। ১ ।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা । অফিসের কাজ শেষ করতে করতে আজ বেশ দেরিই হয়ে গেলো । পার্কস্ট্রিটের Chatterjee International বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল শমীক । কাল থেকে টানা তিনদিন কালীপূজোর ছুটি । তাই দেরি হলেও মনে একটা খুশীর আমেজ লেগে আছে । তার উপর আনোয়ার আজ ‘নুঙ্গি’ র বাজিকারখানা থেকে অনেক বাজি নিয়ে এসে দিয়েছে তার ছেলের জন্য । শুভ সামনের ডিসেম্বরে পাঁচে পড়বে । এ বছর বাজি পোড়াবে বলে খুব আবদার করছিলো, তাই আনোয়ার কে দিয়ে স্পেশাল করে এই বাজি আনানো । এখন প্রথম কাজ হোল একটা বাস ধরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিয়ালদা স্টেশন পৌঁছান । তারপর সেখান থেকে বারাসাত লোকাল ধরে দত্তপুকুর । মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে । বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বেশ । বৃষ্টিতে বাজিগুলো ভিজে গেলে এতগুলো টাকা সব বরবাদ...
। ২ ।
ট্রেনটা দশ মিনিট লেটে ছাড়ল । বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে । তবে বাজিগুলো ভেজেনি । বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বাসটা পেয়ে যাওয়াতে বেশ সুবিধাই হয়েছে । একটা সীটও পাওয়া গেছে । এই সময়ে লোকালে সীট পাওয়াটা বেশ ভাগ্যের ব্যাপার । আজ সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে । যেন সব ছকে বাঁধা । নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবানই মনে হচ্ছে আজ । সামনে তিনদিনের সব প্ল্যান কষা হয়ে গেছে । বৌ, ছেলে আর মাকে নিয়ে খুব মজা করবে এই তিনদিন । ইচ্ছা আছে একদিন টাকি থেকে ঘুরে আসার... । বাবা গত হয়েছে আজ বারো বছর । শমীক তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে । তখন থেকেই শমীকের জীবন সংগ্রাম শুরু । বাবার পেনশনের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে সংসার চলতো না । বাধ্য হয়ে টিউশন শুরু করে শমীক । সকাল বিকেল নিয়মিত টিউশন করেছে আর রাত জেগে পড়াশুনা করেছে । গ্রাজুয়েশন পাশ করেছিল বেশ ভালো নম্বর নিয়েই । তারপর DOEACC থেকে কম্পিউটারের দুটো কোর্স করে এই চাকরিটা পায় ও । তাও আজ পাঁচ বছর হয়ে গেলো । মাইনে এখন মোটামুটি বারো হাজার টাকার মতো পায় । সেই সঙ্গে বাবার পেনশনের টাকাটা আছে বলেই সংসারটা চলছে । এখন তার জীবনের একটাই লক্ষ্য – ছেলেটাকে ভালোভাবে মানুষ করা । আগের বছরই স্থানীয় একটা ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে শুভকে ভর্তি করেছে নার্সারিতে । এখন শুভকে আবর্ত করেই তাদের সবার জীবন…
। ৩ ।
রাত আটটা । দত্তপুকুর স্টেশনে নামলো শমীক । ট্রেনটা আজ খুব ভুগিয়েছে । প্রায় আধ ঘণ্টা লেট । কিন্তু স্টেশন অন্ধকার কেন ? মেন গেট দিয়ে বাইরে এলো শমীক । চারিদিকে অন্ধকার । ভালো বৃষ্টি হয়ে গেছে । ঝড়ও হয়েছে বোঝা যাচ্ছে ।কয়েকটা দোকান খোলা আছে । টিমটিম করে মোমবাতি আর হ্যারিকেনের আলো জ্বলছে । সামনেই একটা দোকান থেকে একটা ক্যাডবেরি কিনল শমীক । দোকানদার কানুদা তার পূর্বপরিচিত । কানুদাকে জিগ্যেস করলো শমীক, “কি ব্যাপার কানুদা? কখন লোডশেডিং হয়েছে?”
