গত রবিবারে গেছিলাম বেড়াচাঁপার খনা-মিহিরের ঢিবি। খনা কে সেটা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে মতভেদ রয়েছে। চন্দ্রকেতুগড় নিয়েও রয়েছে একাধিক জনশ্রুতি। মেগাস্থিনিসের ভারত ভ্রমন বৃত্তান্ত, প্লিনির গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে চন্দ্রকেতুগড়ের। তাদের বিবরন অনুযায়ী চন্দ্রকেতুগড় ছিল প্রাচীন গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের রাজধানী। প্রাসিই এবং গঙ্গারিডি রাজ্যের বাহিনী মিলিতভাবে সিকন্দরমহান আলেকজাণ্ডারের গতি রোধ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আলেকজাণ্ডারের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন দেশ ছেড়ে বাইরে থাকার কারনে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠেছিল। যাইহোক দুপক্ষের যুদ্ধ আর সংঘটিত হয়নি, আলেকজাণ্ডারের বাড়ি ফেরার পথে ব্যবিলনে মাত্র ২৯ বছর বয়সে মারা যান।
খনা-মিহিরের জনশ্রুতি :-
**********************
একটি মত অনুযায়ী খনা হলেন একজন বিদূষী মহিলা যিনি রাজ জ্যোতিষী বরাহের গৃহবধূ এবং মিহিরের ধর্মপত্নী। বরাহের সন্তান মিহিরের জন্ম হলে তিনি গননা করে জানতে পরেন তারপুত্র মিহির অল্পায়ু, জন্মের ১২ দিন পরে মারা যাবে মিহির তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে সদ্যজাত মিহিরের নাম গোত্র ও জন্মস্থান লিখে একটা হাড়িতে চাপিয়ে মিহিরকে জলে ভাসিয়ে দেন। এক কাকদ্বীপিয় ব্রাহ্মণ স্নান করতে গিয়ে মিহিরকে পান। সেখান থেকে শ্রীলঙ্কার রাজবাড়িতে পৌঁছান মিহির। সেই রাজবাড়ির রাজকন্যা ছিলন খনা। খনা এবং মিহির এক সাথেই বড় হতে থাকে তাদের মধ্যে পরিনয় হয় এবং বিয়ে। অপর একটি মতে খনা আততায়ীর চক্রান্তে পিতৃ-মাতৃ হারা হয়ে সেই বাড়িতে পৌঁছায় যেখানে মিহির পালিত হচ্ছিল। দুজনেই সেখানে জ্যোতিষ শাস্ত্র বিষয়ে অধ্যয়ন করেন এবং পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বিয়ের পরে খনা ও মিহির দুজনে মিলে মিহিরের জন্মভূমির অনুসন্ধানে বের হয়। বরাহের অদি বাসস্থানে পৌছায় কিন্তু সেখানে মিহির তার পিতা-মাতার খোঁজ পায়নি। অবশেষে তারা দুজনে পৌঁছায় রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের দ্বিতীয় রাজধানি উজ্জ্বয়িনী নগরে।
শকদের পরাজীত করে রাজা বিক্রমাদিত্য উজ্জ্বয়িনী দখল করেন। বিক্রমাদিত্য শব্দের অর্থ সূর্যের মত তেজ। শকদের উচ্ছেদ করার জন্য বিক্রমাদিত্য শকারি নামেও পরিচিত। উজ্জ্বয়িনীতেই বরাহের সাথে খনা ও মিহিরের সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং মিহির তার পিতৃগৃহে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয়ে খনার গননা রাজদরবারের দাপুটে জ্যোতিষী বরাহের গননাকেও হার মানিয়ে দিতে থাকে এতে বরাহ প্রমাদ গোনেন। সম্ভ্রম নষ্ট হবার ভয়ে অথবা দাপদ কমে যাবার