(১)
স্টেশনে আজ খুব ভিড়।শুধু স্টেশন কেন আজ পার্কে,মাঠে,রেস্তোরায়,ক্যাফেতে এমনকি গাছের আড়ালেও খুব ভিড়।আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে।রবি বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে দেখছিল সমবেত প্রেম পিপাসুদের।বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ উৎসবের আবহাওয়া।ক্লাস জমেনি তেমন।এখন রবি ফিরছে,স্টেশনে এসেও দেখছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মা তার পিছু ছাড়ে নি।আচ্ছা,ভালোবাসাকে কি ঘন্টা মিনিটের বন্ধনে আবদ্ধ করা যায়?উদযাপন করা যায় ভালোবাসার সাত রংকে একদিনের উন্মাদনায়?তাহলে সব লোক কেন এই সমবেত পাগলামিতে অংশগ্রহণ করছে সানন্দে?রবি আনমনা হয়ে ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকাল।কনে দেখা আলোয় ভরে গেছে চারিদিক।অনেকদিন পর এমন হলুদ আলোর বর্ণচ্ছটা আকাশ জুড়ে।কুঁচকানো ভুরু আপনাআপনি সোজা হয়ে যাচ্ছিল রবির,ঠোঁটের রেখা বক্রতা পাচ্ছিল একটু একটু করে।এমন সময় চোখ পড়ল নাড়ুদার চায়ের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার উপর।মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে,পরণে সাধারণ সালোয়ার কামিজ,চুল গুলো হালকা ভাবে মুখের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে নাকের ডগার উপর।নামেই ফেব্রুয়ারি মাস, গরম বেশ।একটি সাধারণ মুখ,কিন্তু আজকের হলুদ বিকালের মাদকতাময় কনে খোঁজা আলো মেয়েটির মুখের উপর বুলিয়ে গেছে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের জাদুতুলি।
ভিতরে ভিতরে একটা অচেনা আবেগে ভরে উঠছিল রবি।এটা কি হচ্ছে?ওই অচেনা মেয়েটাকে কেন এত ভালো লাগছে?একটা অসহ্য ভালোলাগা দমবন্ধ করে দিচ্ছে তার।কে মেয়েটা?
ট্রেন এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে।রবির পা উঠল না।মেয়েটি ট্রেনের ভিড়ে মিলিয়ে গেল।স্টেশনের ৩ নং প্ল্যাটফর্মে বিকেল পাঁচটা বেজে তিন মিনিটে রবি বুঝল প্রেমের প্রথম মানে।অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল রবি,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।"
(২)
প্রিয়া মার্কেটের ৫ নং স্টলে এসেছে এক গোছা লাল টকটকে গোলাপ কেনার উদ্দেশ্যে।পুরো দোকানটাই আজ লাল রঙে সেজেছে।থরে থরে লাল গোলাপ রাখা।দোকানে ভিড়ও খুব।তার মধ্যেই নিজের চাহিদার কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল প্রিয়া।এক গোছা লাল গোলাপ দিয়ে একটা তোড়া বেঁধে দিতে হবে তাকে,তার অনিন্দ্যর জন্য।দোকানদার যখন গোলাপ সাজাচ্ছে বোকেতে তখন প্রিয়ার চোখ ঘুরছিল দোকানে সাজিয়ে রাখা ছোট্ট ছোট্ট ভালোবাসার কুঁড়ি গুলোর উপর। হঠাৎ দোকানের কোণে একটা ঝুড়িতে রাখা কিছু অবহেলিত সাদা গোলাপের উপর তার চোখ পড়ল।প্রিয়া বলে উঠল,"আর ওই সাদা গোলাপের ও একটা বোকে দেবেন।"
একটু পর যখন প্রিয়া বেরিয়ে এল দোকান থেকে তখন তার দুহাতে লাল সাদা রং হাসছে।আজ অনির ভালোবাসার রঙে মায়ের স্নেহের রং ও মিশে যাবে এমনভাবে প্রিয়া একটু আগেও ভাবতে পারেনি।আজ তার দুজন ভ্যালেন্টাইন।মায়ের মুখের অবাক হাসিটা কত মধুর হবে ভেবে আনন্দে চোখে জল এসে গেল তার।আকাশে মুখ তুলে প্রিয়া সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ধন্যবাদ দিল,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে মা।"
(৩)
সমীর আজ ছটা একুশের লোকালটা মিস করল একটুর জন্য।যাহ, অনেকটা দেরি হয়ে যাবে আজ।প্রেসেন্টেশনটা খুব ভালো হয়নি আজ।বসের কাছে কথা শুনতে হয়েছে।তার উপর ট্রেন মিস।আজ রোমিতা কথা শোনাবে।রোমিতার মাসির মেয়ের বিয়ে আজ।পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।বেজার মুখে স্টেশনের গেটের পাশে রাখা ঠেলাগাড়িটার দিকে তাকাল সে,ভ্রাম্যমান ভ্যালেন্টাইন গিফট এর পসরা।কি ভেবে সেদিকে এগিয়ে গেল সমীর।পাঁচ বছরের একসাথে থাকাটা বড্ড রোজকার ডালভাত হয়ে গেছে।আজ রাতে শোয়ার সময় একটা লাল গোলাপ যখন রোমিতা নিজের বালিশের উপর দেখবে ,তখন এক মুহূর্তের জন্যও কি সেই ফুলশয্যার রাতের সলজ্জ অনুরাগের প্রতিচ্ছবি তার মুখে ফুটে উঠবে না!
তখন না হয় সমীর গাঢ়স্বরে রোমিতার কানে কানে বলবে,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।"
(৪)
আজ রায়বাড়িতে রীতিমত হৈচৈ লেগেছে।ছেলে মেয়ে সবার ঘরের নাতি নাতনিরা আজ দাদু বাড়িতে জমায়েত করেছে।তারা আজ তাদের গ্র্যান্ড পেরেন্টদের ভালোবাসা সেলিব্রেট করতে চায়।এমনিতে ফাঁকা পড়ে থাকা নিঝুম পুরী আজ কোন জাদুবলে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে রাজপুত্তুর রাজকন্যাদের কলকাকলিতে।রায়বাবুও নাটিনাত্নীদের ছেলেমানুষিতে সমান অংশীদার।ঠিক বিকেলে গোধূলি লগ্নে তাদের বিয়ে হয়েছিল তাই সেই সময়টাই উৎসবের সময় হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।শাড়ি গয়নায় সাজিয়ে রায়গিন্নিকে নিয়ে আসা হল আসরে।ধুতি চাদরে শোভিত রায়বাবু হাঁটু গেড়ে বসে গিন্নিকে প্রপোজ করলেন।রায়গিন্নি হেসে চোখ উল্টে মুখ ঝামটে বলে উঠলেন,"মরণ!"
নাতি নাত্নীররা হৈ হৈ করে হল্লা শুরু করল।সবার মাঝে দুই গোধূলির চোখ মিলল।পঞ্চাশটা বছর কেটে গেছে একসাথে,তারা একে অন্যের ভ্যালেন্টাইন।ভালোবাসা দিনের অপেক্ষা করে না তারা জানেন।আজ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তাদের এই ছোট ছোট ভ্যালেন্টাইনদের সাথে দিন কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।বুড়ো বুড়ি মহা খুশি আজ।তারাও নাতি নাতনিদের সাথে গলা মিলিয়ে বলে ওঠেন ফুর্তিতে,"উইশ ইউ অল হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।।"
_____________________________
© সুদীপা কুন্ডু
No comments:
Post a Comment