'অভিমান' এক ধরনের রোগ। মুলত প্রিয় মানুষগুলো এই রোগে ভোগে বেশী।
টেবিলের উপর অস্থির ভাবে ফোনটা বেজেই যাচ্ছে।ফোনের অন্য প্রান্তে অহনা মারাত্মক খেপে আছে এটা বেশ বুঝতে পারছি।
যদিও টোং দোকানের ঘুন পোকায় কাটা টেবিল চেয়ার সর্বস্য, ফোকলা পান খাওয়া বুড়ো হোমিও ডাক্তারের নড়বড়ে দাঁতের মতোই আমার কাছে ট্যালিপ্যাথি থিওরির গ্রহণযোগ্যতা।
আপন মানুষগুলোর মনের অবস্থা বুঝতে কোনো প্যাথির দরকার হয় না।তাদের মন হয় খোলা বইয়ের মতো ।এই বই লক্ষ কোটিবার পড়ার পরেও পুরনো হয় না। খেই হারিয়ে ফেলার ভয়ে পৃষ্ঠা মুড়ে রাখার প্রয়োজনো পড়ে না।রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছের মতো প্রাঞ্জল সেই বইয়ের ভাষা।ধর্ম গ্রন্থের মতো পাঠ বিরতিতে যা রেখে দিতে হয় সবচেয়ে পবিত্র সবচেয়ে উঁচু জায়গাটাতে।
অহনার গত সাতদিনের করা প্ল্যান আজ আবারো আমি নষ্ট করে ফেলেছি।শেষ তার সাথে আমার বুধবার বিকেলে ছবির হাটে দেখা করার কথা ছিল।ওই দিন আমাদের কি যেন একটা বিশেষ দিবস ছিল। যে দিবসের মধ্যবিকেলে অহনাকে আমার ফুচকা মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে চার লাইন জীবনান্দ দাশ আবৃত্তি করার নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হলে তার আয়ু দশ বছর কাটা যাবে বলে তার বিশ্বাস।
এই রকম আমাদের আরো বেশ কয়েকটা একান্ত ব্যক্তিগত দিবস আছে, যা শুধুমাত্র আমাদের দুজনকে একত্রে উদযাপন করার জন্যই ঈশ্বর নিয়ম করে দিয়েছে।
সেদিন বিকেলে আমি ঠিক সময় পৌঁছাতে পারিনি।রাত একটায় আমি ছবির হাটের প্রতি ইঞ্চিতে অহনাকে খুঁজেছিলাম।আমি জানি বুকপোড়া হাহাকার নিয়ে সেদিন অহনা আরও অনেকটা সময় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেছে।আমি রিসিভ করবো না জেনেও বারবার আমাকে ফোন করেছে।অবশেষে এক সমুদ্র চোখের জলে ছবির হাট ভাসিয়ে অহনা ফিরে গিয়েছিলো। কেউ সেদিন তার চোখের পানি দেখতে পায়নি। কোনো ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলে ২ টাকার নোটের সাথে তার মুখে চাঁদ পোড়ানো হাসিটাই দেখেছিলো সেদিন।কিন্তু আমিই জানি, কি প্রলয়ঙ্কর অশ্রুধারা ছিলো ওই দুই চোখে।যার সামনে দাঁড়ানোর মতো কোনো বাঁধ পৃথিবীতে তৈরী হবে না কখনো ।
-এই শুনছো?
-হুম
-হুম মানে কি?
-হুম মানে "অহনা আমি শুধুই তোমাকে শুনছি,আজ আমি আর কোনো কিছু শুনবো না,তুমি বলবে আর আমি শুনবো,বাইরের পৃথিবীর হাজার সূর্য তোমার চুলের গন্ধ না পাবার আক্ষেপ নিয়ে প্রতি সন্ধায় ডুবে মরবে যমুনার বুকে।আকাশে থালার মত চাঁদ উঠবে তোমার পা ভিজিয়ে দিতে। তোমার ব্যালকনীর কোনায়...এথায়...ওথায়...পড়ে থাকবে জোছনার ফুল।"
-.....
-অহনা...?
-হুম..
-শুনছো?
-হুম
-বুধবার বিকেলে তুমি তোমার নীল রঙের শাড়িটা পরবে।আর চোখে একটু কাজল ।
-আর তুমি?
