Sunday, 5 February 2017

।। সতের বছর পর একদিন ।।



একটি খুন হইতে চলিয়াছে।   ইতিপূর্বে   সামান্য একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি হইয়া গেল। তাহার পরণে রাবারের চটি। ইহাতে নিঃশব্দে চলাফেরা করার সুবিধা। তবে বৃষ্টি বাড়িলে দূশ্চিন্তার কারণ আছে বৈ কি। খানিক পূর্বেই সে একদম লাগোয়া ঝোপে একটি বেশ বড়সড় গর্ত খুড়িয়াছে । যাহার কথা ভাবিয়া খোড়া, শুনিয়াছে সেই আমিরুলের বিরাট উচা লম্বা চেহারা। এক্ষণে  বড় বৃষ্টি হইলে গর্তের বেশ খানিকটাই  জলে ভরিয়া যাইবে। খুনের পর লাশটি কোথায় গায়েব করিবে? যাহারা তাহাকে জানে তাহারা জানে। সেই জানা লোকের সংখ্যা দু তিনজনের বেশী নয়। কিন্তু তাহারা জানে তাহার কাজে সে কোথাও খুঁত রাখে না। সে যমদূত । পেশাদার খুনী । নাম ভক্তদাস । সে কিছু বিশেষ গুনের অধিকারী । শুধু দুই হাত সমান চলে তাহাই নয়। একটি খুর নিদেনপক্ষে একটি নতুন ব্লেড দিয়াও সে একটি পূর্ণবয়স্ক লোকের গলার নলি দু এক টানে নামাইয়া দিতে পারে। আবলুস কাঠের মত  মিশমিশে কালো গাত্রবর্ণ  বছর পঞ্চাশের বিরাট শক্তিশালী ও নেউলের মত ক্ষিপ্র এই লোকটির মুখের মধ্যে একটি নম্র, গ্রহণযোগ্য, নিরীহ কিন্তু নির্ভরযোগ্য ভাব আছে।
যাহাই হউক  সে তাহার কাজকে ভালোবাসে উপভোগ করে। বিশেষ করিয়া আজকের মত ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কোন খুনের ইজারা লইলে। সীমান্তে গরুপাচার ফেনসিডিল পাচার এইসব সমস্যায় বিএসএফের ভূমিকা লইয়া  যাহাই বিতর্ক থাকুক তা বলিয়া খুনখারাপি ! বিএস এফকে ফাঁকি দেওয়ার বিরাট ঝক্কি তো আছেই। তাছাড়া এবারের ধুরটি(খুনীর লক্ষ্য)সম্পর্কে তাহাকে বিশেষ করিয়া সতর্ক করিয়া দেওয়া হইয়াছে। বছর সাতাশ আঠাশেরএই আমিরুল  নিজেও নাকি একজন প্রথমশ্রেণীর পেশাদার খুনী । শুধু অর্থের লোভে সে পশ্চিমবঙ্গে একাধিকবার নানা সীমান্ত দিয়া প্রবেশ করিয়া খুন করিয়া নিরাপদেই নিজ দেশে ফিরিয়া গিয়াছে।

 বাগদা থানার বয়রা সীমান্তে কাঁটাতারের দুই পাশেই খানিকটা প্রায় শ তিন মিটার লম্বা একটি নয়ানজুলি আছে। ইহাও জঙ্গলময়। ইহার মধ্যেই একটি কয়েক হাত বিস্তৃত অপ্রকট সুড়ঙ্গ আছে যাহার  মধ্য দিয়া একটি রীতিমতো বড়সড় চেহারার মানুষ যাহার শারীরিক দক্ষতা  আছে অনায়াসে এপার ওপার করিতে পারে। গভীর ঝোপঝাড়ে ঢাকা সুড়ঙ্গটি সম্পর্কে উভয় পারের সীমান্তরক্ষীদের কোনো ধারণাই নাই । ইহার সন্ধান জানে একেবারে উচ্চপর্যায়ের দুচারজন সীমান্ত অপরাধী । ভক্তদাসের কাছে খবর আছে আমিরুল বয়রা সীমান্ত অতিক্রম করিয়া খুন করিতে  ঢুকিতেছে। আমিরুলের মত ভয়ংকর অপরাধী যে এই সুড়ঙ্গটিই ব্যবহার করিয়া এদেশে প্রবেশ করিবে এ ব্যাপারে সে একপ্রকার সুনিশ্চিত হইয়া একটি  ঝোপের আড়ালে  ডান হাতে খুর খুলিয়াই অপেক্ষা করিতেছিল। আজ শুক্লা চতুর্দশী।