ভয়ে বরাহ নিজের ছেলে মিহিরকে আদেশ দেন যেন মিহির নিজ স্ত্রী খনার জিহ্বা কেটে বরাহকে উপহার স্বরূপ দান করেন। আদেশ দানের পরে খনাকে ৭ দিন সময় দেওয়া হয়। সেই সাত দিন খনা গ্রামের চাষীদের চাষবাস সম্বন্ধীয় নানান ধরনের টিপস দেন। প্রতিটা পরামর্শ পদের আকারে দিতেন এবং সমস্ত পদেই খনার শ্বশুরের উল্লেখ থাকত। এই পদ গুলিই খনার বচন নামে পরিচিত। সাতদিন পরে খনার জিভ কেটে দেওয়া হয় আর তাতেই তার মৃত্যু হয়। অপর একটি মতে বরাহ মিহিরকে খনার জিভ কেটে নেবার আদেশ দিলে তারা অত্যন্ত গোপনে চন্দ্রকেতুগড় পৌঁছান।
সেই সময় বঙ্গদেশও খুব সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। চন্দ্রকেতুগড়ে আসার পরে খনা ও মিহির স্থানীয় সামন্ত রাজ বা গুপ্ত অধীনস্থ গভর্ণরের সান্নিদ্ধ লাভ করেন। স্থানীয় শাসনকর্তা খনা ও মিহিরকে তার রাজসভায় স্থান দেন। চন্দ্রকেতুগড়ে থাকার সময় খনা স্থানীয় কৃষকদের মনের মানুষ হয়ে ওঠেন। খনার বচন মেনে চলার ফলে কৃষকেরা জমিতে আরো বেশি বেশি ফসল ফলাতে সক্ষম হন। বেড়াচাঁপায় খনার নামে একটা মন্দির নির্মাণ করা হয় যেখানে খনা তার দেবতার আরাধনা করতেন। মন্দিরটি খুব সম্ভবত বিষ্ণু মন্দির ছিল। বর্তমানে ঐ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষটি কলকাতা পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ অধিগ্রহন করেছে। ঐ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষটি খনা-মিহিরের ঢিবি নামে পরিচিত। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী খনা মিহিরের ঢিবির নিচে রয়েছে একটি সোনার নৌকো এবং এটি সোনার সাপ। এই জনশ্রুতি বলবৎ থাকার কারনে খনা-মিহিরের ঢিবির আশেপাশে কোন সাপ দেখা গেলে কেউ তাকে মারেনা।
বেড়াচাঁপা নামের সাথে জড়িয়ে থাকা জনশ্রুতি :-
*******************************************
বেড়াচাঁপা নাম টার পেছনেও আছে একটা ইতিহাস। জনশ্রুতি অনুযায়ী রাজা চন্দ্রকেতুর গৃহবধূ ভোজবাজিতে পারদর্শিনী ছিলেন আবার স্থানীয় এক পীর সাহেবও ভোজবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ম্যাজিশিয়ান কে সেটা নিয়ে তর্ক বাঁধে। রাজার গৃহবধূ অভয় দেন অমাবস্যার রাতে দুটো চাঁদ দেখাবেন আর পীড় সাহেব বলেন বেড়ার গায়ে চাঁপাফুল ফুটিয়ে দেখাবেন। রাজার গৃহবধূ বহুকষ্টে অমাবস্যার রাতে দুটো চাঁদ দেখান তারপরে মারা যান। পীর সাহেবও তার কথা মত বেড়ার গায়ে চাঁপাফুল ফুটিয়ে দেখান। রাজার গৃহবধূ তর্ক চলাকালীন প্রান ত্যাগ করার পীরের জয় হয় এবং সেই থেকে ঐ জায়গার নাম হয় বেড়াচাঁপা।
রাজা চন্দ্রকেতু ও পীর গোরাচাঁদের জনশ্রুতি :-
