সকাল সকাল সমুর ফোন পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে ভাস্করের মন। সমু ফোনে মোটে দু মিনিট কথা বলেছিলো। তাতেই ভাস্করের বুকের ওঠানামা বেড়ে গেলো। সমুর কথায় মনে পড়লো বাবাকে। তখন ভাস্করের বয়স কত হবে। - বছর পাঁচ ছয়। মায়ের হাত ধরে রোজ স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় দেখা হতো বাবার সঙ্গে। দেখা হতো মানে বাবার নামটা বড় বড় করে বড় রাস্তার ধারের পেরেক কলের দেওয়ালে লেখা " শহীদ প্রতাপ রায় অমর রহে। " সাদা দেওয়ালে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা। সারা লেখায় লাল তারার ছড়াছড়ি। বাবার খুন হওয়ার কথা তেমন কিছুই মনে নেই ভাস্করের। তখন ওর বয়স মোটে চার। যে বাবা সকাল বিকেল দুবেলা ওর সঙ্গে খেলা করতো , খুন হবার পরেই হয়ে গেলো পার্টির সম্পত্তি। লাশকাটা ঘর থেকে ফেরার পর ওর বাবা আর বাড়ি আসেনি। শুয়ে ছিল পার্টি অফিসের সামনে। মা অবশ্য ওকে নিয়ে যায়নি ওখানে দেখাতে । তবে যে ছবিটা মায়ের বাক্সে লুকিয়ে রাখা ছিলো , সেটা ভাস্কর বড় হয়ে দেখেছে। পোস্ট মর্টেমের দরুন মাথায় বড় বড় সেলাইর গিঁঠ ছবিতে স্পষ্ট দেখেছিলো।
সেই দেওয়ালে লেখা " শহীদ প্রতাপ রায় অমর রহে " ধীরে ধীরে একদিন মুছে গেলো প্রকৃতিই নিয়মে। পাড়ার মোড়ে মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনের র উপর যে সরু কালভার্ট ছিল তার ধারে পার্টি করে দিয়েছিলো একটা শহীদ বেদি। সারা বছর তাতে ধুলো পড়তো , কাকে হাগতো। তারপর যেদিন কালভার্ট ভেঙে চওড়া করলো তখন , বাবার নাম লেখা শহীদ বেদীটাও উড়ে গেলো। সেই সময়ে ভাস্কর বড় হচ্ছে , সব কিছু বুঝতে পারছে। তারপর একদিন মায়ের হাত ধরে চলে আসে কালীঘাটে দাদুর বাড়িতে। সেখান থেকে দক্ষিণ কলকাতার এই উঁচু বাড়িটার ফ্ল্যাটে। ভাস্করের অফিসের দেওয়া এই ফ্ল্যাটে রেখে মাকে সুখী দেখতে চেয়েছিলো। এই ফ্ল্যাটে এসে মা যেমন নিজের চেনা পাড়া , চেনা লোক হারালো , তেমনি নিজের একাকিকত্ব ভুলতে ভাস্করকে আঁকড়ে রইলো। তখন ভাস্কর ধীরে ধীরে মায়ের মুখ থেকে শোনা বাবার খুন হওয়ার ধটনার পাজল জুড়তে পারলো।
প্রতাপ রায় বাম দলের নেতা , নেতা মানে পাড়ার নেতা। পাড়ায় বেশ প্রতাপ ছিল প্রতাপ রায়ের। এক বর্ষার রাতে পার্টি অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতাপ রায় খুন হন একদল অতি বিপ্লবীদের হাতে। তখন পাড়ায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সেই অতি বিপ্লবীদের দল। সেই খুনি দলের নেতা ছিল ঘোষ বাড়ির ছেলে পল্টু। ঘোষেদের ছিল লোহা লক্কড়ের কারবার। পাড়ার বনেদি বাড়ি বলে নাম ছিল। সেই বাড়ির ছেলে পল্টু অতি বিপ্লবী হয়ে গিয়েছিলো। সবাই ভেবেছিলো হয়তোবা নেহাত শখের রাজনীতি। কিছুদিন পরে মাথা থেকে ভূত নেমে যাবে। তা হয়নি। উল্টে প্রতাপ রায়কে খুন করে পল্টু দলের একশন স্কোয়াডে নাম লিখিয়ে দিয়ে ছিলো। মায়ের মুখ থেকে যেটুকু শুনেছে , সেই বর্ষার রাতে পল্টু বেশ কয়েকজন বাইরের ছেলেকে নিয়ে প্রতাপ রায়কে ঘিরে ধরে। পল্টু প্রথম ছুরি মারে। প্রতাপ রায়কে ঘিরে ধরা ছেলের দল প্রতাপ রায়কে পালাতে দেয়নি। প্রতাপ রায় উঠে দাঁড়াতে গেলে ওকে ওরা ঠেলে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সেই সুযোগে পল্টু একের পর এক ছুরি মেরে গেছে। মায়ের কথা অনুযায়ী মোট উনিশটা ছুরি মারা হোয়েছিলো। সেই বৃষ্টির মধ্যে প্রতাপ রায়ের লাশ যখন ভিজছিলো , পল্টু তখন রাতের ট্রেন ধরতে প্ল্যাটফর্মে বসেছিল। পল্টু অবশ্য বেশিদিন পালতে পারেনি। বছর খানেকের মধ্যে ধরা পড়ে। তারপর আরো দশ বছর জেল খেটে মুক্তি পায়। ততদিনে দেশের রাজনীতি পাল্টে গেছে।
