Thursday, 27 October 2016

পুনর্জন্ম

শেষ ট্রেনটা পেরিয়ে গেল I পরানবাবু একইভাবে স্টেশনের সিমেন্টের চেয়ারটায় বসে থাকলেন I I স্কূল ছুটি হয়েছে অনেক আগেই I আজ যেন বাড়ি ফেরার কোনো তাড়াই নেয় I I কি জন্যেই বা ফিরবে ? কেউ কি তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে ? একে একে সমস্ত কলিগরা বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন I দু চারটে কুকুর ছাড়া স্টেশন চত্বরে আর কেও নেয় I কেউ কেউ অতিউৎসাহী হয়ে ওভাবে বসে থাকার কারণ জিগেস ও করলেন I তিনি কিছু বলতে পারলেন না I

শুধু বললেন অন্য দিকে একটু যাবার আছে I বলবেনই বা কিভাবে যে গিন্নির সাথে তাঁর ভয়ংকর ঝগড়া হয়েছে I তাঁর স্ত্রী তাঁকে গ্রাহ্য করেন না I কথায় কথায় অভিযোগ I যেন সদ্য খোলা এক কমপ্লেন বক্স I অযথা বাপ ঠাকুরদাদের নিয়ে টানাটানি I কিছু বললেই শিক্ষকতা নিয়ে উপহাস করা I গিন্নির ইচ্ছে শুধু বিগ বাজারে শপিং করতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, হোটেলে গিয়ে ডিনার এই সব , সাজ গোজের কথাটা না হয় বাদই দিলাম I গত পরশুদিন আবার বায়না ধরেছেন , হীরের নেকলেস কিনবে পূজোতে I

পরানবাবু বড় হয়ে উঠেছেন গ্রামে I চাকরির সুবাদে এই শহরে আসা I তাঁর চিন্তা ভাবনা সোনাদানাতেই আবদ্ধ I হীরের জিনিস কল্পনার অতীত I কল্পনা করলেও, পাবেন কোথায় এতটাকা I নতুন ফ্লাটের কিস্তি মিটিয়ে আর কত টুকুই বা বাঁচে I কিভাবে সংসার চালাবেন , ছেলেটার ভবিষ্যতের পড়াশুনা জন্য দু চার পয়সা রাখবেন , এই চিন্তাগুলোই সারাদিন ঘুরপাক খেতে থাকে মাথায় I কত বারই না রমাকে বুঝিয়ে বলেছেন


"দেখো রমা, তোমার কথায় এই হাই প্রোফাইল জায়গায় ফ্ল্যাট কিনেছি I মিশছো মিশো, মিসেস আগ্রয়াল, মিসেস শর্মাদের সঙ্গে , কিন্তু ওদের অনুসরণ করতে যেও না, ওরা সব বড় বড় বিজনেস ম্যান, আর আমি ছাপোষা স্কূল মাস্টার I" কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী I জিনিস পত্রের দাম হু হু করে বাড়ে আর সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে গিন্নির আবদার I আর ভালো লাগে না I নিজেকে কলুর বলদের মত মনে হয়, ঘানি টানছেন তো টানছেনই I নিজের অস্থিচর্ম সার অবস্থা I আর সেই তেল মেখে অন্যরা চামড়ার উজ্জ্বলতা বাড়াতে ব্যস্ত I 


গত পরশুদিন রমার হীরের নেকলেসের আবদারটা শুনে মাথা আর ঠিক রাখতে পারেননি পরানবাবু I সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে রাগে গর্জে উঠেছিলন I ভেবেছিলেন হয়তো, গর্জনে কাজ হবে I কিন্তু হায়, তা হল যজ্ঞ এর আগুনে ঘি ঢালা I শোনা মাত্রই রমার সে কি রুদ্রমূর্তি, এই মারে তো এই রাখে....


"মুরোদ নেই তো বিয়ে কি জন্য করেছিলে ? তোমার ভাতের হাঁড়ি ধরার জন্য I সকাল সকাল গরম গরম ভাত খেয়ে ইশকুলে যাবে বলে I চললুম আমি বাপের বাড়ি I যেদিন মুরাদে কুলোবে, সেদিন আনতে যাবে I আর যদি এমনি এমনি পা বাড়িয়েছো, তবে তোমার পা কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো I"


পরানবাবু চুপসে যান I তা যদি রমা তাঁর পা কেটেও দেয় , তিনি কিছুই করতে পারবেন না I তার বাবা, দাদা দুজনেই বড় উকিল I হয়তো তাঁকে এক পা নিয়েই জেল খাটতে হবে নারী নির্যাতনের কেস খেয়ে I পরানবাবুর শেষ আশা ছিল লাটুন, তার ক্লাস এইটে পড়া একমাত্র ছেলে I কিন্ত না, ছেলেটি ও হয়েছে মায়ের মত I খাচ্ছে দাচ্ছে আর মায়ের পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাদিন I বাপের প্রতি একটুও টান নেয় I বলতে না বলতেই সোজা মায়ের পিছনে হাজির I 


