গেছোদাদার
যাত্রা কাহিনী
=============
অন্তিম পর্বঃ কথাশিল্পীর
আঙিনায়
~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সূর্য দিনের
মত পাটে বসে গেলেও আলোর রেশটুকু তখনও ফুরায়নি। সুতরাং ঘরে ফেরার পথে মনোনিবেশ
করলাম। মাঠের কিনারার পুকুর পাড়ে রাস্তার ধারেই, সজলধারা প্রকল্পের একটা সরকারি ট্যাপের কলও
রয়েছে। আসার পথে স্কুলের ডান দিক দিয়ে এসেছিলাম, ফিরছি এবারে স্কুলের সামনে দিয়ে। ছেলের দল
তখনও খেলছে। অন্ধকারে এমন দশাসই প্রেত মূর্তী দেখে, একটি বাচ্চাতো “চাচা চৌধুরীর
সাবু” ই বলে বসল। হবেও বা হয়ত আমার বাড়ি ক্রিপটন গ্রহেই।
সেই সমাধির
পাশে ফিরে দেখি গারোয়ান ভাই আমারই প্রতীক্ষায় দন্ডায়মান। চলো তাহলে ফেরা যাক বলতেই, চমকে উঠে তার
উত্তর
- এখানে এলেন , আর সরোচ চন্দের বাড়ি দেকবেননা
- কোথায় গো? কদ্দুর যেতে হবে?
- যাচ্চলে, এই তো এই বাড়িটাই তো...
দেখলাম সেই
টালির চালের দোতলা বাড়িটা, যেটা সুন্দর করে কোমর সমান উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সর্বত্র পরিপাটির ছাপ
স্পষ্ট। বাড়ির সদরের সামনে দিয়ে ইটবেছানো রাস্তা, উলটো দিকে শানবাঁধানো পুকুর। গেটের দুই থামে
শ্বেতপাথরের ফলকে অমর কথাশিল্পীর অমর বানী খোদিত ( বর্ণনা দিলে চাক্ষুষ করার স্বাদ
নষ্ট হবে)। একটা ফুচকাওয়ালা ঠিক গেটের পাশেই গোটা তিনেক ‘খদ্দের’ নিয়ে জমিয়ে
বিকিকিনি শুরু করে দিয়েছে। বাড়ি ভর্তি ফল ফুল গাছের শোভা। গেট থেকে বাড়ির দাওয়ার
পথটি, বেশ কেয়ারি করে পোড়া মাটির টাইলস দিতে বাধানো।
গেট দিয়ে
ঢুকেই বাম হাতে অনতিদূরেই একটা আবক্ষ মর্মর মুর্তি স্থাপিত অমর কথাশিল্পী ‘শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের’। সন্ধ্যের জন্য ফেরার তাড়ায় লেখককে টিপ করে একটা প্রণাম সেরেই ফেরার উদ্যোগ
নিতে পিছন ফিরে দেখি, নদীপাড়ের সেই যুগল। মেয়েটি “বাবু আছেন? আছেন! শুনছেন” বলে ডাকাডাকি করতেই বাড়ির পিছন দিক থেকে এক
প্রৌঢ় ভদ্রলোকের আগমন হল। মেয়েটির সামান্য অনুরোধেই তিনি গোটা বাড়িটি ঘুড়িয়ে
দেখাতে রাজি হয়ে গেলেন। বুঝলাম ইনিই বাড়ির কেয়ারটেকার।
বাড়িটি সাবেকি
আটচালা টাইপের। শালের খুঁটিতে টালিরচালের বারান্দা বাড়িটির চারিভিতে। জুতো খুলে
লাল সিমেন্টের দাওয়াতে উঠতে তিনটে ছোট সিড়ির ধাপ টপকাতে হয়। দক্ষিনদুয়ারি দুটি ঘর
পাশাপাশি, পশ্চিম প্রান্তে পূবদুরায়ী বৈঠকখানা তথা লেখার ঘর আর পূর্বদিকে অধুনা তৈয়ারি
করা দোতলাতে উঠার জন্য নির্মানিত সিঁড়ির ঘর। সিঁড়ির ঘরের ঠিক সামনের জমিটা খাঁচা
দিয়ে ঘেরা একরত্তি ঘেরা, জানলাম এখানে আগে ময়ূর থাকতো। তত্বাবধায়ক ভদ্রলোকটির তথ্য অনুয়ায়ী গৃহটি
পূর্বে মাটিরই ছিল, পঃবঃ সরকারের তরফ থেকে, বাড়ির মূল কাঠামোটি অক্ষু্ণ্ণ রেখে আধুনিক সংস্কার করেছে। ভদ্রলোকটি বন্ধ