তাহার খাটাশের মত জ্বলন্ত চোখে জ্যোত্স্নার ফুটফুটে  আলো ভেদ করিয়া শীকারকে সে প্রায় দিনের আলোতে দেখার মতই দেখিতে পাইতেছে। তাহার অনুমান  অভ্রান্ত প্রমান করিয়া আমিরুল সুড়ঙ্গ অতিক্রম করিয়া আসিয়া দাঁড়াইলো।
একটি খুন হইল। হ্যা একটি খুন হইল। গলার নলি দুই ফাঁক হইয়া গিয়াছে। ভরা কলসী উপুড় করিয়া জল ফেলিলে যেমন ঢপ্ ঢপ্ ব্লগ্ ব্লগ্ ব্লগ্ ব্লা ব্লা করিয়া আওয়াজ হয় তেমনই আওয়াজ করিয়া গলা হইতে রক্ত নির্গত হইতে লাগিল কেননা শীকার বোধহয় শীকারীকে,‘‘মর্ মর্ ’’,‘‘বাপ বাপ” এইরূপ কিছু বলিতে গিয়াছিল। শীকারি ও বোধহয়   বলিল,“ মরবি তো বটেই। কাইর হাতে পড়ছ এহনে বোঝছো তো। আর এইসময়ে হগলেই(সবাইই) খুনীরে বাপ ঠাওরায়। আমার বাপরে খুন করলে হে (সে) বাপ ডাকতো তেমনই আমার পোলারে খুন করলে হে ও বাপই ডাকতো। ”  
তরলিত চন্দ্রালোকে সে গর্তটি দেখিতে পাইল। শক্তিমান লোকটি তাহারই মত বিশাল চেহারার লাশটি অনায়াস স্বাচ্ছন্দে গর্তে কবর দিয়া ডালপালা দিয়া ঢাকিয়া দিল।এদিককার রাস্তাঘাট সে নিজের হাতের রেখার মতই চেনে। রাস্তায় একটি পুষ্করিণীতে খুরটি ছুড়িয়া ফেলিয়া(একই খুরে নীতিগতভাবে সে দুবার খুন করে না) ধানখেতের মধ্য দিয়া আলপথ ধরিয়া একনাগাড়ে হাঁটিতে হাঁটিতে ভোরভোর সে বনগাঁ আটাত্তর এ বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছিয়া  প্রথম বিড়িতে সুখটান দিল। যথেষ্ট শীত পড়িয়াছে। কাঁধের ঝোলা হইতে চাঁদর বাহির করিয়া মাথামুখ সব ঢাকিয়া লইল। বাস ছাড়িবার পূর্বেই ভাড়া মিটাইয়া দিয়া সে কন্ডাকটরকে ডাকিয়া বলিল খান্না সিনেমা শেষ  স্টপেজে আসিলে তাহাকে ডাকিয়া দিতে।  সে ঘুমাইয়া  পড়িল।      
এই খুনের কিছু পূর্বকথা আছে। ইহা বরং এখন শোনা যাউক। পরে আমাদের  আবার খুনের স্থানে খুনীকে লইয়া  একবার আসিতে হইবে।
বরিশাল জেলায় কীর্তনখোলার চর সংলগ্ন  একটি সাত কাঠা তিন ছটাক জমির উপর ভক্তদাসের দশ পুরুষের ভিটাজমি। দুইটি পুষ্করিণী কিছুটা ফল ফুলের বাগান এবং দশ বিঘা কৃষি জমির মালিক এই সম্পন্ন বৈষ্ণব পরিবারটি ‘‘রাতচরা’’ গোষ্ঠীভূক্ত। তার পূর্বপুরুষের গোপন রজঃ বীর্য চারি চন্দ্রের সাধনা ছিল বলিয়া শোনা যায়। ভক্তদাস ইহার কিছুই জানে না। তবে যখনই অপরিচিত পরিচত কাহারো