*****************************************
রাজা ধর্মকেতুর পৌত্র রাজা চন্দ্রকেতু একজন সুশাসক ছিলেন। তার রাজ্য সুজলা, সুফলা ও শস্যশ্যামলা ছিল। ব্যবসা-বানিজ্যে বর্হিবিশ্বের সাথে চন্দ্রকেতুগড়ের যোগসূত্র ছিল। গাঙ্গে ছিল চন্দ্রকেতুগড়ের প্রধান বন্দর। নাগরিকদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল। হঠাৎ চন্দ্রকেতুগড়ে উদয় হয় পীর হজরৎ সৈয়দ আব্বাস আলীর যিনি পীর গোরাচাঁদ নামে পরিচিত। পীর রাজদরবারে এসে রাজার নিকট এক চর্ম পরিমান জায়গা প্রার্থনা করেন। রাজা ভাবেন কতটুকুই বা জয়গা হবে সেইমত পীরকে মেপে নিতে বলেন। পীর তার কাছে থাকা চামরাটিকে অনেক খণ্ডে বিভক্ত করেন এবং সেই খণ্ডগুলির দ্বারা একটা বিশাল অঞ্চল ঘিরে ফেলেন। রাজা অত জায়গা দিতে অস্বীকার করেন। পীর তৎকালীন দিল্লিশ্বরের নিকট অভিযোগ দায়ের করেন।
দিল্লিশ্বর গৌরের সুলতানকে ব্যপারটি দেখাশোনার ভার দিলে গৌরের সুলতান রাজা চন্দ্রকেতুকে পীরের দাবি মেনে নিতে বললে রাজা চন্দ্রকেতু তা প্রত্যাক্ষান করেন ফলে গৌরের সুলতানের সমর্থনপুষ্ট পীর গোরাচাঁদ ও চন্দ্রকেতুর মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধের আগে রাজা তার রানী ও নগরবাসীকে বলে যান তিনি যুদ্ধে জিতলে রাজধানীর দিকে সাদা পায়রা উড়ে আসবে কিন্তু পরাজিত হলে উড়ে আসবে কালো পায়রা। গৌড়ের সুলতানের পাঠানো পীর শাহ পীর গোরাচাঁদেরর পক্ষ নিয়ে রাজা চন্দ্রকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল চাঁপাতলার রনখেলার প্রান্তরে যেখানে রাজা চন্দ্রকেতুর দুই প্রিয়পাত্র হামা ও দামা যুদ্ধানুশীলন করতেন। যুদ্ধে রাজা চন্দ্রকেতু জয়ী হবার সমীপে চলে এসেছিলেন এমন সময় ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে রাজধানির দিকে উড়িয়ে দেওয়া হয় কালো পায়রা। সেটা দেখে নগরবাসী বিমর্ষ হয়ে পরেন এবং রানী পদ্মদহে ডুবে আত্মহত্যা করেন। এই খবর রাজার কাছে পৌঁছাতেই রাজা মনোবল হারিয়ে যুদ্ধে পরাজয় বরন করেন।
পরাজিত রাজা চন্দ্রকেতু রাজ্যে ফিরে পদ্মদহে প্রান বিষর্জন দেন। সেই পদ্মদহ আজ মজে গেছে। ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী পদ্মদহ আজ চলে গেছে স্থানীয় কৃষকদের দখলে। পদ্মদহ আজ চাষের জমিতে পরিনত হয়েছে। অনেকের মতে রাজা চন্দ্রকেতু এবং পীর গোরাচাঁদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেটা এক চর্ম পরিমান জমিকে কেন্দ্র করে নয় বরং ধর্মকে কেন্দ্র করে হয়েছিল। পীর গোরাচাঁদ নাকি রাজা চন্দ্রকেতুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার জন্য অনুরোধ জানান আর রাজা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলেই নাকি যুদ্ধ অবসম্ভাবি হয়ে ওঠে। ঘুমগড়ে ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর সেনাদের বিশ্রামস্থল, ঘোড়াপোঁতায় ছিল আস্তাবল, হাদিপুরে ছিল হাতিশালা, ধনপোঁতাতে ছিল গুপ্ত রাজকোষ। রনখেলার যুদ্ধ জয়ের পরে পীর গোরাচাঁদ সুন্দরবনের হেতেগড়ের অধিপতি মহিদানন্দের দুই পুত্র আঁকানন্দ ও বাঁকানন্দের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের প্রস্তাব নিয়ে যান। হেতেগড়ের রাজপরিবার ছিল পরম শৈব। প্রস্তাবের কথা শুনেই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পীরকে অস্ত্রাঘাত করেন আঁকানন্দ। আহত পীর গোরাচাঁদ দুই ভাইকে সম্মুখ সমরে হত্যা করেন। ক্ষতস্থান বিষিয়ে পীর মারা যান ১৩৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই ফাল্গুন। পীর মৃত্যু শয্যা নিয়েছিলের হাড়োয়াতে। পীরের সমাধি ঘিরে বিদ্যাধরীর তীরে প্রতিবছর ১২ ফাল্গুন মেলা বসে। পীরের মৃত্যু সাল থেকেই অনুমিত হয় যে রাজা চন্দ্রকেতু খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষ বা চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে কোন এক সময়ে চন্দ্রকেতুগড়ে রাজত্ব করতেন।
পুরাতাত্ত্বিক নমুনা :-
*****************
খনা-মিহিরের ঢিবি এবং তার থেকে প্রায় ২ কি.মি. দুরে অবস্থিত গড় বা রাজা চন্দ্রকেতুর বাড়ি দুটোকেই পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ অধিগ্রহন করেছে। খনা-মিহিরের ঢিবি ও গড়ে অবস্থিত চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নমুনা নিয়ে নিজের বাড়িতেই সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন শ্রী শ্রী দিলীপ কুমার মৈতে। দুটি জায়গা থেকেই নানা ধরনের পুরাতাত্ত্বিক নমুনা পাওয়া গেছে। স্থানীয় মানুষের বাড়িতেও রয়েছে নানান ধরনের নমুনা। লুকিয়ে চুরিয়ে সেগুলি বিক্রিও হয়ে যায়। চন্দ্রকেতুগড় গঙ্গারিডি সভ্যতা, মৌর্য্যযুগ, কুষানযুগ, গুপ্তযুগ, পাল-সেন যুগের বিভিন্ন ঐতিহ্য বহন করে আসছে।
চন্দ্রকেতু গড়ের খননকার্য : -
*************************
প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় মাসিক বসুমতী পত্রিকায় ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে চন্দ্রকেতুগড় নিয়ে বাংলায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। চব্বিশ পরগণার প্রত্নোৎসাহী কালিদাস দত্ত বেশ কয়েকটি পত্রিকায় ১৯২০ থেকে ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত লিখলেন বেশ কয়েকটি ইতিহাসিক প্রবন্ধ। তাঁরই উৎসাহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ববিদ কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী, দেবপ্রসাদ ঘোষ এবং কল্যাণ কুমার গাঙ্গুলী ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে চন্দ্রকেতুগড় দেখতে গেলেন। তারপর ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি পরেশ চন্দ্র দাশগুপ্ত গিয়ে ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে দেখলেন জায়গাটা। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হল চন্দ্রকেতুগড়ে। একটানা না হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়াম খননকাজ চালিয়ে গেছে ১৯৬৭ পর্যন্ত। তার পর চন্দ্রকেতুগড়ে খোঁড়াখুঁড়ি আর প্রায় হয়নি বললেই চলে। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ কয়েক মাস খননকার্য চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে যেমন যেমন পয়সা, অনুমতি এবং উৎসাহ মিলেছে, টুকটাক হয়েছে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি। কিন্তু গত দুই দশক মিলিয়ে এক বছরও কাজ হয়েছে কিনা সন্দেহ।