ঘরগুলির চাবি আনতে বাড়ির ভিতরে যাওয়াতে আমি একাই বাড়িটি ঘুরে দেখতে লাগলাম।
বাড়ির পূর্ব
প্রান্তে যেতে, মুহূুর্তেই যেন টাইমমেসিনে করে দেড়খানা শতাব্দি পিছনে চলে গেলাম। এই তো সেই
বারান্দা, যেখানে মেজদার কড়া নজরে তিন ভাই এক্ষুণি সাঁঝবেলাতে পড়তে বসবেন। বারান্দায়
রাখা কাঠের কেদারাটিতে বসেই হয়ত বৃদ্ধ রামকমল ভট্টাচার্য আফিম সেবন করবেন। দেউড়িতে
অদৃশ্য সেই হিন্দুস্থানী পেয়াদাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। ওই তো সেই অযত্নের
গোঁসাইবাগান, যেখান থেকে হয়ত আর খানিক পরেই ইন্দ্রনাথের মোহন বাঁশীর সুর কানে আসবে।
ছিনাথ
বহুরুপিও রেডির তেলের লন্ঠন জ্বলে উঠার প্রতিক্ষায় বাঁশবাগানের আড়ালেই
প্রতীক্ষারত। বিকালে দেখা নদীর পাড় থেকেই হয়ত শ্রীকান্ত তার ক্ষুদ্র ডিঙি নিয়ে
আড়াআড়ি পাড়ি দেবে সতুয়ার চড়ার মক্কাক্ষেতের উদ্দেশ্যে। সেই পাপোশটাও অবিকল পরে
রয়েছে, যার উপরে ছোড়দা আর যতিনদা কথিত নেকড়ে বাঘটি হুম শব্দে লেজ গুটিয়ে বসে ছিল।
উঠানের প্রান্তের যাবতীয় গাছগুলিকে ডালিমগাছই মনে হতে লাগল। যেন ইন্দ্র খানিক পরে
এসেই ছিনাথ বহুরূপীকে গাছ থেকে উদ্ধার করবে, সড়কি আর মুঙ্গেরি গাদা বন্দুকের নিশানা থেকে।
দৃষ্টি গেল
বাঁশ বাগানের দিকে, মানসচক্ষে দেখলাম এইবাঁশ বাগানের কঞ্চি দিয়েই মাছধরার ছিপ বানাতো দেবদাস, যে ছিপের
সৃষ্ট ক্ষতের দাগ পার্বতীর বাম কপালে আমৃত্যু অঙ্কিত ছিল। ইতিহাস বলছে শিল্পী এই
বাড়িতে বসে ছোটমামার নামাঙ্কিত ‘বিপ্রদাস’ উপন্যাস ছাড়া আর কিছুই রচনা করেননি। কিন্তু
মন সেকথা মানবে কেন! ‘বাল্যস্মৃতি’র কল্পনারা যে এই বাড়িতেই সকল চরিত্রকে খুঁজে পেতে হাঁকুপাঁকু করছে। তাছাড়া
কল্পনাকে ইতিহাস মানতেই হবে এমন দায়ও কেও দেয়নি। আমিনা আর তার বাপ গফুরকে যে
একটিবার না দেখলেই নয়। তার হাতে কিছু টাকা দিতাম যাতে শীর্নকায় মহেশকে আর চালের ঘর
না টেনে খেতে হয়। ওই দূরের ‘পল্লীসমাজে’ই কোন ‘সতী’র ‘স্বামী’র প্রয়াণে, লালুরা শ্মশানযাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়। ‘হরিচরন’ এই আঁধারে
বিন্দুর ছেলেকে খুঁজে পেতে ‘ছেলেধরা’ সেজেছে। ‘একাদশীর বৈরাগী’ ‘হরিলক্ষ্মী’ও এই
ত্রিসন্ধ্যায় উপবাস ভাঙার প্রস্তুতিতে নিমগ্ন। ‘বিরাজবউ’ এর বাড়ি থেকে ত্রস্তপদে ‘পরেশ’ তার ‘মেজদিদি’র হাত ধরে নদী
পথে ঘরে ফিরছে।
জানালা দিয়ে
একটা আলমারি দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে কিছু বইপত্র দলিল দস্তাবেজ। এর ভিতরেই হয়ত ‘অরক্ষনীয়া’ অবস্থায় ‘বৈকুন্ঠের উইল” সযত্নে রেখে
ছিল কোন ‘বামুনের মেয়ে”। অদূরেই শিল্পীর ‘বড়দিদি” অনিলাদেবীর শ্বশুরালয়। এই অনিলাদেবী ছদ্মনামেই অনেক রচনা আত্মপ্রকাশ করেছিল।
এতক্ষনে সেই বৃদ্ধ তত্বাবধায়ক চাবি হাতে এলেন। তিনি তখন আর তত্বাবধায়ন নন, আমার বাঁধভাঙা
