Friday, 9 December 2016

গেছোদাদার যাত্রা কাহিনী- ২


পর্বঃ রূপনারায়ণের তীরে
----------------------

পাতলা ভিড়ে দুলকিচালে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামলাম। হুইশেল মেরে ট্রেনটা হুশ করে বেরিয়ে যেতেই ভিড়ের জটলাটাও আস্তে আস্তে হালকা হয়ে গেল। স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে ফুট ওভার ব্রীজ, সেটাতে চড়ে ডানহাতে অর্থাৎ উত্তর পানে বাঁক নিয়ে একনম্বর প্ল্যাটফর্মে এলাম। ফুট ওভার ব্রীজের পায়দানির সম্মুখেই একটা ঝাঁকড়া গাছ, আর তার গোড়াতে বেদি করা বসার স্থান, পাশেই প্রস্রাবাগার। আরো বিশ কদম পূর্বমুখী আগালেই টিকিট কাউন্টার তথা স্টেশন থেকে বহিঃনির্গমনের পথ।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে বামহাতে পশ্চিম দিকেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সকালের দিকে এখান থেকেই ভ্যান, অটো, রিক্সা পাওয়া যায়। এখন শীতকালের বিকেলবেলা, হয়ত সেই কারনেই এখানে কোন যানবাহনের দেখা মিলল না। একশো মিটার মত এগিয়ে গিয়ে ডানহাতে বাঁক নিলাম। সরু রাস্তা, রাস্তার দুপাশেই মফঃস্বলের বিকিকিনির পসরা সাজানো দোকানের সারি। সেই উত্তর দিক বরাবর আরও দুশো মিটার যেতেই NH 6 এর ফ্লাইওভার। মাথার উপরদিয়ে দু দিক থেকেই অবিরাম ছুটে চলা গাড়ির রাশি। কোলকাতা বা কোলাঘাটের দিক হতে যারা সড়কপথে আসবেন, এই বাসস্টপেই তাদের থামতে হবে। স্টপেজের নাম সামতাবেড়- পানিত্রাসবাসস্টপ।

জাতীয় সড়কের আন্ডারপাশটা পার করে, মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তথা NH -6 এর দিকে পিঠ করে দাঁড়ালাম। সামনেই সবুজ বোর্ডে সাদা অক্ষরে লেখা পথনির্দেশ। বাম হাতে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে একগাদা অটো, টাটা ম্যাজিক ভ্যান, মোটর ভুটভুটি বা হাতে টানা ভ্যান, স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে যাত্রীর প্রতীক্ষায়। এগুলো শেয়ারেই ভাড়া যায় মূলত, তবে আপনি চাইলে রিজার্ভ বুক করতেই পারেন। প্রথমে তেমনই একটা ম্যাজিক গাড়িতে চড়তে চাইলাম, কিন্তু বসার স্থানের অপ্রতুলতা আর বিকল্পের আধিক্যের কারনে সেই ইচ্ছা ত্যাগ করে, এককোণে দাঁড়ানো একটা মোটরভ্যানের দিকে এগোলাম।

মাঝবয়সী ভদ্রলোক, বললাম পিকনিক স্পটে যাব- যাবেন!
- একা যাবেন! তাহলে রিজার্ভ করতে হবে
- বেশ তাই হোক, কত নেবে?
- দেড়শো টাকা দিবেন
- ওমা এতো বেশি বলছ কেন, এখান থেকে তো তিন কিলোমিটার মাত্র
- ও দাদাবাবু, লাইনে ভাড়া বইলে যেতে দশজন আসতে দশজন, মাথাপিছু দশটাকা করে। আপনিই বলেন কি এমন বেশি চেয়েচি! তাছারা ওখানে একঘন্টা বসে থাকতে হবে!!
- সেকি তোমায় কে বল্লো , যে আমি কতক্ষন থাকব।
- সবাই যে তেমনটাই করে।
- ঠিক আছে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, চলো।

গ্রামের ছেলে ঠিকই, কিন্তু জীবনে এইধরনের ভুটভুটি ভ্যানে আগে কখনও চড়িনি। এর ব্রেকিং সিস্টেম সবটাই সম্ভবত উপরওয়ালার ভরসাতে। পা গুটিয়ে বাবু হয়ে চেপে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে, গাড়োয়ান ভাইকে বললাম ধীরে ধীরে চলো। অন্য হাতে চালকের সিটের পিছনের লোহার আংটাটা কষে চেপে ধরলাম। এই সকল গাড়ির হাইড্রোলিক থাকেনা, বা থাকলেই ওটা ফ্লেবার মাত্র। বসা মাত্রই শিরদাঁড়ার যাবতীয় খিলানে রীতিমত ঠোকাঠুকির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। তবে গাড়োয়ান ভদ্রলোক তার পক্ষে যতটা সম্ভব, ততটাই ধীরেসুস্থে চালাচ্ছিলেন।

গোটা দুয়েক রিসর্ট, হোটেল, সামতাবেড় কালিবাড়ি পেরিয়ে দুকিলোমিটার মত গিয়ে তেমাথার মোড় থেকে একট সরু রাস্তা বাঁয়ে টার্ন নিয়েছে, আমার রিজার্ভ ভ্যান সেই সরু পথেই ঢুকল। ভ্যান থামল, ছায়ার ঘোমটা ঢাকা একটা সমাধি ক্ষেত্রেই পাশে। এটা অনেকটা পার্কিং প্লেসের মত।

স্থানটা কয়েকফুট উঁচু বটে আশেপাশের চাষজমির চেয়ে। মাথায় বিশাল একটা ছায়ার ছাওনি। লাল-সাদা রঙের প্রাচীরে ঘেরা সমাধিক্ষেত্রটার পূর্ব প্রান্ত জুড়ে বাগানে ঘেরা একটা আধুনিক স্টাইলের বাগানবাড়ি। আর এই সমাধির বাম দিক দিয়েই একটা ইট বেছানো পথ গ্রামের ভিতর পানে চলে গেছে। ওই পথের একপাশে ধানের জমি অন্যপাশে আপনা থেকে হয়ে যাওয়া জংলি গাছের অযত্নের বাগান। একশো মিটার মত সামনের দিকে এগোতেই একটা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাস্তার একধারে স্কুল আর অপরপাড়ে একটা ছোট্ট খেলার মাঠ।

স্কুলের ডান গায়ে মিডডে মিলের রসুইঘর কে ফের ডানহাতে রেখে একটা মাটির আলপথ বাঁশবনের পেট ফুঁড়ে নদীর পাড়ে পৌঁছেছে। একপাশে সদ্য কাটা ধান গাছগুলো জমিতে আছরা ফেলা রয়েছে, অন্যদিকে আলুর জমির নিপুণ শৈল্পিক কানিমাটি-সারামাটির ডাঁরা। আবার একটা ছোট বাঁশঝাড়, আর সেটা পেরোতেই এক আকাশ খোলা আকাশ, এলোমেলো হাওয়ার ডানাতে ছরিয়ে ছিটিয়ে মুক্তির সিম্ফনি।

শীতের পড়ন্ত বিকেলের রোদ, গায়ে উষ্ণতার শেষ আবেশটুকু বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নদীও সেই ডুবন্ত সুর্যের উত্তাপটুকু শুষে নিতে নিতে তাকে নিজের কোলে ঢলিয়ে নিচ্ছে। ভাটির টানের রূপনারায়ণ তখন বিবসনা নারীর মতই তার পাড়ের নিকটের তলদেশ উন্মুক্ত করে রেখেছে। সেই পঙ্কিল বিভাজিকাতে একটি কুকুর মুখ লাগিয়ে কিছু একটা খুঁজছে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভীষন জীবন্ত একটা প্রতীকি ফ্রেম। নদীর বুকে উজানে বয়ে চলা একটি পানসির সৃষ্ট তরঙ্গরাশি ছাড়া নদী খানিকটা নিস্তেজ। হয়ত বা পড়ন্ত সূর্যের সাথে মৈথুনের পরবর্তী মুহুর্তেই আমি পৌঁছেছি, তাই এই নিস্তেজ বেশ। অনেক অনেক দূরে কোলাহলপূর্ণ কোলাঘাটের বিদ্যুৎ কারখানার আবছা চিমনি। মাঠে গ্রামের বধূরা স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠের কাজে ব্যস্ত। সমঅধিকারের প্ল্যাকার্ডের ভাষা হয়ত এরা পড়তেও জানেনা, তাতে কি! এটাই জীবন মাধুরী, রোজকার। এলোমেলো উত্তুরে বাতাসে ব্যর্থ ঘুড়ি ওড়ানোর প্রয়াসে রত কয়েকটি কচিকাঁচার দল।

