Monday, 31 October 2016

প্রতিপদ

মেজদা
=====

আজ মেজদার সাথে দেখা হ’ল বাজারে। মেজদার সাথে কথা বলে সত্যি ভালো লাগল। সে যে কি আনন্দ, কি বলব! 

এই মেজদার সাথে পরিচিত হতে হলে যেতে হবে চল্লিশ বছর পেছিয়ে। আসলে মেজদা একজনের নাম হয়ে গিয়েছিল।তখন আমি পাড়ার চ্যাংড়া। আড্ডা দিয়ে –কথায় কথায় হাতি মেরে, আর ভান্ডার লুটে দিন কাটাই। এই রকম সময়ে একজন কে দেখতাম রোজ রিকশায়, দিনে-দুপুরে লাট খেতে খেতে যাচ্ছে। সেদিনও দুপুর বেলায় খেয়ে-দেয়ে শিব মন্দিরের রোয়াকে বসে আছি। এমন সময় দেখি সেই লাট খাওয়া লোকটা, এলোমেলো চুল যেন সবে ঘুম থেকে উঠেছে, শরীরের থেকে কয়েকগুণ বড় গায়ে একটা কালি মাখা জামা, ইস্ত্রিবিহীন প্যান্ট কোনরকমে কোমরে জড়ান, রিকশায় আসছে। চোখ বন্ধ, ঢুলে-ঢুলে পড়ছে, কোনরকমে সাইকেল রিকশার সীটের সাইড- হ্যান্ডেলটা ধরে। 

যাচ্ছিল লোকটা বেশ, নিজের খেয়ালে, কিন্তু আমার শয়তানি বুদ্ধি আর কি, চেঁচিয়ে শুন্যে ছেড়ে দিলাম, “এইরকম ভাবে চল্‌লে আর বেশী দিন লাস্টিং করবে না, দেখছি”। রিকশার চাকাটা ৮/১০ পাক ঘুরেছে হয়ত। টাল খেতে খেতে লোকটা পেছনে ঘুরে, জড়ানো গলায় বললে, “এই শোন্‌, আমি কিংকং এর মেজদা, অত সহজে টপকাবো না, মনে রাখিস”।  

তারপর থেকেই সে হয়ে গেল মেজদা। যেতে–আসতে মেজদার সাথে দেখা হয়ে যেত। হাত তুলে, “কি মেজদা, সব ঠিক?” ওমনি মেজদা উত্তর দিতে, “হ্যা বস্‌ আছি”। 

একদিন মেজদার সাথে রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল। সে সেদিন বিকেলে ফেরবার সময় কানাইদার দোকানে পান কিনছিল, রিকশা দাঁড় করিয়ে। 

আমি – কি মেজদা, কি খবর? 

মেজদা – ভালো, কি? পান খাস নাকি?                 

আমি – না, তুমি খাও 

কানাইদা পান বানাতে ব্যস্ত, ততক্ষণে মেজদা বিড়ি ধরিয়ে, তর্জনি আর মধ্যমার ফাঁকে রেখে, বিড়িটাতে এক বুক টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বল্‌ল, “এটা তোকে দিতে পারব না, আমি তোর মেজদা,” বলে এক মুখ সরল হাসি। তারপর এদিক ওদিক সন্তর্পনে দেখে মুখটা আমার কানের কাছে প্রায় নিয়ে বল্‌লে, “কি করা হয়?”   ততক্ষণে চোলাই এর গন্ধে প্রাণ যায়-যায়। মদ খাওয়ায় তখনও অনভ্যস্ত। মাঝে মাঝে কোন পাব্বনে আমার ৯টাক৫০পয়সা, হারুর ৯টাকা৫০পয়সা দিয়ে দুজনে পুকুর পারে, দাঁত দিয়ে ছিপি খুলে, এক বোতল ঠান্ডা ব্ল্যাক লেবেলেই আনন্দ।      

আমি তখনো পড়ুয়া। টিউশানি, বাড়ির এর-ওর দাক্ষিণ্য আর রোজকার বাজার থেকে যা আয় তা দিয়ে বেশ কাটিয়ে দি। চাকরি করার কথা তখনো মাথাতেই আসেনি।কোনরকমে দম আটকে, একটু মজা করেই বল্‌লাম, “কি আবার, কি আর করব? বেকার বসে আছি।   

মেজদা – ফিসফিস করে, “চলে আয় আমার লাইনে”। 

ততক্ষণে কানাইদার পান বানানো হয়ে গিয়েছে, আমারও মদের উগ্র গন্ধ গা সওয়া গয়ে গিয়েছে। দাম মিটিয়ে, পানটা মুখে দিয়ে মেজদা আমাকে নিয়ে রাস্তার দিকে সরে এসেছে।   

আমিঃ কি লাইন?  

