অ্যালার্মের আর্তনাদে রেশ কাটলো। চোখে তো কতকালের অতৃপ্তির ঘুম ! ঠান্ডায় জমে যাওয়া চোখের পিচুটি ঘষে অ্যানড্রয়েডের স্ক্রীনে দেখলাম চারটে দশ বাজে। মনে মনে ভাবলাম....
-সাড়ে সাতটার দিকে ঢুকবো তো। যেতে আড়াই ঘন্টা। তারমানে আর মিনিট দশেক চোখ বুজে থাকাই যায়।
চোখবুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ চমকে উঠলাম। তড়িঘড়ি করে লেপের ভেতর ফোনে তাকিয়ে দেখি পৌনে ছটা। ভূত দেখার মতো শিউরে উঠে চিৎকার করে ডাকলাম... 'মাআআআআ.... ইশশশ কত দেরী হয়ে গেল !' লেপের ভেতর থেকে কোনোরকমে মুখ বের করে
বিড়বিড় করে বললাম,
- কলেজে কে. এম এর ক্লাশে দশ মিনিট চোখ বুজে থাকতাম তবু ঘড়ির কাঁটা বারোটা পনেরো থেকে বারোটা ষোলো অবধিই যেতো। আর এখন সেই দশ মিনিটই চোখ বুজলাম। তবু চারটে দশ থেকে পৌনে ছটা !! মরণ দশা আমার.......
মা একডাকে ওঠেনি। উঠবেই বা কী করে !! রাত জেগে দুই মেয়ের সেবা করতেই তো প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। একজনের পা ব্যথা তো আরেক জনের মাথা ব্যথা। ছেলেটাও তো কম নয়.... চুলকে চুলকে পুরো বিশ্বকে মাথায় তুলে নেয়। তাই বেচারি ভোর দিকেই একটু শান্তির ঘুম দেয়। কিন্তু আমার মনে এখন প্রচুর রাগ। গায়ের লেপটাকে পা দিয়ে ছুঁড়ে পেলে লাফিয়ে উঠেই শীতে কাঁপতে কাঁপতেে আবার চিৎকার,
- 'মাআআআআআআ ও মাআআআআআ... তুমি আমাকে ওঠাওনি কেন !! ও মাআআআআআ'
মা আড়ভেঙে ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
- কী হলো কী ! এত ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লাফাচ্ছিস কেন ?
- কী হলো মানে ! তুমি জানো না আমাকে আজ যেতে হবে ! কবে থেকে তো রোজ বলছি বুধবার যাবো... আজ কী বুধবার নয় ?
- হ্যাঁ বুধবার কিন্তু আজ তো.....
- তুমি চুপ করো তো। একে আমার দেরী হয়ে গেছে। কত লোক আমার আশায় থাকবে। আর আমি কিনা মহারানী লেপের ভেতর সুখবাস করছিলাম। ছিঃ ছিঃ...
- উফফ তুই শুনবি তো একবার....
- চুপ করো। তাড়াতাড়ি ওঠো। গরম জল ইনডাকশানে বসাও, স্নান করবো। আর একটু চা করো। মাথাটা আমার ফেটে যাচ্ছে।
- মাথা তো ফাটবেই। রাত দুটো অবধি তো ফোন নিয়ে লুতুপুতু। যেন ফোনই তোর প্রেমিক ! সারাক্ষণ চিটিয়ে থাকিস। কথা বললে তো শুনবি না !
- না শুনবো না। তুমি আর এখন জ্ঞানের খাতা খুলে বসো না। একে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে......
মা মুখ ঝামটা দিয়ে চাদর জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে এক নম্বরটা সেরে টুথব্রাশটা মুখে ঢোকাতেই মাথায় খেলে গেল, 'ব্যাগ তো গোছানো হয়নি। আর জামাও তো বের করা নেই।'যেন ভাবা অমনি ঐ ঠান্ডাতেও মাথাটা গরম হয়ে গেল........ 'আজ তোকে মেরেই ফেলবো নীলু'
গিয়ে দেখি মাথার বেমোতে ফেবু করতে করতে চশমা পরেই ঘুমিয়ে গেছে হাড়গিলে কঙ্কালটা। নিজে পেঁচা হয়ে ফেবু করলেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাতজেগে ফেবু করলে আমার শান্ত মাথা তুমুল অশান্ত হয়ে যায়।
মেজাজ নিয়েই বললাম,
- নীলুউউউ..... এই মড়াটা ওঠ। ওঠ বলছি।
- কী হলো তোর ? সকাল সকাল কী তোর ঢং শুরু হলো ?