সহিত দেখা হয় ’’রাধে রাধে“ বলিয়া লোকটির কুশল জিজ্ঞাসা করা তাহার রক্তজাত সংস্কার। সারাদিন  চাষবাসে ব্যস্ত থাকিলেও সন্ধ্যায় উদার আনন্দিত কন্ঠে দুইশত বৎসরের পুরাতন অষ্টধাতুর পারিবারিক রাধামাধব বিগ্রহের সামনে বসিয়া কীর্তনগানে  সে আর তার স্ত্রী (বৈষ্ণবী) চারিদিক মাতাইয়া তুলিত । বড় খুকু পদ্মার বয়স পনের। একমাত্র পুত্র অমরের বয়স বছর চোদ্দো। তবে সে বড় দুরন্ত। কিছুটা বেপরোয়াও। একটি খুর নিদেনপক্ষে একটি ব্লেড পাইলেই সে ব্যাঙ কাঠবিড়ালির পেট চিরিয়া ছাড়িয়া দেয়।  গোড়া বৈষ্ণব বাড়ির ছেলে হইয়াও সম্প্রতি সে একটি কুকুর এবং একটি বিড়ালেরও গলা খুর দিয়া  চিরিয়া  দু ফাঁক করিয় দিয়াছে।
তবে রাধামাধবে ভক্তি আসিতে আর কতদিন?আগামী দু চার বছরেই বড়খুকীকে বিবাহ দিয়া সে তাহার মতই কম বয়সে অমরের  বিবাহ দিয়া দিবে।  খাটি বৈষ্ণব ঘরণার কোন সুশ্রী ভক্তিমতী কন্যার সহিত।কন্যাটির মিষ্টতার প্রভাবে অমরের এই হিংস্রতা পলায়ন করিবার পথ পাইবে না। এই সবই ছিল ১৯৭১ সালের পূর্বে ভক্তদাস ও তাহার স্ত্রীর সুখস্বপ্ন।

১৯৭১ সালটি বাঙ্গালীর বিশেষ করিয়া ওপারের বাঙালীর হারানো প্রাপ্তি ও নিরুদ্দেশের বছর । বাঙ্গালী আত্মোপলব্ধি করিয়াছিল দুর্বৃত্ত শাসকগোষ্ঠী  ধর্মের অহিফেন সেবন করাইয়া বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বাকে মুছিয়া দিতে পারিবে না ‘‘বেত মারিয়া মা ভূলান’’ যায় নাই। সোনার স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত  হইয়াছিল। অপরপক্ষে শুধু খান সেনা নয়,রাজাকার,আলবদরের হাতে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর খুনে পবিত্র মাটি লাল হইয়াছিল। লক্ষ লক্ষ নিষ্পাপ বঙ্গ ললনার পবিত্রতা ঘাতকের দন্তেনখরে  ছিন্নভিন্ন  হইয়াছিল। অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন বাস্তুচ্যুত করার লক্ষ লক্ষ ঘটনাও ঘটিয়াছিল। চূড়ান্ত প্রতিরোধের সময় ভক্তদাস মুক্তিবাহিনীর একটি দশজনের দলকে তিন দিনের  জন্য ঠাকুরঘর ও উপরের মাচায় লুকাইয়া  রাখিয়াছিল। তাহারা চলিয়া যাইতে সন্ধ্যানাগাদ এই মালাউন কাফের বংশটিকে নিকাশ করিতে  স্থানীয় আল বদর নেতা জামালুদ্দীন সদলবল প্রবেশ করিয়া প্রথমে  সর্বস্বলুণ্ঠন তৎপর অগ্নিসংযোগ করিয়াই ক্ষান্ত হইল না।