধা হয়নি। সকালে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম ভোর সাড়ে পাঁচটার সময়। তখন ভারী কুয়াশা আর বেশ শীত শীত ভাব, গায়ে একটা পাতলা ট্রাকসুট কাপড়ের জ্যাকেট আর টুপি ছিল। কিন্তু কোলকাতাতে দুটো ঋতু, বর্ষা আর গ্রীষ্ম। সেই গ্রীষ্ম বা গরমকাল গোটা তিনেক ভাগে বিভক্ত, যথাঃ অসহ্য গরম, মোটামুটি গরম আর গরম নেই। এটা সেই নেই গরম কাল, তাই টুপি ব্যাগে ঢোকালেও জ্যাকেট গায়েই ছিল। আর এই কলেবরে খাটো নয়, তিন মন প্রায় ওজনলাশটা বয়ে নিয়ে বেশ খানিকটা হাঁটাচলা করতেই ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে ট্রেনে উঠলাম।

সামনে সিটে দুই ভদ্রলোক জানালার ধারে বসে গন্তব্যের দিকে মুখ করে। গালে খোঁচা দাড়িওয়ালা কালো মতন ছোটখাটো লোকটা, ঢুলতে ঢুলতে প্রায় ঘুমিয়েই গেছেন। আরেকজনও ছোটখাটো ফর্সা মানুষ কিন্তু মুখভর্তি মেচেতা। তিনি কিছু একটা ফর্দের উপর গভীর মনঃসংযোগ করে বসে ছিলেন। ট্রেনে এভাবে মিনিটের মধ্যে ঘুমাতে পারাটা একটা মহান শিল্প নিঃসন্দেহে, আর আমার সামনের ভদ্রলোক সেই শিল্পের নিখুঁত শিল্পী তা বলাই বাহুল্য। দুইজনই ছোট দোকান চালান সম্ভবত, মঙ্গলাহাট থেকে তাদের কেনা, বেশ কিছু মালের ব্যাগে, উপরের বাঙ্কার তো ভর্তিই, পায়ের কাছেও কয়েকটা ছোট বোঁচকা।

দেওয়ালের দিকের লম্বা বেঞ্চসিটটাতে বেশ কয়েকটা মুসলমান দম্পতি ও তাদের সন্তান সন্ততি লটকপটকি আর নিজেদের নিয়েই ভীষন ব্যস্ত। আমার পাশাপাশি ডানদিকের সিটে, আপের দিকে মুখ করে একটি সুশ্রী আধুনিক জিন্স পরিহিতা ভদ্রমহিলা ও তার সুবেশিত টিনেজ কন্যা। উল্টো দিকে সিটটাতে পাঁচটা স্কুল বা কলেজ ফেরত ছেলে গাদাগাদি করে কানে হেডফোন গুঁজে বসে। তাদের লক্ষ্য ও উপলক্ষ্য বলাই বাহুল্য, তবে মেয়েটি ব্যাপারটা উপভোগ করলেও মা-টি কুইনাইন চেবানোর মত মুখ করে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট। কারনটা তার প্রতি অবজ্ঞা না মেয়ের প্রতি দৃষ্টি এটা ঠিক বোধগম্য হলনা। এদিকে ওনার সমবয়সী কেও ছিলেননা যে তাকেও এমন উপভোগ্য অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে ফেলতে পারতো।

আমি জ্যাকেটটা খুলে ওই গাদাগুচ্ছের ব্যাগের ফাঁকে সেটিকে সেঁধিয়ে, জল খেয়ে চেয়ারে বসতেই, চেয়ারটা ককিয়ে জানান দিল সে বড় ব্যাথা পেয়েছে। আর সেই ধপ আওয়াজে, সামনের ঘুমন্ত শিল্পী মানুষটি জেগে গিয়ে মুখটা বিকৃত করে, চোখ পাকিয়ে কিছু কাঁচা বুলি দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু চোখ খুলেই কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে গেলেন। আসলে আমার সিটটার দিকটা এমনিতেই অন্ধকার, তার উপরে মাথাটা ন্যাড়া, ঘামে মুখ চকচক করছে, কালো মুখে দাঁত ঝকঝক করছে সাথে এই দশাশই কলেবর।