নদীর এই স্থানটা বাঁকের জায়গা, তাই যতদুর সম্ভবচোখ যায় ততদুরই অনন্ত ফাঁকা। উপরে নীলাকাশ, অতৃপ্ত প্রেয়সীর মত, পশ্চিমাকাশের নরম সূর্য আত্মসমর্পন করছে নদীর বুকে। দূর দিগন্তে গাছের কালো সীমানা জানান দিচ্ছে তারা নীলকন্ঠের মত দুষনের বিষ পান করে চলেছে অবিরাম ক্রমাগত। পাখির দল বাসায় ফেরার প্রস্তুতিতে বাতাস মুখরিত করছে কলকাকলিতে, কিছু রঙিন ফড়িং ইতিউনি উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতিদের সাথে টেক্কা দিয়ে। প্রায় নিঃস্তব্ধ স্থানে সে এক স্বর্গীয় উপলব্ধি। ঠিক কতক্ষণ সেই মুগ্ধতার আবেশ ছিল ঠিক জানিনা। চটকা ভাঙল কিছু ফক্কর ছেলের দলের থেকে উড়ে আসা রোমিও মার্কা চেনা শব্দে।

একটি প্রেমিকযুগল, সন্ধ্যার সেই মেদুরতার মজা নিচ্ছিল তারিয়ে তারিয়ে, তারা ছবি তুলছিল, নিজেদের মধ্যে স্বলজ্জ চাহনি বিনিময়ে কত জরুরি কথাবার্তা হয়তো সেরে নিচ্ছিল। বাদ সাধল সাইকেলে আসা ওই ছেলের দলটি। মেয়েটি বেশ সুন্দরী, এখনও স্কুলেই যায় সম্ভবত, ছেলেটি একটু খ্যাপাটে গোছের, আর ঠিক সেই অর্থে হ্যান্ডসামও নয়। তাই এই টোন টিটকিরিটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি কান করে শুনলাম অবশ্য, তারা কোন কটূভাষা ব্যবহার করেনি, শুধু চুটুল হিন্দি গান মেয়েটির উদ্দেশ্যে গাইছিল। যুগলটি বোল্ডার বাঁধানো নদীর পাড় ধরে উত্তর পানে হাঁটা জুড়ল।

আমিও ওই যুগলের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে নদীর এক্কেবারে পাড় বরাবর ২০০ ফুট মত যেতেই একটা আয়তকার ফাঁকা বাছরা মত স্থান দেখতে পেলাম। এখানে এক্কেবারে আশেপাশে তেমন কেও নেই। যুগলদুটি আমাকে প্রায় অগ্রাহ্য করে নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে মেতে উঠল। আমিও প্রায় কিছুই দেখিনি গোছের করে স্থানটা ভাল করে পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম।

এই স্থানটাই তো সেইটা, যেটা আমরা চাইছিলাম। এক্কেবারে খাপেখাপ পঞ্চুর বাপ। জমিটার প্রস্থটা নদীর পাড় বরাবর, আর দীঘের অপর প্রান্তটা গ্রামের বুড়ি ছুঁয়ে আছে। ওই প্রান্তেই পুকুরপারে একটা ৫০০ লিটারের সবুজ জলের ট্যাঙ্কি, একটা মাইক্রো বেসিন, আর একটা কি দুটো টয়লেট। মাঠের উত্তর আলে ছোট ছোট গোটা তিনেক অস্থায়ী বাঁশের কাঠামো। এগুলোই সম্ভবত চড়ুইভাতির সময় সামিয়ানা বহন করে। অতএব ব্যবস্থাপনা বেশ পোক্ত। অনতি দূরেই শ্যাওড়া তলায় মানকচুর ঝোপ, বলাই বাহুল্য কারণপ্রেমিদের জন্য স্বর্গরাজ্য তথা সুখবর। মোটের উপর এক্কেবারেই চড়ুইভাতির তীর্থস্থল।


_________
@তন্ময় হক

No comments:

Post a Comment