(১)
-"বলছি, এই অভিজ্ঞতা কি আপনার জীবনে প্রথম?"
-" তাতে আপনার কি?" রীতিমত ঝাঁঝিয়ে উঠল মাসাজ টেবিলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটি। " আই হ্যাভ পেড দ্য সেম।"
- " না, মানে, তার জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থার দরকার। টপিকাল য়্যানাস্থেটিক...."
- " না, যা ই হোক, আমি সেটাই পেতে চাই। একটু যন্ত্রণার পরের সুখটুকু মিস করতে চাই না। প্লীজ, ডু ইট।" মেয়েটির গলায় আকুতি।
- " ম্যাডাম, মাসাজ নেওয়ার সময় কেমন করছিলেন। মনে হচ্ছিল ব্যথা পাচ্ছেন। "
- " হুঁ, জয়েন্টগুলোয় খুব ব্যথা আমার। আর অল্প ড্রাউসি ও ফিল করছি। "
-"স্কিন ও তো খুব খসখসে হয়ে গেছে, ম্যাডাম। এত দামী য়্যারোমা অয়েল তো একটু ও নরম করতে পারল না।
বাই দ্য ওয়ে, সকালে কি খেয়েছেন?"
- "হেলথ ড্রিংক"
- "সংগে বিস্কুট, না টোস্ট?"
- "দূর অত দামী বিদেশী ড্রিংকের সঙ্গে আর কি কিছু খেতে লাগে না কি?
ও মিস্টার, হোয়াই আর ইউ গোয়িং সো সিলি? করো কি করবে? এসো। "
সি গ্রিন তোয়ালে ঢাকা উরুসন্ধিতে গভীর সমুদ্রে ডুবে মরার আমন্ত্রণ।
সস্নেহে ওর পাশে বসে মাথার রঙ করা চুলগুলোয় বিলি কেটে দিতে থাকি। মেয়েটি ভাবে, চরম ঘটনার আগে এটা ফোর প্লে। আরামে চোখ বোঁজায়। একটা হাত আমার কোলের ওপর রাখে।
আমার পাশে চিৎ হয়ে শোওয়া প্রায় উন্মুক্ত এক নারীদেহ। কামনায় সম্পূর্ণ শিথিল। আদরের ছলে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে জানলাম ওর জীবনের কিছু কথা।
মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। বছর চব্বিশ বয়স হবে। গ্র্যাজুয়েশনের পর মডেলিংকে পেশা করার ইচ্ছায় সেইমত প্রস্তুত হওয়া।
এখন কিছু কিছু ফ্যাশান শো এবং মডেলিংয়ের পাশাপাশি একটা বাংলা টিভি সিরিয়ালের ও পরিচিত মুখ।
হঠাৎ হাতে টাকা ঢুকছে। প্রচুর টাকা। খরচ করার উপায় ভেবে মাথা খারাপ। প্রচুর শপিং, পার্লারে সৌন্দর্যচর্চা, স্পা,বডি মাসাজ। ফিগার ধরে রাখতে চটজলদি ক্র্যাশ ডায়েট। নিয়মিত জিম করে,দামী দামী ফুড সাপ্লিমেন্ট খেয়ে স্বাস্থ্যচর্চার সন্তুষ্টি। একহারা, রোগা, ফ্যাকাশে,দুর্বল এক শরীর। ঠিক আমার মায়ের মত।
(২)
আমার মায়ের যদিও কিছু করার ছিল না। আমি তখন খুব ছোট। আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয় নি, দাদার সংসারেও না। লোকের বাড়ি ঝি গিরি করে দু দুটো পেট চালাতে পারত না। ফিগার ভালো ছিল। কার যেন যোগাযোগে আর্ট কলেজে ন্যুড মডেলের কাজটা পেয়েছিল। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঘুরে ঘুরে এক্সট্রার রোল জুটত কখনও। আর কিছু চান্স পেয়েছিল ওই সব য়্যাডাল্ট সিনেমায়। তখন তো হাতে হাতে মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফিক সাইট ছিল না। থার্ড ক্লাস ছেঁড়া সিটের হলে নুন শোয়ে চলত এ সব সিনেমা। আরও কিছু হয়ত করত। করে আমাকে বড় করেছিল।
পাড়ায় মা অবিশ্যি লক্ষ্মী বৌটি সেজে থাকত। আটপৌরে শাড়ি পরে ব্যাগ হাতে যখন কাজে বেরোত, প্রতিবেশীরা জানত শহরে আয়ার কাজ করে।
আমি জানি, মায়ের ওই ঈর্ষণীয় ছিপছিপে ফিগারের মূল রহস্য ছিল ঠিকমতো খেতে না পাওয়া। ওই ফ্যাকাশে চামড়া ভিটামিন, মিনারেলসের অভাবে তৈরি। তার ওপর সবসময় ভাবত এই পাপের পথে নামার জন্য যদি সন্তান, মানে আমার কোনও অকল্যাণ হয়। তাই সব সময় ব্রত, উপবাস করে করে শরীরটাকে আরও শেষ করে ফেলেছিল। নানা রোগে ভুগে চল্লিশের আগেই মরে বেঁচেছিল অভাগী।
মা মারা যাওয়ার সময় আমি মোটে তেরো। স্কুল ছাড়তে হল। ভাগ্যিস প্রতিবেশি রতনকাকুর সেলুনে চুলদাড়ি কাটার কাজটা জুটিয়ে ফেলেছিলাম। না খেয়ে মরতে হয় নি। তারপর রতনকাকিমা পাশেই বিউটি পার্লার করল। ওদের একতলা বাড়ি প্রোমোটিং হতে ফ্ল্যাটের সংগে পুরো গ্রাউন্ড ফ্লোর ওদের হল। ওখানে বড় করে তৈরি করল মেয়ের নামে 'শ্রী ইউনিসেক্স পার্লার।' এই নামের আড়ালে ' বডি মাসাজ উইথ কমপ্লিট স্যাটিসফ্যাকশান' ও। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে আস্তে আস্তে ক্লায়েন্টের ভীড় বাড়তে লাগল।
রতনকাকুর বয়স হয়েছে। চুল- দাড়ি কাটা, উৎসবাদিতে নাপিতগিরি তিনি করেন। একটা শর্ট কোর্সে মাসাজ শিখে এসে ওই কাজটা আমিই করি।
মেল টু মেল, মেল টু ফিমেল,ফিমেল টু মেল, ফিমেল টু ফিমেল সব রকম মাসাজ সার্ভিস এখানে পাওয়া যায়। তবে ফিমেল ম্যাসিওর শ্রীর চেয়ে পুরুষদের কাছে আমার চাহিদাই বেশি। মহিলাদের কাছে তো বটেই।
আউটডোর ও করি। বিরাট বড়লোকের ঘরের বৌয়েরাই মূলত ক্লায়েন্ট। ব্যস্ত স্বামীর সান্নিধ্যের দুধের স্বাদ মেল ম্যাসিওর কাম জিগোলোর ঘোলেই মেটান তাঁরা। মোটা অর্থের বিনিময়ে। এই করেই ঝুপড়ি ছেড়ে রতনকাকুদের য়্যাপার্টমেন্টে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি। প্রদীপ কুমার ঘোষ নাম থেকে পদবী উড়িয়ে নিজেকে অবাঙালী বানিয়ে রাখি সিক্স প্যাক ফিগারের দৌলতে। ভালোই আছি দিব্যি।
(৩)
- " ম্যাডাম, সব সময় সাপ্লিমেন্টের ওপর থাকেন, কৌটোর গায়ে লেখা আছে should be taken with food, দেখেছেন?"
- " দেখেছি। কিন্তু ওই কিনতেই সব ইনকাম শেষ। মাসের শেষে বাবার কাছে হাত পাততে হয় প্রায়ই। তা ছাড়া পেটভরে খাবার খেলে ওয়েট গেন করে যাবো যে। প্রফেশনে টিকে থাকব কি করে?"
- সব সময় সারা শরীর এভাবে সান্সক্রীনে ঢেকে রাখলে চামড়ায় রোদ পড়ে না। ভিটামিন ডি র অভাবে চামড়া তো তাই এমন খসখসে হয়ে গেছে। আর খাবারে ক্যালসিয়ামের ঘাটতিতে হাড়গোড় এমন দুর্বল হয়ে গেছে যে এইটুকু প্রেশারে ব্যথা লাগছে। দিনভর পরিশ্রম অথচ গ্লুকোজ ফ্রি ডায়েট, ড্রাউসি তো লাগবেই ম্যাডাম।
সারাদিনের ক্লান্তির পর রিল্যাক্সিং বডি মাসাজ। অপুষ্টিজনিত দুর্বলতা তো আছেই। তার ওপর আদরের স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। কি নিষ্পাপ তার সেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা।
সব মেয়েই বোধহয় এমন নিষ্পাপ হয়। খুব সহজে বিশ্বাস করে ফেলে চারপাশের সবাইকে। কাউকে ভালোবাসলে তার জন্য সবকিছু উজাড় করে দিতে পারে। আর তাদের সেই সরলতার সুযোগ নিয়ে যে পারে তাদের লুটে নিতে চায়। তাদের প্রতারণা করতে চায়। তারপর মেয়েগুলোকে নষ্ট মেয়ে বলে।
আমার মা খারাপ মেয়ে ছিল। কিন্তু সকলের সামনে একটা মানুষ যে তার সারা জীবনের ভরণপোষণের ভার নিয়েছিল, এক সন্তানের দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সে সব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সরে পড়েছিল । তারই সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মা কে বাধ্য হয়ে খারাপ পথে হেঁটে নিজেকে ক্ষয় করতে হয়েছিল তিলে তিলে।
কিন্তু এই মেয়েটা? মাসাজ টেবিলে শিশুর মত শুয়ে থাকা এই মেয়েটা, যেন সাক্ষাৎ আমার জননী- জন্মভূমি।মাথায় ইন্ডিগো পাওডার পাঞ্চ হেনা পাওডার দিয়ে ডাই করা চুলের ভার যেন ফটোগ্রাফে দেখা কালচে- সবুজ পার্বত্য অরণ্য। অলসভাবে ঘুমিয়ে থাকা স্তনদুটি যেন মধ্যভাগের মালভূমি। ক্রমশঃ গর্তের ভেতর ঢুকে যাওয়া পেট যেন সমভূমি ক্রমশ বালুকাবেলার মত নীচু হয়ে মিশে গেছে তার কটিদেশের সি গ্রীন সমুদ্রমেখলায়। তার শরীর, তার মন, মনন, মেধা, বুদ্ধি, কোনওকিছুই কখনো তার নিজের আয়ত্তাধীন ছিল না। যুগে যুগে তার অধিকার নিয়েছে যে যেমনভাবে পেরেছে।
এই শিক্ষিতা, স্বাবলম্বী মেয়েটিকে কত সহজে বুঝিয়ে দেওয়া গেছে যে দামী ফুড সাপ্লিমেন্ট তার কেরিয়ারের একমাত্র প্রয়োজন। সে সেটাই বিশ্বাস করে অনিয়ন্ত্রিত ডায়েটিংয়ে জীবনপাত করে যাচ্ছে। এমন চলতে চলতে একদিন তাকে ছিবড়ে করে ফেলে দিয়ে দেশের বাজার অর্থনীতি অন্য মেয়ের পেছনে পড়বে। দেশে কি বোকা মেয়ের অভাব? মেয়েটার যোগ্যতায় কি এই পেশা ছাড়া অন্য কোনও অপশন ছিল না? না কি চটজলদি কাঁচা টাকার ওপর তার এত লোভ! মেয়েটার কি সত্যিই বডি মাসাজের নামে একজন বাজারের জিগোলোর কাছে কৌমার্য বিসর্জন দিতে খুব ভালো লাগছে, না কি স্ট্যাটাস মেনটেন করার জন্য অসহায়ভাবে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে?
(৪)
-" সরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাই আপনাকে ডিস্টার্ব করি নি ম্যাডাম। কেমন বোধ করছেন এখন?"
- " ড্রাউসিনেস একদম নেই। বেশ ঝরঝরে লাগছে। "
- " বাড়ি গিয়ে সলিড কিছু খেয়ে এক গ্লাস জল খাবেন, দেখবেন পুরো সুস্থ লাগছে।
বলছিলাম কি, আজকে ওই সার্ভিসটা বরং পোস্টপন্ড থাক। করলে যদিও আমারই লাভ হত। য়্যাডভান্স হিসেবে যা পে করেছেন করেছেন। আর কিছু দিতে হবে না। একা একা ফিরতে পারবেন, না দিয়ে আসব?"
-"থ্যাংকস। পারলারের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিলে আমি একাই যেতে পারব।"
দ্রুত পোশাক পরে বেরিয়ে গেল মেয়েটা।
পুরো টাকা জমা না পড়ায় কাউন্টারে মৃদু অসন্তোষ সৃষ্টি হল। রতনকাকিমাকে মিথ্যে কথা বানিয়েই বলতে হল হঠাৎ মেয়েলি সমস্যা শুরু হয়ে যাওয়ায় পুরো সার্ভিস দেওয়া গেল না।
আমি খারাপ ছেলে হতে পারি। কিন্তু তথাকথিত ভদ্রলোকদের মত একটা মেয়েকে নষ্ট করতে আমার রুচিতে বাধল। আমি তো আর ওদের মত প্যান্ডেলের নারীমূর্তির সামনে '' মা মা" বলে কিংবা স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় পতাকার তলায় দাঁড়িয়ে " বন্দেমাতরম " বলে আধিখ্যেতা করি না।
___________
© শর্মিষ্ঠা নাহা
No comments:
Post a Comment