Wednesday, 21 December 2016

।। ভ্রান্তিবিলাস ।।



অ্যালার্মের আর্তনাদে রেশ কাটলো। চোখে তো কতকালের অতৃপ্তির ঘুম !  ঠান্ডায় জমে যাওয়া চোখের পিচুটি ঘষে অ্যানড্রয়েডের স্ক্রীনে দেখলাম চারটে দশ বাজে। মনে মনে ভাবলাম....
-সাড়ে সাতটার দিকে ঢুকবো তো। যেতে আড়াই ঘন্টা। তারমানে আর মিনিট দশেক চোখ বুজে থাকাই যায়।

চোখবুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ চমকে উঠলাম। তড়িঘড়ি করে লেপের ভেতর ফোনে তাকিয়ে দেখি পৌনে ছটা। ভূত দেখার মতো শিউরে উঠে চিৎকার করে ডাকলাম...  'মাআআআআ....  ইশশশ কত দেরী হয়ে গেল !' লেপের ভেতর থেকে কোনোরকমে মুখ বের করে
বিড়বিড় করে বললাম,
- কলেজে কে. এম এর ক্লাশে দশ মিনিট চোখ বুজে থাকতাম তবু ঘড়ির কাঁটা বারোটা পনেরো থেকে বারোটা ষোলো অবধিই যেতো। আর এখন সেই দশ মিনিটই চোখ বুজলাম। তবু চারটে দশ থেকে পৌনে ছটা !!  মরণ দশা আমার.......

মা একডাকে ওঠেনি। উঠবেই বা কী করে !!  রাত জেগে দুই মেয়ের সেবা করতেই তো প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। একজনের পা ব্যথা তো আরেক জনের মাথা ব্যথা। ছেলেটাও তো কম নয়....  চুলকে চুলকে পুরো বিশ্বকে মাথায় তুলে নেয়। তাই বেচারি ভোর দিকেই একটু শান্তির ঘুম দেয়। কিন্তু আমার মনে এখন প্রচুর রাগ। গায়ের লেপটাকে পা দিয়ে ছুঁড়ে পেলে লাফিয়ে উঠেই শীতে কাঁপতে কাঁপতেে আবার চিৎকার,
- 'মাআআআআআআ ও মাআআআআআ... তুমি আমাকে ওঠাওনি কেন !!  ও মাআআআআআ'
মা আড়ভেঙে ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
- কী হলো কী ! এত ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লাফাচ্ছিস কেন ?
- কী হলো মানে ! তুমি জানো না আমাকে আজ যেতে হবে !  কবে থেকে তো রোজ বলছি বুধবার যাবো... আজ কী বুধবার নয় ?
- হ্যাঁ বুধবার কিন্তু আজ তো.....
- তুমি চুপ করো তো। একে আমার দেরী হয়ে গেছে। কত লোক আমার আশায় থাকবে। আর আমি কিনা মহারানী লেপের ভেতর সুখবাস করছিলাম। ছিঃ ছিঃ...
- উফফ তুই শুনবি তো একবার....
- চুপ করো। তাড়াতাড়ি ওঠো। গরম জল ইনডাকশানে বসাও,  স্নান করবো। আর একটু চা করো। মাথাটা আমার ফেটে যাচ্ছে।
- মাথা তো ফাটবেই। রাত দুটো অবধি তো ফোন নিয়ে লুতুপুতু। যেন ফোনই তোর প্রেমিক !  সারাক্ষণ চিটিয়ে থাকিস। কথা বললে তো শুনবি না !
- না শুনবো না। তুমি আর এখন জ্ঞানের খাতা খুলে বসো না। একে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে......

মা মুখ ঝামটা দিয়ে চাদর জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে এক নম্বরটা সেরে টুথব্রাশটা মুখে ঢোকাতেই মাথায় খেলে গেল, 'ব্যাগ তো গোছানো হয়নি। আর জামাও তো বের করা নেই।'যেন ভাবা অমনি ঐ ঠান্ডাতেও মাথাটা গরম হয়ে গেল........  'আজ তোকে মেরেই ফেলবো নীলু'
গিয়ে দেখি মাথার বেমোতে ফেবু করতে করতে চশমা পরেই ঘুমিয়ে গেছে হাড়গিলে কঙ্কালটা। নিজে পেঁচা হয়ে ফেবু করলেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাতজেগে ফেবু করলে আমার শান্ত মাথা তুমুল অশান্ত হয়ে যায়।
মেজাজ নিয়েই বললাম,
- নীলুউউউ..... এই মড়াটা ওঠ। ওঠ বলছি।
- কী হলো তোর ? সকাল সকাল কী তোর ঢং শুরু হলো ?
- হ্যাঁ রে ঢংই করছি। তুই আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিসনি কেন !!  কত কী নিয়ে যেতে হবে ! জানিস না আজ বুধবার ! আমি যাবো...
- তুই চুপ করবি। আজ তো......
- তুইও আবার জ্ঞান শুরু করিস না। চল ওঠ আমার ব্যাগ গোছা,  জামা বের করে দে। ছটা পনেরো বেজে গেল তোদের জবাবদিহি করতে করতে....
- তুই নিজে করে নে। আমি এই ঠান্ডায় উঠতে পারবো না। সাতটায় আমার টিউশন আছে। আরেকটু শুই।

নীলুর এহেন অবজ্ঞায় ধড়াম করে আলমারীটা খুলে এক দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দিলাম। ঘড়ির দিকে তাকাই একবার তো একবার আলমারীর তাকে। কিছুই খুঁজে পাই না। না পছন্দের চুড়িদার না শাড়ি না পাজামা না সোয়েটার-স্টোল কিচ্ছুটি না। শাড়ি পাই তো ম্যাচিং ব্লাউজ পাই না.... সালোয়ার পাই তো পাজামা গায়েব। ওদিকে আবার খান দুয়েক বেডশীট, টুপি, ......... হ্যান ত্যান কত কী ব্যাগে প্যাক করতে হবে। স্নান করতে হবে...  রেডি হতে হবে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয়ে। রাগে উৎকন্ঠায় ঘন শীতের সকালে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠলাম। মেঝেতে পাতা বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লাম। যেমনি বসা ওমনি আ আ করে প্রিন্স বলে উঠলো,
- দিলি তো আমার পা টা। ঐ হাতির মতো চেহারাটা আমার এই রোগা পায়েই ফেলতে হলো !!
- মাথা আর গরম করাস না প্রিন্স। তখন থেকে আমার একটা কাজও এগোয়নি। কখন যে বেরোবো আর কখন পৌঁছোবো !! মা টা যে রান্নাঘরে এখনও কী করছে !!  ধুস.......  এদের দিয়ে কিছু আর হবে না।
- কিন্তু আপা আজ তো.....
- আজ তো বুধবার। ফোনে দেখ। মাথার কাছেই তো আছে।

ততক্ষণে মা চায়ের কাপটা নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে বললো,
- নে চা টা আগে খা। মাথা ঠান্ডা কর।
- দূর তুমি থামো তো। সেখানে এতগুলো মানুষ আমাদের একডাকে হাজির। আর আমি এখানে বাউন্ডুলে হয়ে বসে !

এ কথাটা শুনে লেপের ভিতর থেকে মুখ বের করে নীলুর বলে উঠলো,
- হ্যাঁ রে মোটি তুই আজ যাবি কোথায় !!  তখন থেকে নাটক করছিস......  আমারও মাথা ধরিয়ে দিলি।
- কোথায় যাবো মানে !!  তুই কী জানিস না আজ বুধবার !  আজ আমাদের অকপটের পিকনিক। এতদিন থেকে তো বলে আসছি.............

এবার মা নীলুর প্রিন্স তিনজনেই একসাথে বলে উঠলো বিরক্ত হয়ে,
- আজ বুধবার জানি। কিন্তু আজ ২৮ তারিখ নয়। আজ ২১ তারিখ।

ওদের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে চার্জার থেকে ফোনটা নিয়ে দেখি, সত্যিই তো আজ ২১ তারিখ। এখনো সা.......ত দিন বাকি। পুরো মাথাই নষ্ট......

তিনজনেই কড়মড় করে আমার দিকে তাকালো। আর সাতসকালে আমার কী হাল হলো বাকিটা বললাম না..........  😁😁😁

© শেহনাজ আলম

Tuesday, 20 December 2016

।। ভুত কাহিনী ।।



হাটগোবিন্দপুরের নামটা লোকমুখে অনেকদিন থেকেই ভুতগোবিন্দপুর হয়ে গেছে। লোকে বলে এখানে আকাশে বাতাসে, জলে স্থলে সবখানে ভুত থিকথিক করছে। কারনও আছে। জায়গাটা বেশ গ্রাম। সুন্দর লোডশেডিং হয়। তালগাছের মাথায়, বাঁশঝাড়ে,  বুড়ো বটের তলায়, বেল গাছে, ভাঙা জমিদারবাড়িতে অন্ধকার আর জোনাকি মাখামাখি করে থাকে। কোন কোন রাতে হুক্কাহুয়ার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে,  গ্রামের দক্ষিণ সীমানার জলাভূমির দিকে তাকালে কয়েকটা আলোকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। আশেপাশের অনেক জায়গা থেকেই ভুতেরা এসে এখানে বাসা বাঁধে। আঁধার ঘনালেই তেনারা সব বেরিয়ে আসেন। তাই কী শীত, কী গ্রীষ্ম সন্ধ্যের পরই হাটগোবিন্দপুরে একটা শিরশিরে হাওয়া ফিসফিস করে বয়।

শীত পড়ি পড়ি করছে। চাঁদের আলো কুয়াশা মেখে পাতলা সরের মত ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামটায়। ঘুম ভেঙে ক্রমে জমে উঠছে ভুতমহল। শাঁখচুন্নী ইয়াব্বড়ো নথ নেড়ে নেড়ে তার প্রাণের বন্ধু ঝামড়িকে শুধাচ্ছে - ওলো সই, ওলো সই / খই কোই, খই কোই? আজ শিবু দাদুর মড়াযাত্রার সময় সে থাকতে পারেনি। ঝামড়িকে বলে গেছিল খই তুলে রাখতে। এখন এসেছে সেই খইয়ের খোঁজ করতে।

প্যাংলা নবীন ভুত। জ্যান্ততেও সে ভীতু ছিল, মরেও ভীতু ভুত হয়েছে। যাইহোক, আজ সে খুব চিন্তায় আছে। খবর পেয়েছে রাঘববোয়াল মরে ভুত হয়েছে আর সে এখানেই আস্তানা বাঁধবে। এই রাঘববোয়ালই মেরেছিল তাকে, তার জমিটা হাতানোর জন্য। প্রথমে সে তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। রাঘববোয়ালের তখন কী বন্ধু বন্ধু ভাব। সকাল বিকেল পোঁদ ঘসাঘসি। একটু সন্দ হয়েছিল, এত বড়লোকের দোস্তি! কিন্তু বাংলার ঠেকে, চাটের সাথে ওটুকু সন্দ উড়ে যেতে বেশি সময় নেয়নি। সম্বিত ফিরেছিল, মদের ঠেক থেকে ফেরার পথে যখন রাঘববোয়ালের স্যাঙাতের ছুরিটা তার গলাটা দু ফাঁক করে দিয়েছিল। অবশ্য ওই ঘটনার কদিন পরেই রাঘববোয়ালও টেঁসে গেছিল হার্ট অ্যাটাকে। ওই জমি আর তার ভোগে লাগেনি।

এ হেন রাঘববোয়াল ভুত হয়ে এখানেই আসছে শুনে, প্যাংলা ভুতের হাঁটুর ঠকঠকানি আর থামছেই না। হঠাৎ তার মনে পড়ল - আরে, সে তো মরেই গেছে। ওই শালার রাঘববোয়াল তার আর কী বালটা ছিঁড়বে! অতঃপর হাঁটুর ঠকঠকানি থেমে গেল তার। অবশ্য একটু আফশোসও হল - রাঘববোয়ালও যে মরে গেছে, প্রতিশোধটা আর নেওয়া হল না।

চিকন ভুত উদাসী মনে পুকুরের উপর ঝুঁকে আসা খেজুর গাছে বসে পা দোলাচ্ছে আর পুকুরের জলে ভেসে থাকা চাঁদের, হাওয়ার ধাক্কায় ভেঙে যাওয়া দেখছে। অনেকের ধারনা, ভুতেদের সবই বুঝি জ্যান্ত মানুষের উল্টো। মানুষ ভুলে যায় বেঁচে থাকার সময়ের কিছু ভাললাগা, মায়া, স্বপ্ন, অতৃপ্তির রেশই তাদের ভুত করে তোলে। তাই আমাদের এই ভুতটিও জোৎস্নাবিলাসী। সে অপেক্ষায় তার প্রেমিকা জলার পেত্নীর জন্য। এ প্রেম তাদের মনুষ্যজন্ম থেকেই। জলাকে কারা যেন ধর্ষণ করার পর মেরে ফেলে রেখে গেছিল দক্ষিণের জলাভূমিতে। না, চিকন  অবিশ্যি তখনই আত্মহত্যা করেনি। কষ্ট পেয়েছিল খুব। আবার সেই কষ্ট সামলেসুমলে জমিয়ে সংসারও করেছিল। কিন্তু না পাওয়া প্রথম প্রেম বলে কথা। অতএব ভুত জীবন। ভুতুড়ে প্রেম জমেছেও বেশ। জলা এসেছে। শুরু হল প্রেমালাপ। বাতাসের ফিসফিসানি আরেকটু ঘন হল। চিকন জড়িয়ে ধরতে গেল জলাকে। হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল হাওয়া। চুমু খেতে গেল - হাওয়া ছুঁল হাওয়া। এত ইচ্ছা, এত আকাঙ্ক্ষা, এত তৃষ্ণা তবুও দুজন কিছুতেই পারছিল না ছুঁতে দুজনকে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর দুজন তাকাল দুজনের দিকে। কিছু একটা কথা হল তাদের মধ্যে।
বারো বছরের দাম্পত্যের অভ্যস্ত মিলনকালে, হঠাৎ করে যেন বিদ্যুৎ খেলল সেন বাবুর শরীরে। যেন বউ না, সে রমণ করছে অন্য নারীর সাথে। সেন গিন্নির শরীরও পাচ্ছে অন্য শরীরের ওম। অনেকদিন পর তুমুল আদর হল দুজনের। অর্গাজমের পর ঘুমিয়ে গেল দুজনে আর চিকন ও জলা বেরিয়ে এল ওদের শরীর থেকে, একরাশ তৃপ্তি নিয়ে।
ওদিকে পাশের ঘরে শুয়ে থাকা সেন বাবুর বৃদ্ধ বাবার ঘুম এখন এমনিতেই কম। আজ যদিও বা চোখদুটো একটু ধরেছিল, ছেলে বৌমার ঘর থেকে আসা খাটের শব্দে আর চাপা শিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে ওনার। অন্ধকার সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, শিথিল লিঙ্গ কচলাতে থাকেন আর ভাবতে থাকেন - যদি ভুত হতাম, তাহলে ...