দুইশত বৎসরের পুরাতন রাধামাধব বিগ্রহকে আছড়াইয়া টুকরা টুকরা করিয়া পদাঘাতে পানিতে নিক্ষেপ করিল এবং এই পূণ্যেই তাহারা বেহস্তে যাইবার অনুমতিপত্র সংগ্রহ করিয়া ফেলিল বলিয়া উল্লাসে চীৎকার করিতে লাগিল। ছোট কন্যাদুটিকে মাথার উপর তুলিয়া তাহারা উপর্যুপরি আছাড় মারিল। তাহারা কিভাবে যে অক্ষতদেহে বাঁচিয়া গেলো কে জানে। প্রাণভয়ে ভক্তদাস স্ত্রীকে লইয়া বড় পুষ্করিণীতে আকণ্ঠ পানিতে ডুবিয়াছিল। দূবৃত্তর দল চলিয়া যাওয়ার সময় পদ্মার মুখে কাপড় চাপা দিয়া তাহাকে হিচড়াইতে হিচড়াইতে লইয়া গেল। জামালুদ্দীন সদলবল স্থান ত্যাগ করিলে ভক্তদাস সস্ত্রীক যখন  গৃহাদির ভস্মরাশির সামনে ফিরিয়া আসিল তখন তপ্ত  ভস্মস্তুপের বাহিরে জীবন্ত গঙ্গা ও চিত্রাকে খুঁজিয়া পাইলেও খানিক পরেই গোয়ালঘরের এককোনে  মৃত পদ্মার ধর্ষিত রক্তাক্ত দেহ তাহাদের নজরে আসে।  জীবিত বা মৃত অমরের কোন খোঁজ তখনই না পাওয়া গেলেও দিন কুড়ি পর  তাহারা চিরকালের মত স্বদেশ ছাড়িয়া আসার আগের দিন কাছেই ঝোপে একটি গলিত বিকৃত শিয়াল কুকুরে খাওয়া  তেরো চোদ্দ বছরের কিশোরের দেহকে স্থানীয় লোকজন অমরের শব বলিয়াই ধরিয়া লয়। ভয়ে আতঙ্কে একমাত্র পুত্রের দেহটি তাহারা স্বামীস্ত্রী আর সনাক্ত করিতে যায় নাই।উদ্বাস্তু ভক্তদাস স্ত্রী ও দুই জীবিত কন্যাসহ সীমান্ত পার হইয়া ভারতবর্ষে পদার্পণ  করার দুদিন আগে পথে একটি মুক্তিবাহিনীর সাক্ষাৎ  পায়।  এইদলে সে যে মুক্তিদলকে আশ্রয় দিয়াছিল তাহাদের জনা তিনেক ছিল। তাহারা তাহাকে একটি বিচিত্র খবর দেয়।  আলবদর জামালুদ্দীন অমরকে প্রাণে মারে নাই। জামালুদ্দীন মূলতঃ সমকামী  বিশেষতঃ অমৃতের মত মিশমিশে কালো কিশোরের মাংসের খুবই ভক্ত ছিল। অমৃতকে সে এরই মধ্যে ইসলামে ধর্মান্তরিত করিয়াছিল।  মূলতঃ আল বদর দলটির লুণ্ঠিত দ্রব্য বহন  এবং শয্যায় জামালুদ্দিনের বিকৃত লালসার শীকার হওয়াই কি ছিল অমরের স্থাযী ভবিতব্য? না! কযদিন পরে এক ভরা দুপুরে জামাল ছায়ায় বসিয়া  অঙ্গাদি অমরকে দিয়া দলনমর্দন করাইতে ছিল। কাছেই পড়িয়াছিল দাড়ি কাটার ধারালো খুরটি । মুহূর্তমধ্যে খুরটি তুলিয়া লইয়া বৈষ্ণব পরিবারের  সন্তান অমর খুরের আড়াআড়ি দুই টানে জামালুদ্দীনের গলা নামাইয়া দিয়া কোথায় পালাইয়া  গেল কি হাওয়ায় মিশিয়া গেল তাহার অদ্যাবধি খোঁজ পাওয়া  যায় নাই।              এসবই সতের বছর  আগের ঘটনা।

অভিজ্ঞ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিয়াছেন সেদিন বয়রা সীমান্তে পেশাদার খুনী পিতা ভক্তদাস আর  বাংলাদেশের পেশাদার খুনী  পুত্র অমর ওরফে আমিরুল মুখোমুখি হইয়াছিল।      