-আমিও হলুদ একটা পাঞ্জাবি কিনে ফেলবো । হুড খোলা রিক্সায় গা ঘেঁষাঘেঁষি বসে ঝগড়া করবো পুরো বিকেল।
-হাহা...বাংলা সিনেমা?
-হ্যাঁ,বাংলা সিনেমার মত দুটো লাল গোলাপের ঠোকাঠুকি হবে খুউব।
রাত বাড়ে। বাড়ে অস্থিরতা।বাড়তে থাকে ফোন স্ক্রীনের উপর ভেসে ওঠা অহনার দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যাও।
-এক্সকিউজ মি
আমি ডক্টরের দিকে তাকাই
-জি?
-আপনি পেশেন্টের কে হন?
-আমি ওর বন্ধু
-উনার ফ্যামিলির কেউ কি এখানে আছেন?
-ওর ফ্যামিলির কেউই এই পৃথিবীতে নেই
-সরি,আসলে উনার কন্ডিশন খুবই সিরিয়াস। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছি।কিন্তু ইঞ্জুরিটা খুব বাজে।লরির ধাক্কাটা সরাসরি বুকে লেগেছে।ভেতরটা একেবারেই থেঁতলে গেছে।আপনাকে সব সিচুয়েশনের জন্যই তৈরী থাকতে হবে।
আমি শুধু ডক্টরে দিকে চেয়ে থাকি।বুকের ভেতর থেকে কি যেন একটা উঠে এসে গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকে।এই অনুভূতির সাথে আমার খুব ছোট বেলায় পরিচয় হয়েছিলো।এমনি খা খা করা পূর্ণিমার এক রাতে বাবা যখন দুম করে আমাকে রেখে চলে গিয়েছিলো, সেইরাতে।
বিছানায় নিথর শুয়ে থাকা বাবাকে দেখে এমনি ভাবেই দলা পাকিয়ে উঠেছিলো গলার কাছে।এহসান সেদিন আমাকে ওর বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো।আমার বন্ধু এহসানের ছোট্ট হাত দুটির শক্ত বাঁধন আমাকে গলার কাছে পাকিয়ে ওঠা ওই জমাট বাঁধা তীব্র জলোচ্ছ্বাসের সাথে আমাকে ভেসে যেতে দেয়নি। কেউ আমার চোখে একফোঁটা জল দেখেনি।সবাই ভেবেছিলো আমি হয়তো পাগল হয়ে গেছি।
আই.সি.ইউ বেডে হাজার রকমের তার শরীরে গেঁথে এহসান পরে আছে।বুকটা হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠছে।প্রতিটা বাতাস টেনে নিতে কি ভীষন কষ্টই না হচ্ছে ওর।এক একটা নিঃশ্বাসের সাথে মুখে লাগানো পাইপটা দিয়ে ছলকে ছলকে রক্ত বেড়িয়ে যাচ্ছে ওর বুক থেকে।আমার বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর কখনো একসাথে সিগারেট ভাগ করে খাওয়া হবে না ওর সাথে।মন খারাপের দিন গুলোতে কিংবা একটুকরো খুশীর প্রহরে দরজায় কলিংবেল বাজিয়ে কেউ এসে বলবেনা ," ল মামা উড়াল দেই....",বুকের মদ্ধে থেকে উথলে আসা দলা গলার কাছে আসলে কেউ শক্ত করে বুকের মধ্যে নিয়ে বলবে না " কিচ্ছু হবে না দোস্ত,আমি তো আছি,আমি আছি না?"
আমি এহসানের কাছ থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।
আকাশ ভরা জোৎস্না খাঁ খাঁ করে শহর পুড়িয়ে দিচ্ছে।প্রকৃতি বোধয় আমাকে এতো শক্ত ভাবে তৈরী করে নি আমি তরল জোৎস্না গায়ে মেখে হেঁটে চলেছি।চোখের পানি জোৎস্নায় ভিজে একাকার হয়ে যাওয়াতে কেউ বুঝতে পারছে না যে আমি কাঁদছি।
হ্যা তাইতো আমি কাঁদছি...জোৎস্নায় ভিজে কাঁদছি...