___________
© শোভন বাগ

।। অঞ্জলি ।।

তুমিতো সবকিছুই আমার কেড়ে নিয়েছো
শুধু নিমীলিত রাতটুকু আমার থাক,
সে তো প্রকৃতির দান, নয় আমার সঞ্চয়
ওটা আমার কাছেই থেকে যাক ।
-
তুমিতো যা চেয়েছো তাই দিয়েছি
ভালবাসার মাসুল দিয়েছি চড়া দামে,
সারা জীবনের যা কিছু সঞ্চয় আমার
সব লিখে দিয়েছি তোমার নামে ।
আরও যদি কিছু লাগে তোমার
আমায় তুমি বলে দিও নিঃসংশয়ে,
আমি যদি কখনো চলেও যাই
সবই তোমার জন্য যাবে রয়ে ।
-
যে অঞ্জলিতে লিখেছি তোমার নাম
সে অঞ্জলি থাক তোমারি চরণে,
অঞ্জলি যে ফেরত নেওয়া যায় না
থাক না তোমার জীবনে মরণে ।
শুধু আমার নিশীথকে কেড়ে নিও না
সে যে আমার বড়ই একান্ত আপন,
অনুভবে আমি তোমায় কাছে পাই
ধন্য হয় আমার সে নিশিযাপন ।
-
তুমি খুশির সাগরে ভেসে যাও আজ
শুধু রাতটুকু আমার জন্য রেখো,
রাতের আঁধারে মিশে যাবে অশ্রুজল
শুধু তুমি নিজে সদা খুশি থেকো ॥

___________
© প্রতাপ মন্ডল

।। মতলবি ।।

দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে করেছিলে তুমি যেসব প্রতিজ্ঞা
পালন তার করনি কিছুই, করেছ শুধু অবজ্ঞা ।
লাভ কী; যেটা মানতে পারবেনা, বলে-কয়ে অযথা
কতবার তুমি বলেছিলে,মন শুনেছিল সেসব কথা ।
'বাঁচতে পারবনা তোমায় ছেড়ে, না পেলে তোমায় যাব গো মরে,
যাব না কখনও পরের ঘরে,বাঁচব শুধু তোমার তরে '।
এ'সব ভারীভারী কথা বলে, তুমি ধীরে-ধীরে গেছ সরে
এখন প্রেম-দুঃখে,গুমোটব্যথায় মনটা গুমড়ে মরে ।
ছলচাতুরী বুঝলাম আমি, তোমার প্রকাশিত ছলে বলে
জানতাম না আমি ছেড়েযাবে তুমি, এমন অভিনব কৌশলে ।
টাকা-পয়সা, জমি-জমা,বাড়ি, পেয়েছ স্বামীর মনটা
ভূলেগেছ তাই সব গুণগান, সোনা-দানা পেয়ে ধনটা ।
ভালোকথা প্রিয়, সুখেথেকো তুমি দোয়াকরে সদা মনটা
মধুময় হোক,শান্তিতে ভরুক,ধন্যহোক তোমার জীবনটা ।
______________
© নাজমুল হোসেন

তারিখ :- 21Nov. 2016(09:18 pm) রাঁচি, ঝাড়খন্ড ।

।। রক্তাক্ত অভিনন্দন প্রিয়তমাকে ।।

 কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আমার হাতের সাদা গোলাপ
 তোমার হাতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমার হাত ছিঁড়ে রক্ত ঝরে।
 ফলতঃ সাদা গোলাপেরা রক্তাত হয়ে তোমার বিবমিষা উৎপন্ন করে ও প্রত্যাখ্যাত হয়।
 মাটিতে পড়ে থাকা গোলাপদের সীমান্তের প্রহরীরা  হেলায় মাড়িয়ে যায়।
                                                   
 নাছোড়বান্দা আমি স্বর্গের দুয়ার থেকে
পারিজাত ছিনিয়ে এনে তোমার হাতে দিতে যাইl
“মৃত্যুর তীব্র গন্ধবাহী এ ফুল কিছুটা রোমান্টিক ততটা বাস্তবিক নয়",
 কপোতাক্ষের মৃত খাতে তুমি  ছুড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললে,“হৃদয়!একটা গোটা  প্রেমিক হৃদয় দিতে পারো?”

আমার রক্তমাখা হৃদপিণ্ডটি তোমার পায়ে উপড়ে দিতে তুমি শিউরে  উঠে বললে,“হৃদয়হীন  এ তো রক্তমাংসের দলা !আন্তরিক কিন্তু রোমান্টিক নয়।
তবে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় সংরক্ষণযোগ্য অবশ্যই । ”

বছর ঘুরতেই ‘এক নির্বোধের হৃদপিন্ড’ শিরোনামে তোমার সংগ্রহ প্রথম পুরস্কার জিতলে তুমি আদর করে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে।

  আমার হৃদপিন্ড একান্তে বলে উঠল,“রক্তাক্ত অভিনন্দন প্রিয়তমা! কাচের ঘরে নয় অন্ততঃ তোমার পায়ে রাখ এবারে।


_________
পৃথ্বী ব্যানার্জী

।। পরকীয়া প্রস্তাব - মন নিয়ে ।।


যে শব্দে প্রেম দিয়েছিলে - বিছানা শরীর ও ভাঙ্গন।
তিনটি বানানই ভুল।ফিরতে ফিরতে মাটিতে প্রস্তাবিত নকশা।
সুড়ঙ্গ আশ্রয় - এতোটা গভীরতম নয় মানুষের কাছে।।


দিন এগিয়ে এলে নোনা ঘামে শুকনো বিপর্যয় - খেয়ালে এগিয়ে রাখো।পরজন্মে মেফিস্টোফেলিস লীনতাপ।উচ্চতর প্রস্তুতুতে আলগা আগুন - যখের ধন্।ঘনিষ্ঠ শব্দকাড়ার প্রভাতী লোভ।।


লু-রাতে মাঝবরাবর নদী।উপত্যকায় হাঁ-মুখ - পিয়াস মেটায় না চাতক।আকাশভেদী বৃষ্টি কেবল পিঠ ভেজায়।জল চোঁয়ানো শাড়ি - একাকিত্ব স্পষ্ট করে - অশ্লীল স্পর্শদুটো - তোমাকে বিনির্মাণের স্বার্থে।।


ব্যাসশব্দে মেলানো নেই একঘেয়েমির বুদবুদ।
যদিও নিশুতি বিকেলের শুরুতে পুরো সমুদ্রটা গোটানো।কয়েকটা ঢেউ - ঠিক তোমার মতো।
ভাঙ্গছ - মিলছো - আকছো - শেখাচ্ছ - টলাচ্ছ।
উল্টানো যতিচিহ্ন কয়েকটা ই-কারজনিত সাবেক আহ্লাদী।দীপশিখা পরিপূর্ণ........


এখনোও মায়াজাল - চামচিকে রোদ - পোড়া ঘুড়ি - কমলা জানালা - বেগুনী বিকেল।
টবমতে একগোছা - ক্লান্ত ও আম্লিক - ছেড়া পাতা - ক্লকওয়াইজ কবিতা।
যন্ত্রণা বাড়ে না কেন?মাটি মেখে চুল ভেজালে অন্ধকারে।


লিভলাভ তত্ত্বে বিগত পরশু থেকে শুকনো চায়ের ডাঁটিভাঙ্গা কাপ।হাঙর ঠোঁট বাসি নয় - সাপচুমুর চুমুক।ঝরা কাঁটা আলগা খোঁপা থেকে - ছাল ছাড়ানো ঋনাত্মক বেলুন।
কামুক কামুক চোখের বাইক - নিঃশব্দে উড়িয়ে দেয় ডিসেল।আগ্রাসী প্রত্নতত্ত্বে আবগারি প্রশমন।
অথচ ঝুলন্ত সময় নাটুকে স্বপ্নে।
রাঁধেভ্যু মতে - বাসন্তী রঙা পরকীয়া ঘনিষ্ঠতা ছিঁড়ে বাইক চেপে পৌঁছয় - বনগাঁ থেকে মেটিয়াবুরুজ।।


এক চিলতে কাটাকুটি কথা - যেটুকু ছিল চু-কিতকিত সম্বল।কিশমিশ জিভে কুইনাইনের আচার - একমাত্র তোমার হাতেই সমাধিত্তোর।
কালো তোরণে চার্মিণার ছাপ - রিগরমটিসে মরামাছের হলদেয়ানা কার্নিশ জোড়া।
চলো।তাপ পালিশ করি।বার্নিশ দিয়ে বাড়াই শান্তরোদ।হয় আজ মারাত্মক রাত - অথবা কোনো সর্বনাশ আর নয়।।


মেদমুক্ত উপত্যকা - পিকাসো প্রতীক।পিসার মিনার জুড়ে যে শালিক গ্যালিলিও চিনিয়েছিল
আবার এসেছে বিজোড় ছাদ।এখানেই তোমার জন্য আমৃত্যু প্রথম।হেমলকে মন নেই - বনসাই আমেজে মরফিন দাবি।ভিজলে ভারি অসভ্য - শুকনো খরায় রোমকূপ চাপে কার্টিজের ছবি।
বুলেটেও চেতনা ভাঙ্গন কেন?বাষ্পীয় জলছবি মাখা তুমি।এসো।দেওয়ালকেও ঠান্ডা মাথায় খুন করার প্রতিশ্রুতি পালন করি।


আওয়াজ ছুঁলেই শিৎকার - চাঁদঘড়ি ছুঁতে হাত বাড়াচ্ছে কমলালেবু।আমরা চাইছি ছাপোষা প্রজাপতি।মাসের শেষ - যদিও পুজিমার্কা কোলাজে সিগারেট লভ্যাংশ নয়।
ঝুটমুট গুলিয়ে দিলে ট্রামলাইনের রুপো।একএকটা আকরিক মালিকানার ঠিকানায় তোমাকে চিঠি।
মুখোমুখি বসে থাকার আপোষ - জলময় সুযোগে তোমাকে ডাকি ছু-মন্তর মেঘ ডাকনামে।।
ডাকঘর শাঁখ বাজালো অবশেষে.........

১০
হাত ফস্কে জ্বালিয়েছি মধুমেহ - পুড়লো জোনাকী শরীর।মৃত্যুও প্রেম চেয়েছিল যৌবনে।
মরাল ঈশ্বরের ঘাম স্বাদ - একপা এগিয়ে অতর্কিত।
কবিতায় তরল হয় তরলিত - গ্লাসভর্তি চুমুর ফোয়ারা ফৌজদারি আকর্ষণে তোমার অলীক সীমান্ত।।

১১
ছোবলের পরেও ছোবল - শ্যেন আকৃতি অশান্ত নয় কৃত্তিম নাভিশ্বাসে।হয়তো কবিতাও তোমার জন্য ভুল - কোনো ভুল নয় ক্রিয়াপদ আক্রোশে।
বহু ঝড়ের খেয়াল টুকরোটুকরো হয় - শতাংশের হিসাবে ক্রমশঃ ঠোঁঁটের নীল নিঃশ্বাসে ঘন।।

১২
যে কবির কবিতা ছাপে না কেউ - রোমান্টিক মেজাজে নিঃস্বতা প্রিয়।
কবিতারও গোলাপি ভাস্কর্য - আতস আয়নায় ক্ষত।
পৃথিবী নিজস্ব মরশুমে বিলীয়মান ধাতব।
বিপরীত চাঁদমারিতে আটকানো টিকটিকির সংশোধীয় খসে পড়া - ঋ।।

___________
শব্দরূপ : রাহুল

।। স্মৃতিগুলি মোরে ক্ষণে ক্ষণে বাঁচায় ।।


বাবা মায়ের কোমল স্নেহ
সে বড় আনমোল জেনো,
মা বাবার স্নিগ্ধ ছত্রছায়া
বিশাল যেন অশ্বত্থ-কায়া ।
শৈশবের জোর কানমলা
সেই নিয়ে মোর পথচলা,
বেত খেয়ে অসহায় কান্না
সে স্মৃতি আজ চুনি পান্না ।
বেড়াতে গিয়ে আলুকাবলি
 ফুচকা, এগরোল, চপমুড়ি,
ছোটবেলার সেই পুরনো স্বাদ
 সে ছিল নির্ভেজাল নিখাদ ।
স্কুলের লাইনে মারামারি
 আর টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি,
রেজাল্ট-পূর্ব বিনিদ্র রাত
 নতুন বইয়ের রঙিন মলাট ।
সদ্যপ্রাপ্ত অনাবিল কৈশোর
 সে ছিল এক নিষ্কলুষ ভোর,
পাশের গার্লস স্কুলে উঁকিঝুঁকি
 অন্য এক স্বপ্নের আঁকিবুঁকি ।
স্যারদের নতুন নতুন নামকরণ
 ধরা পড়ে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ,
গরমের দুপুরের ঘুমহীন দাপাদাপি
 বর্ষার মাঠে কাদা মাখামাখি ।
সে সবই আজ দূর আলোকবর্ষ
 মনে রয়েছে তার বিপন্ন স্পর্শ,
বন্দী এখন যৌবনের খাঁচায়
 স্মৃতিগুলি মোরে ক্ষণে ক্ষণে বাঁচায় ।

______________
© ফিরোজ আখতার

।। অভ্যাস ।।


কফি খাওয়ার আমার অভ্যাস নেই। আমি ব্যাচেলর মানুষ। সাধারণত ব্যাচেলরদের সকালটা শুরু হয় চা এর সাথে সিগারেটের পাছায় হালকা চুমুতে। বিছানায় শুয়ে বাসি মুখে সিগারেটের পাছায় চুমুর যে অনুভুতি তা প্রেয়সীর নরম অধর কেও হার মানায়।

গত কিছুদিন ধরে কফি খাচ্ছি। কফি কেনার মত বিলাসিতা, সামর্থ্য বা সাহস কোনটাই আমার নেই। কফি দিয়েছে টুনি। ভালোবেসেই দিয়েছে। সে কফির প্যাকেট গুলোও সুন্দর। দারুন ঘ্রাণ। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে না খেয়ে গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াই। গোলাপ জলের মত এর ওর গায়ে ছিটিয়ে দেই। কফির ঘ্রানে সুবাসিত হোক জনতা। রাতে গায়ে কফি মাখতে গিয়ে দেখি কফি শেষ। এখন শরীরটা চিড়বিড় করছে। অভ্যাস বড় খারাপ জিনিস। টুনির সাথে দেখা হচ্ছে না অনেক দিন। তার দেখা পাওয়ার জন্য আমি সারাদিন গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার পর বিড়বিড় করে বলি, "আজ কি তবে সেই বিশেষ দিন? আজ কি তবে সে আসছে?"। অপেক্ষার শেষ হয় না। তীব্র অভিমান বুকে পুষে আমি জানালার গ্রীল এর ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করি। চার কোণা সে আকাশে মাঝে মাঝে ডানায় হলুদ রোদ মেখে চমৎকার এক ঝাঁক কবুতর উড়াউড়ি করে। মোঘলদের আমলে জন্ম হলে খারাপ হতো না। কবুতরের পায়ে চিরকুট বেঁধে তার কাছে পাঠানো যেত। সারাদিনের তীব্র অপেক্ষা আর দীর্ঘ না কাটা রাতের বুক ভরা শুণ্যতা নিয়ে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আমার ঘুম ভাঙল মুঠোফোনের বিকট আর্তনাদে। ভোর বেলার শক্ত ঘুম এ মুঠোফোনের আওয়াজ আর ট্রাকের হর্ন এর মধ্য আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা। দুটোই সমান।
আমি খেয়াল করে দেখেছি, ভোর বেলা সাধারণত যে সব ফোন আসে তার বেশীর ভাগই রঙ নাম্বার। ফোন রিসিভ করলে দেখা যায়, অপর প্রান্তে সিরাজগঞ্জের ভাষায় কেউ জানতে চাইবে... "অ বাই, আনোয়ার আছে নি?"
আমি মনে মনে "অ বাই, আনোয়ার আছে নি?" শোনার প্রস্তুতি নিয়ে ফোন রিসিভ করেই বললাম,
- আনোয়ার নাই, আর এটা ফায়ার সার্ভিস কিংবা পুলিশ স্টেশনও না।
- ভাইয়া আমি নাতাশা...এসব কি বলছেন?
-ও আচ্ছা আচ্ছা...
-ভাইয়া শুভ সকাল...
সাত সকালে ঘুম ভাঙিয়ে কোন অষ্টাদশী রুপবতী যদি ভাইয়া ভাইয়া ডাকা শুরু করে তাহলে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন। আমি কঠিন মেজাজ নিয়ে বললাম,
-আমার জন্য অশুভ...
-তা হবে কেন? দেখুন বাইরে কি সুন্দর সকাল...
- সেটা তোমার সুন্দর লাগতে পারে... সবার লাগতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। আমার তো আজকের সকাল খুবই অশুভ মনে হচ্ছে। বাইরে শফিকুল এর মুখ ধোঁয়ার শব্দ পাচ্ছি। যে দিন তার মুখ ধোঁয়ার আওয়াজ পাই সে দিন আমার দিন খারাপ যায়। কোন না কোন পাওনাদার এর মুখোমুখি পরে যাই।
-ভাইয়া আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
-হুম...
-ভাইয়া খুব জানতে ইচ্ছে করছে...আপনি আমার সাথে কেন খারাপ ব্যবহার করছেন?
নাতাশাকে আমি কিভাবে বোঝাই...যার মন জুড়ে জারুল ফুলের রঙ, শরীরের প্রতিটি লোহিত কণিকায়, প্রতিটি নিউক্লিয়াস জুড়ে জারুলের ঘ্রাণ জড়িয়ে থাকে...অন্য যে কোন মেয়েকেই তার কাছে ধুতুরা ফুল মনে হয়। ধুতুরা ফুলের স্বভাব খারাপ। এ ফুলে মানুষের মাথা ঘুরায়, পেট উঁচু ছাড়াই বমি বমি ভাব আনে।

___________
© মহম্মদ সামি

।। নিষিদ্ধ শহর-2 ।।



শেষ পর্ব
********


   ‘কোলকাতা’! এক অদ্ভুত বৈচিত্র (বৈপরিত্বও বটে)। আমার সেই বিখ্যাত “কুখ্যাত নগরী” কে ঘিরেও রয়েছে সেই বৈচিত্র। সোনাগাছিকে যদি কেন্দ্রবিন্দু ধরে চলি তো তার উত্তরে রয়েছে বাঘবাজার যেখানে মা আর সিস্টার নিবেদিতা আমৃত্যু কাটিয়েছেন। নাট্যকার গিরীশ ঘোষ’ও এখানেই থাকতেন। সোনাগাছির পূর্ব দিকে বিডন স্ট্রিট সাহেবদের আবাস স্থল, যার পাশেই অধুনা বিবেকানন্দ রোড আমাদের স্বামীজির বাড়ি। পশ্চিমে স্রোতাশিনী গঙ্গা এবং আধুনিক বাংলার সংস্কৃতির পীঠস্থান ঠাকুর বাড়ি।   দক্ষিণে চৌরঙ্গী, বউবাজার।

   আর এ’সবের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল সোনাগাছি! পণ্ডিতেরা বলেন পতিতালয় নাকি সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তৈরী হয়েছে!
   ‘সে যুগ’ আর ‘এ যুগ’ সমাজ এগিয়েছে পিছিয়েছে, সোনাগাছি রয়েগেছে সোনাগাছিতেই। এদের জীবনে কোনও পরিবর্তন হয়নি। এরা আজও অবহেলিত অবদমিত। কখনও কথা বলার সৌভাগ্য না হলেও এদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ অবশ্যই হয়েছে। আর সেই সুযোগ থেকেই একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছি। যেখানে আমাদের সমাজ আজও পুরুষ শাষিত সেখানে এদের সমাজ নারি পরিচালিত। মহাভারতে প্রমিলার দেশের কথা শুনেছিলাম এটা সত্যি সত্যি প্রমিলার দেশ। সম্পূর্ণ রূপে পুরুষ বর্জিত (পুরুষ এখানে উপার্জনের মাধ্যম মাত্র)। আমাদের মধ্যে আজ আর কোনও মিলমিশ নেই কিন্তু এরা আজও এক। এদের মা বাবা ভাই বোন স্বামি স্ত্রী সন্তান সব এরা নিজেরাই! এখানে বংশ রক্ষা স্ত্রী সন্তান দ্বারা হয় পুরুষ সন্তান নয়।

   অনেক বছর আগে আমার এক কলিগ খিদিরপুরে কাজ করতেন। তিনি একদিন গল্প করতে গিয়ে বলেছিলেন এক গরমের দুপুরে খুব তেষ্টা পাওয়ায় এক বাড়িতে জল চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন না সেটা এক পতিতার বাড়ি। সেই ভদ্রমহিলা তাঁকে ঘরে বসিয়ে শুধু জল’ই নয় সাথে মিষ্টিও দিয়েছেলেন। আমরা ভাবতেও পারি?
   সারাজীবন ছাই ঘেঁটে গেছি রত্ন খুঁজতে, পুঁথিগত বিদ্যে আমার নেই। চারিদিকে যা দেখেছি কুড়িয়ে বাড়িয়ে শেখার চেষ্টা করেছি মাত্র। শুধু আমি নয় এদের থেকে পুরো সমাজের শেখার আছে।

   বোধহয় একটু আবেগ প্রবন হয়ে গেলাম... হোকগে! জীবনের শেষ মুহূর্ত অব্দি যেন এদের মনে রাখতে পারি, ভালবাসতে পারি।
   বেঁচে থাক তোরা...মা, বেঁচে থাক আমার সাধের “অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট”।
___________
© দীপাঞ্জন দাস

।। মম স্বাধীনতা কথা ।।


বিবাহিত পুরুষের স্বাধীনতা দিবস 15th August নয়রে পাগলা। বউ যেদিন বাপের বাড়ি যায়, সেদিনই হল গিয়ে স্বাধীনতা দিবস।

না গো, না। তোমাকে বলছি না। এটা বাকি সব দুষ্টু বউদের পোষ্য স্বামীদের উদ্দেশ্যে। তুমি তো আমার সোনা বউ। এইতো কালকেই তুমি বললে বাজার থেকে পঁচিশ তিরিশটা সোয়া ইঞ্চি মাপের চিকেন ব্রেস্ট পিস নিয়ে আসতে। তুমি তো বলতেই পারতে ঠিক সাতাশটা  বা ছাব্বিশটা আনতে। কিন্তু পুরো পাঁচ পিসের স্বাধীনতা তুমি আমাকে দিয়েছিলে।
তারপর ওই যেদিন শপিং করে ফিরছিলে, সেদিনও তো বলনি যে লাল রঙের ব্যাগটা ডান হাতে আর সবুজ ব্যাগটা বাঁহাতেই ধরতে হবে। আমি তো দিব্বি একবার লালটা মাথায়, সবুজটা হাতে, আরেকবার সবুজটা মাথায়, লালটা হাতে নিলাম।
কারো বাড়ি যাবার সময়ও রীতিমত দু দুটো ড্রেসের মধ্যে একখানি বেছে নিতে দাও। যেদিন ভাতের সাথে কাঁচালঙ্কা খাওয়ার অনুমতি দাও, সেদিনও তো আমি আমার ইচ্ছেমতো কাঁচালঙ্কা ফ্রিজ থেকে বেছে নিতে পারি। কতো সুন্দর করে তুমি জিজ্ঞেস করো, হাতখরচের পঞ্চাশটাকা একটা নোটেই দেবে নাকি পাঁচটা দশটাকার নোট দেবে। তোমার সিরিয়াল দেখার ব্রেকের মাঝে আমি আমার ইচ্ছেমতো চ্যানেলও দেখতে পারি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া,  মদ খাওয়া, নেটে অসভ্য দেখা - এগুলো তো স্বাধীনতা নয়, উচ্ছন্নে যাওয়া। তাই এগুলো বন্ধ করে তুমি একদম ঠিক করেছ। সেই কতিপয় দিনগুলি ছাড়া, যেদিন তোমার "মাথা ব্যাথা" করেনা বা "ঘুম" পায়না, আমার পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমানোরও স্বাধীনতা আছে। এমনকি, মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে ওই পাশবালিশ তোমার কোন বান্ধবী হয়ে গেলেও, সবদিন স্বপ্নের মধ্যে তুমি মোটেও বারন করো না।
তাই তো বলছি, এটা মোটেও তোমাকে উদ্দেশ্য করে বলা নয়।

কিছুক্ষন পর -
এই তো, আমি এখানে। খাটের তলায়। না না, ভয় পাব কেন! ওই মশা মারছিলাম আর কি। ফেসবুকের ওইটা? না মানে, ওটাতো তোমার উদ্দেশ্যে... আহা, তুমি তো আমার সোনা ব... সবাই তো আর তোমার মতো... কী বলছ, কতজনের বউয়ের সাথে সম্পর্ক আছে? বিশ্বাস কর, পাশবালিশের ব্যাপারটা হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো, তাই। এইতো বেরুচ্ছি খাটের তলা থেকে। আহা, হাতে লাগল নাকি? ঝাঁটাটা এনে দেই? তোমার নরম হাত আর আমার হাড়গুলোও যা শক্ত। আচ্ছা, ঠিক আছে। কান ধরেই দাঁড়াচ্ছি।

দেখছেন তো, ও একবারও বললো কি, কান ধরে কোথায় দাঁড়াতে হবে? কান ধরে আমি শোবার ঘরের কোন কোনে দাঁড়াব, সে বিষয়ে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।।।

___________
© শোভন বাগ

।। একটি নস্টালজিয়া- গ্রামবাংলার যাত্রাপালা ।।



শীতকাল মানেই সোয়েটার টুপি নতুন গুড় আর নবান্নের স্বাদ। শহরে বইমেলা, পিঠেপুলি উৎসব হয়ত বা আরো অনেককিছু। কিন্তু গ্রামে শীতের সাথেই কোলকাতার চিৎপুর থেকে বাস ভর্তি করে হাজির হত পরিযায়ী যাত্রাপালার দলগুলি। ছড়িয়ে পড়তো বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম মফঃস্বলের মঞ্চে মঞ্চে। অগ্রহায়ণ এর কেটে নেওয়া ধানের জমির উপরেই তৈরি হত অস্থায়ী মঞ্চ বা মাচা। করোগেটেট টিন দিয়ে ঘিরে তৈরি হত অডিটোরিয়াম, যার মাথার উপরে থাকত বাঁশের খুটির বলে ছাওয়া চটের ছাওনি। তিন চার ঘন্টার সে এক মনোজ্ঞ পারিবারিক বিনোদন। শুকনো খটখটে জমিতে কাটা ধানগাছের গোঁড়া গুলোকে বিছিয়ে, চটিজোড়া খুলে তার উপরে বাবু হয়ে বসে চাদর মুড়ি দিয়ে চিনে বাদাম চিবোতে চিবোতে চার ঘন্টা কাবার।

আজকাল স্যাটেলাইট টিভির রমরমা আর অধুনা  মোবাইলেই শত মনোরঞ্জের ভিরে যাত্রার সেই সুদিন আজ অতীত। কিছু স্থানে টিমটিম করে টিকে আছে ঠিকিই, কিন্তু সেখানেও টালিগঞ্জের সিরিয়াল শিল্পীদের দাপট। শুধুমাত্র এই পেশা দিয়ে আজ আর পেট চালানো যায়না, তাই পেশাদার যাত্রা শিল্পী আজ বিরল। যাত্রাশিল্পটা কলা হিসেবে বহু প্রাচীন, ভারতের শিল্পসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্দ্য অঙ্গ। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র তো বটেই, মহাভারত, হরিবংশ, শ্রীচৈতন্য ভাগবতে, এমনকি গ্রীক ভূপর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণেও যাত্রাপালার উল্লেখ রয়েছে। বালক নরেন্দ্রনাথও গোবিন্দ অধিকারীর পালা দেখে সেই মত হাঁটাচলা কথাবার্তা বলতেন, এই যাত্রাপালাতেই বুঁদ হয়ে  আপ্লুত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যার জন্য আজও যাত্রালক্ষ্মী নামে বীনা দাশগুপ্তের স্মৃতি বাবা কাকাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

সেকালে, গ্রামের মাতব্বর স্থানীয় দাদু জ্যাঠারাই এই যাত্রানুষ্ঠানের যাবতীয় দৌড়ঝাঁপের দায় দায়িত্ব নিতেন। পরবর্তী কালে পাড়ার ক্লাব সেই স্থান দখল করে। তখন যেকোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে পাড়ার পাড়ায় এ্যমেচার যাত্রারও একটা জনপ্রিয় চল ছিল। তখনই জেনেছিলাম যাত্রা দলের মালিককে অধিকারী বলা হয়, প্রম্পটারকে মাস্টার, আর ভিকিরি থেকে রাজার পোষাক সবই ভাড়া পাওয়া যায়।

পেশাদার ভাড়ার নায়িকাদের সাথে নিজেরাই সেই পালার নায়ক খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতাম। এমনই সব শীতের সন্ধ্যাগুলোতে মেতে থাকতাম যাত্রার মহড়াতে। আর আমাদের মায়েদের কাছ থেকে, আমাদের কাকার দল সেই অনুমতি যোগাড় করে আনত। তবে ওই নায়িকার সাথে যাত্রার দিন দুপুরেই একমাত্র মহড়া হতো। সেই নায়িকাদের দেখার জন্য পাড়ার ছেলে ছোকরাদের সে কি উঁকিঝুঁকি আর আগ্রহ। আমাদের মত ছেলে ছোকরাদের কাছে সেই কালে মেয়ে মানেই ভিনগ্রহের বাসিন্দা ছিল। কারন মা বোন তো মা বোনই, তারা তো আর মেয়েমানুষ নয়। তাই পর মেয়েমানুষ নিয়ে, নকল গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে, সকল গুরুজনেদের সামনে আড়ষ্ট অভিনয়, সে এক মিষ্টি অভিজ্ঞতা।

বছর পাঁচেক আগে একবার চারচাকা করে তামিলনাড়ুর ভেলোরে গেছিলাম এমনই এক শীতকালে। বাংলা-উড়িষ্যা-অন্ধ্রের বিস্তীর্ন গ্রামাঞ্চল পেরিয়ে সে যাত্রা কোন ভ্রমণের থেকে কম কিছু ছিলনা। সেই পথেই দেখেছিলাম যাত্রা পালা আজও জীবিত। জানিনা সেখানেও আর কত দিন প্রাসঙ্গিক থাকবে। আজকাল আমাদের রাজ্য সরকার অবশ্য যাত্রা একাডেমি গঠন করে, তার মাধ্যমে একগুচ্ছ সঞ্জীবনি প্রকল্প ঘোষনা করে এই সুপ্রাচীন সংস্কৃতিকে অক্সিজেন যোগানোর সৎ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

কিছুবছর আগে আমাদের গ্রামবাংলার পথঘাট মুখরিত থাকত যাত্রা তথা বিচিত্রানুষ্ঠান এর প্রচারব্রম্ভে। ভ্যান, রিক্সা, এমনকি এম্বাসেডর গাড়ির ছাদে মাইকের চোঙা বেঁধে চলত সেই অপরূপ বাচন ভঙ্গির প্রচার। দেওয়ালে দেওয়ালে রঙিন লিথো পোষ্টার। যে পাড়ায় যাত্রাপালা হবে, সেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয় অভ্যাগতদের ভীড় জমে যেত যাত্রা দেখার জন্য। যাত্রার দিন সকালেই সামনের উইন্ডস্ত্রিনে পালার নাম লেখা বাসে করে বাজনাদারেরা আর সহ কলাকুশলীরা এসে যেত। নায়ক নায়িকা বা কোন বয়স্ক বিখ্যাত শিল্পী থাকলে তিনি প্রাইভেট গাড়িতে দুপুরের দিকে গ্রামে ঢুকতেন। আর কোন মাতব্বর গোছের লোকের বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন। আর এর দরুনই সেই বাড়ির ছেলে মেয়েরা বন্ধু মহলে কলার উঁচু করে চলতো আর ভীষণ সমাদৃত হত মাস খানেক।

সেই সুমধুর প্রচার ভঙ্গির কিছুটা তুলে দেবার চেষ্টা করলামঃ

সুধী যাত্রামোদী বন্ধুগণ, ভুল করবেন না ভুলে যাবেন না, আগামী অমুক তারিখে তমুক স্থানের রঙ্গমঞ্চে, তিনরাত্রী ব্যাপি বিশাল যাত্রানুষ্ঠানে, ঝলমল করে ফুটে উঠতে চলেছে, জাপানী আলোকমালায় সজ্জিত সুপার সাইক্লোরামা পদ্ধতিতে এ যুগের সবচেয়ে সাড়া জাগানো অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালা... শ্বশুর কেন অসুর....

যাতে অভিনয় করতে আসছেন যাত্রাজগৎের উদিত সূর্য, গায়ক নায়ক কুমার ইন্দ্র, সাথে বোম্বে থেকে আগত সিনেমার গ্লাম্যারকুইন যৌবনবতী লাস্যময়ী নায়িকা মিস খিলখিল, খলনায়কের ভূমিকায় জীবন্ত সন্ত্রাস কামাক্ষ্যা প্রসাদ, আর হাসির ডালি সাজিয়ে মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন হাসির রাজা... হোঁচট কুমার...