পরানবাবু যত বেশি ভাবতে লাগলেন, অপমান, লাঞ্ছনা,বঞ্চনাগুলি নতুন শক্তি নিয়ে তাঁকে যেন আরো বেশি গ্রাস করতে লাগল I বিবাহিত জীবনে একটা দিনও শান্তি নেই I চাকরি পাওয়ার একবছরে মধ্যে বিয়ে I তারপর থেকে যন্ত্রণা শুরু, যেন সত্যি নরক নেমে এসেছে তাঁর জীবনে I বিয়ে করার পরই শহরে ছুটে আসা মরীচিকা নামক সুখের সন্ধানে I বাবা মা শখ করে নাম রেখেছিলেন পরান I তিনি ভেবেই পান না, সেই প্রাণের ধন পরান কে ছাড়া তাঁদের দিন কাটে কিভাবে ?
তাঁর পাঠানো মাসিক তিন হাজার টাকায় বাবা মা বেঁচে আছেন কিভাবে ? 


না, এরকম দুর্ভাগ্য নিয়ে যার জন্ম, তাঁর বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না I সেই জীবনের দামই বা কি যা কারো কোনো কাজে লাগে না, যে জীবনের কারো কাছে মূল্য নেয় I মনে স্থির সিধান্ত নিয়ে পরানবাবু এগিয়ে চললেন রেল লাইনের দিকে I 
রাত্রি ঘনিয়ে এসেছে I স্টেশনের আলো গুলো সব জ্বলে উঠেছে I পরানবাবু রেল লাইন ধরে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকলেন সামনের দিকে I কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটু ক্লান্তি অনুভব করলেন I শুয়ে পড়লেন রেল লাইনের উপর I আজ বিকেলে বৃষ্টি হয়েছে I ভিজে ভাবটা এখনো আছে I মনে অনেক কিছু চিন্তাই আসতে লাগল I কিন্তু কোনো কিছুই তাঁকে যেন স্পর্শ করছে না I মৃত্যু চিন্তা বোধহয় এরকমই হয় I ইতিমধ্যে স্টেশনে ঘোষণা হল, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস কিছুক্ষণের মধ্যই স্টেশনে আসছে I


তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকলেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শেষ I তাঁর শরীরটা ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে যাবে I পরানবাবু শুয়ে আছেন মৃত্যুর অপেক্ষায় I হঠাত্ কে যেন পিছন থেকে সজোরে লাথি মারল I ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলেন স্টেশনের পাগলটা I চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে -শালা,কাপুরুষ কোথাকার, মরতে এসেছিস এখানে I প্রেম ধোঁকা খেয়েছিস, বৌ পালিয়েছে I মরবি তো অন্য কোথাও গিয়ে মর I এখানে কেন ? এই লাইন আমার সব খেয়েছে I আমি এখানে কাউকে মরতে দেবো না I যাবি এখান থেকে, নইলে এই পাথর দিয়ে তোর মাথা ফাটিয়ে দেবো I "


অগত্যা ভয়ে ওখান থেকে পরান বাবু পালিয়ে এলেন I ট্রেনে চাপা পড়ার থেকে পাথরের ঘা খাওয়া হয়তো বেশি কষ্টের I মরার চিন্তা কোথায় যেন উবে গেল I সারারাত মশার কামড় খেয়ে ভোরের ট্রেনে বাড়ি ফিরলেন I দরজায় গিয়ে দেখলেন ভিতরে আলো জ্বলছে I তিনি তো আলো নিভিয়ে স্কূলে গেছলেন I কে জ্বালালো আলো ? কপাট ও ভিতর দিক থেকে লাগানো I সাহস করে বেল বাজালেন I কপাট খুলতেই দেখলেন, সজল নয়নে রুমা দাঁড়িয়ে, "কোথায় ছিলে তুমি সারারাত ? কাল সন্ধ্যায় বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পর কতবার ফোন করলাম তোমাকে । ফোন সুইচ অফ কেন ? জানো, সারারাত এক বিন্দু ঘুমোতে পারিনি তোমার চিন্তায় । একটা খবরও কি দিতে নেয় ?"



পরানবাবু কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলেন "স্কূলের কাজে আটকে পড়েছিলাম, তাই শেষ ট্রেনটা মিস করলাম । হঠাত্ লক্ষ্য করলেন রুমার গলায় হীরের নেকলেসটা জ্বলজ্বল করছে । আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন ।

_________________
@দূর্জয় সাউ 

No comments:

Post a Comment