চাটুজ্জেদের রোয়াক- ২
---------------------
@সৌমেন চাটুজ্জ্যে
হরগোবিন্দ চাটুজ্জে নবমী রাতে
খুব ব্যস্ত ছিলেন বলেন চাটুজ্জে গিন্নী আর ভাসানের কথাটা বলবার সুযোগ পাননি। যতোই
হোক পারিবারিক রীতি রেওয়াজ তো মানতেই হবে। তামার পয়সা টা যখন বার কয়েক ঘষল তখনই
বারণ করবে বলে মনে মনে ভেবেও থেমে গিয়েছিলেন। যাকগে মরুকগে। বছরে একটা রাত তো।
একটু সিদ্ধির নেশা না করলে আর পুরুষ মানুষ কিসের! কিন্তু যখন সংযুক্তা বিজন সবাই
মিলে বসল তখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস টা টেনে
নিয়ে একচুমুকে শেষ করেই সেই যে বেরিয়ে গেলেন তারপর আর কিছুই মনে নেই।
দশমীর
সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম লক্ষ্য করলেন নেশাটা কাটেনি এখনও। কিন্তু টানা চল্লিশ
বছরের অভ্যাস। চাটুজ্জে বাড়ির বৌ হয়ে আসার পর থেকেই ভোর ভোর উঠে দুর্গাদালানে ঝাঁট
দেওয়া, উঠোনে জলের ছড়া দেওয়া, ফুল তুলে রেখে
শ্বাশুড়ির জন্য স্নানের জল গরম করে দেওয়া সব কাজ করতে হয়েছে। সকালে ওঠাটা তাই
একেবারে অস্থিমজ্জাতে ঢুকে গেছে। সংযুক্তা শ্বশুরের পেয়ারের বৌমা। সকালে উঠলেই
বকাবকি করবে। মা সকাল সকাল উঠলে নাকি বিতনুর সর্দি হবে।
আর সে যে এই চল্লিশ বছর
একটানা ঘুম থেকে উঠছে ভোর চারটে তে তাতে কারো সর্দি হলো না। সাইনাস বাড়লো না। মাথা
ধরে গেল না। যতো আদিখ্যেতা।
চাটুজ্জে গিন্নী হাতের ঝাঁটাটা নিয়ে চারিদিকে তাকালেন। অস্পষ্ট আবছা কাকডাকা ভোরে শিউলি ফুলের গন্ধ নাকে ঝাপটা দিলো। আর একবার জোরে শ্বাস নেবার জন্য বাতাস টানতেই বুঝল সিদ্ধির নেশাটা কাটেনি এখনও। দ্রুত দুর্গাদালানে উঠে এলেন। আজ ভাসান। মা এর দিকে তাকিয়ে একবার ভাবলেন সেই কবেই তেরো বছর বয়সে বাবা ভাসিয়ে দিয়েছে সংসার সাগরে।
চাটুজ্জে গিন্নী হাতের ঝাঁটাটা নিয়ে চারিদিকে তাকালেন। অস্পষ্ট আবছা কাকডাকা ভোরে শিউলি ফুলের গন্ধ নাকে ঝাপটা দিলো। আর একবার জোরে শ্বাস নেবার জন্য বাতাস টানতেই বুঝল সিদ্ধির নেশাটা কাটেনি এখনও। দ্রুত দুর্গাদালানে উঠে এলেন। আজ ভাসান। মা এর দিকে তাকিয়ে একবার ভাবলেন সেই কবেই তেরো বছর বয়সে বাবা ভাসিয়ে দিয়েছে সংসার সাগরে।
তারপর থেকে শুধু সংসারের
জোয়াল কাঁধে ছুটে চলেছে। এখনও বিশ্রাম নেই। বাবা মারা যাবার পর আর সে দেশে যাওয়া
হয়নি আজ কতোদিন হলো। দুর্গার সৌভাগ্য দেখে হিংসা হয়। বাপের বাড়ি আসছে বলে
চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ। আর সেই যে ছোটো বেলায় পুতুল খেলা ছেড়ে চলে এসেছিল সংসার
করতে তারপর বাপের বাড়ি গেছেও তো কতোবার। এতো হৈ চৈ তো দেখেনি কখনও। চলে আসার সময়
শুধু বাবা বলতো আবার আসবি। মা মরা মেয়েটাকে ঐ একটা লোক ভালো বাসতো শুধু। সেও নেই, বাপের
বাড়ি যাওয়াও উঠে গেছে। একটা কুকুর কে দুর্গাদালানে উঠতে দেখে হৈ হৈ করে ছুটে
গেলেন।
হরগোবিন্দ চাটুজ্জে এখনও
সিদ্ধির নেশায় চূর হয়ে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু সংযুক্তা কি এখনও উঠেনি। কুকুর টা কে
তাড়িয়ে নেমে এলেন। ছেলে বৌ ঘরে থাকলে কখনও তিনি ঢোকেন না। আর এখন তো ঘুমোচ্ছে।
ঢোকার প্রশ্নই নেই। তবুও আজ দশমী। মেলা কাজ। এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোলে চলে। বাইরে থেকে
হাঁক দেবেন ভাবলেন। কি মনে করে থেমে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় এসে
দাঁড়ালেন।
তখনও ভোরের আলো ফোটেনি ভালো
করে।। শিউলি গাছটা ছেয়ে আছে সাদা ফুলে। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে অল্প। ভেজা মাটির
ওপর সাদা শিউলি ফুলের চাদর বিছিয়ে আছে দেখে দীর্ঘশ্বাস টা আরও দীর্ঘ হলো।
অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন অথবা নেশা ঠিক মতো না কাটায় একটু চোখ লেগে গিয়েছিল।
হঠাৎ সাদা মতো কি একটা ভারী কিছু এসে পায়ের ওপর পড়তেই তন্দ্রা ছুটে গেল।
বিজয়ার
প্রণাম গ্রহণ করো
আশীর্বাদ করো মা।
আশীর্বাদ করো মা।
লাফিয়ে
উঠে ছিটকে গেলেন চাটুজ্জে গিন্নী।
আ
মরণ! আমি বিজনের মা। মিনশের নেশা এখনও কাটেনি দেখছি।
মেঝের
ওপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে থাকা অবস্থায় হরগোবিন্দ চাটুজ্জে বলে উঠলেন, 'কে লতু?
আমি তো ভাবলাম মা এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়।'
হরগোবিন্দর মুখে বহুদিন পরে লতু নাম শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে চাটুজ্জে গিন্নী বললেন, আমি মালতী, ঘরে চলো, ছি ছি কেউ উঠেনি ভাগ্গিস। দেখলে কি ভাবতো বলতো।
হরগোবিন্দর মুখে বহুদিন পরে লতু নাম শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে চাটুজ্জে গিন্নী বললেন, আমি মালতী, ঘরে চলো, ছি ছি কেউ উঠেনি ভাগ্গিস। দেখলে কি ভাবতো বলতো।
আমি
ঠিক সেই সময়ে দাঁত মাজতে মাজতে টাটকা শিউলি ফুলের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে চাটুজ্জেদের
রোয়াকে এসে দাঁড়াতেই এই দৃশ্যের খন্ড চিত্র দেখে ফেললাম।
আমি
আর দাঁড়ালাম না ওখানে। একমুঠো শিউলি ফুল আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নেমে এলাম রোয়াক
থেকে।
বুঝলাম
আজ সত্যিই শুভ বিজয়া দশমী।।
No comments:
Post a Comment