বিশেষ করে মনে রাখবেন, মহিলাদের বসিবার আর সাইকেল রাখিবার পৃথক বন্দোবস্ত রয়েছে। পালা শেষে তিনটি রুটে ফেরার জন্য বিনামূল্যে বাসের ব্যবস্থাও থাকবে।

এবারের আমাদের বিশেষ আকর্ষন, যাত্রা শুরুর পূর্বে ৩০ মিনিট ব্যাপি, মিস ডলি, মিস মাধুরী, মিস ববিতা আর মিস কুমকুক (নামগুলো উচ্চারনের সময় গলার স্বরের তারতম্য, নেশা ধরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট)  দ্বারা পরিবেশিত  ‘বোম্বে ড্যান্স হাঙ্গামা”

টিকিটের দাম কাউন্টারে, জমিন ৩০ টাকা, চেয়ার ৫০ টাকা, সিজন টিকিট জমিন ৭০ টাকা, চেয়ার ১২০ টাকা ।  সুতরাং, ভিড় এড়াতে আজই টিকিট কেটে রাখুন। অগ্রিম টিকিটে, দৈনিকে ৫ টাকা আর সিজন টিকিটে ১০ টাকার বিশাল ছাড় পেতে আজই টিকিট কাটুন। অগ্রিম টিকিটের উপরে থাকলে আকর্ষনীয় পুরস্কার। লটারির মাধ্যমে তিন ভাগ্যবানকে বেছে নেওয়া হবে। টিকিট আমাদের প্রচার গাড়িতেই পাওয়া যাচ্ছে।

সত্যিই আজ এই শিল্পটা প্রায় লুপ্তপ্রায়। তার বদলে ফি সন্ধ্যায় সংবাদ চ্যানেলে চ্যানেলে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নামে চড়া দাগের যাত্রাপালা। দেশের সংসদ ভবন থেকে পাড়ার পার্টির নেতা পর্যন্ত, সেই চড়া মেলোড্রামার যাত্রা প্রতিনিয়ত সহ্য করছি আমরা।

মাচার যাত্রাপালাতে সত্যের কথাটা বলার জন্য অন্তরালে ‘বিবেক’ বলে একটা শিল্পী থাকত। আমাদের দূর্ভাগ্য আজকালকার এই রোজনামচা যাত্রাপালাগুলোতে উত্তেজনা বিনোদনে আবেগের কোন মশলার ঘাটতি নেই, অভাব শুধু ‘বিবেকের’।


(উন্মাদীয় বানানবিধি অনুসৃত)
________

© উন্মাদ হার্মাদ

।। সেলুকাস ।।

মৃত দুপুরকে ঠুকে ঠুকে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত দাঁড়কাক,
ফিরে এসো গোলাপী দিন-
আমরাও অদ্যবধি হাতড়ে চলেছি কিছু বিচিত্র উপহাস।

চারিদিকে কি দুরন্ত হাকডাক,
এবার পাল্টে ফেলবো নিজেকে!
পাল্টে ফেলবো সব-
এবার সুনিশ্চিত পাল্টে যাবে এ ঘুণেধরা সমাজ...

অথচ স্থুল রাতের শবদেহে স্থির পরাভূত সময়,
আসেনা সকাল- নতুন সূর্য;
গলিত অন্ধকার ঢেউ খেলে যাচ্ছে
পরজীবী মগজ নদীতে আজ...

পরিবর্তনের ধ্যানে মগ্ন সুদীর্ঘ চেতনার বীজ,
পায়ে পায়ে পিষ্ট মায়াবী কেচ্ছার সাতকাহন;
কালের পাথর বুকের গভীরে সলাজে
গুমরে মরছে বিপর্যস্ত সভ্যতার অঙ্কুরোদ্গম।

মৃত দুপুরকে ঠুকে ঠুকে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত দাঁড়কাক,
পাল্টে যাচ্ছে নদীর গতি স্রোত ও শরীর,
পাল্টে গেছে পৃথিবীর উষ্ণতা;
তবু খোলেনি আমাদের উপলব্ধির দরজা,
আর;
শুধু পাল্টায়নি আমাদের আত্মস্বার্থের চরিত্রের ধরণ...

কি নির্লজ্জ আমরা!
মন্ত্রমুগ্ধ অঙ্গিকারের এ বর্ষপঞ্জি শেষে,
হয়তোবা আগামী নববর্ষে আমরা
আবারও করবো পাঠ-
নিজেকে পাল্টানোর ইস্তেহার...
সেলুকাস!
______________
© মোশ্ রাফি মুকুল

Monday, 19 December 2016

।। প্রথমবার সবার মাথা ঘোরে ।।



চেম্বারে ভালোই ভিড়। ভেতরের বসার জায়গা অপ্রতুল হওয়ায় বেশিরভাগ ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ গেট এর কাছেই পান দোকানে দাঁড়িয়ে এটা সেটা কিনে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভেতরে গিয়ে খবর নিয়ে আসে, কত জনের পর তার লাইন? ডাক্তারবাবুর বিরাট বাড়ির দিকে তাকিয়ে অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে," ভিত দিতেই তো লাখ গেছে।" পাশ থেকে একজন পানের পিক গলা বাড়িয়ে ড্রেনে ফেলে বলে, 'সব কালো টাকা। দুনম্বরি সব'।

সুজিত একটা পিলারে ঠেস দিয়ে এদের আলোচনা শুনছিলো। সাদা মার্বেলের কার্নিশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ' আমার ছেলে কেও ডাক্তার বানাবো।' পরক্ষনেই চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আগে ছেলেপুলে তো হোক। তারপর না হয়। কি যে হবে কে জানে। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে। ভেতরে উঁকি মেরে একবার দেখে। খুব ভিড়। কত দেরি হবে কে জানে। দেরি হতে থাকলে তো সম্যসা বাড়বে, বই কমবে না।

 ডাঃ অনিল রয়। এলাকার নামকরা গাইনিকলজিস্ট।বয়স বাড়ার সাথে সাথে নাম ও কেমন বেড়েই চলেছে।  কম্পউন্ডার এক এক করে পেশেন্টের নাম ডেকে ভেতরে পাঠাচ্ছে। এক জনের দেখা শেষ হলে আর এক জন কে পাঠায়।শ্যামলি রাউত, কুলসুম বেগম, রঞ্জিতা দাস একে একে ডাকে।

 খাতা তুলে পরের নাম ডাকতে গিয়ে থমকে যায় কম্পাউন্ডার। চোখ তুলে বিস্মিত কণ্ঠে ডাকে - সুজিত বর।
কানে যেতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ছুটে আসে সুজিত। কম্পাউন্ডার তার ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখে মাথা থেকে পা অব্দি দেখে। নাহ:, এতো গোটাসোটা ছোকরা।

 - পেশেন্ট কই?
 -' আমি.. .. আমিতো।' আমতা আমতা করে সুজিত বলে। ' আমার বউ বাড়িতে। আমি শুধু ডাক্তার বাবুর সাথে একটা আলোচনা করতে এসেছি।'
 -'ও'। বলে ভেতরে নিয়ে যায়।
ভেতরে ঢুকে সুজিত পেশেন্টের জন্য বরাদ্দ চেয়ার টেনে বসে। অনিল বাবু চশমার ফাঁক দিয়ে একপলক দেখে বলেন, ' আপনি ?'
 কপালে জমা হওয়া বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের চেটো তে মুছে বলে -' খুব বিপদে পড়েছি ডাক্তারবাবু। বউ বাড়িতে। আমিই এলাম।'
 অনিল রয় খুব মিশুকে মানুষ। চেয়ারে গা এলিয়ে বলেন ' হুম। সে তো সবাই সম্যসায় পড়লেই আসে। আনন্দে কি কেউ এ চত্বর মাড়ায়?'
সোজা হয়ে বসে সুজিত চিন্তিত মুখে বলে, 'সমস্যা বিয়ের দুমাস পর থেকেই শুরু। এখন তো খুব বাড়াবাড়ি রকম স্যার।' বলেই কানের ধার বরাবর নেমে আসা ঘাম জামা দিয়ে মোছে।
 অনিল বাবু ভালোই বুঝতে পারছেন, ছোকরা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছে।তিনি ও তো.. যাইহোক ডাক্তারি বিদ্যে পেটে ছিল বলেই এই ছোকরার মতো হাল হয় নি। মুচকি হেসে ফেললেন।
 - আচ্ছা বুঝলাম। স্ত্রী বমি করছে খুব?
 - হ্যাঁ স্যার।
হাসি ঠোটে চেপে জিগ্যেস করেন, ' বাড়িতে বাবা মা বা শশুর শাশুড়ি কেউ আছেন?'
- না, আমরা এখন একাই থাকি।
আজকালকার এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির এই একটা সম্যসা। তুমিতো চাকরিবাকরি করতে বাইরে যাবে নিশ্চই, তখন কে দেখবে এই শরীরখারাপ?
- বমি হচ্ছে ভালো তো। কদিন ধরে হচ্ছে?
- তা সে গত একমাস ধরে।
ডাক্তারি ভঙ্গিতে ভারিগলায় জিজ্ঞেস করেন ' আর কি কি অসুবিধে?'
- মাথা ঝিমঝিম করে, ক্লান্তি বোধ করে খুব। একদম দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না স্যার। একটুতেই শুয়ে পড়ে।
- আচ্ছা আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন', বলে একটা বমির ওষুধ আর একটা ভিটামিন লিখে দেন প্রেসক্রিপশনে। কলেজে সেই যে শিখেছিলেন, কোনো পেশেন্ট কে বিনা ওষুধ লিখে ছাড়তে নেই।পুরো সুস্থ হলেও ভিটামিন লিখে দাও। নইলে তুমি খারাপ ডাক্তার, রোগ ধরতে পারোনি তাই ওষুধ দিতে পারো নি। বদনাম রটে যাবে।
সুজিত গলা নামিয়ে হাত  কচলাতে কচলাতে বলে,' তা নিয়ে আসবো স্যার। কিন্তু হাত দিয়ে আদর করলেও কেমন সাড়া দেয় না। ওর মুডটা তখন অফ হয়ে যায়। এর সুরাহা হবে স্যার?'

অনিল বাবু হালকা হাসতে বলেন, "হ্যা, সব সুরাহা হবে। এই সময় একটু ওইরকম হবে। নতুন বিয়ে, প্রথমবার তো। দিন গেলে আপনি ও ঠিক হয়ে যাবেন।'
সুজিতের মুখে হাসি ফুটে ওঠে এবার।উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ। ' হেঁ হেঁ। প্রথমবার তা ঠিক স্যার। ঠিক হয়ে যাবে বলুন?
- হ্যা। কয়েকমাস পর সুখবরও পেয়ে যাবেন।
খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে সুজিত। 'খুব আশা করেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি স্যার। জানতাম আপনি পারবেন।' কিন্তু 'কয়েকমাস' কথাটা কেমন বড্ড দেরি ঠেকলো। একটু থেমে ঝুঁকে ডাক্তার বাবুর মুখে চেয়ে বলে ' একটু তাড়াতাড়ি করা যাবে না?তাহলে বড্ডো উপকার হয়।'
পেশেন্টের চাপ আছে। কথাটা শুনেই রাগ  হল অনিল বাবুর। ঝেড়ে বললেন, " স্ত্রীকে নিয়ে আসুন। সব টেস্ট করে বলে দেব কত দিনে বাচ্চা হবে।"
- ওর কেন টেস্ট করবেন স্যার? সম্যসা তো  আমার।

অনিলবাবু চাবুকের মতো ছিটকে সোজা হয়ে চিৎকার করে উঠলেন,' এই মাথা ঘোরা, বমি হওয়া তবে কার?' আওয়াজে কম্পাউন্ডার ছুটে এসছে। সুজিত কাঁদো কাঁদো মুখে হাত জোড় করে নত মুখে বলে, ' আমার স্যার। উত্তেজিত হলে ও সাড় দেয় না। বেরিয়ে যায়। আমার মাথা ঘোরে, ঝিম ঝিম করে, দুর্বল লাগে স্যার। আমাকে দেখলেই ওর আজকাল নাকি ঘেন্নায় বমি পায়।

 ডাক্তারবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে বেসিনে মুখ আর মাথায় জল দেন। তিরিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে এই প্রথম।।।

____________
© সাফিন আলি

।। লিওনার্দো - চায়ের দোকান ।।

সকালে গরম চা।রাত্রেও।বারোটা বাজলে রাম।লিকার।ছন্দপতনে অবনতি।কেটলি গরম।ফোস্কা।
মাওবাদ ও খিস্তী।লেড়োবিস্কুট।চটকলে চুল।ধপধপে নুন।চুন।মেশে না।লালচে ছোপ।ইস্কুল।মিলিটারি পোষাক।বিড়ি থেকে বর্গা।খাতায় টান।মা.......মানুষ।গেরুয়া চাদর।শীতঘুম।আলিমুদ্দিন ছরছর করে।একহাঁটু জল।।
লিওনার্দো চায়ের ছবিতে।কাশ্মীর।কল্যাণী।খড়দা।যাদবপুর।বেলেঘাটা।বরাহনগর।রক্তাক্ত আঁতেল।কবিপকেট।ধর্মযাজক।।

অস্বস্তি।খুচরো মাল।খালাশ।হড়হড়ে।বাড়িতেই বাজার।হ্যা হ্যা হ্যা।দাঁত কেলানো হনুমান।সবুজ হানিমুন।গোলগোল।পালানো হিসেব।হিস্যা।পয়সায় পাঁচ।।

ঘূর্ণিঝড়ের চুল্লখোরী বন্ধ নয়।কৈফিয়ত - দায় নেই।
শালপাতায় ঘুঘু বাসা।গোয়েন্দা অমনিবাস।বেবুন ঝোলা।আদিম মানুষ কি মশার ভ্রূণ নিয়ে পরীক্ষা করেছিল?কপারের তার বা বিরাশি শিক্কার থাপ্পড় - শুক্লপক্ষে সব প্রমাণ মজুত।একটু বন্য হয়ে যাক গলার শিরা।বিপ্লবী মূল্যবোধ।বড়শিগাঁথায় মছলিবালী - টুপটাপ রেটতত্ত্ব প্রত্নতত্ত্বীয় গতিবিধি।।

কচি হাতে উনবিংশ শতাব্দীর পুজ গন্ধ।
চুমু খাই অক্লেশে - সবুজ সার্চলাইটের স্বার্থহীন অভ্যাস।সাদা থান্ ছোপানে মাটিতে - মরুভূমি।
সাত দিনের পরা জামা।আমিষ ঘাম।নুনরেখায় আন্টার্টিকা।হ্যাংলা গ্যাংবাঙে অসতীও দুর্যোধন যতি।।ব্রহ্মশাপ - আগুনে পুড়ে শারদ সম্মানে আনত নাবিক।ঋতুগত চেরা ঠোঁটে লিওনার্দো - চাপ্রশ্ন লেখে।আলসে স্লেট-পেন্সিল........

