Saturday, 10 December 2016

।। নিবারণ ।।


সেবার ডিসেম্বর মাসে দার্জিলিং বেড়াতে গেছি। যদিও ঠান্ডা একটু বেশি থাকে সেই সময়ে , তবুও যাওয়ার কারণ সেই সময়ে আকাশ থাকে পরিস্কার । হিমালয়ের অপূর্ব শোভা বিনা বাধায় দেখা যায়। ছিলাম প্রায় তিন দিন। রোজ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে এসে বোসতাম মলের পাতা বেঞ্চিতে। সকালে ওইপাশে বেঞ্চিতে মিষ্টি রোদের আমেজ পাওয়া যায়। সেখানে বসে বসে বই পড়া , গান শোনা চলে বেলা এগারোটা পর্য্যন্ত , তারপর বেরিয়ে পড়তাম আশেপাশের টুরিস্ট প্লেস গুলো ঘুরে দেখতে। প্রথম দিন সকালে আমরা দুজন বসে আছি। সামনের চাওয়ালা চা দিয়ে গেছে। কাঁচের গ্লাস মুঠো করে ধরে চায়ের উষ্মতার আমেজ নিচ্ছি , ঠিক তখনি হাজির হলো সে।

বছর পঁচিশ ছাব্বিশের ছোকরা। পরনে জিনের প্যান্ট , ওপরে মত চামড়ার জ্যাকেট , পায়ে গাবদা বুট , গলায় মাফলার , মাথায় কাউবয় টুপি । হাতে একটা ছোট লাঠি , পুলিশের বড় অফিসারদের হাতে যেটা দেখি , দেখি মানে সিনেমাতে যেটা দেখায়। আজকাল কাউবয় টুপি সব টুরিস্ট প্লেসে পাওয়া যায়। অনেকেই মাথায় চাপিয়ে ঘোরে। কাজেই ওই ছেলেটাকে দেখে টুরিস্ট মনে হোলো। কিন্তু পরনের জামা প্যান্ট বেশ ঢিলে ঢোলা। এই বয়সের ছেলের পক্ষে বেশ বেমানান। অবশ্য আজকাল রাস্তা ঘটে অনেক রকম ক্ষ্যাপা লোক দেখি। তাই প্রথম নজরে মনে হলো , সেও হয়তো তেমনি ক্ষ্যাপা ছেলে , আমাদের সামনে চাওয়ালা দেখে হয়তো থেমেছে চা খাবে বলে।

ভুল ভাঙ্গলো ছেলেটার প্রশ্নে "দাদা নিবারনকে দেখেছেন ? দেখলে আমার সঙ্গে একটু কথা বলতে বলবেন"। কে নিবারণ , আর ইনিই বা কে। নিবারনকে আমিই বা চিনবো কি করে। আমি কিছু প্রশ্ন করার আগেই ছেলেটা হন হন করে এগিয়ে গেলো , রাস্তার কোনের বই আর ম্যাগাজিন কর্নারে। ভাবলাম ছেলেটার হয়তো কিছুটা পাগলামি আছে। তা নাতো অচেনা লোককে এমন প্রশ্ন করার কোনো অর্থ নেই। ঠিক তার দুঘন্টা পরে , আমরা মল থেকে বেরোবো বেরোবো করছি , দেখি সেই ছেলেটা আবার হাজির। এসে আবার প্রশ্ন "দাদা নিবারনকে দেখেছেন ? দেখলে আমার সঙ্গে একটু কথা বলতে বলবেন"। আবার আমার অবাক হবার পালা। কিছু বলার আগেই দেখি ছেলেটা মল থেকে নিচে নেমে যাবার রাস্তা ধরে হন হন করে নেমে যাচ্ছে। ভাবলাম একবার ওর পিছনে গিয়ে ওকে ধরি , ধরে জিজ্ঞেস করে কে নিবারণ। কিন্তু একবার নিচে নামলে আবার হেঁটে উপরে আসা বেশ শক্ত। তাই বেবাক বকর মতন ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে সেই এক সিন। ছেলেটা আসে , এসে প্রশ্ন করে হন হন করে হাঁটা মারে। ইচ্ছে করলে দৌড়ে গিয়ে ধরতে পারি। কিন্তু অর হাতের ওই ছোট ব্যাটন তাকে একটু সমঝে চলি। বলা যায়না , আধ পাগলার নাকি অল্পতেই ক্ষেপে যায়। একবার ক্ষেপে গেলে ওই ব্যাটনের মার খেতে পারি। ওই বিদেশ বিভূঁইতে আর কে মারামারি করে। তাই চেপে যাই। যাই হোক শেষ দ্রষ্টব্য চিড়িয়াখানা দেখতে বেরিয়ে পড়ি। ছোটো খাটো চিড়িয়া খানা , বেশ ভালোই সাজানো গোছানো। ভিতরে একটা বড় চা কফির দোকান আছে। ঘুরে ফিরে সেখানে বসে কফি খাচ্ছি।
আমরা দুজনে একদম শেষের টেবিল দখল করেছি। ঢোকার দরজার দিকে পিঠ করে আমি বসে আছি। একটু পরের জনা ছয়েকের একটা দল ছেলে মেয়ে এসে পিছনের টেবিলে বসেছে। ওই বয়সের ছেলেমেয়েদের যা স্বভাব , কথার কচকচানি চলছে। দেখি আমার গৃহিনী , চায়ে কাপ হাতে ধরে চুপ করে চেয়ে আছে আমার পিছনে বসা ছেলেমেয়েদের দিকে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি "কি হলো"। গৃহিনী ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বলে , নিচু গলায় জানালো সেই "নিবারণ " কে নিয়ে প্রশ্ন করা ছেলেটা আমার পিছনে বসে আড্ডা মারছে।

আমি চুপ করে শুনি সেই ছেলেটা বলে চলেছে " কোলকাতার পাবলিক একটুতেই চমকে যায়। এই তিন দিনে বেছে বেছে জনা কুড়ি কলকাতার মালদের বারে বারে নিবারণের খোঁজ নিয়ে ওদের ধন্দে ফেলে দিয়েছি। দেখবি এরা সব বাড়ি ফিরে নিবারণের গল্প করবে। আর আমি যে বদ্ধ পাগল তা বলতে ভুলবেনা"। 

আমি পিছন ফিরে খালি বলি " আরে নিবারণ , এখনো তুই বেঁচে আছিস"। সঙ্গে সঙ্গে হাসির ফোয়ারা ছুটলো। চায়ের দোকানটা হাসিতে হসিতে ভরিয়ে ফেললো নিবারণ ও তার বন্ধুরা।


_________
@সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment