জলাতঙ্ক নিয়ে লুই পাস্তুর অনেক গবেষণা করে জলাতেঙ্কর টিকা আবিস্কার করলেন। কিন্তু কেন শীতকালে আমার জলাতঙ্ক হয়, সেটা আমি নিজেও জানি না। পাস্তুর সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো তার কাছে যেতাম।
আমার একটি আতঙ্কের স্মৃতি আপনাদের বলছি। কয়েক বছর আগের কথা, ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা চলছে ।
আমার কর্ম-জীবন সবে শুরু হয়েছে।মামাবাড়ি যেতে হবে বিশেষ প্রয়োজনে, বড়মামী চিঠি লিখেছেন।বাবা- মা যেতে পারবেন না। আমাকেই একা যেতে হবে।
কিন্তু অফিস ছুটি দিচ্ছে না, অনেক কষ্টে ছুটি পেলাম,তৎকালে ট্রেনের টিকিট কাটলাম। আমার মামাবাড়ি দার্জিলিং ।সত্যি এখনো আমার তিন মামা দার্জিলিং থাকেন। দার্জিলিং জেলার এক অল্পখ্যাত জায়গায়, যেখানে গ্রাম্য পরিবেশ, গাছগাছালি আর পাখির কুজন সব সময় দেখা যায়।
অনেকবছর পরে যাচ্ছি মামাবাড়ি, তাও একা একা।খুব রোমাঞ্চ হচ্ছে আমার।আগের রাতে ভাল ঘুম হল না।
মামাবাড়ি পৌঁছে প্রথম রাতটা আনন্দে ভেসে গেলাম।সবার আদর খাচ্ছি। অনেক নতুন পাকা বাড়ি হয়েছে, লোকের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে ।পরদিন সকাল থেকে বাস্তবের রুক্ষ জমিতে আছড়ে পড়লাম ।আমার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। বাড়িতে আমাদের ঘরের লাগোয়া টয়লেট, বাথরুম ।কিন্তু মামাবাড়িতে বিশাল উঠানের অপরপ্রান্তে বাথরুম।তোয়ালে পরিধান করে ঘরে বড়মামীর ঘরে গেলাম,লেপ কম্বলের মধ্যে কোনটা মামা আর কোনটা মামী বোঝা যাচ্ছে না।
অনেক হাঁকাহাঁকির পর লেপের মধ্যে থেকে বড়মামার মুখ বের হলো এবং কড়া ধমক-“রাতের বেলা ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?যা ঘুমা !!”
আমি-“সকাল হয়ে গেছে মামা, খুব পটি পেয়েছে।সকালে আমি চান ও করি। তোমাদের তো গিজার নেই। বড় মামীকে বলোনা প্লিজ, একটু জল গরম করে দিতে...।”
“গিজার ?ডাক হাজার..!!তোর কোন মামী ঘুম থেকে উঠবে না ।আবার ঘুমিয়ে পড়।”
বড়মামা আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
আমি উভয় সংকটে পড়েছি,কি করে ঘুমাই? মাধ্যাকর্ষণের তীব্র টান আমার শরীর কে আনচান করে তুলেছে ।
খালি গায়ে তোয়ালে পরে উঠানে নামলাম, তীব্র উত্তেজনা অনুভব করছি।শীতের কামড় কুকুরের কামড়ের মত গায়ে লাগছে।কলে জল আসেনি,বাথরুমে থাকা একটা জলভরা বালতি হাতে নিলাম আর সাথে সাথে.........।
জলের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতর থেকে একটা আওয়াজ উঠে আসছে-“হি-হি-হি-হি.......।”
কিছুতেই আর থামছে না, আমি দাঁড়িয়েই আছি আর কাঁপছি।
অরন্যদেব ছাড়াও একজন আছেন, যিনি রাতে ঘুমান না- আমার দিদা।ভাগ্যিস ঘুমান না...।
“কেডা রে? হাসে কেডা ???”-দিদা চেঁচিয়ে উঠল ।
ভয়ে আমার হি-হি সামান্য কমলো,তারপর আবার...।
দিদার চিৎকার চলছে আমার কাঁপুনিও চলছে।
আস্তে আস্তে তীব্র হচ্ছে-“হি-হি-হি-হি.......।”
দিদা এবার বড়মামীকে ডাকলেন ।
বড়মামীকে এসে দেখেই-“ওমা!! দেখ কাণ্ড ...!!মামাদের ডাকি” বলে কোথায় চলে গেলেন আর খোঁজ পাওয়া গেল না।মনে হয় আবার লেপের নিচে চলে গেলেন ।
তীব্রতর হচ্ছে আমার হি-হি-হি-হি.......।
আমি একদম হতভম্ব হয়ে পড়েছি। মনে হল –“হাজার বছর ধরে আমি করিতেছি হিহিহিহি...।”
জলাতঙ্ক হল কিনা আমার বুঝতে পারছি না।
শীতে একদম জমে গেছি।
আমাকে রক্ষা করলো পাশের বাড়ির বুঁচকি ।সত্যি আমার জীবন রক্ষা করল, কিন্তু মন নিয়ে নিল।এই মেয়েটির সম্পর্কে আগের রাতে সব মামী সাবধান করে দিয়েছে আমাকে।মেয়েটির নাকি ছেলে-দেখা স্বভাব আছে। বুঁচকির বাবা-মা সকালে বেরিয়ে যান আর বুঁচকি দোতলার জানলা দিয়ে ছেলে দেখে ।কিন্তু বুঁচকি কি আমার জন্যই ভোর রাতে উঠে অপেক্ষা করছিল? কে জানে?