আমার চোখে দেখা চন্দ্রকেতুগড় :-
******************************
★ খনা-মিহিরের ঢিবি :- আমার চাক্ষুষ আন্দাজ অনুযোগী খনা-মিহিরের ঢিবিটি প্রস্থে ১২-১৫ মিটার এবং দৈর্ঘ্যে ২৮-৩০ মিটার মত। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের কলকাতা সার্কেল এই ঢিবিটিকে অধিগ্রহন করেছে এবং চারিদিকে প্রায় চার ফুট উঁচু প্রাচীর ও স্থানে স্থানে তারকাঁটা দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। এখানে বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন দেখা যায়। কোন দূর্গ অথবা কোন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। দেওয়াল গুলি চওড়াই প্রায় ৯০-১০০ ইঞ্চি। কোন কোনন ক্ষেত্রে তারতম্য রয়েছে। ঢিবিটির উপরে একাধিক বনস্পতি রয়েছে। দেওয়াল গাত্রের ইঁট গুলি বর্তমান ইঁটের মত নয়। আকার আয়তনে পার্থক্য রয়েছে। এখান কার জল নিকাশি ব্যবস্থা বেশ উন্নত মানের ছিল। পোরামাটির শক্ত পাইপ দিয়ে দূর্গে ব্যবহৃত জল বাইরে নিকাশ করা হত।
খনা-মিহিরের ঢিবিতে সকাল বিকেল স্থানীয় কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা ভীড় জমাই। প্রায় সকলের হাতেই অ্যানডয়েড সেট। দু-এক জনের কাছে জানলাম এখানে ইন্টারনেট পরিসেবা নাকি সবসময় ভালো থাকে। এখানে বসে কেউ কেউ মোবাইল চালিয়ে নেট সার্ফ করে আবার কেউ গ্রুপ করে গল্প আলোচনাই মেতে ওঠে আবার কেউ কেউ এখানে হাল্কা নেশা করতে আসে। আবার কেউ কেউ দূর-দূরান্ত থেকে বয়ে চলা ইতিহাসের ধারাকে অনুভব করতে আসে। সত্যি কথা বলতে গেলে এটা একটা বিনোদনের জায়গায় পরিনত হয়েছে।
★ চন্দ্রকেতুগড় বা গড় :- খনা-মিহিরের ঢিবি থেকে বেড়াচাঁপা মোড় পার করে সোজা দেড় কিমি গেলে আসবে গড় নামে একটা স্টপেজ। প্রধান সড়ক থেকে বাম দিকে বেড়িয়ে গেছে একটা সংকীর্ন রাস্তা। রাস্তার বামদিকে রয়েছে ঘন জঙ্গল আর ডান দিকে ফাঁকা মাঠ। অনেক দূর অন্তর একটা বা দুটো বাড়ি। ঐ রাস্তা ধরে প্রায় ৬০০-৭০০ মিটার হাঁটলেই পড়বে রাজা চন্দ্রকেতুর বাড়ি। একটা সরু রাস্তা বেয়ে উঠতে হবে ঢিবিতে। সরু রাস্তার মুখের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের সাবধানবানী লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। যাতে জায়গাটিতে কেউ পিকনিক না করে সেটাও সাবধানবানীতে লেখা আছে। ঢিবির উপরে উঠে কিছুটা এগুলেই একদা লোহার ফটক চোখে পড়বে। বামদিকে রয়েছে ছোট্ট খেলার মাঠ। সেখানে স্থানীয় ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। খেলার মাঠ বামে ছেড়ে একটু এগিয়ে গেলেই রাজা চন্দ্রকেতুর রাজপ্রাসাদের প্রাচীর দেখা যাবে। এটিকে দূর থেকে দেখলে কোন বৃহত্তর পুষ্করিনী বা বিলের উচ্চ বাঁধ বলে মনে হবে। এই উচ্চ ঢিবিটি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢিবিটিতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে।