কিন্তু এই ঘটনার চূড়ান্ত নাটকীয়তা উন্মোচন করিবার পূর্বে আমরা বরং জানিয়া  লই “রাতচরা‘’ গোষ্ঠীর নিবেদিত বৈষ্ণব ভক্তদাস কি করিয়া পেশাদার খুনী হইয়া উঠিল।    কি করিয়া তাহারই মত সর্বস্ব খোয়ানো আরো কয়েকটি দলের সহিত সে নানা ঘাটে ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে এই মছলন্দপুরে একটি জবরদখল কলোনীতে এক কাঠা সোয়া ছটাকের বাস্তুভিটায় একটি দর্মার বেড়া খাপরার ছাউনিতে স্ত্রীকন্যাসহ  থিতু হইল সে কথা থাকুক। সেই সময়কার উদ্বাস্তু উপনিবেশ জীবনের কদর্যতার কথাও বরং থাক। মাথার উপর একটি আশ্রয় জুটিয়াছে। যেমনই হোক অপেক্ষাকৃত নিরাপদ একটি গোষ্ঠীভাবাপন্ন জীবন জুঠিয়াছে কিন্তু নিজে এবং তাহার স্ত্রী যদিবা উপবাস করিয়া থাকে রাধামাধবের উদ্দেশ্যে একটি বাতাসা তো তাহারা নিবেদন করিতে হইবে। বাড়ন্ত কন্যাগুলিকে দুটি ভাত তো দিবে অন্ততঃ একবেলা। গ্রাম হইতে চাহিয়া চিন্তিয়া কিছু পেপে,পেয়ারা আমলকি নারিকেল  লইয়া   সে মছলন্দপুর স্টেশন সংলগ্ন চত্বরের এককোনে কাগজ পাতিয়া বসিয়া পড়িল। কিন্তু কেনে কে?কলোনীর লোকেদের এইসব কিনিয়া নষ্ট করিবার মত পয়সা কোথায়? আর পুরনো বাসিন্দারা যাহাদের ক্রয় ক্ষমতা আছে তাহাদের প্রত্যেকেরই বাগানে এই সমস্ত ফলের ফলন্ত  গাছ আছে । তাহার স্ত্রীও গৃহপরিচারিকার  কাজে বহাল হইতে পারিল কই?তখন কলোনীতে কে  কাহাকে বহাল করে? আর যাহারা বহাল করিতে পারে সেই এদেশীয় লোকদের ইহাদের উপর অবিশ্বাস ও বিরক্তি । ঘৃণাও একরকম বলা যায়। পরণের কাপড় শতচ্ছিন্ন ।আব্রু এমনিই আর থাকে না। একদিন তাহার স্ত্রী বলিয়াই ফেলিল,“খানসেনাদের হাতে মরণ হয় নাই। ঐ কচি দুইখান মাইয়ারে বেইচ্যা দি। নয়তো তিনজনেই আন্ধারে গিয়া দাঁড়াই। খানকিগিরি কইরা প্যাডের জ্বালা মিডাই(মিটাই)। আর নয় বাজার থন তুইত্যা (তুতে)লইয়া আহো(আসো)। চাইরো জনেই বিষ খাইয়া মরি। ”        

এই অবস্থায় একদিন একটি অদ্ভূত ঘটনা ঘটিল। কয়দিন ধরিয়াই স্টেশনে  সে যখন ফল লইয়া বিক্রীর চেষ্টায় বসিয়াছিল। একটি অসম্ভব ফর্সা রোগা বেটে লোক স্থিরচোখে তাহাকে নজর করিতে ছিল । সে আগাইয়া আসিলে ভক্তদাস স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে  বলিল,“রাধে রাধে। কি খরিদ করবেন কর্তা?নাইরকেল নেন শ্বাসপুরু।“ তাহাকে বিস্মিত করিয়া লোকটি বলিয়া উঠিল,“ভক্তদাস! এইভাবে তুমি না পারবে বৌ বাচ্চাদের বাঁচাতে না নিজে বাঁচবে। এত বড় চেহারা এই ক্ষিপ্রতা এই খুর চালিয়ে নারকোল ছোলার ক্ষমতা নিয়ে পড়ে  পড়ে  মার খাচ্ছ। মাগ মেয়েদের  পেটে ভাত নেই পাছার  কাপড় ছেঁড়া। আমি তোমার বরিশাল থেকে আজ অবধি সব ইতিহাস না জেনে আসি নি। আমি জহুরী, হীরা চিনি। কাজ আছে করবে?”