বুঁচকি এলো এবং নিজের চাদর খুলে আমাকে জাপটে ধরল ।আমাদের দু’জানার মধ্যে কেবল একটি চাদরের ব্যবধান। ওর নিঃশ্বাস আমার গায়ে পড়ছে, আমার নিঃশ্বাস ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে, আমি ওর চেয়ে অনেক বেশি লম্বা, প্রায় ছয় ফুট ।কতক্ষণ আমরা অর্ধনারীশ্বর মূর্তির মত ছিলাম, মনে নেই।
আমি প্রথমে মুখ খুললাম- “বুঁচকি এবার তোমার বোঁচকা সরাও, আমার খুব গরম লাগছে..।”
“না-না, তোমার অবস্থা খুব খারাপ”- বুঁচকি উত্তর করলো ।
সত্যি আমার অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে আস্তে আস্তে।কি গরম! মেয়েটাও খুব মোটা, গায়ে কি জোর !!
নিজেকে শাহারুখ খান আর বুঁচকি কে আমার কাজল মনে হচ্ছে ।
সিনেমায় ভিলেন কে আস্তেই হয়।যবনিকার পতন হল । বড়মামী এলেন আর গঞ্জনা শুরু হল-
“হায় হায় ডোডো,তোর মাকে কি কৈফিয়ত দেব? এই জন্যই এত ভোরবেলায় ওঠা তোর?ছি-ছি!! দু’জনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঁচকি ওকে ছাড় তাড়াতাড়ি..।”
“আরে ছেলেটা মরে যাচ্ছে..” বুঁচকি বললো ।
আমি তখন সত্যি মরে যাচ্ছিলাম । বড়মামী গালাগালি করতে করতে চলে গেলেন ।
আমাদের দেখতে পাড়ার লোকসব জড় হল ।কে একজন বলে উঠল-“শঙ্খ লাগছে,দৌড়ে আয়...।”
সব মামা-মামী ঘুমের মাদকতা অগ্রাহ্য করে এলেন।
ছোট মামী এসেই সপাসপ...।লাঠির বাড়ি পরতে লাগলো আমাদের ওপর ।
বুঁচকির গায়ে বেশি পড়ল.. । মেয়েটার কি সহ্যশক্তি ?অনেক পরে ও আমাকে ছাড়ল । বুঁচকির মার সাথে মামীদের জোর ঝগড়া বাঁধল ।
আমি দিদার ঘরে শুয়ে আছি।পটি আর পাচ্ছে না, চলে গেছে ।
দিদা আমার মাথায় হাত দিচ্ছে-“আমারে ডাকলি না ক্যান?আমি তোরে গরম জল করে দিতাম? আহারে ছেলেটার খুব লাগছে রে ...।”
“তোমরা ভাল না কেউ। আমি কাল বাড়ি চলে যাব”-আমি বললাম ।
“আমরা তো ভাল না। কিন্ত অই মেয়েটা কেমন রে ডোডো ?”
“খুব মায়া-মমতা মেয়েটার”- আমি বললাম।
“বুঝ্সি, আজ-ই তোর মারে চিঠি দিতাছি”- দিদা উত্তর করলো ।
কিন্ত কোন চিঠি গেল না আমাদের বাড়ি, কারণ মামীদের চূড়ান্ত আপত্তি ছিল।
মেয়ে ফর্সা কিন্তু বেঁটে আর ওর স্বভাব নিয়ে মামীদের নাকি সংশয় আছে ।
আমি পরদিন একা একা বাড়ি ফিরে এলাম। আসবার দিন ও দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে আমার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। বুঝতেই পারছেন কে... ?
আমি তারপর আর মামাবাড়ি যাইনি।
_______
@রমেন দে
No comments:
Post a Comment