বিগত সময়ের মতো এখনও পাহাড়ের দুঃখ বোঝা গেল না।সই পাতানো দুফোঁটা বৃষ্টি - মৃত কনকচাঁপা গাছ ফুলে ঢোল।বিকৃত চোখ ও যকৃত।ফুসফুস গলা কয়েক গ্যালন বালিশ ঝড়ে।লিওনার্দো ইদানীং কাগুজে এরোপ্লেনের গপ্পো টোকে।
ফাঁস লাগানো কালশিটে - শিরায় সর্দি ছাপ হিমবাহি তাপ।জিমনাস্টিক করা লতার ডগায় দরজার খিল।
দশমিকের অত্যধিক প্রয়োগ - লিওনার্দো উদাসীন সিঁড়ি উচ্চতায় নদীর কাছে ঠকে।ঠকাই উচিত ছিল।।
___________
শব্দরূপ : রাহুল

Wednesday, 14 December 2016

।। আমার জল-আতঙ্ক (পানিত্রাস) ।।




জলাতঙ্ক নিয়ে লুই পাস্তুর অনেক গবেষণা করে জলাতেঙ্কর টিকা আবিস্কার করলেন। কিন্তু কেন শীতকালে আমার জলাতঙ্ক হয়, সেটা আমি নিজেও জানি না। পাস্তুর সাহেব বেঁচে থাকলে হয়তো তার কাছে যেতাম।
আমার একটি আতঙ্কের স্মৃতি আপনাদের বলছি। কয়েক বছর আগের কথা, ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা চলছে ।

আমার কর্ম-জীবন সবে শুরু হয়েছে।মামাবাড়ি যেতে হবে বিশেষ প্রয়োজনে, বড়মামী চিঠি লিখেছেন।বাবা- মা যেতে পারবেন না। আমাকেই একা যেতে হবে।
কিন্তু অফিস ছুটি দিচ্ছে না, অনেক কষ্টে ছুটি পেলাম,তৎকালে ট্রেনের টিকিট কাটলাম। আমার মামাবাড়ি দার্জিলিং ।সত্যি এখনো আমার তিন মামা দার্জিলিং থাকেন। দার্জিলিং জেলার এক অল্পখ্যাত জায়গায়, যেখানে গ্রাম্য পরিবেশ, গাছগাছালি আর পাখির কুজন সব সময় দেখা যায়।

অনেকবছর পরে যাচ্ছি মামাবাড়ি, তাও একা একা।খুব রোমাঞ্চ হচ্ছে আমার।আগের রাতে ভাল ঘুম হল না।
মামাবাড়ি পৌঁছে প্রথম রাতটা আনন্দে ভেসে গেলাম।সবার আদর খাচ্ছি। অনেক নতুন পাকা বাড়ি হয়েছে, লোকের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে ।পরদিন সকাল থেকে বাস্তবের রুক্ষ জমিতে আছড়ে পড়লাম ।আমার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। বাড়িতে আমাদের ঘরের লাগোয়া টয়লেট, বাথরুম ।কিন্তু মামাবাড়িতে বিশাল উঠানের অপরপ্রান্তে বাথরুম।তোয়ালে পরিধান করে ঘরে বড়মামীর ঘরে গেলাম,লেপ কম্বলের মধ্যে কোনটা মামা আর কোনটা মামী বোঝা যাচ্ছে না।

অনেক হাঁকাহাঁকির পর লেপের মধ্যে থেকে বড়মামার মুখ বের হলো এবং কড়া ধমক-“রাতের বেলা ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?যা ঘুমা !!”
আমি-“সকাল হয়ে গেছে মামা, খুব পটি পেয়েছে।সকালে আমি চান ও করি। তোমাদের তো গিজার নেই। বড় মামীকে বলোনা প্লিজ, একটু জল গরম করে দিতে...।”
“গিজার ?ডাক হাজার..!!তোর কোন মামী ঘুম থেকে উঠবে না ।আবার ঘুমিয়ে পড়।”
বড়মামা আবার ঘুমিয়ে পড়লো।

আমি উভয় সংকটে পড়েছি,কি করে ঘুমাই? মাধ্যাকর্ষণের তীব্র টান আমার শরীর কে আনচান করে তুলেছে ।
খালি গায়ে তোয়ালে পরে উঠানে নামলাম, তীব্র উত্তেজনা অনুভব করছি।শীতের কামড় কুকুরের কামড়ের মত গায়ে লাগছে।কলে জল আসেনি,বাথরুমে থাকা একটা জলভরা বালতি হাতে নিলাম আর সাথে সাথে.........।
জলের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতর থেকে একটা আওয়াজ উঠে আসছে-“হি-হি-হি-হি.......।”
কিছুতেই আর থামছে না, আমি দাঁড়িয়েই আছি আর কাঁপছি।
অরন্যদেব ছাড়াও একজন আছেন, যিনি রাতে ঘুমান না- আমার দিদা।ভাগ্যিস ঘুমান না...।
“কেডা রে? হাসে কেডা ???”-দিদা চেঁচিয়ে উঠল ।

ভয়ে আমার হি-হি সামান্য কমলো,তারপর আবার...।
দিদার চিৎকার চলছে আমার কাঁপুনিও চলছে।
আস্তে আস্তে তীব্র হচ্ছে-“হি-হি-হি-হি.......।”
দিদা এবার বড়মামীকে ডাকলেন ।
বড়মামীকে এসে দেখেই-“ওমা!! দেখ কাণ্ড ...!!মামাদের ডাকি” বলে কোথায় চলে গেলেন আর খোঁজ পাওয়া গেল না।মনে হয় আবার লেপের নিচে চলে গেলেন ।
তীব্রতর হচ্ছে আমার হি-হি-হি-হি.......।
আমি একদম হতভম্ব হয়ে পড়েছি। মনে হল –“হাজার বছর ধরে আমি করিতেছি হিহিহিহি...।”
জলাতঙ্ক হল কিনা আমার বুঝতে পারছি না।
শীতে একদম জমে গেছি।

আমাকে রক্ষা করলো পাশের বাড়ির বুঁচকি ।সত্যি আমার জীবন রক্ষা করল, কিন্তু মন নিয়ে নিল।এই মেয়েটির সম্পর্কে আগের রাতে সব মামী সাবধান করে দিয়েছে আমাকে।মেয়েটির নাকি ছেলে-দেখা স্বভাব আছে। বুঁচকির বাবা-মা সকালে বেরিয়ে যান আর বুঁচকি দোতলার জানলা দিয়ে ছেলে দেখে ।কিন্তু বুঁচকি কি আমার জন্যই ভোর রাতে উঠে অপেক্ষা করছিল? কে জানে?

বুঁচকি এলো এবং নিজের চাদর খুলে আমাকে জাপটে ধরল ।আমাদের দু’জানার মধ্যে কেবল একটি চাদরের ব্যবধান। ওর নিঃশ্বাস আমার গায়ে পড়ছে, আমার নিঃশ্বাস ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে, আমি ওর চেয়ে অনেক বেশি লম্বা, প্রায় ছয় ফুট ।কতক্ষণ আমরা অর্ধনারীশ্বর মূর্তির মত ছিলাম, মনে নেই।
আমি প্রথমে মুখ খুললাম- “বুঁচকি এবার তোমার বোঁচকা সরাও, আমার খুব গরম লাগছে..।”
“না-না, তোমার অবস্থা খুব খারাপ”- বুঁচকি উত্তর করলো ।

সত্যি আমার অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে আস্তে আস্তে।কি গরম! মেয়েটাও খুব মোটা, গায়ে কি জোর !! 
নিজেকে শাহারুখ খান আর বুঁচকি কে আমার কাজল মনে হচ্ছে ।
সিনেমায় ভিলেন কে আস্তেই হয়।যবনিকার পতন হল । বড়মামী এলেন আর গঞ্জনা শুরু হল-
“হায় হায় ডোডো,তোর মাকে কি কৈফিয়ত দেব? এই জন্যই এত ভোরবেলায় ওঠা তোর?ছি-ছি!! দু’জনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঁচকি ওকে ছাড় তাড়াতাড়ি..।”
“আরে ছেলেটা মরে যাচ্ছে..” বুঁচকি বললো ।
আমি তখন সত্যি মরে যাচ্ছিলাম । বড়মামী গালাগালি করতে করতে চলে গেলেন ।
আমাদের দেখতে পাড়ার লোকসব জড় হল ।কে একজন বলে উঠল-“শঙ্খ লাগছে,দৌড়ে আয়...।”
সব মামা-মামী ঘুমের মাদকতা অগ্রাহ্য করে এলেন।

ছোট মামী এসেই সপাসপ...।লাঠির বাড়ি পরতে লাগলো আমাদের ওপর ।
বুঁচকির গায়ে বেশি পড়ল.. । মেয়েটার কি সহ্যশক্তি ?অনেক পরে ও আমাকে ছাড়ল । বুঁচকির মার সাথে মামীদের জোর ঝগড়া বাঁধল ।
আমি দিদার ঘরে শুয়ে আছি।পটি আর পাচ্ছে না, চলে গেছে ।
দিদা আমার মাথায় হাত দিচ্ছে-“আমারে ডাকলি না ক্যান?আমি তোরে গরম জল করে দিতাম? আহারে ছেলেটার খুব লাগছে রে ...।”

“তোমরা ভাল না কেউ। আমি কাল বাড়ি চলে যাব”-আমি বললাম ।
“আমরা তো ভাল না। কিন্ত অই মেয়েটা কেমন রে ডোডো ?” 
“খুব মায়া-মমতা মেয়েটার”- আমি বললাম।
“বুঝ্‌সি, আজ-ই তোর মারে চিঠি দিতাছি”- দিদা উত্তর করলো ।
কিন্ত কোন চিঠি গেল না আমাদের বাড়ি, কারণ মামীদের চূড়ান্ত আপত্তি ছিল।
মেয়ে ফর্সা কিন্তু বেঁটে আর ওর স্বভাব নিয়ে মামীদের নাকি সংশয় আছে ।

আমি পরদিন একা একা বাড়ি ফিরে এলাম। আসবার দিন ও দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে আমার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। বুঝতেই পারছেন কে... ?

আমি তারপর আর মামাবাড়ি যাইনি।

_______
@রমেন দে

Tuesday, 13 December 2016

।। বাঁচার আশা দিগন্ত সোনালী ।।

চৌপদী চার


নোট নিয়ে কাড়াকাড়ি এ.টি.এম.
ব্যান্কগুলো হাসি ঠাট্টা মশকরায়
ঘরমুখো ভেতো স্বাদ বাঙ্গালী
সারারাত তবলা শোনে চিন্তায় ৷

কত কী ভাবা টাকা স্বপ্নে
দরকার ছিল বড় অল্প
নিজের টাকা হাতে, নিজেই অন্ধ
ব্যান্ক ম্যানেজার শোনালো রঙিন গল্প ৷

চায়ের দাম দেয়া একান্ত ভার
সেঁদো ভারে তলানী গন্ধ
ছিপছিপে গোলাপী ২০০০ কুমারী
চা মুদীর দোকানে পকেটেই বন্ধ ৷

ভোরবেলা এখন নেই রোদ্দুর
পোয়ানোর নামে শীতের হেঁয়ালী
মায়াবী ১০০০/৫০০ থাকে পকেটে নির্বাক
তবুও বাঁচার আশা দিগন্ত সোনালী ৷
_________
© অনুপ দত্ত

।। খুন ।।



সকাল সকাল সমুর  ফোন পেয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে ভাস্করের মন।  সমু ফোনে মোটে দু মিনিট কথা বলেছিলো।  তাতেই ভাস্করের বুকের ওঠানামা বেড়ে গেলো।  সমুর কথায় মনে পড়লো বাবাকে।  তখন ভাস্করের বয়স কত হবে। - বছর পাঁচ ছয়।  মায়ের হাত ধরে রোজ স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় দেখা হতো বাবার সঙ্গে।  দেখা হতো মানে বাবার নামটা বড় বড় করে  বড় রাস্তার ধারের পেরেক কলের দেওয়ালে লেখা " শহীদ প্রতাপ রায় অমর রহে। "  সাদা দেওয়ালে বড় বড় কালো অক্ষরে লেখা।  সারা লেখায় লাল তারার ছড়াছড়ি।  বাবার খুন হওয়ার কথা তেমন কিছুই মনে নেই ভাস্করের।  তখন ওর বয়স মোটে  চার।  যে বাবা সকাল বিকেল দুবেলা ওর সঙ্গে খেলা করতো , খুন হবার পরেই হয়ে গেলো পার্টির সম্পত্তি।  লাশকাটা ঘর থেকে ফেরার পর ওর বাবা আর বাড়ি আসেনি।  শুয়ে ছিল পার্টি অফিসের সামনে।  মা অবশ্য ওকে নিয়ে যায়নি ওখানে দেখাতে ।  তবে যে ছবিটা মায়ের বাক্সে লুকিয়ে  রাখা ছিলো , সেটা ভাস্কর বড় হয়ে দেখেছে। পোস্ট মর্টেমের দরুন মাথায় বড় বড় সেলাইর গিঁঠ ছবিতে স্পষ্ট দেখেছিলো।

সেই দেওয়ালে লেখা " শহীদ প্রতাপ রায় অমর রহে " ধীরে ধীরে একদিন মুছে গেলো প্রকৃতিই নিয়মে।  পাড়ার মোড়ে মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনের র উপর যে সরু কালভার্ট ছিল তার ধারে পার্টি করে দিয়েছিলো একটা শহীদ বেদি।  সারা বছর তাতে ধুলো পড়তো , কাকে হাগতো।  তারপর যেদিন কালভার্ট ভেঙে চওড়া করলো তখন , বাবার নাম লেখা  শহীদ বেদীটাও উড়ে গেলো।  সেই সময়ে ভাস্কর বড় হচ্ছে , সব কিছু বুঝতে পারছে।  তারপর একদিন মায়ের হাত ধরে চলে আসে কালীঘাটে দাদুর বাড়িতে।  সেখান থেকে  দক্ষিণ কলকাতার এই উঁচু বাড়িটার ফ্ল্যাটে।   ভাস্করের অফিসের দেওয়া এই ফ্ল্যাটে রেখে মাকে সুখী দেখতে চেয়েছিলো।  এই ফ্ল্যাটে এসে মা যেমন নিজের চেনা পাড়া , চেনা লোক হারালো , তেমনি নিজের  একাকিকত্ব ভুলতে ভাস্করকে আঁকড়ে রইলো।  তখন ভাস্কর ধীরে ধীরে মায়ের মুখ থেকে শোনা বাবার খুন হওয়ার ধটনার পাজল জুড়তে পারলো।

প্রতাপ রায় বাম  দলের নেতা , নেতা মানে পাড়ার নেতা।  পাড়ায়  বেশ প্রতাপ ছিল প্রতাপ রায়ের। এক বর্ষার রাতে পার্টি অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতাপ রায় খুন হন একদল অতি  বিপ্লবীদের হাতে।  তখন পাড়ায় মাথা চাড়া  দিয়ে উঠছে সেই অতি বিপ্লবীদের দল।  সেই খুনি দলের নেতা ছিল ঘোষ বাড়ির ছেলে পল্টু।  ঘোষেদের ছিল লোহা লক্কড়ের কারবার।  পাড়ার বনেদি বাড়ি বলে নাম ছিল।  সেই বাড়ির ছেলে পল্টু অতি বিপ্লবী হয়ে গিয়েছিলো।  সবাই ভেবেছিলো হয়তোবা নেহাত শখের রাজনীতি।  কিছুদিন পরে মাথা থেকে ভূত নেমে যাবে।  তা হয়নি।  উল্টে প্রতাপ রায়কে খুন করে পল্টু দলের একশন স্কোয়াডে নাম লিখিয়ে দিয়ে ছিলো।  মায়ের মুখ থেকে যেটুকু শুনেছে , সেই বর্ষার রাতে পল্টু বেশ কয়েকজন বাইরের ছেলেকে নিয়ে প্রতাপ রায়কে ঘিরে ধরে।  পল্টু প্রথম ছুরি মারে।  প্রতাপ রায়কে ঘিরে ধরা ছেলের দল প্রতাপ রায়কে   পালাতে  দেয়নি।  প্রতাপ রায় উঠে দাঁড়াতে গেলে ওকে ওরা  ঠেলে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।  সেই সুযোগে পল্টু একের পর এক ছুরি মেরে গেছে।  মায়ের কথা অনুযায়ী মোট উনিশটা ছুরি মারা হোয়েছিলো।  সেই বৃষ্টির মধ্যে প্রতাপ রায়ের লাশ যখন ভিজছিলো , পল্টু তখন রাতের ট্রেন ধরতে প্ল্যাটফর্মে বসেছিল।  পল্টু অবশ্য বেশিদিন পালতে পারেনি।  বছর খানেকের মধ্যে ধরা পড়ে।  তারপর আরো দশ বছর জেল খেটে  মুক্তি পায়। ততদিনে দেশের রাজনীতি পাল্টে গেছে।

ততদিনে অবশ্য নিজেকে দাঁড় করতে ভাস্কর এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে পল্টুর খবর নিতে পারেনি।  তবে শুনেছিলো পল্টু আর বাড়ি আসেনি।  পয়সাওয়ালা বাড়ির ছেলে।  হয়তো বাড়ির লোকে পল্টুকে দূরে কোথাও রেখে দিয়েছিলো পরিবার ম্যান সম্মান বাঁচাতে।  তারপরেও বহু বছর কেটে গেছে।  আজ সমুর ফোনে জানতে পারলো পল্টু বাড়িতে ফিরে  এসেছে। বিকেলে  যেন ভাস্কর ওদের বাড়ি পৌঁছে যায়।  সেই সময়ে নাকি পল্টু বাড়ির বাইরে বেরোয়।  কাজেই তখন ভাস্কর ওর সঙ্গে দেখা করতে পারে।

 ভাস্কর ভাবতে লাগলো এখন কত বয়স হবে পল্টুর।  নিজের বয়স যদি পঁয়তাল্লিশ হয় তবে পল্টুর বয়স এখন নিশ্চয় সত্তরের কম  নয়।  নিজের মায়ের বয়স পঁচাত্তর , এখন রোগে ভুগে প্রায় শয্যাশায়ী।  তবে কি পল্টু এখনো শক্ত পোক্ত আছে ? খুনিরা শক্ত পোক্ত না হলেও মনের দিক দিয়ে হয়।  পল্টুর সঙ্গে দেখা করা কি ঠিক হবে ? সত্তর বছরের পল্টু ওর কি করতে পারবে ? যদি দেখা হয় তবে ভাস্কর ওকে কি বলবে ? ইচ্ছে তো হয় যে জিজ্ঞাসা করে ওর বাবা পল্টুর কি ক্ষতি করেছিল যে ওকে খুন করা হলো ? ওর বাবাকে খুন করে পল্টুর কি লাভ হলো ?