কল্পনার সমুদ্রে তিনিই ‘পন্ডিত মশাই’, তাই তার ‘নববিধান’ অনুসারে তার পশ্চাদ অনুসারী হতে দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ পেলামনা, সাথে সেই
যুগল। ঘরে ঢুকে কি কি দেখলাম সেটা বলবনা, নিজেরা এসে চাক্ষুষ করাই উত্তম।
শরৎচন্দ্রকে, অন্তরের
আত্মীয় বলে ভাবতে পারার মত সুখ, আমি খুব কম বিষয়েই অনুভব করি। অতএব তার
ব্যবহৃত বস্তুসামগ্রী দেখে কল্পনারাও থমকে গেল। তত্বাবধায়ক তথা গাইড ভদ্রলোক সেই
যুগলকে সাথে করে পাশের ঘরে গেলেন। যতক্ষনে আমার হুঁশ ফিরল ততক্ষনে যুগল দ্বিতলে
আরোহণ করেছে, আর বয়স্ক ভদ্রলোক সন্ধ্যা আরতির নিমিত্তে ব্যস্ত হয়েছেন। ঘরে ফেরার তারা
এতক্ষণ ভুলেই ছিলাম।
দ্বিতলের পথে
পা বাড়িয়ে সিড়ির ঘরের “আলো ও ছায়াতে” দেখলাম ‘অভাগির স্বর্গ’ লাভের এক চরম রমনীয় দৃশ্য। যুগলের মেয়েটি দেওয়ালের সাথে পৃষ্ট, তার হাতদুটিও
ছেলেটির করতলে আবদ্ধ। তাদের দুজনের ঠোঁটের সে কি নিবিড় ‘দেনা-পাওনা’। আমিও ‘চরিত্রহীন’ এর মত দুচোখ
ভরে, মেকি ভদ্রতার ‘দর্পচূর্ন ঘটিয়ে সেই অপরূপ কামনার ‘গৃহদাহ’ অবলোকন করতে লাগলাম।। এই ছেলেটিই হয়ত ‘কাশিনাথ’ বা সুমতি হওয়া
রাম। আশেপাশের গৃহের লোকনজর এই ‘আধারে আলো’র অপ্রতুলতায় তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল ‘রসচক্রের’ ‘অনুপমার প্রেম’। মেয়েটি হয়ত
ছেলেটির বাগ‘দত্তা’। আমার হৃদয়পটে এই ‘অনুরাধা’র ‘ছবি’টি চিরকাল অমলিন থাকবে তা বলাই বাহুল্য। অন্তরথেকে শুভকামনা করলাম ওই ‘পরিনীতার’ উদ্দেশ্যে।
তাদের প্রেমের ‘মন্দির’ স্থাপিত হোক, ‘নিষ্কৃতি’ মিলুক এই গোপন প্রণয়ের হাত থেকে। তবে লুকিয়ে করা প্রেমের মত মাধুর্য আর
দ্বিতীয়টি নেই।
সন্ধ্যা
উত্তীর্ণ হয়ে রাত্রির সূচনা হয়ে গেছে, চারিদিক নিঃস্তব্ধ। অতএব আর থাকা চলেনা, সময় মত রওনা
না দিলে ‘পথের দাবি’ মেনে রাস্তাতেই রাত্রিবাস করতে হতে পারে। তাই একরাশ ভাললাগা আর আবার ফিরব
প্রতিজ্ঞা করে রওনা দিলাম স্টেশনের পথে।
‘শুভদা’ কে ধন্যবাদ, এমন একটি স্থান নির্বাচনের জন্য। যেখানে বল্গাহীন কল্পনারাও কল্পনার জগতে
হারিয়ে যায় অক্লেশে। শরৎচন্দ্র ১৯০৬ সালে বার্মার নাঙ্গলবিনে বেশ কিছুদিন ধানের
ব্যবসাও করেছিলেন, আমিও চালকল ব্যবসায়ী তথা সেই ধানেরই তো ব্যবসাদার। তাই এই সূত্রেও শিল্পী আমার
ধানব্যবসাতুতো পরমাত্মীয় না হয়ে যাবেন কোথায় ! আকাশে তখন ‘চন্দ্রনাথ’ উদিত হয়েছে।
আমি আমার
ছেঁড়া সাহিত্যের ‘বিলাস’এ, ‘পথনির্দেশ’ দেবার চেষ্টা করলাম সাধ্যমত। জানিনা শেষ পর্যন্ত ‘মামলার ফল’ কি দাঁড়াবে।
তবে অকপটকে চাক্ষুষ করার ‘বোঝা’ নিতে আমরা টিম অকপট প্রস্তুত, ‘শেষের পরিচয়’টা সেদিনের জন্যই তাকে তুলে রাখলাম যতনে।
‘শেষ প্রশ্ন’-
- আপনি আসছেন তো?
-ইতি শ্রীকান্ত
(সরি তন্ময়, আসলে ক্যারেক্টার থেকে বেরোতে মনই চাইছে না যে...)
______________
@Tanmay Haque
পোষ্টারঃ উন্মাদ
হার্মাদ
No comments:
Post a Comment