____________________________
© মোহাম্মাদ সামি
টেবিলের উপর অস্থির ভাবে ফোনটা বেজেই যাচ্ছে।ফোনের অন্য প্রান্তে অহনা মারাত্মক খেপে আছে এটা বেশ বুঝতে পারছি।
যদিও টোং দোকানের ঘুন পোকায় কাটা টেবিল চেয়ার সর্বস্য, ফোকলা পান খাওয়া বুড়ো হোমিও ডাক্তারের নড়বড়ে দাঁতের মতোই আমার কাছে ট্যালিপ্যাথি থিওরির গ্রহণযোগ্যতা।
আপন মানুষগুলোর মনের অবস্থা বুঝতে কোনো প্যাথির দরকার হয় না।তাদের মন হয় খোলা বইয়ের মতো ।এই বই লক্ষ কোটিবার পড়ার পরেও পুরনো হয় না। খেই হারিয়ে ফেলার ভয়ে পৃষ্ঠা মুড়ে রাখার প্রয়োজনো পড়ে না।রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছের মতো প্রাঞ্জল সেই বইয়ের ভাষা।ধর্ম গ্রন্থের মতো পাঠ বিরতিতে যা রেখে দিতে হয় সবচেয়ে পবিত্র সবচেয়ে উঁচু জায়গাটাতে।
অহনার গত সাতদিনের করা প্ল্যান আজ আবারো আমি নষ্ট করে ফেলেছি।শেষ তার সাথে আমার বুধবার বিকেলে ছবির হাটে দেখা করার কথা ছিল।ওই দিন আমাদের কি যেন একটা বিশেষ দিবস ছিল। যে দিবসের মধ্যবিকেলে অহনাকে আমার ফুচকা মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে চার লাইন জীবনান্দ দাশ আবৃত্তি করার নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হলে তার আয়ু দশ বছর কাটা যাবে বলে তার বিশ্বাস।
এই রকম আমাদের আরো বেশ কয়েকটা একান্ত ব্যক্তিগত দিবস আছে, যা শুধুমাত্র আমাদের দুজনকে একত্রে উদযাপন করার জন্যই ঈশ্বর নিয়ম করে দিয়েছে।
সেদিন বিকেলে আমি ঠিক সময় পৌঁছাতে পারিনি।রাত একটায় আমি ছবির হাটের প্রতি ইঞ্চিতে অহনাকে খুঁজেছিলাম।আমি জানি বুকপোড়া হাহাকার নিয়ে সেদিন অহনা আরও অনেকটা সময় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেছে।আমি রিসিভ করবো না জেনেও বারবার আমাকে ফোন করেছে।অবশেষে এক সমুদ্র চোখের জলে ছবির হাট ভাসিয়ে অহনা ফিরে গিয়েছিলো। কেউ সেদিন তার চোখের পানি দেখতে পায়নি। কোনো ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলে ২ টাকার নোটের সাথে তার মুখে চাঁদ পোড়ানো হাসিটাই দেখেছিলো সেদিন।কিন্তু আমিই জানি, কি প্রলয়ঙ্কর অশ্রুধারা ছিলো ওই দুই চোখে।যার সামনে দাঁড়ানোর মতো কোনো বাঁধ পৃথিবীতে তৈরী হবে না কখনো ।
-এই শুনছো?
-হুম
-হুম মানে কি?
-হুম মানে "অহনা আমি শুধুই তোমাকে শুনছি,আজ আমি আর কোনো কিছু শুনবো না,তুমি বলবে আর আমি শুনবো,বাইরের পৃথিবীর হাজার সূর্য তোমার চুলের গন্ধ না পাবার আক্ষেপ নিয়ে প্রতি সন্ধায় ডুবে মরবে যমুনার বুকে।আকাশে থালার মত চাঁদ উঠবে তোমার পা ভিজিয়ে দিতে। তোমার ব্যালকনীর কোনায়...এথায়...ওথায়...পড়ে থাকবে জোছনার ফুল।"
-.....
-অহনা...?
-হুম..
-শুনছো?
-হুম
-বুধবার বিকেলে তুমি তোমার নীল রঙের শাড়িটা পরবে।আর চোখে একটু কাজল ।
-আর তুমি?