সারা সকালটা যাবে কি যাবে না সেই দ্বন্দতেই কেটে গেলো।  সেই দোনোমোনো ভাবনা নিয়ে ভাস্কর ওদের পুরোনো পাড়ায় সমুর  বাড়িতে বিকেলের অনেক আগে   হাজির হয়ে যায় ।  তারপর সমুর সঙ্গে ওদের দোতলার ঢাকা বারান্দায় বসে রইলো।  সামনে পাড়ার খেলার মাঠ।  মাঠের ধারে ঘোষদের তিনতলা বাড়ি।  পল্টু বেরোলে সেই বাড়ির গেট খুলেই বেরোবে।  সমুর মুখ থেকে শুনলো যে পল্টু এতদিন বেনারসে ছিল।  বিয়ে টিয়ে করেনি।  সেখানে মিষ্টির দোকান চালাতো।  সেখানে  স্ট্রোক হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে পল্টু।  তখন বাধ্য হয়ে ওর ভাইপোরা  ওকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে এসেছে।  ভাস্কর বার বার জিজ্ঞেস করে পল্টু কি খুব বুড়ো হয়ে গেছে।  সমু কথা কেবল এড়িয়ে যায়।  সেই বারান্দায় বসে বসে মাঠের দিকে চেয়ে থাকতেই রোদ কমে এলো।  তারপর ভাস্কর দেখে একটা হুইল চেয়ারে এক বৃদ্ধকে নিয়ে একজন চাকর গোছের লোক ঘোষদের বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে এলো।  হুইল চেয়ারে বসা লোকটার মুখ সমুদের  বারান্দা থেকে ঠিক মতন দেখা যাচ্ছেনা।  ভাস্কর ব্যস্ত হয়ে সমুদের  বাড়ি থেকে দ্রুত রাস্তায় নেমে এলো।  পিছন পিছন সমুও  এলো।  ভাস্কর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে এলো সেই হুইল চেয়ারের কাছে।  ভাস্করের হার্ট বিট বেড়ে চলেছে।  বুকের ধুক  পুক করা শব্দ আর সব শব্দকে ছাপিয়ে  গেছে।  হুইল চেয়ারের কাছে এসে দেখে এক বৃদ্ধর  মুখ , একদিকে কাত  হয়ে আছে।  চোখ দুটো খোলা , কেমন যেন আনমনে চেয়ে আছে।  মুখটা অল্প খোলা।  জিভ একটু বেরিয়ে ঠোঁটের উপর এসে পড়েছে।  মুখ দিয়ে একটু একটু লালা গড়াচ্ছে।  দেখেই বুঝতে পারে স্ট্রোকের পরে পল্টু পুরোপুরি পঙ্গু।  কেবল বুকে প্রাণটা আছে।  চোখ মুখ দেখে টের পাওয়া যায়  বুদ্ধি শুদ্ধি সব কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।  শরীরটা কেবল প্রাণের অস্তিত্ব  নিয়ে পড়ে  আছে শেষের সেদিনের অপেক্ষায়।  পল্টুর মুখ দেখে ভাস্করের মুখ ঘৃনায় কেমন কুঁচকে গেলো।  গুলতির মতন সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো ভাস্কর।

ভাস্কর হন হন করে হাঁটতে থাকে বড় রাস্তার দিকে।  আর এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে নেই।  পিছন পিছন এসে সমু  জিজ্ঞেস করে , ' কিরে ভাস্কর কি বুঝলি পল্টুকে দেখে ? ' ভাস্কর মুখ ঘুরিয়ে বলে , ' নারে আমি এখন মড়া মেরে খুনের দায়ে ধরা পড়তে চাইনা। ' ভাস্কর হাঁটতে থাকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে।

_________
© সনৎ মিশ্র

।। উন্নয়ন ।।

শহরের রাস্তায় কান পাতি -

যানবাহনের গদ্যময় শব্দ অথবা কাব্যিক ট্রাম ছাপিয়ে
উঠে আসে কে যেন অবিশ্রান্ত কেশে চলেছে -
খক খক খক
তারসাথে মিশে থাকে ওঁয়া ওঁয়া
অক্লান্ত ঘ্যানঘ্যান - খিদে পেয়েছে, খেতে দে মা

বেশ শুনতে পাই
হাতাখুন্তির টুংটাং, কড়াইতে ছ্যাঁকছোঁক
টেইমের জল এয়েচেএএএএ
বউটার ফোঁপান - ওর বর আজো ওকে মেরেছে
ভেসে আসে খাটের শব্দ আর সোহাগী শিৎকার

পিচগলা রাস্তায় চকচক করে হলুদের দাগ
আলতা ছাপ
ছুটন্ত বাসের পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যায় শিশুদল
কোলাহল রূপ নেয়  - বল হরি, হরিবোল
বৃষ্টির মতো নেমে আসে সাদা খই

শহরের রাস্তায় কান পাতো -
শুনতে পাবে আরেক শহর
যেটা ছিল কখনো এখানেই
আর এখন আছে গুমরানো কান্নায়

___________
© শোভন বাগ

।। চারিদিকে ভাম্পায়ার ।।

বিমুগ্ধ হিংসার ছুরিকাঘাত চতুর্দিকে,
দিনের দেহ সুষমায় প্রতিদিন পড়ছে রক্তের কালচিটে দাগ-
রাতের শরীরে নির্মম রক্তক্ষরণ!

মানবতা আজ যেন তুলে রাখা সৌখিন গহনা,
ধর্মের বর্ম পরে চলছে কি নিদারুণ টালবাহানা!
যুগযুগ ধরে পশুবৃত্তি আর মায়াযাদুর
চর্চা চলেছে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে;
তবে কি এ নষ্ট সময় পরাজিত সেইসব-
রক্তচোষক ভাম্পায়ারদের কাছে?

হে সভ্যতা তুমি থেকোনাকো নিশ্চুপ-মুখ খোলো আজ,
হে বর্তমান তুমিও এবার তোলো গগন বিদারী আওয়াজ;
এ পৃথিবী শুধু সভ্য মানুষের,
হত্যাকারী নরপশুদের নয়।

বিমুগ্ধ হিংসার ছুরিকাঘাত চলছে চতুর্দিকে,
বুলেটবিদ্ধ মানবতা আজ ভাসছে নাফ নদীর জলে,
ঝুলছে কাটাতারে,
রক্তাক্ত ধর্ষিতার খন্ডিত যোনি,
সমুদ্রে পঁচা কুমড়োর মতো ভেসে যাচ্ছে মৃত দুধের শিশু,
বাতাসে উড়ছে মানবতার পোড়া গন্ধ...

হে নিরেপেক্ষ কন্ঠ তুমি বেরিয়ে এসো-
বলো,এ নারকীয় উল্লাস এবার হোক বন্ধ।

আহ্ একি ভয়ানক মানবতা লুন্ঠন!
অবিরত ঝরছে মানুষের খুন-
মানবতার লজ্জিত রক্তক্ষরণ...

বিমুগ্ধ হিংসার ছড়ি ঘুরছে চতুর্দিকে...
চারিদিকে ঘুরছে রক্তভোজী ভাম্পায়ার...
______________
© মোশ্ রাফি মুকুল

।। জেদি ।।



ডালহাউসি বেড়াতে গেছি।  দোতালায় একটা বারান্দা লাগানো সুন্দর ঘর পেয়েছি। রিসোর্টটা বেশ ঘরোয়া টাইপের। একটা টিলার উপরে , সুন্দর গাছপালা দিয়ে সাজানো  বড় একটা লন।  একটাই অসুবিধা।, আমার রুমটা যে কোনায় , সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসেনা।  তাই রিসোর্টের  ওয়াইফাই একমাত্র ভরসা।  সেদিন ভোরে উঠে দেখি ওয়াইফাই কাজ করছেনা।  রিসেপশনে ফোন করে জানলাম ওদের ওয়াইফাইর রাউটার খারাপ।  দুপুরের আগে ঠিক হবেনা।  গৃহিনী ঘুমোচ্ছেন।  সকাল প্রায় সাতটা।  বাইরে একটু ঠান্ডা আছে।  আমি একটা পুলওভার গায়ে দিয়ে নিচে লনে পাতা গোল টেবিল ঘিরে রাখা গোটা পাঁচেক চেয়ারের একটায় বসে পড়লাম আমার আইপ্যাড নিয়ে।  দেখি ওখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে।  সকাল নয়টায়  বেড়াতে যাবার প্রোগ্রাম।  হাতে দু ঘন্টা সময় , তাই আমি গল্প লিখতে বসলাম।

তখন শুনি সুরেলা নারী কণ্ঠ " আমি কি আপনার টেবিলে বসতে পারি"। দেখি বছর পঁচিশের সুন্দরী স্মার্ট একটা মেয়ে ,কটকটে লাল একটা পুলওভার গায়ে , হাতে চায়ের মগ।  মাথা নাড়তেই ঐ টেবিলে আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসেই পরিচয় দিলেন " আমার নাম বিদিশা। দিল্লিতে সফটওয়ারে চাকরি করি"। নিজের নাম জানিয়ে প্রশ্ন করলে " বৌদিকে দেখছিনা"। গৃহিণীর খবর দেওয়ার পর , ফের প্রশ্ন " আপনি এই সকালে আইপ্যাডে কি করছেন"। বুঝলাম বিদিশা অতি সহজে লোককে প্রশ্ন করতে পারে।  আমি খালি বলেছি " মাঝে মাঝে গল্প লিখি।  তাই একটা কিছু লেখার চেষ্টা করছি"। তার পরেই বিদিশার জিজ্ঞাসা " আপনার লেখা গল্পটা পড়তে পারি"। 

নীলুকে নিয়ে গল্প  কাল রাতে শুতে যাবার আগেই লিখেছিলাম।  সকালে বসে একটু ঠিকঠাক করে নিচ্ছিলাম।  বিদিশা পড়তে চায় , জেনে আইপ্যাড ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম।  আইপ্যাড হাতে নিয়ে বিদিশা বলে " নিশ্চিন্ত থাকবেন , আমি খালি গল্পটাই পড়বো।  আপনার ব্যক্তিগত কিছু দেখার ইচ্ছে নেই"। বেশ বুঝতে পারছি , বিদিশা চাঁছাছোলা কথা বলে।  আমি একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলি " তুমি পড়ো , আমি ঐ কোনায় গিয়ে সিগারেট খেয়ে আসি"। বিদিশা বলে "এখানেই খেতে পারেন , আমার কোনো আপত্তি নেই”।

 আমি বসে বসে সিগারেট শেষ করার মধ্যে বিদিশার গল্প পড়া শেষ হলো।  আইপ্যাড আমাকে ফেরত দিয়ে বলে " আপনার গল্পের নীলু মনে হয় বেশ জেদি।  মেয়েদের বেশি জিদ থাকা ভালোনা"। আমি হেসে জিজ্ঞেস করি " এমন উপসংহারে পৌঁছনোর কারণ কি" ? বিদিশা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলে "নিজেকে দিয়ে বুঝেছি।   রবীন্দ্রনাথ আমার ভীষণ প্রিয়।  তাঁর জীবনী পড়তে গিয়ে জানলাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে উনি ডালহাউসি এসেছিলেন।  তাই আমি তন্ময়কে বললাম চলো দুজনে মিলে ডালহাউসি ঘুরে আসি।  ভাবতে পারেন , ও পুরো নাকচ করেদিলো।  কারণ ওর ঠান্ডা লাগার ধাত আছে , তাই কোনো পাহাড়ে যেতে চায়না।  তাও আমি জোরাজুরি করতে বলে তোমার ইচ্ছে হলে তুমি একলা যাও।  তাই আমিও আমার জেদ  নিয়ে একা  একাই চলে এলাম"। বুঝলাম বিদিশা জিদের বসে একলা চলে এসেছে বটে , কিন্তু এখানে এসে আর একলা ভালো লাগছেনা।  কিন্তু আমার কৌতূহল তন্ময়টা কে ? তাই জিজ্ঞেস করি " হাসব্যান্ড যখন মানা করেছিলো , সেটা তুমি মেনে নিতে পারতে"।

 বিদিশা টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধারালো।  ও আমার সিগারেট নেবার আগে কোনো রকম রিকুয়েস্ট করেনি।  বেশ বুঝতে পারছি , এখানে একলা এসে বিদিশা খুব ডিস্টার্বড।  এক মুখ ধোয়াঁ ছেড়ে বিদিশা বলে " তাও হাসব্যান্ড হলে পুরুষ মানুষ কিছুটা অধিকার বোধ দেখাতে পারে।  কিন্তু ও তো আমার বয়ফ্রেন্ড।  সে হিসাবে তার কোনো অধিকার থাকবে কেনো ? সত্যি কথা বলতে গেলে তন্ময় কোনোদিন আমার উপর কোনো অধিকার দেখায়নি"।  আমি জিজ্ঞেস করি " তোমরা এর আগে কোথায় কোথায় একসঙ্গে বেড়াতে গেছো "? বিদিশা হেসে বলে " কোনোদিন যাইনি।  আসলে ওকে আমি রিকুয়েস্ট করি ওর মোরালিটি টেস্ট করার জন্য। ও যদি বলতো যে বিয়ের আগে একসঙ্গে যাওয়াটা ইমমোরাল  , তবে আমি থেকে যেতাম ওর মরালিটিকে সম্মান জানাতে।  কিন্তু ও যেই ঠান্ডা লাগার ভয়ে , আমার ডালহাউসি যাবার প্রপোজাল ক্যানসেল করলো , তখন আমার জিদ চেপে গেলো”।

আমি এবার বলি " তোমার মনে হয় তন্ময়কে ফেলে এসে গিল্টি ফিলিং হচ্ছে"। কেমন একটু উদাস হয়ে বিদিশা বলে " আমি না হয় জেদি , ওতো আমায় একটা ফোন করতে পারতো।  নিদেন পক্ষে একটা SMS পাঠাতে পারতো।  আসলে ছেলেরা মনে হয় মেয়েদের কোনো ইচ্ছের দাম দেয়না"।