ঢিবির বামদিকে গা লাগোয়া ছোট্ট একটা কলা বাগান সবুজের রূপরেখা অঙ্কন করেছে। ঢিবির ডান ও বামদিকে রয়েছে বিস্তীর্ণ ক্ষেতি জমি। অনেকের মতে রাজা চন্দ্রকেতুর দূর্গটি মাটি নির্মিত ছিল। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের কলকাতা সার্কেল যেটুকু অংশ ঘিরেছে সেটা বিশাল একটা দূর্গের সামান্য অংশ। ঢিবিতে দু-এক জন মানুষ আর চারটে গরু ছাড়া আর কারুর দেখা মিলল না। পাশের মাঠ গুলি যখন সর্ষে ফুলে ভরে ওঠে তখন গড়ের উপরিস্থিত বৃক্ষ গুলিও ফুলে ভরে ওরে। জায়গাটির শোভা অপরূপ বর্ধিত হয়। দর্গের প্রাচীরগাত্র মাটি নির্মিত হলেও ভেতরে ছিল পুরু ইঁটের গাঁথনি। স্থানে স্থানে অনাবৃত ইষ্টকখণ্ড সেই সাক্ষই বহন করে। এক জায়গায় একটি উপরে যাওয়া বৃক্ষ আমার চোখে পড়ল কাছে গিয়ে দেখলাম বৃক্ষের শেকরে মাটির থেকে বেশি ইষ্টক খণ্ড লেগে আছে। এর থেকে প্রমানিত হয় যে মাটির চার-পাচ আঙুল নীচেই রয়েছে ইঁটের গাঁথনি। জায়গাটি অত্যন্ত মনোরম হলেও বিরাজ করছে সীমাহীন নিরবতা।
খনা মিহিরের ঢিবিতে দুটো ছেলের মুখে শুনেছিলাম গড়ের মাটি খুঁড়তে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তবে থেকে খননকার্য বন্ধ রয়েছে। আজ ফের একজন স্থানীয় ছেলেকে জিজ্ঞেস করে যেটা জানলাম সেটা হল- একবার একজন পুরাতাত্ত্বিক বিভাগীয় অফিসার ১৫০ জন লোককে গড়ের মাটি খোড়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। খননকার্য শুরু হবার আগেই অধিকাংশ শ্রমিক স্বপ্নে দেখেন যদি তারা চন্দ্রকেতুগড়ে খননকার্য চালান তাহলে মারা পরতে হবে। এই স্বপ্নের ফলে অনেকে সরে এসেছে, আর গড় মুখো হয়নি। বাকী যারা ছিল তাদের নিয়েই শুরু হয় খননকার্য। তাতে ঘটল আরেকটা বিপর্যয়। যারা খননকার্য শুরু করছিল তাদের কেউ কেউ মারা যেতে থাকে। প্রানের আগে কিছু না, স্বভাবতই প্রান ভয়ে কেউ আর গড়ের খননকার্যে রাজি হননা। এই সূত্র ধরেই গড়ের পিঠে হয়ত একটা অভিশপ্ত জায়গার তকমা লেগে গেছে আর সেটাকে সকলে এড়িয়ে চলতেই চাই।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :-
*****************
১. ইন্টারনেট ও গুগল।
২. ভ্রমন গাইড।
৩. স্থানীয় জনশ্রুতি।
বি:দ্র: - জায়গাটি সম্বন্ধে আমার খুব ভালো ভাবে কিছু জানা নেই। পোস্টটিতে কিছু কিছু জায়গায় বিতর্কিত কথা লেখা আছে। ইতিহাসের মূললক্ষই হল সত্যানুসন্ধান। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
___________
@রামকৃষ্ণ বড়াল
No comments:
Post a Comment