" তেতো কথাটা আগেভাগে সেরে নিতে চাই। আমার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে হলে আমার ধর্ম গ্রহণ করতে হবে এবং সেইমত সমস্ত আচরণ করতে হবে। আমার গরীবের ঘরে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে। বড়লোক বাবার কাছ থেকে কানাকড়িটিও নেওয়া চলবে না। "
এক বছর আগে প্রোপোজ ডে তে রাজন্যার প্রেম নিবেদনের উত্তরে ঘাড় শক্ত করে বলেছিল বসির।
রাজন্যা তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল। রোজ ডে র গভীর রাতে পানশালা থেকে একা বাড়ি ফেরার পথে দুই মাতালের খপ্পর থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে রাজন্যার সম্মান রক্ষা করেছিল যে অটোওয়ালা,সেই বসির আহমেদকেই সমস্ত মন সঁপেছিল সে। এক কাপড়ে বাবার আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসে মসজিদে কলমা পড়ে পরভিন সুলতানা হওয়ার পর সেখানেই কাজীর কাছে নিকাহ পড়ে বসিরের সঙ্গে তার বস্তিবাড়ির ভাঙাচোরা ঘরে এসে উঠেছিল। ভ্যালেন্টাইনস ডে র সন্ধ্যায়।
এখানে জীবনযাপনে আগের মত আরাম নেই। নেই আগের বন্ধুবান্ধব। নেই ছুতোনাতায় হরেক উদযাপনের বাহানা। মেয়েমানুষের ঘরের চৌহদ্দির বাইরে পা দেওয়া মানা।এখানে জীবনযাপন খুব কঠোর। ডিজাইনার ড্রেস এখানে চলে না। দু চোখ ছাড়া আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢেকে রাখতে হয়। কাজের মাসি, রান্নার লোক এখানে অলীক স্বপ্ন। সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের হাতে।
এক বছরে অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে রাজন্যার। মানুষটা মোটের ওপর ভালোই। যথেষ্ট গোছানো আর সংসারী। স্বল্প আয়ে সংসার ভালোই চালায়। মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হয় না।
আজ আর একটা ভ্যালেন্টাইনস ডে। ঘরের সামনে রাস্তায় সরকারী জলের কলে বাসন মাজতে মাজতে উদাস হয়ে পড়ল রাজন্যা। আগের বছরগুলোয় সুন্দরী রাজন্যার কৃপাপ্রার্থী যুবকদের দেওয়া উপহারের স্তুপ হয়ে যেত। চকলেট, টেডি, এমনতর গুচ্ছের হাবিজাবি। রাজন্যা ফিরেও তাকাতো না। বিলিয়ে দিত কাজের আর রান্নার মাসির মেয়েদের। এ বছর ও ওর ভালোবাসার মানুষ হয়ত পেয়েছ। কিন্তু সে মানুষ এতই কেজো যে বিশেষ দিনে প্রিয়জনকে উপহার দেওয়াকে হয়ত পাগলামি বলে মনে করে। শুকনো মুখে বাসনের পাঁজা নিয়ে ভিজে কলতলা থেকে জল পায়ে ঘরের দিকে এগোয় রাজন্যা।
" পরভীন এক মিনিট ঘরে এসো। খুব জরুরী কথা আছে।" অটোটা সাইড করে বলল বসির।
এমন অসময়ে ঘরে আসে না সে। কি ব্যাপার! রাজন্যা পড়ি কি মরি করে ঘরে এল।
" এগুলো পায়ে দিয়ে দেখো তো সাইজ ঠিক আছে কি না।"
প্যাকেট থেকে দু জোড়া হাওয়াই চটি বের করে বলল বসির।
" হঠাৎ!" অবাক গলায় জানতে চাইল রাজন্যা।
" হঠাৎ কেন হবে? আজ তো ভ্যালেনটাইনস ডে। আমাদের লাইনের সবাই যে যার মানুষের জন্য গিফট কিনছে।" খুশি খুশি গলায় বলল বসির।
"বিয়ের আগে শোওয়ার ঘরেও পায়ে চটি গলিয়ে থাকতে, বলছিলে সে দিন। পা দুটো তোমার চট করে ঠান্ডা হয়ে যায়। এখানে তো জলে জলে কত কাজ করতে হয়। ঘরের মাটির মেঝে থেকেও ঠান্ডা ওঠে। তাই তোমার জন্য এই চটি দু জোড়া কিনলাম। একটা ঘরের, একটা বাইরের জন্য। কথাটা আগে জানলে আরও আগেই দিতে পারতাম। যাক গে। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে। আমি চললাম অটোস্ট্যান্ডের লাইনে।"
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই অটোয় স্টার্ট দিয়ে চোখের নিমেষে ধাঁ হয়ে গেল বসির।
_____________________________
© শর্মিষ্ঠা নাহা
No comments:
Post a Comment