মেজদাঃ এই লোকের পকেট কেটে, হাত সাফাই।

আমিঃ আমার কি হাঁড়-গোড়গুলো ঠিকঠাক জায়গায় আছে, তা তুমি চাও না?   

মেজদাঃ নিজের দিকে পা থেক মাথা অবধি দেখিয়ে বল্‌লে, এই দ্যাখ, আমার কোন হাঁড়টা সরেছে বলত? । আরে তোকে কি আজ ভর্তি করে কালকেই নামিয়ে দেওয়া হবে? তোর চলবে টেনিং এক মাস- দুই মাস। তারপর তুই পাস করলেই তোকে লাইনে নাবানো হবে।  

আমিঃ ট্রেনিং? মানে?   

মেজদাঃ এই ধর পথমে তোকে চালু বাসে ওঠা-নামা করানো হবে, তারপর আসবে  ক্যালানি সহ্য করার টেনিং – কদিন তোকে রাম ক্যালান্‌ ক্যালানো হবে – ওষুধ-পত্তর পেয়ে যাবি সে নিয়ে চিন্তা করিস না। তারপর সে সব সহ্য করে উঠবার পর তোর হবে আসল টেনিং।কি ভাবে লোকের গায়ের উপর পড়ে গিয়ে পকেট থেকে পেন গায়েব করবি, কত তাড়াতাড়ি পকেট থেকে তুলতে পারবি মনি ব্যাগটা।জিভের নিচে কি করে বেলেড লুকিয়ে রাখবি......................................। এই সব হয়ে গেলে আসবে বেলেড মারার পালা। একটা লাউ এর উপর পাতলা ভিজে আদ্দির কাপড় রেখে বলা হবে বেলেড চালাতে। যেদিন তুই লাউএ টাচ না করে আদ্দির কাপড়টা কাটতে পারবি সেদিন তুই হবি অল রাউন্ডার পকেট মার।     

আমিঃ না বাবা এসব হবে না আমায় দিয়ে।   

মেজদাঃ তা হলে ছেড়ে দে কোন ব্যাপার নয়। আসি। এই বলে সময় নষ্ট না করে মেজদা রিকশায় উঠে গেল।

এরপরে মেজদার সাথে দেখা হয়ে যেত এদিকে সেদিকে। বাসে জিনিষ খুইয়ে মেজদার শরণাপন্ন হয়ে হারানো মাল উদ্ধারও করেছি অনেকবার। দুই-একবার ক্ষেপেও গিয়েছে পুলিশে এফ আই আর করানোর জন্যে। উত্তেজিত হয়ে তখন বলেছে যা না তোর মামু দিয়ে দেবে তোকে। অবাক হয়েছি, শা* পকেটমার খবর কি করে পায় আমি থানায় গিয়ে দরখাস্ত দিয়েছি। 

আজ প্রায় ৬ বছর পর সেই মেজদার সাথে দেখা। জানলাম মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।  মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি ভাই ফোঁটা দিতে তার দাদাকে। তাই বাজার করছে মেয়ের জন্যে। আমায় দেখে – “কি রে চুলগুলো পাকিয়ে তো আমার থেকেও বুড়ো হয়ে গেলি?” 

আমিঃ কি আর করি, হয়ে গেল? তা তুমি কেমন আছ?   

মেজদাঃ আমি হেবি ভালো রে। ওসব লাইন ছেড়ে দিয়েছি। ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি করছে। ও-সব কাজ কি আর করা যায়? ছেলের পেস্টিজ বলে কথা। আর এখন যে বড়বাবু এসেছে থানায় সত্যি ভগবান। আমি যেই গিয়ে বল্‌লুম আর এ লাইনে কাজ করব না, ছেলে চাকরি পেয়েছে। শুধু আপনারা কথা দেন আমায় এ লাইনে ভজাবার আর ধান্দা করবেন না, কি বল্‌ল জানিস? – “কোন শুয়ার তোকে আর ঘাঁটাতে যাবে না, এই তোর নাম লিস্টি থেকে দিলাম কেটে” এই বলে কম্পুটার খুলে কি সব করল।   

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে দেখে সেই পুরোনো সরল হাসি হেসে বল্‌লে “তুই তো আর আমার ফ্যামিলি নিয়ে জানতিস না। ভাই-বোন দুটো তো মামা বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। আমি শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি”।  

আমি তখনো ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। মেজদা – ওর ছেলে, সে ব্যাঙ্কে চাকরি করছে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছে – সব মিটিয়েছে এই লাইনে থেকে? কিন্তু মনে মনে সত্যি খুশি হচ্ছিলাম এরকম জীবন যুদ্ধে জেতা একটা মানুষের গল্প শুনে।
:

_________________
© দেবাশীষ দাসগুপ্ত     

1 comment: