Thursday, 6 October 2016

চাটুজ্জেদের রোয়াক


লেখাঃ সৌমেন চট্টোপাধ্যায়। 
-----------------------------

বলি অ বৌমা শোনো দিকি একবার। সেই তখন থেকে শুধু মুধু ছেলেটাকে না পিটিয়ে একটু লিকার দেওয়া চা করে দাও তো। 

বাড়ির এক ও অদ্বিতীয় কর্তাবাহাদুর শ্রী শ্রী হরগোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় হাঁক দিলেন ছোটো ছেলের বৌ কে।
এই বৌটির সুমিষ্ট স্বভাব ও কবিতা লেখার অসামান্য প্রতিভা দেখে যেমন চমৎকৃত তেমনি এলাচ দেওয়া চা এর স্বাদে অভিভূত । যেদিন ছোটো ছেলে এসে বলল বাবা আমি আমার কলেজের বান্ধবী সংযুক্তা কে বিয়ে করব তখনই দারুণ খুশিতে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে এমন বাঁজখাই গলা বের হয় যে সামনে থাকা কাঁচের গ্লাস টা উল্টে যায়। তারপর থেকে তিন বছর কেউ ভয়ে আর বিয়ের কথা বলতে পারেনি। সেদিনের বাঁজখাই গলাটা যে আসলে অধিক খুশিতে ডগমগ হবার জন্য তা আর তিনিও সেই তিন বছরে একবারও কাউকে বলতে পারেন নি। শেষে একদিন চুপিচুপি ছোটো ছেলের ঘরে ঢুকে ছেলেকে ভয়ে ভয়ে বললেন, "হ্যাঁ রে তুই যে একটা মেয়েকে বিয়ে করবি বলছিলিস তার কি হলো?" 

বিজন চট্টোপাধ্যায় , এল এল বি, বাবার প্রশ্নের কারণ
টা অনুধাবন করতে চেষ্টা করল তারপর খুব সাবধানে বলল ও ঐ সংযুক্তা? ওর তো....
"বিয়ে হয়ে গেছে?" বিজন কে শেষ করতে না দিয়েই বললেন, হতচ্ছাড়া একটা কাজও ঠিক করে করতে পারো না? ওরে তোর বাবাকে দেখে শেখ। তিন তিনটে মেয়ের সাথে প্রেম করে তবে তোর মায়ের সঙ্গে বিয়ে করেছে। আর তুই এই চাটুজ্জে বংশের নাম ডোবালি। 

আবার বাঁজখাই গলার চোটে জানলার কাঁচ টা ফাটল। হরগোবিন্দ বাবু থামলেন। তারপর ছেলেকে বললেন তিন দিন সময় দিলাম সংযুক্তা কে এনে হাজির করবে আমার সামনে, সে তার বিয়ে হোক আর না হোক।
তিনদিন নয়, পরদিন সকালেই সংযুক্তা আর তার এক বান্ধবীকে কে নিয়ে এলো বিজন।
তারপর চাটুজ্জে বংশের মুখ উজ্জ্বল করে একদিন এলো বিতনু।
আর এলো এই চা এর অর্ডার।। 

ছোটো বউ কে ভালোবাসার আরও একটি কারণ আছে। 

ছোটো বউ ইস্টবেঙ্গল এর সাপোর্টার আর শ্বশুরমশাই মোহনবাগান এর। সবাই মোহনবাগি বা সবাই ইস্টবেঙ্গলি হলে খেলা দেখা একপেশে হয়ে যায় বলেই চাটুজ্জে মশাই মনে করেন। তাই বৌমা থাকলে খেলা দেখাটা জমে ভালো।
চা এর জন্য গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আর এদিকে নাতিটাকে মারছে এটা হরগোবিন্দ চাটুজ্জের এর সহ্য হলো না।
এইবার ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করলেন, 'বলি অ বৌমা শোনো দিকি একবার। সেই তখন থেকে শুধু মুধু ছেলেটাকে না পিটিয়ে একটু লিকার দেওয়া চা করে দাও না গো। বলি ইস্টবেঙ্গল খেলতে ভুলে গেছে ঠিকই তাই বলে ল্যাটা মাছ আর কচুর ঝোল আর লঙ্কার ঝালে পোড়া শুঁটকি মাছ রান্নাও কি ভুলে গেলো নাকি, আর আদা দেওয়া চা টাও?
শ্বশুর এর খোঁচাটা হজম করতে পারল না সংযুক্তা। 

চা এর কাপ টা এনে সামনে ধরে শুধু বলল, 'নিন বাবা আপনার চা, অফসাইড এ ঢুকে গোল দেওয়া টা মোহনবাগানের থেকে এখনও শিখতে পারল না এই যা সুখের কথা আর ফালতু পেনাল্টির অভিনয় করে গোল দেবার চেষ্টা টাও আপনাদেরই থাক। আমরা আপাততঃ জেতার দিকে মন দিই।' 

ছোটো বৌমার কথাটা শুনেই চট্টোপাধ্যায় বংশের এর রক্ত চলকে উঠল। আগের ম্যাচের পেনাল্টির ব্যাপারে খোঁচাটা হজম না হওয়ায় বাঁজখাই গলার আওয়াজে গরম চায়ের কাপ টা ছিটকে এসে পড়ল সংযুক্তার পায়ের ওপর।
বিতনুও চিৎকার করে উঠল আর সেই চিৎকারে একটা কাক আলসের ধারে বসি বসি করেও বসল না। বিজন সেই মাত্র ঢুকছিল বাড়িতে, সেও চমকে উঠে বাইক টা স্ট্যান্ড করতে ভুলে গেল। আর সোজা শান বাঁধানো উঠানে গাড়িটা উল্টে গেল। 

সংযুক্তা পায়ের ওপর জলের বোতল টা ঢেলে দিতে দিতে মনে করতে পারল আজ যুবভারতীতে ডার্বি ম্যাচে পয়েন্ট না পেলে ইস্টবেঙ্গল এবারের আই লীগ থেকে ছিটকে যাবে।
বিজন গাড়ি টা সোজা করে তুলে হাতের প্যাকেট টা নিয়ে ডাইনিং হল এ ঢুকল। চাটুজ্জে গিন্নী আওয়াজ শুনে রান্না ঘর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলেন। 

চিল চিৎকারে ডাইনিং হল এ হাজার কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে হরগোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় এর সামনে খুন্তি হাতে বলে উঠলেন মিনশের গলার আওয়াজ কবে কমবে গো আ্যঁ! ছেলের বিয়ে পিছিয়ে যায় এমন চিৎকার! আর আজ বেচারির বিবাহ বার্ষিকীর দিনে এমন করে গরম চা ফেলে কেউ পা টা পুড়িয়ে দেয়। 

হরগোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় একবার নিজের বৌ এর দিকে একবার ছোটো ছেলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে ছোটো বৌমা কে বলল, 'বৌমা আজকের ম্যাচ টা কোন চ্যানেলে দেখাবে?' 

পরদিন আমি চাটুজ্জে দের রোয়াকে যখন দাঁত মাজব বলে বসলাম দেখলাম চারিদিকে কি প্রশান্তি। প্রাচীরের ধারের শিউলি গাছটার ফুলে চারিদিকে শরৎ এর মেলা বসেছে। দূরে একটা কাক বসে আছে।আর পাশের কাক টার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে। 

আমি চমৎকৃত হলাম। 

বুঝলাম কালকের সব ম্যাচ ড্র হয়েছে।

No comments:

Post a Comment