ল্যাম্পপোস্টের নীচে ছায়া মেখে দাঁড়িয়েছিল একটা অবয়ব। দূর থেকে বোঝা দুস্কর, সেটি নারী শরীর নাকি পুরুষ। কিছুটা কাছে গেলে অবশ্য বোঝা যায়, সেটি একটি নারী। মুখহীন, একটা নারী শরীরের আদল। তবে সেটি আলোর অভাবের দরুন নাকি দৃষ্টির ক্ষুদ্রতার জন্য, তা তর্কের বিষয়। আরো কাছে গেলে, ওই আদল ক্রমশ একজন মানুষীর রূপ নেয়। গড়ে ওঠে তার চুল, নাক, কান, চোখ, ঠোঁট ও আরো অনেককিছু। বোঝা যায়, তার চুলে লাগানো সস্তার গন্ধ তেল। কপালের ঝিকিমিকি বিন্দি। কাজল লাগানো দুটো রক্তশুন্য চোখ। লালের ছোঁয়া লাগা একটু বসা গাল। টকটকে লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট। আর নাক। টিকালো একটি নাক। সমগ্র মুখমণ্ডলের সাথে বেমানান, একটি অদ্ভুত সুন্দর নাক। তাতে লাল পাথর বসানো একটি নথ। অন্ধকারে কামনার আগুনের মতো দীপ্যমান, জ্বলজ্বলে। অপুষ্ট শরীরে ভারী দুটো বুক। দেখলেই সন্দেহ জাগে, গোঁজামিল আছে। পরনে একটা সিল্কের শাড়ি। অতীত সৌভাগ্যের চিহ্ন বহনকারী রিক্ত বর্তমান।
চেহারা, বেশভূষা আর দাঁড়ানোর জায়গা থেকেই পরিস্কার মেয়েটির পেশা। হ্যাঁ পাঠক, মেয়েটি একটি বেশ্যা। হাই সোসাইটির escort বা মেহফিলের রঙ জমানো খানদানি তবায়েফ নয়। ওই লরিচালক, রিক্সাওয়ালা বা ঠেলাওয়ালারা যাদের কাছে যায় শরীরের প্রয়োজনে, সেরকম একটি পাতি বেশ্যা।
না, ভুল বললাম। পাতি নয়। কোন মানুষই পাতি হয় না। প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজস্বতায় অনন্য। মানুষ তৈরির ছাঁচগুলো শুধু একবার ব্যবহারের জন্য। তাই প্রত্যেকটা ছাঁচ আলাদা, আর মানুষও আলাদা। যাইহোক, তত্ত্বকথা ছেড়ে এবার গল্পে ফেরা যাক।
একটি যুবক ওই রাস্তা ধরে হেঁটে আসছিল। ঠিক সোজা হেঁটে আসছে না, পা দুটো মাঝেমাঝেই টলে যাচ্ছে। বেশভূষায় বেশ চাকচিক্য আছে। সর্বাঙ্গে মার্জিত রুচি ও সচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট। লম্বা, দোহারা চেহারা। চশমার পেছনে একজোড়া উদাসী, বিষণ্ণ চোখ।
“যাবেন নাকি?”
চমকে ওঠে মেয়েটি। অন্যমনস্কতার বা মুখ থেকে ভকভক করে বেরিয়ে আসা মদের গন্ধের কারনে নয়, সম্ভাষণে এবং সম্ভাষণকারীকে দেখে। “আপনি” শুনতে অভ্যস্ত নয় তার কান। আর এরকম খদ্দেরও তার জোটেনা।
“কোথায়? কোথায় যেতে হবে?”
“যেখানে হোক। মানে, আমি তো বিশেষ কিছু চিনিনা। যেখানে সুবিধে হয়। আপনার ইচ্ছেমত যেকোনো জায়গায়।”
'ও। মালটা এ লাইনে নুতন মনে হচ্ছে। এখনও আড় ভাঙ্গেনি' - মনে মনে ভাবে মেয়েটি। মুখে বলে, “চলুন আমার ওখানে। ছোট জায়গা, তবে কোন ঝঞ্ঝাট নেই। কিন্তু রেট বেশি লাগবে। আর শুনুন, একবার করলে এক রেট আর সারারাত থাকলে...”
হাত তুলে থামিয়ে দেয় ছেলেটি। বলে, “সে ঠিক আছে। কোন অসুবিধে নেই।”
ভালোই মুরগী পেয়েছি। একচিলতে হাসি জন্ম নিয়েই মিলিয়ে যায় মেয়েটির ঠোঁটে।
ঠিকই বলেছিল মেয়েটি। ঘরটা ছোট, গলির ভিতরে। খারাপ পাড়ার, তেমন পসার না থাকা মেয়েদের যেমন ঘর হয়, তেমনই। তবে, পরিস্কার।
“আসুন, ভেতরে আসুন।” মেয়েটির আহ্বানে ভেতরে ঢোকে ছেলেটি।
ঘরের একপাশে একটা তক্তপোষে বিছানা পাতা। তোশক, কাঁথা, চাদর আর দুটো বালিশ। একটা পাশবালিশও আছে। এককোণে একটি আলমারি জাতীয় বস্তু। আরেক কোনের কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মীর পট। তার সামনে কিছু পোড়া ধুপ, একটা রেকাপিতে দুটো বাতাসা আর এক গ্লাস জল, নিত্তপুজার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
“মাল চলবে? মানে, মদ? দাম কিন্তু আলাদা দিতে হবে।”
“চলবে।”
আলমারি থেকে একটা আধখাওয়া হুইস্কির বোতল বের করে মেয়েটি। কোন এক কাস্টমারের ফেলে যাওয়া বোতল।
“সাথে কিছু লাগবে? ঘরে চানাচুর আছে। অন্য কিছু লাগলে, আনাতে হবে। তার রেট আলাদা।”
“না, না। ওতেই হবে।” আড় চোখে তাকিয়ে দেখে বোতলটার দিকে। সস্তা মাল। স্কচ নয়।
দুটো গ্লাস, একটা প্লেটে চানাচুর আর জলের বোতল নিয়ে আসে মেয়েটি। বিছানার ওপর একটা পেপার পেতে সাজিয়ে দেয় সমস্ত আয়োজন। অভ্যস্ত হাতে মদ ঢালে দুটো গ্লাসে। মেশায় পরিমান মতো জল।
“আপনার নাম কি?” জিগ্যেস করে ছেলেটি।
“নাম দিয়ে কি হবে? শেফালি, মালতি যাহোক কিছু একটা ভেবেনিন।”
“বাড়ি কোথায় ছিল?”
“আমার ঠিকুজী জেনে আপনার কি দরকার?”, মুখ ঝামটে ওঠে মেয়েটি। “যা করতে এসেছেন চটপট করে, ফুটুন এখান থেকে।”
সব শালার এই রোগ। সবাই পুরনো কথা জানতে চায়। কি করে সে এই লাইনে এল। এই কাজ করতে তার কেমন লাগে। হারামির বাচ্চা, এসেছিস তো কাঠি গলাতে। এত খবরে তোদের কী দরকার? নাকি এগুলো মদের সাথে চাটের মতো। মস্তিটা আরো জমাট হয়। আগে সে বলত। সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে। তখনো সে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়নি। যখন সে বোকা ছিল। এখন আর নয়। এ লাইনে কম দিনতো হোল না। এখন এসব কথা শুনলে, তার মাথা গরম হয়ে যায়। সব শালা ঢ্যামনা।
“আমি একটা কবিতা পড়ব? শুনবেন আপনি?”
আবার চমকাল মেয়েটি। এতো আজব মাল!