এই সব পরিস্থিতিতে কি আর বলা যায়।  দেখি বিদিশা নিজের ঠোঁট কামড়ে , মোবাইলে কি যেন খুঁজে চলেছে।  হটাৎ বলে উঠলো "ইউরেকা"। আমি অবাক হয়ে বলি "কি হলো "? বিদিশা ওর মোবাইলটা আমাকে বাড়িয়ে দেয় , তাতে দেখি ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছে " তুমি যা যা দেখবে সব ফোটো তুলে পাঠাও।  আমি দুধের  স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নেবো"।  বিদিশা এবার বলে " আপনারাতো দুদিন ধরে সব ঘুরে দেখলেন।  আমাকে বলুনতো কোথায় কোথায় গেলে সুন্দর সব ছবি তোলা যাবে"।  আমি খালি মন্তব্য করি "স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ দেবা ন জানন্তি"।
_________
© সনৎ মিশ্র

।। বনফুল তোকে ।।

ঠাঁই হলোনা পূজার থালায়
কারো খোঁপার 'পরে,
কন্ঠে দোলা ফুলের মালায়
প্রেমের বাসর ঘরে।

ফুটলি যখন দেখলনা কেউ
জুটলনারে অলি,
আপন গন্ধে রূপে রসে
বিভোর হয়ে রলি।

রাত্রি শেষে পথের ধারে
পড়লি যখন ঝরে,
মাটি তোকে বুকে ধরে
নিলো আপন করে।

ভোরের আলো ফুটবে যখন
ধূলায় মিশে যাবি,
তবু যেন ফুটিস আবার
তোর পিয়াসী কবি।
_____________
© অনাদি চক্রবর্তী

Monday, 12 December 2016

।। অবিনাশি পতাকা উড়িয়ে দে ।।

এই বাংলায় যারা এনেছে বিজয়,
তাদের নামে বাংলার আকাশে বাতাসে-
লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দে,
ঐ গৌরবের সৌরভ ছড়িয়ে দে;
ওদের রক্তমাখা নিথর দেহে দে, চুম্বন দে...
অতন্দ্র প্রহরী ওরা দেশমাতৃকার প্রেমে হয়েছে শহিদ,
দে,সোনার অক্ষরে তাদের নাম লিখে দে।
অকুতোভয়;
করেনি মৃত্যুর ভয়,
এনেছে মুক্তির স্বাদ- চির অম্লান জয়।
দিয়েছে বিজয়গাঁথা মহান স্বাধীনতা,
সোনার পালঙ্কে ওদের স্মৃতিগুলো সাঁজিয়ে রেখে দে।
বড়ই উচ্ছ্বল মহাচঞ্চল মুক্তিসেনানীদল,
বীরদর্পে করে আজো হাঁটছে যেন তারা এই বাংলায়-দৃঢ় চিত্তে;
শত্রুরা তোরা হুঁশিয়ার সাবধান-
চোখ তুলে কভু তাকাস না যেন এই বাংলার স্বাধীনতা স্বার্বভোমত্বে।

এই রক্তঝরা ডিসেম্বরে,চেতনায় কড়া নেড়ে,
স্মৃতিসৌধে ওরা ফুল দিতে আসবেই,
নে,ওদের বুকে জড়িয়ে নে,
নে,ওদের বরণ করে নে।

জন্মিলে একাত্তরে আমিও যুদ্ধে যেতাম মা,
হতাম মুক্তিযোদ্ধা- বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান-
বড় আফসোস হয় মাগো,হয়নি কেন সে অনিবার্যতা!
সারাটা ডিসেম্বরে তাই-
বুক ভরে গা'ই বিজয়ের গান।

আয়,সে মহাসংগ্রামের গানে গানে আবার জেগে উঠি,
সেই উদ্দীপ্ত চেতনার দীপ্ত শ্লোগানে...
নে,
নির্ভয় দুর্জয় সৈনিকদের স্মরণে নিজেকে জাগিয়ে নে।
দে,পাহাড় চূড়ায় বৃক্ষ শীর্ষে সমুদ্র সীমায়-
এ নদীবিধৌত সারাবাংলায়- চারিদিকে দে,
লাল সবুজের অবিনাশি পতাকা উড়িয়ে দে।
দখিনা বাতাসে সবুজের বুকে লাল হাসে,
পতঃ পতঃ স্বরে উড়ে চলা সে বিজয় নিশানের দূর্বার শব্দ-
আমার বড় বেশি ভালো লাগে।
______________
© মোশ্ রাফি মুকুল

।। স্বপ্নের রাজকন্যে ।।

যদি আমি রাজপুত্র না হয়ে
শুধু একজন সাধারণ সৈনিক হই....
তাহলে রাজকন্যে পাবো না, তাইতো ?
রাজত্ব নেই, দেহে রাজরক্ত নেই
রত্নহার নেই, ঐশ্বর্য নেই....
শুধু আছে শাণিত তরবারি
শুধু যুদ্ধ করতে পারি,
হাসতে হাসতে মরতে পারি ।
-
যদি আমি রাজপুত্র না হয়ে...
শুধুমাত্র একজন সাধারণ মানুষ হই---
তাহলে আমি রাজকন্যে পাবো না, তাইতো ?
পাখির কলরবে আমার ঘুম ভাঙা,
ঘাসের আঁচলে নিশ্চিত আশ্রয়
মাঠের আলে পা ফেলে ফেলে
নিশ্চিন্তে পাড়ি দিই যুগ থেকে যুগান্তরে !
-
যদি আমি রাজপুত্র না হয়ে
শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হই---
তাহলে আমি রাজকন্যে পাবো না, তাইতো ?
শুধু রাজপুত্র হলেই হবে...
শুধু রাজরক্ত হলেই হবে...
রাজ উষ্ণীষে ঢাকা পড়ে যায় সব,
জয় রাজউষ্ণীরের জয় ।
কিন্তু মনে ভয়
যদি যুদ্ধ হয়...
আসে পরাজয় ?
তাহলে রাজনন্দিনী
নিমেষে বন্দিনী ।
-
ঠিক আছে, আমি রাজকন্যে চাইনে...
রাজপুত্র হতে চাইনে...
আমি যুগে যুগে হতে চাই সাধারণ মানুষ,
হতে চাই সাধারণ চাষী, শ্রমিক মজুর
যদি দুমুঠো ফসল ফলাতে পারি,
যদি ইঁটের ওপর ইঁট সাজিয়ে
নতুন স্বপ্ন গড়তে পারি,
তাহলেই আমি খুশি ।
-
কোনো এক সাধারণ কন্যে---
ঠিক অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্যে,
নিজের হাতে করে তার অভিষেক করে
তিল তিল করে তাকে গড়ে তুলবো
আমার সেই স্বপ্নের রাজকন্যে ।
___________
© প্রতাপ মন্ডল

।। দশের তরে ।।

তুমি কী ভেবেছো সাগর স্রোতের এত কেন উচ্ছাস,
মোহনার দিকে কেন ভেসে আসে পথ ঘাটের নির্যাস।
কপোত কপোতি জড়াজড়ি বসে কেন করে ফিসফাস,
ধনীর ধনে মেটেনা পিপাসা সদা করে সে হাঁসফাঁস।

তুমি কী শুনেছো সংসার মাঝে কত রয় অবিশ্বাস,
গরীবের কান্নায় ভেজেনা মাটি ওঠে শুধু নাভিশ্বাস।
কেউ হাসে কেউ ভীত ত্রাসে নয়কো এটা ইতিহাস,
সমাজ জীবন অতি যে কঠিন বদমায়েশী দীর্ঘশ্বাস।

তুমি কী দেখেছো নারীকে নিয়ে পুরুষের ছেলেখেলা,
রজনীর কোলে আলো আঁধারে চলে কত লীলাখেলা।
কেউ খেটে মরে কেউ আরাম করে এটাই ভবলীলা,
অনাহারে যে ফুটপাতে থাকে কপালে তার অবহেলা।

তুমি কী বুঝেছো কেন যে মানুষ স্বার্থের তরে ছোটে,
জঙ্গল মাঝে সুবাস বিহীন আজও বনফুল কেন ফোটে।
জীবনের ঝুঁকি দেয় সদা উঁকি তবু মানুষ খুশিই খোঁটে,
আশা নিরাশার মাঝে মানুষের মনে কদাপি সুখ জোটে।

তুমি কী পেয়েছো গহন মনের ঘৃণা উদ্গিরনে তিক্ত স্বাদ,
মানুষের ভালবাসা কৃত্রিম আজ মিশে গেছে তাতে খাদ।
জীবন পথের মলিন গ্রাসে রয়ে গেছে কত হিংস্র ফাঁদ,
আশার আলোক তমসাঘন মেশে তাতে ঘাত প্রতিঘাত।

তুমি কী দিয়েছো প্রেম অভিনয়ে কারর মনেতে ব্যথা,
আজও সে কাঁদে অলসক্ষণে মনে করে অতীত কথা।
মন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে গড়ে প্রেমহীন গাথা,
অন্যায় পথে চলছে যারা তারাই আজ সমাজের মাথা।

তুমি কী করেছো সমাজের তরে কল্যাণময় কোন কাজ,
তুমি কী গড়েছো মানব সেবায় করনীয় কিছু সুপ্ত সাজ।
তুমি কী রেখেছো কোন অবদান নাকি করেছো শুধু রাজ,
জীবন মৃত্যু সবই সমান মরমে বাসা বেঁধেছে মলিন লাজ।
__________
© নির্মল সাহা

।। বেদন বাজে মনের মাঝে ।।


বর এসেছে , বর এসেছে  --বলে চিল চিৎকার করতে করতে অন্দর মহলের দিকে ছুট দেয় চৌধুরী বড়ির দুটি মেয়ে।জলের ঘড়া ,মিষ্টান্ন,শাঁখ নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই  হাজির হবু শাশুড়ি মায়েরা।  শ্যালিকারা নতুন জাম্বুকে ঠকানোর  শলা পরামর্শে ব্যস্ত।হৈ হুল্লোর ,ক্যামেরার ফ্ল্যাস লাইট,এল- ই-ডির তীক্ষতায়,  সানাই এর মায়াবি আবেশে জমে উঠেছে বিয়ে বাড়ি।বর দেখা মাত্রই রমা কাকিমা হেড়ে গলায় বলেন --"বর খাসা হয়েছে  বাপু --যেমন হাঁড়ি তেমন  তার সড়া । "পিসিমার বক্তব্য অন্য।তিনি বলেন -"আমাদের বড় জামাই এর চেয়ে ঢের ভালো।"

    এতক্ষণ সবার সঙ্গে তিতলিও বর দেখছিল ।কিন্তু মাসিমা ,পিসিমাদের আদিখ্যেতা দেখে  অন্ধকারের দিকে সরে দাঁড়ায় সে।

      সাত বছর আগে আজকের দিনেই বিয়ে হয়েছিল তিতলির।তার সুপুরুষ বরকে দেখে আজকের মতোই মাসিমা পিসিমারা বলেছিল---"তিতলি,তুই সত্যিই ভাগ্যবতী,সাত জন্ম তপস্যা করে তবে এমন বর  পেয়েছিস।"সেদিন তিতলি বিশ্বাস করেছিল মাসিমা পিসিমাদের কথাই সত্য হয়।কিন্তু আজ আলোর রশনাই এর দিকে পিঠ ফিরিয়ে দেখে  শুধু অন্ধকারে ঢাকা রাস্তা।

     তিতলির বিয়ের দুবছর পর  থেকেই তার সুপুরুষ বর নিরুদ্দেশ।তাদের মধ্যে যে বনিবনার অভাব ছিল তা নয়।অভাব ছিল না তিতলির রূপ-সৌন্দর্যের।তবুও তিতলিকে ছেড়ে তার বর কেন  যে পালাল তা কেউ জানে না।তিতলিও জানে না।

        আজ পাঁচ বছর ধরে তিতলি তার মায়ের ঘরে স্বামীর দেওয়া শাঁখা সিঁদুর পড়ে এয়োতি সেজে বসে আছে।তার বর কবে ফিরবে? আদেও ফিরবে কিনা? সে জানে না।তবুও সে হিন্দুঘরের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই স্বামীর মঙ্গল কামনায় সকাল সন্ধ্যায় সীমন্তিনী সাজে।আর প্রতি মুহূর্ত নতুন করে মনের মাঝে তার বেদন বাজে।

            তিতলি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে।আর কত রাত এমনি করে সে জেগে থাকবে জানি না।

  চৌধুরী বড়ির সানাই  আস্তে আস্তে নীরব হয়ে আসে।আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে আসে।আস্তাকুড় থেকে থেমে থেমে ভেসে আসে ইতর প্রাণির  অধিকার প্রতিষ্ঠার  সদম্ভ চিৎকার । বিয়ে বাড়ির ভদ্রলোকের কলরব থেমে আসে। হয়তো তিতলির অন্তরের কোলাহল তখনো থামে না।
___________
© তাপস ঘোষ
                                    

।। শিরোনামহীন ।।

স্বপ্নের শেষ নেই জানি
শেষ নেই কোনও চাওয়ারও ....
সব স্বপ্নপূরণ হয়না স্বাভাবিক নিয়মে ই
সব চাওয়াও ... পাওয়া ছুঁতে পারে না একইভাবে
তবু নিত্য স্বপ্নদেখা -- স্বপ্নসায়রে ভেসে যাওয়া
ছোটোখাটো চাওয়া আর ইচ্ছেগুলোর অবিরাম উঁকিঝুঁকি !
পালকছাঁটা ইচ্ছেডানার উড়াল ভরার অদম্য দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ...
কতো কিছু যে চাই ; জীবন জোড়া চাওয়া আর পাওয়ার না মেলা হিসেবে নিকেশ ---
কিন্তু তাও যে চাই , চাই কত কিছুই এমনতরো
এক টুকরো আকাশ না হয়ে অনন্ত আকাশের নীল অসীমে হারাতে চাই
দু'চোখ ভরে নিতে চাই শ্যামলিমা - বনানী সৌন্দর্য্য - আঘ্রাণ ...
কাজলপলকে সাতরঙা রামধনু , অঞ্জলিপুটে জীবনসুধা
মুঠো ভরে রাখতে চাই মুহূর্তের জীবন আনন্দ প্রাণের স্পন্দন - দুঃখ বেদন জ্বালা যন্ত্রণা ... অশ্রুকথন
সব সঅব অনুভবের পরম প্রাপ্তি ... !!
শুধুই নয় অলস প্রহর গোণা ; পারের খেয়ার অপেক্ষার প্রতীক্ষা ....

