Tuesday, 20 December 2016

।। ভুত কাহিনী ।।



হাটগোবিন্দপুরের নামটা লোকমুখে অনেকদিন থেকেই ভুতগোবিন্দপুর হয়ে গেছে। লোকে বলে এখানে আকাশে বাতাসে, জলে স্থলে সবখানে ভুত থিকথিক করছে। কারনও আছে। জায়গাটা বেশ গ্রাম। সুন্দর লোডশেডিং হয়। তালগাছের মাথায়, বাঁশঝাড়ে,  বুড়ো বটের তলায়, বেল গাছে, ভাঙা জমিদারবাড়িতে অন্ধকার আর জোনাকি মাখামাখি করে থাকে। কোন কোন রাতে হুক্কাহুয়ার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে,  গ্রামের দক্ষিণ সীমানার জলাভূমির দিকে তাকালে কয়েকটা আলোকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। আশেপাশের অনেক জায়গা থেকেই ভুতেরা এসে এখানে বাসা বাঁধে। আঁধার ঘনালেই তেনারা সব বেরিয়ে আসেন। তাই কী শীত, কী গ্রীষ্ম সন্ধ্যের পরই হাটগোবিন্দপুরে একটা শিরশিরে হাওয়া ফিসফিস করে বয়।

শীত পড়ি পড়ি করছে। চাঁদের আলো কুয়াশা মেখে পাতলা সরের মত ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামটায়। ঘুম ভেঙে ক্রমে জমে উঠছে ভুতমহল। শাঁখচুন্নী ইয়াব্বড়ো নথ নেড়ে নেড়ে তার প্রাণের বন্ধু ঝামড়িকে শুধাচ্ছে - ওলো সই, ওলো সই / খই কোই, খই কোই? আজ শিবু দাদুর মড়াযাত্রার সময় সে থাকতে পারেনি। ঝামড়িকে বলে গেছিল খই তুলে রাখতে। এখন এসেছে সেই খইয়ের খোঁজ করতে।

প্যাংলা নবীন ভুত। জ্যান্ততেও সে ভীতু ছিল, মরেও ভীতু ভুত হয়েছে। যাইহোক, আজ সে খুব চিন্তায় আছে। খবর পেয়েছে রাঘববোয়াল মরে ভুত হয়েছে আর সে এখানেই আস্তানা বাঁধবে। এই রাঘববোয়ালই মেরেছিল তাকে, তার জমিটা হাতানোর জন্য। প্রথমে সে তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। রাঘববোয়ালের তখন কী বন্ধু বন্ধু ভাব। সকাল বিকেল পোঁদ ঘসাঘসি। একটু সন্দ হয়েছিল, এত বড়লোকের দোস্তি! কিন্তু বাংলার ঠেকে, চাটের সাথে ওটুকু সন্দ উড়ে যেতে বেশি সময় নেয়নি। সম্বিত ফিরেছিল, মদের ঠেক থেকে ফেরার পথে যখন রাঘববোয়ালের স্যাঙাতের ছুরিটা তার গলাটা দু ফাঁক করে দিয়েছিল। অবশ্য ওই ঘটনার কদিন পরেই রাঘববোয়ালও টেঁসে গেছিল হার্ট অ্যাটাকে। ওই জমি আর তার ভোগে লাগেনি।

এ হেন রাঘববোয়াল ভুত হয়ে এখানেই আসছে শুনে, প্যাংলা ভুতের হাঁটুর ঠকঠকানি আর থামছেই না। হঠাৎ তার মনে পড়ল - আরে, সে তো মরেই গেছে। ওই শালার রাঘববোয়াল তার আর কী বালটা ছিঁড়বে! অতঃপর হাঁটুর ঠকঠকানি থেমে গেল তার। অবশ্য একটু আফশোসও হল - রাঘববোয়ালও যে মরে গেছে, প্রতিশোধটা আর নেওয়া হল না।

চিকন ভুত উদাসী মনে পুকুরের উপর ঝুঁকে আসা খেজুর গাছে বসে পা দোলাচ্ছে আর পুকুরের জলে ভেসে থাকা চাঁদের, হাওয়ার ধাক্কায় ভেঙে যাওয়া দেখছে। অনেকের ধারনা, ভুতেদের সবই বুঝি জ্যান্ত মানুষের উল্টো। মানুষ ভুলে যায় বেঁচে থাকার সময়ের কিছু ভাললাগা, মায়া, স্বপ্ন, অতৃপ্তির রেশই তাদের ভুত করে তোলে। তাই আমাদের এই ভুতটিও জোৎস্নাবিলাসী। সে অপেক্ষায় তার প্রেমিকা জলার পেত্নীর জন্য। এ প্রেম তাদের মনুষ্যজন্ম থেকেই। জলাকে কারা যেন ধর্ষণ করার পর মেরে ফেলে রেখে গেছিল দক্ষিণের জলাভূমিতে। না, চিকন  অবিশ্যি তখনই আত্মহত্যা করেনি। কষ্ট পেয়েছিল খুব। আবার সেই কষ্ট সামলেসুমলে জমিয়ে সংসারও করেছিল। কিন্তু না পাওয়া প্রথম প্রেম বলে কথা। অতএব ভুত জীবন। ভুতুড়ে প্রেম জমেছেও বেশ। জলা এসেছে। শুরু হল প্রেমালাপ। বাতাসের ফিসফিসানি আরেকটু ঘন হল। চিকন জড়িয়ে ধরতে গেল জলাকে। হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল হাওয়া। চুমু খেতে গেল - হাওয়া ছুঁল হাওয়া। এত ইচ্ছা, এত আকাঙ্ক্ষা, এত তৃষ্ণা তবুও দুজন কিছুতেই পারছিল না ছুঁতে দুজনকে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর দুজন তাকাল দুজনের দিকে। কিছু একটা কথা হল তাদের মধ্যে।
বারো বছরের দাম্পত্যের অভ্যস্ত মিলনকালে, হঠাৎ করে যেন বিদ্যুৎ খেলল সেন বাবুর শরীরে। যেন বউ না, সে রমণ করছে অন্য নারীর সাথে। সেন গিন্নির শরীরও পাচ্ছে অন্য শরীরের ওম। অনেকদিন পর তুমুল আদর হল দুজনের। অর্গাজমের পর ঘুমিয়ে গেল দুজনে আর চিকন ও জলা বেরিয়ে এল ওদের শরীর থেকে, একরাশ তৃপ্তি নিয়ে।
ওদিকে পাশের ঘরে শুয়ে থাকা সেন বাবুর বৃদ্ধ বাবার ঘুম এখন এমনিতেই কম। আজ যদিও বা চোখদুটো একটু ধরেছিল, ছেলে বৌমার ঘর থেকে আসা খাটের শব্দে আর চাপা শিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে ওনার। অন্ধকার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, শিথিল লিঙ্গ কচলাতে থাকেন আর ভাবতে থাকেন - যদি ভুত হতাম, তাহলে ...

___________
© শোভন বাগ

No comments:

Post a Comment