“আমি কবিতা টবিতা বুঝি না।”
“বুঝতে হবে না। আমি পড়ি। আপনি শুনুন।”
“আচ্ছা। তবে টাইম বেশি নিলে রেটও বেশি লাগবে।”
মালটার বোধহয় দাঁড়ায় না। এরকম অনেকে আসে তার কাছে। মদের ঘোরে আটভাট বকে। চটকা-চটকি করে চলে যায়। এটাও মনে হয় সেইরকম। ভাবে মেয়েটি।
কবিতা পড়তে শুরু করে ছেলেটি। কিছুই বোঝেনা মেয়েটি। তবু আস্তে, আস্তে তার মাথাটা কেমন যেন করতে থাকে। বুকের ভেতরে চিনচিন। ঘন হয় দৃষ্টি।
“চোখে রাখ চোখ, আলো ফুটুক অন্ধকার হতে
যেমন ফুটেছিল গতজন্মে, এক সূর্যোদয়ের দিনে –
ঠোঁটে রাখ ঠোঁট, ডানা পাক জমে থাকা কষ্টেরা
যেমন পেয়েছিল কোন এক কদম ফুলের দিনে –
হাতে রাখ হাত, আবার জেনে নেই
ভুকে যাওয়া সেই পুরাতন ছুঁয়ে থাকার মানে –”
কবিতা পড়ে চলে ছেলেটি। একটার পর একটা।
তারপর, মেয়েটি এগিয়ে আসে। চুমু খায়। মাথাটা টেনে নিয়ে গুঁজে দেয় নিজের বুকে। ছেলেটি পেঁয়াজের খোসা ছাড়াবার মতো করে উন্মুক্ত করে তাকে। আদরে, আদরে ভিজে যায় সে। অনুভব করে দৃঢ় পুরুষাঙ্গের আকুলতা। সে আস্তে আস্তে খুলে নেয় ছেলেটির সমস্ত পোশাক। গ্রহন করে তাকে। শরীরে এবং মনে।
উত্তেজনার তুমুল শিখরে, চোখ বন্ধ হয়ে আসে ছেলেটির। নিজের শরীর দিয়ে মেয়েটির শরীর পিষে দিতে দিতে, অস্ফুট কণ্ঠে বিড়বিড় করে ওঠে একটা নাম ধরে।
আবেশের, পুলকের ভেলায় ভেসে যেতেযেতে, আচম্বিতে মেয়েটির কানে প্রবেশ করে ছেলেটির কণ্ঠস্বর। এক ধাক্কায় ছিটকে দেয় ছেলেটিকে।
“শালা, হারামি। শুয়োরের বাচ্চা, ভাগ এখান থেকে।”
ছেলেটি হতবাক হয়ে যায়। তখনো তার সারা শরীর জুড়ে উত্তেজনা। ধাতস্ত হতে সময় নেয় সে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করে।
“মারব পোঁদে এক লাথি। এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ডাকবো জগাকে?”
পড়িমরি করে জামাপ্যান্ট পরে নেয় ছেলেটি। জিগ্যেস করে, “কত দেব?”
“তোর টাকায় মুতি আমি। বেরো এখান থেকে।”
ছেলেটি বেরিয়ে যেতেই, দরজা বন্ধ করে মেয়েটি। বন্ধ দরজার পেছনে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে এক চিরন্তনী নারী।
দীর্ঘদিন ধরে শরীরের ব্যাপারী হয়েও, বারবার ঠোকা খেয়েও, মন তার এখনো মরেনি। আজও সে গ্রহন করতে চায় কোন পুরুষকে, যেমন করে আজ সে গ্রহন করেছিল ওই যুবকটিকে। আর তাই সঙ্গমকালে তার মুখে অন্য নারীর নাম শুনে, আজও তীব্র অপমানে ফোঁস করে ওঠে তার নারীসত্ত্বা।
পাঠক, বলেছিলাম না। কেউ পাতি নয়। প্রত্যেকেই অনন্য, যে যার মতো করে।
___________
© শোভন বাগ
No comments:
Post a Comment