আমাকে ধমকাতে গিয়ে, বেচারা নিজেই বিষম খেয়েছে। দেখলাম উঁ উঁ করছেন, আর সেই মিনমিনে গলাতেই বলল একটু দেকে চলতে পারেন না ! । বুঝলাম তার পা, আমার জুতোর নীচে চাপা পড়েছিল। ভারি অন্যায় হয়েছে, ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই সেই ফর্দওয়ালা বললেন, আহা যাচ্ছেন কোথায়, বসেন বসেন, আমাদের দেখতেই একটু গুন্ডামার্কা যা, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সেই ভোরে বেইরেচি, চান টান করিনি- বুজতেই পাচ্চেন... তাছারা দোষটাও আমাদেরও। বোচকার ফাঁকে আপনিই বা দেকবেন কিভাবে! আমি ক্ষমা চাইতে গিয়ে ওনার মুখে গুন্ডামার্কা চেহারার গর্ব শুনে ভাবলাম , সাহস কলিজাতেই থাকে, চেহারাতে কখনই নয়। হয়তবা হবেও এনারা গুন্ডামার্কা, কিন্তু এমন রাজপাল যাদব মার্কা চেহারাকে গুন্ডা কল্পনা করতে গিয়ে ফ্যাক করে হেসে ফেললাম।

এবারে ট্রেন ছেড়ে দিতেই আমি মোবাইলে নেট অন করে ফেবুটা খুলে বসলাম। একটা সুন্দর পোষ্ট পড়ছিলাম, হঠাৎ - ও স্যার শুনছেন! কানে এলো কথাটা ঠিকিই, তবুও সেই ডাক আমার নয় ধরেই আমার ফেবুতে মনোযোগ করলাম।
- আপনাকেই ডাকছি মোবাইল স্যার।
- বলুন
- জয়ার খবর জানেন?
- এবার আমার হকচকিয়ে যাবার পালা, এমন ভাবে জয়ার খবর চাইলেন যেন আমার সাথে এই ট্রেনে জয়ারও যাওয়ার কথা ছিল আমার সাথে। আমি বললাম আমি কি করে জানবো!
- যা ব্বাবা আপনিই তো ফেসবুক করছেন!
- তো? ফেসবুক করা কি অপরাধ !
এবার সেই ঘুমন্ত ব্যক্তির উবাচ,
- আরে ইনিও তোরই মতোন , শুধু ছবি দ্যাকে। কাল রাতেই টিবিতে দেকলাম স্টোক হয়েচে, ভোরের টেনে কোলকাতা এসেচি, তাই শুদোচ্চিলাম।
বুঝলাম উনি জয়ললিতার কথা বলছেন, বললাম
- উনি মারা গেছেন।
এবারে আমি বেমালুম উহ্য হয়ে গেলাম, ওনারা দুজনেই শুরু করলেন
- বল্লামনা, আগেই মরেচে, শুদু ওর সমপত্তির ভাগ কত্তে গিয়েই এত দেরি, লোক জানাজানি হলে সেই আসরানি ওম পুরির সিনিমাটার মত সবাইকে ভাগ দিতে হত।
- আরে নারে, দিল্লি থেকে আমসের দাকতার এসেচিলনা, তারাই মেরে দিয়েচে।
- তোর সবেতেই মোদির দোস
- তা নই তো কি, কি লাব হয়েচে টাকা বাতিল করে বল
- কত যেন তুই সব বুজিস, দেশ ডিজিটাল কত্তে এই সিদ্ধান্ত লিয়েচে, এখন সব মোবাইল থেকেই হবে
সুতরাং আমি আমার মোবাইলেই ফিরলাম, মিনিট পাঁচেক যেতেই আবার ডাক,
- ও দাদা শিশুচুরি ভাল না খারাপ

