শীতকাল মানেই সোয়েটার টুপি নতুন গুড় আর নবান্নের স্বাদ। শহরে বইমেলা, পিঠেপুলি উৎসব হয়ত বা আরো অনেককিছু। কিন্তু গ্রামে শীতের সাথেই কোলকাতার চিৎপুর থেকে বাস ভর্তি করে হাজির হত পরিযায়ী যাত্রাপালার দলগুলি। ছড়িয়ে পড়তো বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম মফঃস্বলের মঞ্চে মঞ্চে। অগ্রহায়ণ এর কেটে নেওয়া ধানের জমির উপরেই তৈরি হত অস্থায়ী মঞ্চ বা মাচা। করোগেটেট টিন দিয়ে ঘিরে তৈরি হত অডিটোরিয়াম, যার মাথার উপরে থাকত বাঁশের খুটির বলে ছাওয়া চটের ছাওনি। তিন চার ঘন্টার সে এক মনোজ্ঞ পারিবারিক বিনোদন। শুকনো খটখটে জমিতে কাটা ধানগাছের গোঁড়া গুলোকে বিছিয়ে, চটিজোড়া খুলে তার উপরে বাবু হয়ে বসে চাদর মুড়ি দিয়ে চিনে বাদাম চিবোতে চিবোতে চার ঘন্টা কাবার।
আজকাল স্যাটেলাইট টিভির রমরমা আর অধুনা মোবাইলেই শত মনোরঞ্জের ভিরে যাত্রার সেই সুদিন আজ অতীত। কিছু স্থানে টিমটিম করে টিকে আছে ঠিকিই, কিন্তু সেখানেও টালিগঞ্জের সিরিয়াল শিল্পীদের দাপট। শুধুমাত্র এই পেশা দিয়ে আজ আর পেট চালানো যায়না, তাই পেশাদার যাত্রা শিল্পী আজ বিরল। যাত্রাশিল্পটা কলা হিসেবে বহু প্রাচীন, ভারতের শিল্পসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র তো বটেই, মহাভারত, হরিবংশ, শ্রীচৈতন্য ভাগবতে, এমনকি গ্রীক ভূপর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণেও যাত্রাপালার উল্লেখ রয়েছে। বালক নরেন্দ্রনাথও গোবিন্দ অধিকারীর পালা দেখে সেই মত হাঁটাচলা কথাবার্তা বলতেন, এই যাত্রাপালাতেই বুঁদ হয়ে আপ্লুত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যার জন্য আজও যাত্রালক্ষ্মী নামে বীনা দাশগুপ্তের স্মৃতি বাবা কাকাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
সেকালে, গ্রামের মাতব্বর স্থানীয় দাদু জ্যাঠারাই এই যাত্রানুষ্ঠানের যাবতীয় দৌড়ঝাঁপের দায় দায়িত্ব নিতেন। পরবর্তী কালে পাড়ার ক্লাব সেই স্থান দখল করে। তখন যেকোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে পাড়ার পাড়ায় এ্যমেচার যাত্রারও একটা জনপ্রিয় চল ছিল। তখনই জেনেছিলাম যাত্রা দলের মালিককে অধিকারী বলা হয়, প্রম্পটারকে মাস্টার, আর ভিকিরি থেকে রাজার পোষাক সবই ভাড়া পাওয়া যায়।
পেশাদার ভাড়ার নায়িকাদের সাথে নিজেরাই সেই পালার নায়ক খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতাম। এমনই সব শীতের সন্ধ্যাগুলোতে মেতে থাকতাম যাত্রার মহড়াতে। আর আমাদের মায়েদের কাছ থেকে, আমাদের কাকার দল সেই অনুমতি যোগাড় করে আনত। তবে ওই নায়িকার সাথে যাত্রার দিন দুপুরেই একমাত্র মহড়া হতো। সেই নায়িকাদের দেখার জন্য পাড়ার ছেলে ছোকরাদের সে কি উঁকিঝুঁকি আর আগ্রহ। আমাদের মত ছেলে ছোকরাদের কাছে সেই কালে মেয়ে মানেই ভিনগ্রহের বাসিন্দা ছিল। কারন মা বোন তো মা বোনই, তারা তো আর মেয়েমানুষ নয়। তাই পর মেয়েমানুষ নিয়ে, নকল গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে, সকল গুরুজনেদের সামনে আড়ষ্ট অভিনয়, সে এক মিষ্টি অভিজ্ঞতা।
বছর পাঁচেক আগে একবার চারচাকা করে তামিলনাড়ুর ভেলোরে গেছিলাম এমনই এক শীতকালে। বাংলা-উড়িষ্যা-অন্ধ্রের বিস্তীর্ন গ্রামাঞ্চল পেরিয়ে সে যাত্রা কোন ভ্রমণের থেকে কম কিছু ছিলনা। সেই পথেই দেখেছিলাম যাত্রা পালা আজও জীবিত। জানিনা সেখানেও আর কত দিন প্রাসঙ্গিক থাকবে। আজকাল আমাদের রাজ্য সরকার অবশ্য যাত্রা একাডেমি গঠন করে, তার মাধ্যমে একগুচ্ছ সঞ্জীবনি প্রকল্প ঘোষনা করে এই সুপ্রাচীন সংস্কৃতিকে অক্সিজেন যোগানোর সৎ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
