Monday, 12 December 2016

।। না বলা কথা ।।



ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সবে ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি। তখন আমার কেল্লা ফতে করার মনোভাব। আর কিছুদিন পরেই মুক্তপুরুষ হয়ে যাব। চাল চলনে হয়ত তেমনি কোনো উদ্দীপ্ত ভাব এসে গিয়েছে। সব উদ্দীপনা শেষ হয়ে গেলো কলেজ থেকে ফেরার পথে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে। পিছনের কারোর পায়ের চাপে আমার সাধের বাটা কোম্পানির টোপাজ চটি পটাং করে ছিঁড়ে গেল। অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে অর্ধেক ছেঁড়া অবস্থায় টেনে নিচ্ছিলাম । কিন্তু চটি তার শেষের সেইদিনে পৌঁছানো মাত্র আমাকে এক করুন দশায় ফেলে গেলো। কোনো মতে পা ঘেঁষতে ঘেঁষতে হেঁটে চলেছি। সেদিন প্ল্যাটফর্মের বাইরে যে মুচিকে রোজ দেখি , সেও কোনো অজ্ঞাত কারণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে। কাজেই যেন কিছুই হয়নি তেমনি একটা ভাব মুখে রেখে , ধীরে ধীরে পা টেনে টেনে চলেছি।

তখনি সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে সামনে সাইকেল নিয়ে হাজির নিলু। নিলু তখন MA ভর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু সাইকেল নিয়ে টো টো করে ঘোরা ছাড়েনি। আমাকে কিছুটা আদেশের স্বরে বলে "বসে পড় , তোমায় ছেড়ে আসি। " যাওবা বসতাম , কিন্তু ওর লেডিস সাইকেলে বসার জন্য মাঝখানের রডটাই  নেই। আমার ইতস্তত ভাব দেখে নিলু আমায় ওর পিছনের ক্যারিয়ারে বসতে বলে। একটা মেয়ের সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে কোনদিন যাইনি। আমি ওকে পাশ কাটানোর জন্য এদিক ওদিক দেখতে থাকি।

ঠোঁটকাটা নিলু বেশ জোরেই বলে " কোনো মেয়ের সাইকেলে ক্যারিয়ারে বসলে তোমার মান সম্মান যাবেনা। উঠে পড়। সামনের বাস স্ট্যান্ডের মোড়ে ছেড়ে দেবো। ওখানে মুচি পেয়ে যাবে। " এরপর আর কি বলা যায়। নিজের মান সম্মান বজায় রাখতে ওর সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে যাই বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে মুচির কাছে চটি সরাই করছি। সারাক্ষণ নিলু ঠায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আমার পাশে। চটি ঠিক করার পর নিলু বেশ আদেশের সুরে বলে " চল আমাদের বাড়ি। মামার বাড়ি থেকে এক ঝুড়ি আম পাঠিয়েছে। " আর কিছু না বলে আমি ওর সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসি।

নিলু ওদের পাড়ার মুখে এসে আমাকে সাইকেল থেকে নামিয়ে আমার সঙ্গে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ায় ঢোকে। এবার মওকা পেয়ে আমি বলি " আমাকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে গেলে কি তোর মান সম্মান চলে যেতো। " নিলু ওর স্বভাব মতন চট জলদি জবাব দেয় " পাড়ার হাড়গিলে চোখদের হাত থেকে তোমার মান রক্ষা করলেই আমার মান বাড়ে। "

নিলুদের বসার ঘরে বসে আড্ডা মারছি। মিনু বৌদি একটা থালায় বড় একটা আম কেটে আমায় দিয়েছে। আমি বেশ তরিয়ে তরিয়ে আমের ফালিগুলি শেষ করছি। নিলু কিন্তু আম নেয়নি। চুপ করে  ম্যাগাজিন ঘাঁটছে, আর টেরিয়ে টেরিয়ে আমার আম খাওয়া দেখছে।

আমি সবে আমের ফালি গুলি শেষ করে , আঁটিতে কামড় দিয়েছি , নিলু উঠে এসে আমার হাত নাড়িয়ে দিলো আর আমের আঁটি আমার হাত থেকে খসে সোজা মাটিতে। আমি একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করি "এটা কি করলি ?" নিলু নির্বিকার ভাবে " তোমার আমে আমার লোভ পড়েছিল। পাছে আমার লোভের জন্য তোমার পেট খারাপ হয় তাই ওটাকে ফেলে দিলাম ,"

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি " তুইতো পাশে বসে আছিস। আমার কাছে আমের দু এক ফালি চেয়ে নিতে পারতিস। "

নিলু কিছু না বলে উঠে গিয়ে আর একটা আম কেটে এনে আমার সামনে রেখে বসে বেশ জোর দিয়ে বলে " দুদিন পরে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে লোকজন নিয়ে কাজ কর্ম করবে , আর অন্যের না বলা কথা বোঝার মতন বিদ্যাবুদ্ধি আয়ত্ত করতে পারনি। "

সেই মুহুর্তে নিলুকে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছিল তা আর কি করে লিখি।
_________
© সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment