চেম্বারে ভালোই ভিড়। ভেতরের বসার জায়গা অপ্রতুল হওয়ায় বেশিরভাগ ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ গেট এর কাছেই পান দোকানে দাঁড়িয়ে এটা সেটা কিনে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভেতরে গিয়ে খবর নিয়ে আসে, কত জনের পর তার লাইন? ডাক্তারবাবুর বিরাট বাড়ির দিকে তাকিয়ে অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে," ভিত দিতেই তো লাখ গেছে।" পাশ থেকে একজন পানের পিক গলা বাড়িয়ে ড্রেনে ফেলে বলে, 'সব কালো টাকা। দুনম্বরি সব'।
সুজিত একটা পিলারে ঠেস দিয়ে এদের আলোচনা শুনছিলো। সাদা মার্বেলের কার্নিশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ' আমার ছেলে কেও ডাক্তার বানাবো।' পরক্ষনেই চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আগে ছেলেপুলে তো হোক। তারপর না হয়। কি যে হবে কে জানে। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে। ভেতরে উঁকি মেরে একবার দেখে। খুব ভিড়। কত দেরি হবে কে জানে। দেরি হতে থাকলে তো সম্যসা বাড়বে, বই কমবে না।
ডাঃ অনিল রয়। এলাকার নামকরা গাইনিকলজিস্ট।বয়স বাড়ার সাথে সাথে নাম ও কেমন বেড়েই চলেছে। কম্পউন্ডার এক এক করে পেশেন্টের নাম ডেকে ভেতরে পাঠাচ্ছে। এক জনের দেখা শেষ হলে আর এক জন কে পাঠায়।শ্যামলি রাউত, কুলসুম বেগম, রঞ্জিতা দাস একে একে ডাকে।
খাতা তুলে পরের নাম ডাকতে গিয়ে থমকে যায় কম্পাউন্ডার। চোখ তুলে বিস্মিত কণ্ঠে ডাকে - সুজিত বর।
কানে যেতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ছুটে আসে সুজিত। কম্পাউন্ডার তার ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখে মাথা থেকে পা অব্দি দেখে। নাহ:, এতো গোটাসোটা ছোকরা।
- পেশেন্ট কই?
-' আমি.. .. আমিতো।' আমতা আমতা করে সুজিত বলে। ' আমার বউ বাড়িতে। আমি শুধু ডাক্তার বাবুর সাথে একটা আলোচনা করতে এসেছি।'
-'ও'। বলে ভেতরে নিয়ে যায়।
ভেতরে ঢুকে সুজিত পেশেন্টের জন্য বরাদ্দ চেয়ার টেনে বসে। অনিল বাবু চশমার ফাঁক দিয়ে একপলক দেখে বলেন, ' আপনি ?'
কপালে জমা হওয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের চেটো তে মুছে বলে -' খুব বিপদে পড়েছি ডাক্তারবাবু। বউ বাড়িতে। আমিই এলাম।'
অনিল রয় খুব মিশুকে মানুষ। চেয়ারে গা এলিয়ে বলেন ' হুম। সে তো সবাই সম্যসায় পড়লেই আসে। আনন্দে কি কেউ এ চত্বর মাড়ায়?'
সোজা হয়ে বসে সুজিত চিন্তিত মুখে বলে, 'সমস্যা বিয়ের দুমাস পর থেকেই শুরু। এখন তো খুব বাড়াবাড়ি রকম স্যার।' বলেই কানের ধার বরাবর নেমে আসা ঘাম জামা দিয়ে মোছে।
অনিল বাবু ভালোই বুঝতে পারছেন, ছোকরা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে।তিনি ও তো.. যাইহোক ডাক্তারি বিদ্যে পেটে ছিল বলেই এই ছোকরার মতো হাল হয় নি। মুচকি হেসে ফেললেন।
- আচ্ছা বুঝলাম। স্ত্রী বমি করছে খুব?