কাজ সামান্যই। সোনারপুরে আবাদকাঁদি নামে গ্রামেএকটি সত্তর বছরের বৃদ্ধ সন্ধ্যাবেলায়  মাঠ সারিতে যায়। খুর দিয়া তাহার গলা নামাইয়া দিতে হইবে। অবিশ্বাস্য টাকার পরিমান !তাহার মত  হতদরিদ্র কেন অনেকের কাছেই তাহা মনে হইবে। অর্ধেক অগ্রিম বাকি অর্ধেক কাজ শেষ হইলে। খুন কেন? ভক্তদাসের জানিবার কোন প্রয়োজন নাই। জাত বৈষ্ণব ঘরাণার সন্তান সে প্রথমে শিহরিত হইয়া উঠিলেও খুনটি সে করিল। পরে আজ যখন সতের বছরে তিরিশটির উপর খুন তাহার করা হইয়া গিয়াছে খুব নিস্পৃহ নিরাসক্ত ভঙ্গীতে সে ভাবে ঐ রোগা বেটে অসম্ভব ফর্সালোকটিই তার নিয়তি। লোকটির নাম ঠিকানা আজও সে জানে ন।  বছরে দু একবারই আসে কাজ নিয়া। কোথা হইতে আসে কোথায় মিলাইয়া যায় আজও সে জানে না। জানার দরকারই বা কি?  এক একটি খুনের ইতিহাস এক একরকম। তবে সবই নিখুঁত।ভক্তদাস আজ পেপে নারিকেলের বিক্রেতার  আড়ালে অত্যন্ত  তুখোড় পেশাদার খুনী । বাস্তব  প্রায়ই কল্পনা অপেক্ষাও বিচিত্র

হ্যা,বাস্তব  কল্পনা  অপেক্ষা প্রায়ই বিচিত্র ।  না হইলে পিতা ভক্তদাস  আর পুত্র আমিরুল ওরফে অমর দুই জাত পেশাদার খুনী পরস্পরের মুখোমুখি কি করিয়া  হইল? এক্ষনে আমরা আর একবার বয়রা সীমান্তে ফিরিয়া  যাই।      আমিরুল ও কি জানিত সে ভারতের মাটিতে পা দেওয়া মাত্রই খুন হইতে পারে না কি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বার্তায় সে  খুর বাগাইয়া ধরিয়াছিল? তবে? তবে? কে খুন হইল? পিতা ভক্তদাস না পুত্র অমর? আসলে পিতা সতের বছর পরেও পুত্রকে পূর্ণিমার আলোয় চিনিতে ভূল করে নাই। সে অন্ধকারেও দেখিতে পাইতো। পাইযাছিলও। পুত্রের গাত্র হইতে স্নেহের গন্ধও কি পিতার নাকে প্রবেশ করে নাই? ঐ তন্মুহূর্তের আবেগে সে পুত্রের নাম ধরিয়া ডাকিয়াছিল,‘‘অমর!অমর! বাপ! বাপ!” কিন্তু মুহুর্তের সুযোগ অমরের  মত পেশাদার হাতছাড়া করে নাই।তাহার হাতের খুরে ভক্তদাসের গলার নলি ততক্ষনে ফাঁক হইয়া গিয়াছে। রক্তস্রোতের  মধ্য দিয়া বাতাস ঢুকিয়া যাহা আওয়াজ হইয়া বাহির হইয়া অমরের কর্ণে প্রবেশ করিল তাহা এইরূপ,‘‘ঢক্  ঢক্  ঢক্ ব্লা ব্লা ব্লা ব্লগ ব্লগ ব্লগ মর (অমর) মর (অমর) বাপ বাপ। ” আর অমর  উত্তর দিয়াছিল,‘‘  মরবি তো বটেই। আমার বাপও এই সময আমাকে বাপ ডাকিত ছেলেও ডাকিত।”      

সতের বছরের চেষ্টায সে মাবাপের মছলন্দপুরের ঠিকানা জোগাড় করিযাছে।কাল যাইবে বলিযাও ঠিক করিযাছে। বাবার সহিত তাহার শেষ দেখা হইযাছিল বাবাকে খুন করিযা কবরস্থও করিযাছে সে  তাহা জানিতেও পারিবে না।
___________________________________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী 

No comments:

Post a Comment