কিছুবছর আগে আমাদের গ্রামবাংলার পথঘাট মুখরিত থাকত যাত্রা তথা বিচিত্রানুষ্ঠান এর প্রচারব্রম্ভে। ভ্যান, রিক্সা, এমনকি এম্বাসেডর গাড়ির ছাদে মাইকের চোঙা বেঁধে চলত সেই অপরূপ বাচন ভঙ্গির প্রচার। দেওয়ালে দেওয়ালে রঙিন লিথো পোষ্টার। যে পাড়ায় যাত্রাপালা হবে, সেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয় অভ্যাগতদের ভীড় জমে যেত যাত্রা দেখার জন্য। যাত্রার দিন সকালেই সামনের উইন্ডস্ত্রিনে পালার নাম লেখা বাসে করে বাজনাদারেরা আর সহ কলাকুশলীরা এসে যেত। নায়ক নায়িকা বা কোন বয়স্ক বিখ্যাত শিল্পী থাকলে তিনি প্রাইভেট গাড়িতে দুপুরের দিকে গ্রামে ঢুকতেন। আর কোন মাতব্বর গোছের লোকের বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন। আর এর দরুনই সেই বাড়ির ছেলে মেয়েরা বন্ধু মহলে কলার উঁচু করে চলতো আর ভীষণ সমাদৃত হত মাস খানেক।
সেই সুমধুর প্রচার ভঙ্গির কিছুটা তুলে দেবার চেষ্টা করলামঃ
সুধী যাত্রামোদী বন্ধুগণ, ভুল করবেন না ভুলে যাবেন না, আগামী অমুক তারিখে তমুক স্থানের রঙ্গমঞ্চে, তিনরাত্রী ব্যাপি বিশাল যাত্রানুষ্ঠানে, ঝলমল করে ফুটে উঠতে চলেছে, জাপানী আলোকমালায় সজ্জিত সুপার সাইক্লোরামা পদ্ধতিতে এ যুগের সবচেয়ে সাড়া জাগানো অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা... শ্বশুর কেন অসুর....
যাতে অভিনয় করতে আসছেন যাত্রাজগৎের উদিত সূর্য, গায়ক নায়ক কুমার ইন্দ্র, সাথে বোম্বে থেকে আগত সিনেমার গ্লাম্যারকুইন যৌবনবতী লাস্যময়ী নায়িকা মিস খিলখিল, খলনায়কের ভূমিকায় জীবন্ত সন্ত্রাস কামাক্ষ্যা প্রসাদ, আর হাসির ডালি সাজিয়ে মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন হাসির রাজা... হোঁচট কুমার...
বিশেষ করে মনে রাখবেন, মহিলাদের বসিবার আর সাইকেল রাখিবার পৃথক বন্দোবস্ত রয়েছে। পালা শেষে তিনটি রুটে ফেরার জন্য বিনামূল্যে বাসের ব্যবস্থাও থাকবে।
এবারের আমাদের বিশেষ আকর্ষন, যাত্রা শুরুর পূর্বে ৩০ মিনিট ব্যাপি, মিস ডলি, মিস মাধুরী, মিস ববিতা আর মিস কুমকুক (নামগুলো উচ্চারনের সময় গলার স্বরের তারতম্য, নেশা ধরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট) দ্বারা পরিবেশিত ‘বোম্বে ড্যান্স হাঙ্গামা”
টিকিটের দাম কাউন্টারে, জমিন ৩০ টাকা, চেয়ার ৫০ টাকা, সিজন টিকিট জমিন ৭০ টাকা, চেয়ার ১২০ টাকা । সুতরাং, ভিড় এড়াতে আজই টিকিট কেটে রাখুন। অগ্রিম টিকিটে, দৈনিকে ৫ টাকা আর সিজন টিকিটে ১০ টাকার বিশাল ছাড় পেতে আজই টিকিট কাটুন। অগ্রিম টিকিটের উপরে থাকলে আকর্ষনীয় পুরস্কার। লটারির মাধ্যমে তিন ভাগ্যবানকে বেছে নেওয়া হবে। টিকিট আমাদের প্রচার গাড়িতেই পাওয়া যাচ্ছে।
সত্যিই আজ এই শিল্পটা প্রায় লুপ্তপ্রায়। তার বদলে ফি সন্ধ্যায় সংবাদ চ্যানেলে চ্যানেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নামে চড়া দাগের যাত্রাপালা। দেশের সংসদ ভবন থেকে পাড়ার পার্টির নেতা পর্যন্ত, সেই চড়া মেলোড্রামার যাত্রা প্রতিনিয়ত সহ্য করছি আমরা।
মাচার যাত্রাপালাতে সত্যের কথাটা বলার জন্য অন্তরালে ‘বিবেক’ বলে একটা শিল্পী থাকত। আমাদের দূর্ভাগ্য আজকালকার এই রোজনামচা যাত্রাপালাগুলোতে উত্তেজনা বিনোদনে আবেগের কোন মশলার ঘাটতি নেই, অভাব শুধু ‘বিবেকের’।
(উন্মাদীয় বানানবিধি অনুসৃত)
________
© উন্মাদ হার্মাদ
No comments:
Post a Comment