Wednesday, 12 October 2016

মুক্ত শ্রেনীকক্ষ


দ্বীপ জ্বেলে যাই-৩ 
****************

সমস্ত অকপট বন্ধুদের শুভ বিজয়ার ও মহরম মুবারক-এর প্রীতি ও শুভেচ্ছা। উৎসবের মরশুম চলছে। বিজয়া এবং মহরম দুটোই অশুভের উপর শুভের জয়গাথা। তৎসত্ত্বেও বিজয়া ও মহরম দুটোই কোথাও একটা বিষাদের সুর যেন বয়ে আনে।

  তবু, মানবজীবন একইভাবে একই ধারায় বয়ে যায়। এই বহমানতাই তো প্রকৃতি, জীবন, সমাজ আর সভ্যতার মুল চালিকাশক্তি। আমাদের সবার প্রিয় গ্রুপ অকপটেরও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গতিময়তা।

  অকপটে আমরা বিশ্বাস করি- 'Rolling stone gathers no moss..!!' কারোর জন্য কোথাও কিছু থেমে থাকে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি আমাদের জন্য অকপট যতটা, তার থেকে বেশী অকপটের জন্য আমরা। Tom, Dick, Harry, আপনি এবং আমি- কাল ছিলাম না.. আজ আছি.. আগামীকাল নাও থাকতে পারি...!! তাই আমাদের  প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অকপটকে ভালোবেসে 'গান-গল্প-ছবি-আড্ডা-যুক্তি-তক্কো-রাগ-অনুরাগে' এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের  ঠেকটাকে জমজমাট রাখার প্রয়াস জারি রাখবো এই আশা রাখি।

  সাম্প্রতিক কালে আমরা বেশকিছু নতুন বন্ধুকে পেলাম যাঁরা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমী। তাঁদের জন্য অন্ততঃ ব্যক্তিগতভাবে আমার তরফ থেকে একটা এক্সট্রা স্যালুট। স্রেফ স্রোতে গা না ভাসিয়ে, গড্ডলিকা প্রবাহ অনুসরন না করে তাঁরা যে তথাকথিত সমাজের চোখে blacklisted হওয়ার তোয়াক্কা না করেও বিভিন্নভাবে নানান ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতার যুক্তিপুর্ণ বিরোধীতা করে নিজস্ব বলিষ্ঠ মতামত জাহির করছেন এটা বেশ ভালো ব্যাপার। যেকোনো মুক্তমনা গ্রুপের কাছেই এগুলো গর্বের ব্যাপার।
 
   আজ আপনাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে চাই আমাদের এক নতুন বন্ধু রানী মজুমদারের সাথে, যিনি এই গতানুগতিক সমাজের বুকে একজন দৃষ্টান্তস্বরুপ। রুপান্তরকামী রানী তাঁর জীবনসংগ্রাম দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত, অনুপ্রেরিত করে প্রমান করে দিয়েছেন যে ইচ্ছাশক্তির জোরে বদ্ধসংস্কারের পাহাড়কেও টালানো যায়.. প্রতিকুলতার সুনামীকেও রোখা যায়। একাধিক পত্র-পত্রিকায় রানীকাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, এবিপি আনন্দে তাঁর সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, রানী একজন সুলেখিকাও বটেন। বইমেলাতে তাঁর বইও প্রকাশিত হয়েছে। রানীকে অকপট চিত্তে অভিবাদন জানাই।

  এপ্রসঙ্গে, আরেকজন 'অনন্যা'র কথা মনে পড়ে গেল। এক দুঃস্বপ্নময় শৈশব কেটেছে তাঁর। কাজ করেছেন পরিচারিকা হিসেবে। সত্যি বলতে কী, এখনও পেশাগত পরিচয়ে তিনি একজন পরিচারিকাই। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি একজন স্বনামধন্য লেখিকা। নিজের বই নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট বা হংকং-এর মতো শহরে। মোট ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা বই, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি বিদেশি ভাষা। ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপানে রয়েছেন তাঁর বইয়ের পাঠক-পাঠিকা। সারা দেশে বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবে তিনি আমন্ত্রিত হন তাঁর লেখা পাঠের জন্য। তিনি বেবি হালদার।

  তবে, যত সংক্ষেপে এই দুজনের জীবনকথা বলে ফেললাম, বাস্তবের সুদীর্ঘ রুক্ষপথটা কিন্তু এনাদের ততটা সহজে পথ করে দেয় নি। সমাজে এঁদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল এই সমাজটা নিজেই। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, রুচী প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের বাঙালী সমাজের যুগপৎ সুনাম-দুর্নাম দুই-ই কিছু কিছু আছে। তবে বাঙালীর অনেক গুনের মধ্যে একটা হল সহনশীলতা.. যেটাকে কেউ কাপুরুষতা, কেউ ইগো, কেউ একগুঁয়েমি ভেবে ভুল করে থাকেন। জোরগলায় কোনো ভুল বিষয়কে ভুল বলার জন্য নিজের স্থানটা কীভাবে ধরে রাখতে  হয় তা আমরা রানী, বেবীর মতো আরো অনেকের কাছেই শিখতে পারি। তবু, বাঙালীই বাঙালীর ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়। এই জন্যই কোনো মনিষী বলেছিলেন- 'বাঙালী হল কাঁকড়ার জাত'!

  এই কথাটা এখন আপ্তবাক্যে পরিনত হয়ে গেছে বলা যায়। আমরা যে যখন পারছি হাটে-বাজারে ইচ্ছামত এই কথাটা অন্যের সম্বন্ধে প্রয়োগ করছি। গত একশো বছরে আমরা বাঙালীরা অনেক এগিয়েছি- তবু কোথাও একটা যেন আমরা স্থবিরতা আর অহং ঝেড়ে ফেলার ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পুরোপুরি সক্ষম হইনি। বিশেষ করে কোনো দল, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের অংশ যদি হন।  

এবিষয়ে বিদ্যাসাগরের চরিত্র বর্ণনায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা রচনাংশ দিয়ে আজকের সাতিদীর্ঘ লেখায় দাঁড়ি টানবো। এর প্রতিটা শব্দকে দর্পণের মতো ব্যবহার করে আমি নিয়ত নিজের দোষত্রুটি, অক্ষমতা, অপ্রতুলতা সংশোধনের চেষ্টা করি। মনেহয় এটা সবারই করা উচিত। অনেকের কাছেই পরিচিত, তবু যাঁরা আগে দেখননি তাঁদের জন্যঃ-

  " বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন.......

.......তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন- আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করিনা, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভুরিপরিমান বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমান আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরনে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।

  এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ, তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।" 
(সংক্ষেপিত)
********** ********** ************
সবাই ভালো থাকুন! ভালো ভাবুন! ভালো রাখুন!

© সুদীপ ভৌমিক

No comments:

Post a Comment