Friday, 2 December 2016

।। ক্লান্তি শেষে ।।


তখনও ভোরের   কুয়াশা ভালোভাবে  কাটেনি । একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে রমাদেবী ।  সকাল থেকে এভাবেই সারাদিন জানলা দিয়ে বাইরে দিকে  তাকিয়ে থাকা । কি বা করার আছে । দুএক জনের সাথে একটু গল্পসল্প আর বাকি সময়টা  বাইরের মানুষজনের যাতায়াত দেখে   কোনমতে কাটিয়ে দেওয়া । বৃদ্ধাশ্রমের সকলের এই  একই রুটিন  । এভাবেই সকলেই   নিজেদের ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন  কিন্তু কোথায় যেন একটা চিনচিনে ব্যাথা । রমাদেবীর চিরকালই  ভোরে উঠা অভ্যেস । সময়ের নিয়মে  অনেক কিছুই বদলে গেছে  । কিন্তু কিছু মজ্জাগত জিনিস সঙ্গ ছাড়ে না  কখনই ।

            তখন তমাল  অনেক ছোট । কত হবে বছর ছয় কি সাত । এমনই এক শীতের দিনে তাকে একাকী ছেড়ে চলে গেলেন  তমালের  বাবা ।  মর্নিং ওয়াক  করে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনায় সব শেষ । সকালে উঠেই তিনি হাঁক দিতেন 'কই গো  রমা, একটু চা দেখি, বেরোতে যে দেরি হয়ে যাচ্ছে । ' রমাদেবী তাড়াতাড়ি চা নিয়ে হাজির হতেন  । চা খেতে খেতে বিমলবাবু বলতেন ' তোমার হাতের চা না খেলে ভোরটা যেন  ঠিক  ভোরের মতো মনে হয় না । রমাদেবী অতশত হেয়ালি বুঝতেন না  " । তিনি মনে মনে হাসতেন ।  ময়ূরীর মত তিনি যেন সকালের এই শিশির বিন্দুরটিরই খোঁজ করতেন । সকালের  এই মিষ্টি শীতল শিশিরবিন্দু গায়ে  মেখে সারাদিনের কাজে লেগে পড়তেন । সেই থেকেই সকালে উঠা অভ্যেস । পরে চাকরি জীবনে এর কোনো হেরফের হয়নি । বিমলবাবুর মৃত্যুর পর অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তিনি চাকরিটি জোগাড় করেছিলেন ।ভগবানের কৃপায় দুইপ্রাণীর সংসারটি কোনোভাবে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে  বেঁচে গিয়েছিল ।

         তারপর প্রতিদিন  ভোর হতে না হতেই তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তেন । মনে মনে তিনি যেন তাঁর  ডাকটি শুনতে পেতেন    তমালকে স্কুলের জন্য তৈরি করা, খাইয়ে দেওয়া, স্কূলের বাসে চাপিয়ে দিয়ে আসা ।  তারপর  কোনো ভাবে মুখে কিছু দিয়ে অফিসে রওনা দেওয়া ।  ফিরে এসে আবার  ছেলেকে  পড়তে বসানো,  স্কুলের কাজ ঠিকমতো করিয়ে দেওয়া, ছেলের আবদার অভিযোগ শোনা, তারপর  ঘরের  টুকিটাকি কাজ বাগিয়ে ক্লান্ত শরীরটিকে বিছানায় এলিয়ে দেওয়া । হেল্পিং হ্যান্ড বলতে কাজের বকুল মাসি।তবে তমাল  ছিল মা দরদী ছেলে তার । পুরো তার বাবার মতো । মায়ের মন বুঝত সে ।

         দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেল । রমাদেবী অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে । তমালও   ভালো কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরির পেয়েছে । কিন্তু চাকরিটি দূরের শহরে । প্রথমে তো যেতেই চায়নি সে । অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রমাদেবীই রাজি করিয়ে ছিলেন । মাসের শেষে  ছুটি পেতেই ছুটে চলে আসত মায়ের কাছে  । ছুটির দিনগুলি মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াত   শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে । বকুলমাসি  হেসে হেসে বলত - " এমন ছেলে হাজারে একজন হয় গো দিদি "

রমাদেবীর  মন একরাশ আনন্দে ভরে উঠত I মনে মনে ভাবতেন,  ভগবান তাকে পতীসুখ না দিলেও পুত্রসুখ দিতে কার্পণ্য করেননি । বছর ঘুরতে তা না ঘুরতেই নতুন ফ্ল্যাটে  মাকে নিয়ে গেল তমাল । বেশ ভালই সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট । সেদিন  নতুন বাড়িতে তমালকে খাবার খেতে দিতে দিতে  রমাদেবীই নিজের থেকেই  বললেন -
"চাকরি, ঘরবাড়ি সবই তো হল বাবা, এবার একটি টুকটুকে বউ ছাড়া যে ঘর  মানায় না !"
তমাল একটু লজ্জা পেয়ে কাঁচুমাচু করে বলল-
"মা তোমাকে কয়েকদিনে ধরেই বলব  বলব ভাবছিলাম । আমাদের অফিসেই  কাজ করে....সাইনা...তোমার যদি আপত্তি না থাকে..."

"সে তো ভালো কথা । দুর্ বোকা, আপত্তি থাকবে কেন ! আমাকে তুই অনেক বড় দায়িত্ব থেকে রেহাই দিলি বাবা । এই বয়সে তোর বউ খোঁজা আমার পক্ষেও সম্ভব নয় ।"
রমাদেবী খুব ধুমধাম করেই বিয়ে দিলেন তমালের  । আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, হইরই করে কেটে গেল বিয়ের কয়েকটা দিন ।

ওদিকে তমালের ও ছুটি শেষ হয়ে গেল । সে নতুন বউ নিয়ে পাড়ি দিল কর্মস্থলে ।
এবার যেন নতুন জায়গায় রমাদেবী খুবই একাকী হয়ে পড়লেন । এখানে পুরনো বাড়িটার  মতো পাড়া পাড়া ভাবটা  নেই । সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত । কাজের মাসিটার পর্যন্ত একটু কথা বলার সময় নেয় ।বকুল মাসির মত একটু সুখ দুঃখ ভাগ  করে নেবে তা হয়ে উঠে না । ওদিকে তমালেরও আসা যাওয়া কমে গেছে । হয়তো সময় হয়ে উঠে না । প্রথমে মাসে মাসেই আসতো । পরে পরে দুমাস, তিন মাস পর্যন্ত পেরিয়ে যেতে থাকল । এখন ছয়মাসে হয়তো একবার । এক চরম একাকীত্ব যেন রমাদেবীকে ঘিরে ধরতে থাকল ।মন আনচান করে, বয়সের ভারে একা একা  বাইরে যাওয়ার সাহসও করেন না। ভরসা বলতে আবাসনের কমবয়সী সিকিউরিটি ছেলেটি । সেই বা কতবার  নিজের ডিউটি ছেড়ে তাঁর   ফাইফরমাস খাটবে ।

পুজোর ছুটিতে তমাল বাড়ি এলে তাকে মনের কথা না বলে থাকতে পারলেন না  রমাদেবী ।
" বাবা, আমার এখানে আর একা একা থাকতে ভালো লাগছে না  । তারপর শরীরেও আর সাথ দিচ্ছে না । "
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তমাল বলল "মা, আমিও  সেটাই ভাবছিলাম  । তারপর দিনকাল ও ভালো নয় । যা সব ঘটনা ঘটছে চারদিকে, তোমার একা থাকাটাও নিরাপদ নয় । তাই ভাবছিলাম, শহরে নতুন যে old age home টা খুলেছে, সেখানে গিয়ে থাকাটায় বোধহয় তোমার পক্ষে নিরাপদ । তুমি তো জানই আমি ও তোমার বউমা দুজনেই নিজের নিজের অফিসের কাজে ব্যস্ত....তাছাড়া ওই হোমে  তুমি দুএকজন কথা বলার সংগও  পেয়ে যাবে । "

তমালের কথাটা শুনেই রমাদেবী বুকের উপর দিয়ে যেন কয়েকশ টনের রেলগাড়ি দড়াম দড়াম শব্দ করে পেরিয়ে যেতে থাকল । অনেক  কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিলেন । তবু যেন গলাটা কেঁপে উঠল -
"বাবা তুই ঠিকই বলেছিস ! "
"না মানে তোমাকে একা ছাড়তে আমারও ভয় করে ।"

অনেকদিন পর আজকের রাত্রে বিমলবাবুকে  দেখতে পেলেন রমাদেবী । হাসতে হাসতে বলছেন "ওগো আজ তোমার ছেলে আসবে , অনেকদিন পরে আসছে তো, ওর প্রিয় লাউ চিংড়ি রেঁধে রেখো যেন !"

ধড়ফড়িয়ে উঠলেন রমাদেবী । না স্বপ্নই ছিল । এখনো ভোরের কুয়াশা কাটেনি । বৃদ্ধাশ্রমের সকলে তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন । নাকি সবাই ঘুমিয়ে থাকার ভান করছে । রমাদেবীর আর ঘুম আসে না, জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কুয়াশাচ্ছন্ন বাইরের দিকে, সকালের অপেক্ষায় ।
(সমাপ্ত )
_________
© দূর্জয় সাউ

No comments:

Post a Comment