- হ্যাঁ স্যার।
হাসি ঠোটে চেপে জিগ্যেস করেন, ' বাড়িতে বাবা মা বা শশুর শাশুড়ি কেউ আছেন?'
- না, আমরা এখন একাই থাকি।
আজকালকার এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির এই একটা সম্যসা। তুমিতো চাকরিবাকরি করতে বাইরে যাবে নিশ্চই, তখন কে দেখবে এই শরীরখারাপ?
- বমি হচ্ছে ভালো তো। কদিন ধরে হচ্ছে?
- তা সে গত একমাস ধরে।
ডাক্তারি ভঙ্গিতে ভারিগলায় জিজ্ঞেস করেন ' আর কি কি অসুবিধে?'
- মাথা ঝিমঝিম করে, ক্লান্তি বোধ করে খুব। একদম দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না স্যার। একটুতেই শুয়ে পড়ে।
- আচ্ছা আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন', বলে একটা বমির ওষুধ আর একটা ভিটামিন লিখে দেন প্রেসক্রিপশনে। কলেজে সেই যে শিখেছিলেন, কোনো পেশেন্ট কে বিনা ওষুধ লিখে ছাড়তে নেই।পুরো সুস্থ হলেও ভিটামিন লিখে দাও। নইলে তুমি খারাপ ডাক্তার, রোগ ধরতে পারোনি তাই ওষুধ দিতে পারো নি। বদনাম রটে যাবে।
সুজিত গলা নামিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলে,' তা নিয়ে আসবো স্যার। কিন্তু হাত দিয়ে আদর করলেও কেমন সাড়া দেয় না। ওর মুডটা তখন অফ হয়ে যায়। এর সুরাহা হবে স্যার?'
অনিল বাবু হালকা হাসতে বলেন, "হ্যা, সব সুরাহা হবে। এই সময় একটু ওইরকম হবে। নতুন বিয়ে, প্রথমবার তো। দিন গেলে আপনি ও ঠিক হয়ে যাবেন।'
সুজিতের মুখে হাসি ফুটে ওঠে এবার।উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ। ' হেঁ হেঁ। প্রথমবার তা ঠিক স্যার। ঠিক হয়ে যাবে বলুন?
- হ্যা। কয়েকমাস পর সুখবরও পেয়ে যাবেন।
খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে সুজিত। 'খুব আশা করেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি স্যার। জানতাম আপনি পারবেন।' কিন্তু 'কয়েকমাস' কথাটা কেমন বড্ড দেরি ঠেকলো। একটু থেমে ঝুঁকে ডাক্তার বাবুর মুখে চেয়ে বলে ' একটু তাড়াতাড়ি করা যাবে না?তাহলে বড্ডো উপকার হয়।'
পেশেন্টের চাপ আছে। কথাটা শুনেই রাগ হল অনিল বাবুর। ঝেড়ে বললেন, " স্ত্রীকে নিয়ে আসুন। সব টেস্ট করে বলে দেব কত দিনে বাচ্চা হবে।"
- ওর কেন টেস্ট করবেন স্যার? সম্যসা তো আমার।
অনিলবাবু চাবুকের মতো ছিটকে সোজা হয়ে চিৎকার করে উঠলেন,' এই মাথা ঘোরা, বমি হওয়া তবে কার?' আওয়াজে কম্পাউন্ডার ছুটে এসছে। সুজিত কাঁদো কাঁদো মুখে হাত জোড় করে নত মুখে বলে, ' আমার স্যার। উত্তেজিত হলে ও সাড় দেয় না। বেরিয়ে যায়। আমার মাথা ঘোরে, ঝিম ঝিম করে, দুর্বল লাগে স্যার। আমাকে দেখলেই ওর আজকাল নাকি ঘেন্নায় বমি পায়।
ডাক্তারবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বেসিনে মুখ আর মাথায় জল দেন। তিরিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে এই প্রথম।।।
____________
© সাফিন আলি
No comments:
Post a Comment