ততদিনে অবশ্য নিজেকে দাঁড় করতে ভাস্কর এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে পল্টুর খবর নিতে পারেনি। তবে শুনেছিলো পল্টু আর বাড়ি আসেনি। পয়সাওয়ালা বাড়ির ছেলে। হয়তো বাড়ির লোকে পল্টুকে দূরে কোথাও রেখে দিয়েছিলো পরিবার ম্যান সম্মান বাঁচাতে। তারপরেও বহু বছর কেটে গেছে। আজ সমুর ফোনে জানতে পারলো পল্টু বাড়িতে ফিরে এসেছে। বিকেলে যেন ভাস্কর ওদের বাড়ি পৌঁছে যায়। সেই সময়ে নাকি পল্টু বাড়ির বাইরে বেরোয়। কাজেই তখন ভাস্কর ওর সঙ্গে দেখা করতে পারে।
ভাস্কর ভাবতে লাগলো এখন কত বয়স হবে পল্টুর। নিজের বয়স যদি পঁয়তাল্লিশ হয় তবে পল্টুর বয়স এখন নিশ্চয় সত্তরের কম নয়। নিজের মায়ের বয়স পঁচাত্তর , এখন রোগে ভুগে প্রায় শয্যাশায়ী। তবে কি পল্টু এখনো শক্ত পোক্ত আছে ? খুনিরা শক্ত পোক্ত না হলেও মনের দিক দিয়ে হয়। পল্টুর সঙ্গে দেখা করা কি ঠিক হবে ? সত্তর বছরের পল্টু ওর কি করতে পারবে ? যদি দেখা হয় তবে ভাস্কর ওকে কি বলবে ? ইচ্ছে তো হয় যে জিজ্ঞাসা করে ওর বাবা পল্টুর কি ক্ষতি করেছিল যে ওকে খুন করা হলো ? ওর বাবাকে খুন করে পল্টুর কি লাভ হলো ?
সারা সকালটা যাবে কি যাবে না সেই দ্বন্দতেই কেটে গেলো। সেই দোনোমোনো ভাবনা নিয়ে ভাস্কর ওদের পুরোনো পাড়ায় সমুর বাড়িতে বিকেলের অনেক আগে হাজির হয়ে যায় । তারপর সমুর সঙ্গে ওদের দোতলার ঢাকা বারান্দায় বসে রইলো। সামনে পাড়ার খেলার মাঠ। মাঠের ধারে ঘোষদের তিনতলা বাড়ি। পল্টু বেরোলে সেই বাড়ির গেট খুলেই বেরোবে। সমুর মুখ থেকে শুনলো যে পল্টু এতদিন বেনারসে ছিল। বিয়ে টিয়ে করেনি। সেখানে মিষ্টির দোকান চালাতো। সেখানে স্ট্রোক হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে পল্টু। তখন বাধ্য হয়ে ওর ভাইপোরা ওকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে এসেছে। ভাস্কর বার বার জিজ্ঞেস করে পল্টু কি খুব বুড়ো হয়ে গেছে। সমু কথা কেবল এড়িয়ে যায়। সেই বারান্দায় বসে বসে মাঠের দিকে চেয়ে থাকতেই রোদ কমে এলো। তারপর ভাস্কর দেখে একটা হুইল চেয়ারে এক বৃদ্ধকে নিয়ে একজন চাকর গোছের লোক ঘোষদের বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে এলো। হুইল চেয়ারে বসা লোকটার মুখ সমুদের বারান্দা থেকে ঠিক মতন দেখা যাচ্ছেনা। ভাস্কর ব্যস্ত হয়ে সমুদের বাড়ি থেকে দ্রুত রাস্তায় নেমে এলো। পিছন পিছন সমুও এলো। ভাস্কর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে এলো সেই হুইল চেয়ারের কাছে। ভাস্করের হার্ট বিট বেড়ে চলেছে। বুকের ধুক পুক করা শব্দ আর সব শব্দকে ছাপিয়ে গেছে। হুইল চেয়ারের কাছে এসে দেখে এক বৃদ্ধর মুখ , একদিকে কাত হয়ে আছে। চোখ দুটো খোলা , কেমন যেন আনমনে চেয়ে আছে। মুখটা অল্প খোলা। জিভ একটু বেরিয়ে ঠোঁটের উপর এসে পড়েছে। মুখ দিয়ে একটু একটু লালা গড়াচ্ছে। দেখেই বুঝতে পারে স্ট্রোকের পরে পল্টু পুরোপুরি পঙ্গু। কেবল বুকে প্রাণটা আছে। চোখ মুখ দেখে টের পাওয়া যায় বুদ্ধি শুদ্ধি সব কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শরীরটা কেবল প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে পড়ে আছে শেষের সেদিনের অপেক্ষায়। পল্টুর মুখ দেখে ভাস্করের মুখ ঘৃনায় কেমন কুঁচকে গেলো। গুলতির মতন সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো ভাস্কর।
ভাস্কর হন হন করে হাঁটতে থাকে বড় রাস্তার দিকে। আর এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে নেই। পিছন পিছন এসে সমু জিজ্ঞেস করে , ' কিরে ভাস্কর কি বুঝলি পল্টুকে দেখে ? ' ভাস্কর মুখ ঘুরিয়ে বলে , ' নারে আমি এখন মড়া মেরে খুনের দায়ে ধরা পড়তে চাইনা। ' ভাস্কর হাঁটতে থাকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে।
_________
© সনৎ মিশ্র
No comments:
Post a Comment