- হ্যাঁ রে ঢংই করছি। তুই আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিসনি কেন !! কত কী নিয়ে যেতে হবে ! জানিস না আজ বুধবার ! আমি যাবো...
- তুই চুপ করবি। আজ তো......
- তুইও আবার জ্ঞান শুরু করিস না। চল ওঠ আমার ব্যাগ গোছা, জামা বের করে দে। ছটা পনেরো বেজে গেল তোদের জবাবদিহি করতে করতে....
- তুই নিজে করে নে। আমি এই ঠান্ডায় উঠতে পারবো না। সাতটায় আমার টিউশন আছে। আরেকটু শুই।
নীলুর এহেন অবজ্ঞায় ধড়াম করে আলমারীটা খুলে এক দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দিলাম। ঘড়ির দিকে তাকাই একবার তো একবার আলমারীর তাকে। কিছুই খুঁজে পাই না। না পছন্দের চুড়িদার না শাড়ি না পাজামা না সোয়েটার-স্টোল কিচ্ছুটি না। শাড়ি পাই তো ম্যাচিং ব্লাউজ পাই না.... সালোয়ার পাই তো পাজামা গায়েব। ওদিকে আবার খান দুয়েক বেডশীট, টুপি, ......... হ্যান ত্যান কত কী ব্যাগে প্যাক করতে হবে। স্নান করতে হবে... রেডি হতে হবে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয়ে। রাগে উৎকন্ঠায় ঘন শীতের সকালে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠলাম। মেঝেতে পাতা বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লাম। যেমনি বসা ওমনি আ আ করে প্রিন্স বলে উঠলো,
- দিলি তো আমার পা টা। ঐ হাতির মতো চেহারাটা আমার এই রোগা পায়েই ফেলতে হলো !!
- মাথা আর গরম করাস না প্রিন্স। তখন থেকে আমার একটা কাজও এগোয়নি। কখন যে বেরোবো আর কখন পৌঁছোবো !! মা টা যে রান্নাঘরে এখনও কী করছে !! ধুস....... এদের দিয়ে কিছু আর হবে না।
- কিন্তু আপা আজ তো.....
- আজ তো বুধবার। ফোনে দেখ। মাথার কাছেই তো আছে।
ততক্ষণে মা চায়ের কাপটা নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে বললো,
- নে চা টা আগে খা। মাথা ঠান্ডা কর।
- দূর তুমি থামো তো। সেখানে এতগুলো মানুষ আমাদের একডাকে হাজির। আর আমি এখানে বাউন্ডুলে হয়ে বসে !
এ কথাটা শুনে লেপের ভিতর থেকে মুখ বের করে নীলুর বলে উঠলো,
- হ্যাঁ রে মোটি তুই আজ যাবি কোথায় !! তখন থেকে নাটক করছিস...... আমারও মাথা ধরিয়ে দিলি।
- কোথায় যাবো মানে !! তুই কী জানিস না আজ বুধবার ! আজ আমাদের অকপটের পিকনিক। এতদিন থেকে তো বলে আসছি.............
এবার মা নীলুর প্রিন্স তিনজনেই একসাথে বলে উঠলো বিরক্ত হয়ে,
- আজ বুধবার জানি। কিন্তু আজ ২৮ তারিখ নয়। আজ ২১ তারিখ।
ওদের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে চার্জার থেকে ফোনটা নিয়ে দেখি, সত্যিই তো আজ ২১ তারিখ। এখনো সা.......ত দিন বাকি। পুরো মাথাই নষ্ট......
তিনজনেই কড়মড় করে আমার দিকে তাকালো। আর সাতসকালে আমার কী হাল হলো বাকিটা বললাম না.......... 😁😁😁
© শেহনাজ আলম
No comments:
Post a Comment