" আরো আরো প্রভু আরো আরো
এমনি করে এমনি করে আমায় মারো ... "
_________________
© সুচরিতা মুখোপাধ্যায়

।। জীবন পথে ।।

অগোছালো দিন এলোমেলো রাত
        গোছানো হয়না কিছু
যত করি জড়ো  উড়ে যায় সব
        অজানা ঝড়ের পিছু।

যখনি যা কিছু    হয় রে গভীর
        নিবিড় নিকটে রাখা,
কে যেন বাজায়  বেহাগী সে রাগ
        মধুর বিরহ মাখা।

সে সুরের তানে  দেহ মনে জাগে
        পথ হারানোর নেশা,
ছেঁড়া ছেঁড়া ভুল জড়ো করা ফুল
        ভগ্ন স্বপ্নে মেশা।

বয়ে চলে যায়  থামেনা তাহার
        ছান্দিক পথ চলা,
যা কিছু হারায়  সব করে জড়ো
        গাঁথে বিজয়ের মালা।

_____________
© অনাদি চক্রবর্তী

।। অনন্যা ।।



ল্যাম্পপোস্টের নীচে ছায়া মেখে দাঁড়িয়েছিল একটা অবয়ব। দূর থেকে বোঝা দুস্কর, সেটি নারী শরীর নাকি পুরুষ। কিছুটা কাছে গেলে অবশ্য বোঝা যায়, সেটি একটি নারী। মুখহীন, একটা নারী শরীরের আদল। তবে সেটি আলোর অভাবের দরুন নাকি দৃষ্টির ক্ষুদ্রতার জন্য, তা তর্কের বিষয়। আরো কাছে গেলে, ওই আদল ক্রমশ একজন মানুষীর রূপ নেয়। গড়ে ওঠে তার চুল, নাক, কান, চোখ, ঠোঁট ও আরো অনেককিছু। বোঝা যায়, তার চুলে লাগানো সস্তার গন্ধ তেল। কপালের ঝিকিমিকি বিন্দি। কাজল লাগানো দুটো রক্তশুন্য চোখ। লালের ছোঁয়া লাগা একটু বসা গাল। টকটকে লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট। আর নাক। টিকালো একটি নাক। সমগ্র মুখমণ্ডলের সাথে বেমানান, একটি অদ্ভুত সুন্দর নাক। তাতে লাল পাথর বসানো একটি নথ। অন্ধকারে কামনার আগুনের মতো দীপ্যমান, জ্বলজ্বলে। অপুষ্ট শরীরে ভারী দুটো বুক। দেখলেই সন্দেহ জাগে, গোঁজামিল আছে। পরনে একটা সিল্কের শাড়ি। অতীত সৌভাগ্যের চিহ্ন বহনকারী রিক্ত বর্তমান।

চেহারা, বেশভূষা আর দাঁড়ানোর জায়গা থেকেই পরিস্কার মেয়েটির পেশা। হ্যাঁ পাঠক, মেয়েটি একটি বেশ্যা। হাই সোসাইটির escort বা মেহফিলের রঙ জমানো খানদানি তবায়েফ নয়। ওই লরিচালক, রিক্সাওয়ালা বা ঠেলাওয়ালারা যাদের কাছে যায় শরীরের প্রয়োজনে, সেরকম একটি পাতি বেশ্যা।

না, ভুল বললাম। পাতি নয়। কোন মানুষই পাতি হয় না। প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজস্বতায় অনন্য। মানুষ তৈরির ছাঁচগুলো শুধু একবার ব্যবহারের জন্য। তাই প্রত্যেকটা ছাঁচ আলাদা, আর মানুষও আলাদা। যাইহোক, তত্ত্বকথা ছেড়ে এবার গল্পে ফেরা যাক।

একটি যুবক ওই রাস্তা ধরে হেঁটে আসছিল। ঠিক সোজা হেঁটে আসছে না, পা দুটো মাঝেমাঝেই টলে যাচ্ছে। বেশভূষায় বেশ চাকচিক্য আছে। সর্বাঙ্গে মার্জিত রুচি ও সচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট। লম্বা, দোহারা চেহারা। চশমার পেছনে একজোড়া উদাসী, বিষণ্ণ চোখ।
“যাবেন নাকি?”
চমকে ওঠে মেয়েটি। অন্যমনস্কতার বা মুখ থেকে ভকভক করে বেরিয়ে আসা মদের গন্ধের কারনে নয়, সম্ভাষণে এবং সম্ভাষণকারীকে দেখে। “আপনি” শুনতে অভ্যস্ত নয় তার কান। আর এরকম খদ্দেরও তার জোটেনা।
“কোথায়? কোথায় যেতে হবে?”
“যেখানে হোক। মানে, আমি তো বিশেষ কিছু চিনিনা। যেখানে সুবিধে হয়। আপনার ইচ্ছেমত যেকোনো জায়গায়।”
'ও। মালটা এ লাইনে নুতন মনে হচ্ছে। এখনও আড় ভাঙ্গেনি' - মনে মনে ভাবে মেয়েটি। মুখে বলে, “চলুন আমার ওখানে। ছোট জায়গা, তবে কোন ঝঞ্ঝাট নেই। কিন্তু রেট বেশি লাগবে। আর শুনুন, একবার করলে এক রেট আর সারারাত থাকলে...”
হাত তুলে থামিয়ে দেয় ছেলেটি।  বলে, “সে ঠিক আছে। কোন অসুবিধে নেই।”
ভালোই মুরগী পেয়েছি। একচিলতে হাসি জন্ম নিয়েই মিলিয়ে যায় মেয়েটির ঠোঁটে।

ঠিকই বলেছিল মেয়েটি। ঘরটা ছোট, গলির ভিতরে। খারাপ পাড়ার, তেমন পসার না থাকা মেয়েদের যেমন ঘর হয়, তেমনই। তবে, পরিস্কার।
“আসুন, ভেতরে আসুন।” মেয়েটির আহ্বানে ভেতরে ঢোকে ছেলেটি।
ঘরের একপাশে একটা তক্তপোষে বিছানা পাতা। তোশক, কাঁথা, চাদর আর দুটো বালিশ। একটা পাশবালিশও আছে। এককোণে একটি আলমারি জাতীয় বস্তু। আরেক কোনের কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মীর পট। তার সামনে কিছু পোড়া ধুপ, একটা রেকাপিতে দুটো বাতাসা আর এক গ্লাস জল, নিত্তপুজার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
“মাল চলবে? মানে, মদ? দাম কিন্তু আলাদা দিতে হবে।”
“চলবে।”
আলমারি থেকে একটা আধখাওয়া হুইস্কির বোতল বের করে মেয়েটি। কোন এক কাস্টমারের ফেলে যাওয়া বোতল।
“সাথে কিছু লাগবে? ঘরে চানাচুর আছে। অন্য কিছু লাগলে, আনাতে হবে। তার রেট আলাদা।”
“না, না। ওতেই হবে।” আড় চোখে তাকিয়ে দেখে বোতলটার দিকে। সস্তা মাল। স্কচ নয়।
দুটো গ্লাস, একটা প্লেটে চানাচুর আর জলের বোতল নিয়ে আসে মেয়েটি। বিছানার ওপর একটা পেপার পেতে সাজিয়ে দেয় সমস্ত আয়োজন। অভ্যস্ত হাতে মদ ঢালে দুটো গ্লাসে। মেশায় পরিমান মতো জল।
“আপনার নাম কি?” জিগ্যেস করে ছেলেটি।
“নাম দিয়ে কি হবে? শেফালি, মালতি যাহোক কিছু একটা ভেবেনিন।”
“বাড়ি কোথায় ছিল?”
“আমার ঠিকুজী জেনে আপনার কি দরকার?”, মুখ ঝামটে ওঠে মেয়েটি। “যা করতে এসেছেন চটপট করে, ফুটুন এখান থেকে।”

সব শালার এই রোগ। সবাই পুরনো কথা জানতে চায়। কি করে সে এই লাইনে এল। এই কাজ করতে তার কেমন লাগে। হারামির বাচ্চা, এসেছিস তো কাঠি গলাতে। এত খবরে তোদের কী দরকার? নাকি এগুলো মদের সাথে চাটের মতো। মস্তিটা আরো জমাট হয়। আগে সে বলত। সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে। তখনো সে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়নি। যখন সে বোকা ছিল। এখন আর নয়। এ লাইনে কম দিনতো হোল না। এখন এসব কথা শুনলে, তার মাথা গরম হয়ে যায়। সব শালা ঢ্যামনা।

“আমি একটা কবিতা পড়ব? শুনবেন আপনি?”
আবার চমকাল মেয়েটি। এতো আজব মাল!
“আমি কবিতা টবিতা বুঝি না।”
“বুঝতে হবে না। আমি পড়ি। আপনি শুনুন।”
“আচ্ছা। তবে টাইম বেশি নিলে রেটও বেশি লাগবে।”
মালটার বোধহয় দাঁড়ায় না। এরকম অনেকে আসে তার কাছে। মদের ঘোরে আটভাট বকে। চটকা-চটকি করে চলে যায়। এটাও মনে হয় সেইরকম। ভাবে মেয়েটি।
কবিতা পড়তে শুরু করে ছেলেটি। কিছুই বোঝেনা মেয়েটি। তবু আস্তে, আস্তে তার মাথাটা কেমন যেন করতে থাকে। বুকের ভেতরে চিনচিন। ঘন হয় দৃষ্টি।

“চোখে রাখ চোখ, আলো ফুটুক অন্ধকার হতে
যেমন ফুটেছিল গতজন্মে, এক সূর্যোদয়ের দিনে –
ঠোঁটে রাখ ঠোঁট, ডানা পাক জমে থাকা কষ্টেরা
যেমন পেয়েছিল কোন এক কদম ফুলের দিনে –
হাতে রাখ হাত, আবার জেনে নেই
ভুকে যাওয়া সেই পুরাতন ছুঁয়ে থাকার মানে –”

কবিতা পড়ে চলে ছেলেটি। একটার পর একটা।
তারপর, মেয়েটি এগিয়ে আসে। চুমু খায়। মাথাটা টেনে নিয়ে গুঁজে দেয় নিজের বুকে। ছেলেটি পেঁয়াজের খোসা ছাড়াবার মতো করে উন্মুক্ত করে তাকে। আদরে, আদরে ভিজে যায় সে। অনুভব করে দৃঢ় পুরুষাঙ্গের আকুলতা। সে আস্তে আস্তে খুলে নেয় ছেলেটির সমস্ত পোশাক। গ্রহন করে তাকে। শরীরে এবং মনে।

উত্তেজনার তুমুল শিখরে, চোখ বন্ধ হয়ে আসে ছেলেটির। নিজের শরীর দিয়ে মেয়েটির শরীর পিষে দিতে দিতে, অস্ফুট কণ্ঠে বিড়বিড় করে ওঠে একটা নাম ধরে।

আবেশের, পুলকের ভেলায় ভেসে যেতেযেতে, আচম্বিতে মেয়েটির কানে প্রবেশ করে ছেলেটির কণ্ঠস্বর। এক ধাক্কায় ছিটকে দেয় ছেলেটিকে।

“শালা, হারামি। শুয়োরের বাচ্চা, ভাগ এখান থেকে।”
ছেলেটি হতবাক হয়ে যায়। তখনো তার সারা শরীর জুড়ে উত্তেজনা। ধাতস্ত হতে সময় নেয় সে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করে।
“মারব পোঁদে এক লাথি। এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ডাকবো জগাকে?”
পড়িমরি করে জামাপ্যান্ট পরে নেয় ছেলেটি। জিগ্যেস করে, “কত দেব?”
“তোর টাকায় মুতি আমি। বেরো এখান থেকে।”
ছেলেটি বেরিয়ে যেতেই, দরজা বন্ধ করে মেয়েটি। বন্ধ দরজার পেছনে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে এক চিরন্তনী নারী।

দীর্ঘদিন ধরে শরীরের ব্যাপারী হয়েও, বারবার ঠোকা খেয়েও, মন তার এখনো মরেনি। আজও সে গ্রহন করতে চায় কোন পুরুষকে, যেমন করে আজ সে গ্রহন করেছিল ওই যুবকটিকে। আর তাই সঙ্গমকালে তার মুখে অন্য নারীর নাম শুনে, আজও তীব্র অপমানে ফোঁস করে ওঠে তার নারীসত্ত্বা।

পাঠক, বলেছিলাম না। কেউ পাতি নয়। প্রত্যেকেই অনন্য, যে যার মতো করে।

___________
© শোভন বাগ

।। মানবী ।।


কদিন ধরেই স্বামীকে ফোনে পাচ্ছে না মানবী ।আজও পায়নি ।তাই কিছুটা বিরক্তি ও অভিমান নিয়েই সবে শুয়েছে ,এমন সময় সে দরজায় টোকা পরার শব্দ শুনতে পেল -- শুনছেন ,দরজা খুলুন ।কে আছেন ? দরজা খুলুন, প্লীস। বালিশের পাশে রাখা, মোবাইলে মানবী দেখে-- রাত বারোটা দশ। আমাকে বাঁচান -- দয়া করে দরজা খুলুন ।বলে আবার দরজায় টোকা পড়ে । এত বার টোকা শুনে কিছুটা ইতস্তত করেও দরজা খুলে দেয় মানবী ।কিছুটা আরষ্ট ভাবে সে নাইট ল্যাম্পের মৃদু আলোয় দেখে একটা আঠাশ তিরিশ বছরের ছেলে ,গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ।মানবী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটি তাকে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় খিল দিয়ে দেয় ।মানবী আলনা থেকে ওড়না টেনে নিয়ে কিছুটা বিরক্তির সুরেই বলে ---কে আপনি? কি চায়?


----বলছি ,বলছি ।এক গ্লাস জল হবে?
ছেলেটির সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না।মানবী গ্লাস ভর্তি জল এগিয়ে দেবার আগেই ছেলেটি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে যে ভাবে খেল তা দেখে মানবীর মনে হল --নিশাচর চাতক নাকির বাবা !
------কে তুমি ?এত রাতে কি চায় ?
------আমি খুনি । পুলিশ আমাকে খুঁজছে।



মানবী হঠাৎ চিৎকার করে --খুনি --খুনি।তৃতীয়বার খুনি বলে চেঁচানোর আগেই ছেলেটি হাতের তালু দিয়ে মানবীর মুখ সজোড়ে চেপে ধরে বলে ----খবরদার !আর একবার চিৎকার করলেই খুন করে ফেলব।মানবী এই শীতের রাতেও ঘামতে থাকে ।
কিন্তু এর মধ্যেই মানবী ছেলেটির ডান ভ্রূর উপর কাটা দাগ দেখতে পেলে কিছুটা ধাতস্ত হয়।



-----কাকে খুন করেছ ?কেন করেছ ?
-----বলছি।কিছু খাবার পাওয়া যাবে ? দুদিন কিছু খাওয়া হয়নি ।
----মানবী জল ,মুড়ি , বতাসা -এগিয়ে দিলে মুড়ি খেতে খেতে ছেলেটি বলে ---আমি একটা মেয়েকে ভালো বাসতাম ।বিশ্বাস করুন মন থেকে ভালোবাসতাম ।এক বছর আগে আমারই এক বন্ধু তাকে বিয়ে করে মুম্বাই পাড়ি দেয় ।সাত দিন আগে মুম্বাই এ সেই বন্ধুকে খুন করে পালিয়ে এসেছি ।
আপনি যাকে ভালোবাসতেন তার নাম কী ?



ছেলেটি এক কামড় বাতাসা চিবিয়ে এক ঢোক জল খেয়ে বলে ---তার নাম মানবী ।
নামটা শোনামাত্র মানবীর বুকের ভিতরটা ধরাস করে ওঠে ।কাঁপা কাঁপা গলায় মানবী জিজ্ঞাসা করে আচ্ছা তোমার নাম কী রাজেন্দ্র ?কথা শেষ করার আগেই দরজায় টোকা পড়ে --শুনছেন ?দরজা খুলুন।থানা থেকে আসছি।
মানবী দরজা খুলতেই পুশিশের পোষাক পড়া দুজন প্রায় ঘরের মাঝ খানে এসে জিজ্ঞাসা করে --রোগা মতো ,গালে খোঁচ খোঁচা দাড়ি,ডান ভ্রূর উপর কাটা দাগ আছে,এমন কাউকে এদিকে আসতে দেখেছেন ।
মানবী মাথা নীচু করে শুধু বলে -না ।



----খাটের উপর কে শুয়ে আছে 
----আমার স্বামী ।
--আপনার স্বামী তো মুম্বাই এ থাকেন,না?
এক বছর পর উনি আজ বিকালেই মুম্বাই থেকে বাড়ি ফিরেছেন ।খুবই ক্লান্ত ।তাই ঘুমাচ্ছেন।
ঠিক আছে ।এত রাতে ডিসটার্ব করার জন্য দুঃখিত ।আর হ্যাঁ --এই মোবাইল নম্বরটা রাখুন । কোন সন্দেহ ভাজন ব্যক্তিকে দেখলেই খবর দেবেন ।গুড নাইট। 



পুলিশ চলে যেতেই ছেলেটি লেপের নীচ থেকে বেড়িয়ে বলে-- আপনিতো আমার মানবীর মতোই বুদ্ধিমতী । একজন আসামীকে, স্বামী বলে বাঁচিয়ে দিলেন । ছেলেটির ভ্রূর উপর কাটা দাগটির দিকে পুনরায় চোখ যায় মানবীর ।সঙ্গে সঙ্গে মানবী খাটের উপর নিজের মোবাইল খুঁজতে হাত বড়ায়। ছেলেটি দরজা খুলে ভোরের হিমেল কুয়াশার মধ্যে মিশে যায়।মানবী খোলা দরজার দিকে চেয়ে মোবাইলের কলিং বাটন প্রেস করে।

___________
@তাপস ঘোষ