আমি আর চাপ না নিয়ে অফলাইন হতে হতে জবাব দিলাম, খারাপ খুব খারাপ।
ততক্ষনে আমার পাশে আরেকজন মধ্যবয়সী লোক এসে বসেছেন সাঁকরাইল স্টেশন থেকে। এবার তিনি তাদের সাথে কথপোকথন শুরু করতেই, আমি প্রাণে বাঁচলাম। একটু শোবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নজর গেল সেই ছেলে গুলোর দিকে, তারা জমিয়ে সমবেত ভাবে মেয়েটিকে এক্সরে করতেই ব্যস্ত। মা মহিলাটিকে মনে হল আমাকেই যেন ফলো করছেন। ঘাবড়ে গিয়ে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল। নাকি আমারই মনের ভুল কে জানে, বুঝলাম আমিও আসলে ছেলেগুলো সহ ওই মহিলা আর তার কন্যাটির দিকেই দেখছিলাম, উদ্দেশ্য ভিন্ন সেটা আমি জানতাম, কিন্তু মায়ের মন তাই তিনিও হয়ত আমায় ষষ্ঠজন ভেবে আমার প্রতি গরল দৃষ্টিপাত করছিলেন। হাজারহোক সাংসারিক মানুষ, আমাদের জীবনে গরল দৃষ্টিতেই ঘরের প্রিয়া প্রেম নিবেদন করে থাকেন, তাই আমার কাছে প্রেমনিবেদন আর গরলদৃষ্টি কিছুটা সমার্থক। অতএব এটাকেও আমি প্রেমময়তা ভেবে পেনাল্টিতে গোল খেয়েছি নিশ্চিত।

ওদিকে সেই পরিবারগুলো আর তাদের বাচ্চাকাচ্ছাদের চ্যা ভ্যা শুরুর মত একই লয়ে চলছে। এই লাইনে বহুবার সফর করেছি এক্সপ্রেস ট্রেনে, তা সে শ্বশুরবাড়ি ভুবনেশ্বরই হোক, ভ্রমন বা স্বাস্থ্য চিকিৎসার জন্য দক্ষিন ভারত, লোকাল ট্রেনে এই প্রথমবার। উলুবেড়িয়া আসতেই ঝাঁকে ঝাঁকে চপবিক্রেতার ভিড়ে ডিব্বাটা চলমান চপের দোকান হয়ে উঠল, কিসের না চপের সম্ভার রয়েছে হকার ভাইদের কাছে, যাত্রীরা খাচ্ছেনও সেই তালে। সাথে কমলালেবু, ভুজিয়া মিক্স, সাবুর পাঁপর, ঘুগনি, কত্তো কি। হঠাতই খেয়াল গেল আমার মাথার উপরের দিকে, দেখি কামরার দেওয়ালে সাঁটা যৌনরোগ নিরাময়ের বিজ্ঞাপন । ডাঃ এল প্রসাদ। সেখানেই সন্ধান পেলাম বুলাদির পুরুষাকারকে। কি সুন্দর নামের প্লেসমেন্ট, বুলাদি ওইখানে আর বুলাদা এইখানে।

এর মাঝেই কখন যেন বাগনানে পৌঁছে গেছি, মাঝে শুধু ঘোড়াঘাটা তার পরেই আমার গন্তব্য দেউলটি। হাওড়া থেকে দেউলটি- মাঝে টিকিয়াপাড়া, দাসনগর, রামরাজাতলা, সাঁতরাগাছি, আন্দুল, শাঁকরাইল, আবাদা, নলপুর, বাউরিয়া, চেঙ্গাইল, ফুলেশ্বর, উলুবেড়িয়া, বীরশিবপুর, কুলগাছিয়া, বাগনান, ঘোড়াঘাটা এবং গন্তব্য স্টেশন দেউলটি। এখন অবশ্য অনেক লোকাল ট্রেনেই নতুন কোচ এসেছে যেগুলো কোলকাতার মেট্রোর মত অনবরত ঘোষনা করে যাত্রীদের জানিয়ে দেয়, কোন স্টেশনে গাড়িটি পৌঁছেছে বা পরবর্তী কোন স্টেশন আসছে।


.........ক্রমশ

_____________
@তন্ময় হক

No comments:

Post a Comment