-আমিও হলুদ একটা পাঞ্জাবি কিনে ফেলবো । হুড খোলা রিক্সায় গা ঘেঁষাঘেঁষি বসে ঝগড়া করবো পুরো বিকেল।
-হাহা...বাংলা সিনেমা?
-হ্যাঁ,বাংলা সিনেমার মত দুটো লাল গোলাপের ঠোকাঠুকি হবে খুউব।
রাত বাড়ে। বাড়ে অস্থিরতা।বাড়তে থাকে ফোন স্ক্রীনের উপর ভেসে ওঠা অহনার দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যাও।
-এক্সকিউজ মি
আমি ডক্টরের দিকে তাকাই
-জি?
-আপনি পেশেন্টের কে হন?
-আমি ওর বন্ধু
-উনার ফ্যামিলির কেউ কি এখানে আছেন?
-ওর ফ্যামিলির কেউই এই পৃথিবীতে নেই
-সরি,আসলে উনার কন্ডিশন খুবই সিরিয়াস। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছি।কিন্তু ইঞ্জুরিটা খুব বাজে।লরির ধাক্কাটা সরাসরি বুকে লেগেছে।ভেতরটা একেবারেই থেঁতলে গেছে।আপনাকে সব সিচুয়েশনের জন্যই তৈরী থাকতে হবে।
আমি শুধু ডক্টরে দিকে চেয়ে থাকি।বুকের ভেতর থেকে কি যেন একটা উঠে এসে গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকে।এই অনুভূতির সাথে আমার খুব ছোট বেলায় পরিচয় হয়েছিলো।এমনি খা খা করা পূর্ণিমার এক রাতে বাবা যখন দুম করে আমাকে রেখে চলে গিয়েছিলো, সেইরাতে।
বিছানায় নিথর শুয়ে থাকা বাবাকে দেখে এমনি ভাবেই দলা পাকিয়ে উঠেছিলো গলার কাছে।এহসান সেদিন আমাকে ওর বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো।আমার বন্ধু এহসানের ছোট্ট হাত দুটির শক্ত বাঁধন আমাকে গলার কাছে পাকিয়ে ওঠা ওই জমাট বাঁধা তীব্র জলোচ্ছ্বাসের সাথে আমাকে ভেসে যেতে দেয়নি। কেউ আমার চোখে একফোঁটা জল দেখেনি।সবাই ভেবেছিলো আমি হয়তো পাগল হয়ে গেছি।
আই.সি.ইউ বেডে হাজার রকমের তার শরীরে গেঁথে এহসান পরে আছে।বুকটা হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠছে।প্রতিটা বাতাস টেনে নিতে কি ভীষন কষ্টই না হচ্ছে ওর।এক একটা নিঃশ্বাসের সাথে মুখে লাগানো পাইপটা দিয়ে ছলকে ছলকে রক্ত বেড়িয়ে যাচ্ছে ওর বুক থেকে।আমার বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর কখনো একসাথে সিগারেট ভাগ করে খাওয়া হবে না ওর সাথে।মন খারাপের দিন গুলোতে কিংবা একটুকরো খুশীর প্রহরে দরজায় কলিংবেল বাজিয়ে কেউ এসে বলবেনা ," ল মামা উড়াল দেই....",বুকের মদ্ধে থেকে উথলে আসা দলা গলার কাছে আসলে কেউ শক্ত করে বুকের মধ্যে নিয়ে বলবে না " কিচ্ছু হবে না দোস্ত,আমি তো আছি,আমি আছি না?"
আমি এহসানের কাছ থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে গেলাম।
আকাশ ভরা জোৎস্না খাঁ খাঁ করে শহর পুড়িয়ে দিচ্ছে।প্রকৃতি বোধয় আমাকে এতো শক্ত ভাবে তৈরী করে নি আমি তরল জোৎস্না গায়ে মেখে হেঁটে চলেছি।চোখের পানি জোৎস্নায় ভিজে একাকার হয়ে যাওয়াতে কেউ বুঝতে পারছে না যে আমি কাঁদছি।
হ্যা তাইতো আমি কাঁদছি...জোৎস্নায় ভিজে কাঁদছি...
____________________________
© মোহাম্মাদ সামি
No comments:
Post a Comment