- “ আর বলিস না শমীক, প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কারেন্ট নেই… । এই একটু আগেই তো ঝড় বৃষ্টি থামল…”
- “সে তো দেখতেই পাচ্ছি… । ভালই বৃষ্টি হয়ে গেছে”, শমীকের উত্তর ।
- “তোদের বাড়ির ওদিকে কোথায় তার ছিঁড়ে পড়ে আছে নাকি রাস্তায় । তাই তো লোডশেডিং… । সাবধানে যাস কিন্তু !”
- “হুম… রাস্তা তো পুরোই অন্ধকার দেখছি…”
- “আজ আর কারেন্ট আসবে বলে মনে হয় না । আমিও একটু পরে দোকান বন্ধ করে দেবো…”, কানুদা উত্তর দিল ।
- “যাচ্ছি গো…”, পা বাড়াল শমীক ।
স্টেশন থেকে তার বাড়ি প্রায় পনের মিনিটের হাঁটা রাস্তা । রিক্সাও নেই একটা আশেপাশে । ‘যাক গে, এটুকু তো রাস্তা…’ – বেশ জোরেই পা চালাল শমীক । বাড়িতে শুভ অপেক্ষা করে বসে আছে তার জন্য…
। ৪ ।
-“মা, বাবার আস্তে আর কত দেরী হবে?”, অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত শুভ । আজ দুপুরে না ঘুমিয়ে পড়াও করে নিয়েছে সে । বাপি আসলে একসঙ্গে বাজি পোড়াবে…
-“তোর কি তর সইছে না… দেখছিস না লোডশেডিং হয়ে গেছে, সেজন্য আসতে দেরি হচ্ছে…”, “ বলল বটে মিঠু কিন্তু দুশ্চিন্তা তারও শুরু হয়েছে । রাত নয়টা বাজে । এত দেরি হবার তো কথা নয় । সাড়ে সাতটার সময় একবার ফোন করেছিল বটে শমীক… বলেছিল ট্রেন লেট আছে । কিন্তু তাই বলে এত লেট !
-“দাঁড়া তোর বাপিকে একটা ফোন করে দেখি…”
মোবাইলটা কিন্তু বেজেই গেলো । ধরল না শমীক ।আবার ফোন করলো মিঠু । এবারেও রিং হয়ে হয়ে কেটে গেলো ।
কপালের ভাঁজ আরও ঘন হোল মিঠুর । পাশে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল সে । তার শাশুড়ি আজ ছেলের জন্য লাউ-চিংড়ি রাঁধছে । সকালে কোনওমতে নাকে মুখে গুঁজে খেয়ে গেছে মানুষটা…
-“মা, আপনার ছেলের আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন? এতো দেরি তো হয় না…!”
-“ফোন করেছিলে?”
-“হ্যাঁ… রিং হয়ে যাচ্ছে। ফোন ধরছে না…”
-“ততক্ষণ শুভকে খাইয়ে দাও… ঝড়বৃষ্টির রাত । তায় আবার লোডশেডিং । এসে যাবেখন…”
। ৫ ।
রাত সাড়ে এগারোটা । ক্লাবের ছেলেদের বেশিদূর যেতে হয়নি । শমীকের বাড়ী থেকে এক কিলোমিটার দূরে রাস্তার ধারে পাওয়া গেলো শমীকের লাশটা । ঝড়ে ছিঁড়ে যাওয়া তারটা পুরো পেঁচিয়ে নিয়েছিল তার দেহটা । সাদা হয়ে গেছিলো পুরো শরীর । তার দেহের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শুষে নিয়েছে যেন রাক্ষুসী তারটা…
শুভ কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে । বাপির উপর তার খুব রাগ হয়েছে ওর । বাপির সঙ্গে আর কথা বলবে না ঠিক করেছে ও…
_________________
©ফিরোজ আখতার
No comments:
Post a Comment