(১)
----পরানদা ও পরানদা--- শোনো--বিকেলে একটু সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তোমার রিক্সাটা চাই।
----আচ্চা দীপদাদা তুমার গরে টিক পাঁচডার সময় পইচে যাবো।
----না না, ঘরে এসো না। আমি এই মোড়ের মাথাতেই দাঁড়াবো। তুমি থেকো।
----আচ্চা তাই হবে গো
----আর শোনো, ওই প্লাস্টিকের ঢাকনাটা রেখো কিন্তু যেটা বর্ষায় লাগাও।
----এঁজ্ঞে, রাকবো গো
ঠিক পাঁচটার মধ্যে পরান রিক্সা নিয়ে হাজির হয়ে গেল পাড়ার মোড়ে। দীপদাদাটা অনেক সময়ই তাকে সাহায্য করে টাকা পয়সা ধার দিয়ে। তাই ওর কথা কাটতে পারেনা পরান। পৌনে ছটা নাগাদ দীপ এল।
----শোনো পরানদা এমন কোন রাস্তা আছে যেখানে লোকজন একটু কম থাকে, মানে সন্ধ্যের দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকা থাকে আর কি; জানো?
---এঁজ্ঞে দীপদাদা ওই ডাগদারদের পাড়াডার পেচন দিগটা সনদেবেলা এগদম ফাঁকা থাকে গো
----বা বা, বেশ বেশ, ওদিকটাতেই চলো। শোনো তার আগে আরেকজনকে তুলব চলো।
পরান রিক্সা ছোটালো। দুটো পাড়া পরেই রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিলো স্নিগ্ধা। তাকে দেখেই দীপ বলল,----পরানদা দাঁড়াও।
হাতের ইশারায় স্নিগ্ধাকে ডেকে রিক্সায় উঠিয়ে নিল দীপ। পরান আবার রিক্সা ছোটালো।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ডক্টরস কলোনিটা ফাঁকা থাকে বলেছিল বটে পরান কিন্তু এতটা ফাঁকা হবে দীপ ভাবতে পারেনি। হালকা শীতের আমেজ এখনো রয়েছে। তাই প্রতিটা বাড়িরই দরজা জানালা সব বন্ধ। দেখে খুব খুশি হয়ে গেল দীপ। বাহ্! মোক্ষম জায়গা বাতলেছে পরানটা! রিক্সাটা ধীরে চালাতে বলে প্লাস্টিকের ঝাঁপটা নামিয়ে দিল দীপ। জামার ভেতর থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে স্নিগ্ধাকে দিয়ে বলল,----হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।
----তোমাকেও -----বলে স্নিগ্ধা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে দীপকে দিল। দীপ চকলেট সমেত স্নিগ্ধার হাতটা ধরে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে ওর ঠোঁটে ডুব দিলো।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে পরান টুকটুক করে শুধু দুটো পাড়ার মধ্যেই রিক্সাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দীপ ঝাঁপটা তুলে বলল,-----পরানদা এবার বাড়ির দিকে চলো।
স্নিগ্ধাকে নামিয়ে পাড়ায় ঢুকতে গিয়ে দীপ হঠাৎ বলে উঠল,------একটু দাঁড়াওতো পরানদা। এই মৌ, মৌ, এখানে কি করছিস?
----তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি দীপদা।----হাতে একটা প্লাস্টিকের থলে নিয়ে সবুজ শালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েটা রিক্সার কাছে এগিয়ে এল।
----আমার জন্য? কেনো রে? কিছু দরকার আছে?
----আমার তোমার সঙ্গে কটা কথা ছিল দীপদা।
----তা বল না
----এখানে? একটু অন্য কোথাও যাওয়া যায় না? মানে একটু নিরিবিলি....
----অন্য কোথাও? আচ্ছা, আয়, উঠে আয় রিক্সায়। পরানদা----
----এঁজ্ঞে দীপদাদা ---
পরান আবার রিক্সাটা ঘুরিয়ে ডক্টরস কলোনির দিকে চলল। এতক্ষণ ধরে একটানা রিক্সা চালিয়ে খুবই হাঁপিয়ে গেছে সে। পেটের ব্যাথাটাও চিনচিন করে বাড়ছে। তবু দীপের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না।
ডক্টরস কলোনিতে ঢুকে দীপ বলল,----বল, কি বলবি বলছিলি?
----বলছি, আগে এটা নাও---- বলে মৌ প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একটা লাল গোলাপের তোড়া বের করে দীপের হাতে দিলো।
----এটা কি?
----আচ্ছা দীপদা, তুমি কি কোনদিন বুঝতে পারোনি আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি?
----কি বলছিস?
----হ্যাঁ গো! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো তোমাকে ছাড়া!
----তুই আগে কেনো বলিস নি রে যে আমাকে এত ভালোবাসিস?
----এখন তো বললাম, এখন আমাকে তোমার করে নাও।-----বলে হাতদুটো বাড়িয়ে দিল মৌ।
দীপ সেই হাত ধরে মৌ কে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো।
অন্ধকার রাস্তাটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল পরান। আর টানতে পারছে না রিক্সাটা।দীপদাদা নিশ্চয় বকবে এই ভেবে পেছন ফিরে তাকাতেই থ হয়ে গেল। মৌকে কোলে বসিয়ে গভীর চুম্বনে ব্যস্ত দীপ। তার একটা হাত মৌ কে পেঁচিয়ে ধরে রয়েছে; আর একটা হাত চলে গেছে ওর বুকে। আগেরবার তবু ঝাঁপটা টেনে দিয়েছিল। এবারে সেই সবুরটুকুও সয় নি। পরান ধীরে ধীরে রিক্সা থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
মিনিট পনেরো পরে দীপ ডেকে বলল,----পরানদা, এবার চলো।
পাড়ার মোড়ে মৌকে নামিয়ে দেওয়ার পর পরান জিগ্গেস করল,----আচ্চা দীপদাদা, তবে কি ওই আগের দিদিমণিট তুমার বৌ হবেক নাই?
----কি বললি? রিক্সা থামা, থামা বলছি!----রেগে লাল হয়ে গেল দীপ -----শালা ছোটলোক! দুটো ভালো করে কথা বলেছি তো মাথায় চাপতে চাইছে! এই নে তোর টাকা। ভাগ শালা!-----বলে দীপ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে পরানের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল। পরান কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে টাকাটা কুড়িয়ে পকেটে পুরল। রিক্সাটা ঘোরাতে গিয়ে দেখল লাল গোলাপের তোড়াটা রাগের মাথায় দীপ রিক্সাতেই ফেলে গেছে। অত সুন্দর অতগুলো ফুল ফেলে দিতে মন চাইল না। সিটের নিচে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখল। ফুলিটাকে দিলে খুশি হয়ে যাবে। আর আজকে ভাড়া চালাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। পেটের ব্যাথাটাও বেড়েই চলেছে।
(২)
এই সকালবেলাটায় ফুলির খুব তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। ভোর থেকে উঠে অবধি ঘর, বাসন, কাপড়; তারপর চান করে রান্না বসায়। তারপর ছেলেদুটোকে ঘুম থেকে টেনে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করা। ছেলেদুটো যতক্ষণে বইখাতা গুছাতে থাকে ততক্ষণে চাট্টি আলুভাতে-ভাত মেখে নিজেই খাইয়ে দেয় ওদেরকে। দুপুরের খাবারটা স্কুলেই পাওয়া যায়। তাই খানিকটা নিশ্চিন্তি। ওদেরকে পlঠিয়েই স্বামীর জন্যেও ভাত বেড়ে দেয়। সেও তো বেরাবে কাজে! তারপর নাকে মুখে চাট্টি গুঁজে নিজেও বেরিয়ে যায়। এই এত কিছু ফুলিকে করতে হয় সকাল ন'টার মধ্যে। ন' টার মধ্যে না পৌঁছালে বৌদিমণি খুব রাগ করে, চেঁচামেচি করে। আজ তো খুব দেরি হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়েইছে ন'টার পর। আজ কপালে ঝামেলা লিখেছে!
ঠিক তাই! ঢোকার সাথে সাথে বৌদিমণি শুরু হয়ে গেল-----ফুলি, তুমি আজ আবার দেরি করলে? ওটির দিনগুলোতেই তোমার দেরি করা পায় না?
----মরদটর শরীলডা ভালো নাই গো বৌদিমণি, প্যাটট মেলায় বাজছে গো!
----এই তুমি চুপ কর তো! তোমার ওই রোজকার প্যানপ্যানানি আর ভালো লাগে না। তোমার বরের লিভারটা পচে গেছে শোন। যা গেলে দিনরাত! ওসব ছাড়ো। আমাদের বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। টিয়ার আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হবে। আড়াইটার সময় আসবে। খাবার টাবার গরম করে দিও। আমাদের আজ অনেকগুলো ওটি আছে। ফিরতে সন্ধ্যে হবে।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বৌদিমণি ভেতরে চলে গেল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার। একই নার্সিংহোমে আছে। তাই রোজ একসঙ্গেই যাওয়া আসা করে। ওরা বেরিয়ে গেলে ফুলি নিজের মত করে ঘরের কাজকর্মে মন দেয়। রান্নাটা অবিশ্যি করতে হয় না। ওটার জন্যে অন্য একটি লোক আছে। সকালে একবার আর রাতে একবার এসে করে দেয়। ফুলির কাজ হল সংসারটাকে গুছিয়ে রাখা। বাসন, কাপড়, ঘর সবকিছুই তার দায়িত্ব। তারপর চারটে নাগাদ টিয়া দিদিমণি আসলে তাকে খাবার খাইয়ে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তার ছুটি হয়। আজ আবার টিয়া দিদিমণি তাড়াতাড়ি ফিরবে! ফুলি আর দেরি না করে লেগে পড়ল।
ঘরে ঢুকেই দুম করে বইএর ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে টিয়া চিৎকার শুরু করল,----ফুলি, ও ফুলি, এক গ্লাস জল দাও না গো।
----এই যে দিদিমণি
এক চুমুকে জলটা শেষ করে টিয়া বলল,----শোন, একটু পরে আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে। কোল্ড ড্রিংকটা ফ্রিজ থেকে বের করে রাখো। ওরা এলে স্ন্যাকস আর ড্রিংকটা দেবে কেমন ?
ফুলি মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
মিনিট পনেরো পরেই ডোরবেল বাজল। ফুলি গিয়ে দরজা খুলে দিল। দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, টিয়ারই বয়সী হবে, হাতে লাল গোলাপ চকলেট এই সব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদেরকে ভেতরে নিয়ে এসে টিয়ার ঘরে বসাল ফুলি। টিয়াও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসে গেছে।
----এসে গেছিস? ফুলি ------
----আনচি গো
একটা ট্রে তে কোল্ড ড্রিংকস আর চিপস নিয়ে এসে টি টেবিলটাতে রাখল ফুলি।
----এবার তুমি যাও ফুলি, আর যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাও।
নিজের মনে কাজই করছিল ফুলি। হঠাৎ দিদিমণির ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে চোখ পড়তেই চমকে গেল। ঘরের ভেতরে দুটি ছেলে দুটি মেয়েকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে! কতই বা বয়েস হবে দিদিমণির? ষোল-সতের বড়জোর! বিহ্বল হয়ে এই কাণ্ড দেখতে দেখতে ভুল করে দরজায় হাত পড়ে গেল। দরজাটা একটু শব্দ করে খুলে গেল। ফুলি চট করে সরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে টিয়া দেখে ফেলেছে!
----ফুলি, কি করছ তুমি এখানে? নজর রাখছো আমার ওপর?
----না, না গো দিদিমণি
----না গো মানে? আমি পরিষ্কার দেখলাম!
----মাপ কদ্দাও গো দিদিমণি। ঝাঁট দিতে দিতে হয়ে গেচে গো
----মিথ্যা কথা বলছ? দাঁড়াও আজ বাপি মামনি আসুক! তোমার হচ্ছে!
একটু পরেই ছেলেমেয়েগুলি চলে গেল। টিয়াও ফোনটা নিয়ে সোফায় বসে কার সঙ্গে জানি কথা বলতে শুরু করল।
----মেজাজটা খিঁচড়ে গেল রে! কাজের মেয়েটা এমন বজ্জাত! আয় না একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার খুব।
তার আবেদনে যে উল্টোপক্ষ সাড়া দিয়েছে একটু পরেই তা বোঝা গেল।
ছেলেটি ঘরে ঢুকতেই টিয়া তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে দরজায় খিল দিল। এবারে আর সে মেজাজ খারাপ করতে চায় না।
দরজার ওপার থেকে মনিবের মেয়ের শীৎকার শুনে ফুলির গা শিরশির করে উঠল। দুটি ছেলের মা হলেও যৌবনটা তো তার এখনো শেষ হয়ে যায় নি! পরানটা তো তাকে কোনদিন ভালো করে চেয়ে দেখলই না। আর এখন আবার শরীরে রোগ ধরেছে!
(৩)
বাড়ি ফেরার সময় আজ একটু গন্ধ চাল আর দুধ কিনে নিয়ে ফিরল ফুলি। দুর্গাপূজোর অষ্টমীর দিনে মনিবের ঘর থেকে নিয়ে আসা ভোগের পায়েসটা খেয়ে অবধি ছেলে দুটো আর পরানটা যা বায়না জুড়েছিল! এখনো দু-চারদিন ছাড়া ছাড়াই হিড়িকটা চাগিয়ে ওঠে। তাই আজ ভাবল একটু বানিয়েই দেবে ওদেরকে। মনটা আজ বড় ফুরফুরে লাগছে। দিদিমণির কাছে বকাঝকা খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য একটু খারাপ লাগছিল বটে, কিন্তু এখন আবার বেশ লাগছে। কে জানে হয়ত ওই বাবুদের ছেলেমেয়েগুলোর উৎসব, কি যেন বলছিল---- হ্যাঁ ভেলোটিন ডে না কি, হয়ত তার জন্যই হবে! দুগ্গাপুজোর সময় যেমন বাতাসে একটা ফুর্তি মিশে থাকে, নতুন শাড়ি না জুটলেও যেমন আনন্দে টইটই করতে ইচ্ছে করে, আজ ঠিক সেরকমই হচ্ছিল ফুলির। এ এক নতুন পুজো এসেছে বটে! গাঁয়ে থাকতে তো এই ভেলোটিন পুজোর নামও কখনো শোনেনি সে। অবিশ্যি গাঁয়ে থাকতে পুজো আচ্চা পালন করার মত সংস্থানই বা তাদের ছিল কোথায়? পিঁপড়ের ডিম আর ঘাসের বীজ খেয়ে খেয়ে পিলে ঠিকরে শরীর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়! সেসব দিনের কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। তারপর একদিন সব পিছুটান ফেলে, ছেলে দুটোর একটাকে কোলে আর একটাকে পেটে নিয়ে দুটি ভাতের আশায় ওরা দুটিতে চলে এসেছিল এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। সম্বল বা সহায় বলতে ছিল একমাত্র গাঁয়ের মধুদাদা; যে কয়েক বছর আগেই চলে এসেছিল গাঁ ছেড়ে। মধুদাদা সেইদিনই পরানকে নিয়ে গিয়ে তার মালিককে ধরে একটা ভাড়া রিক্সার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সে আজ কতদিন আগেকার কথা! তা বছর আষ্টেক তো হবেই। বছর খানেক পরে ফুলির এই ঠিকা কাজটাও জুটে গেল।ধীরে ধীরে নিজের সংসার গুছালো সে।ছেলেদুটোকে ইস্কুলে পড়াবার যে সুপ্ত ইচ্ছাটা ছিল, খেয়ে না খেয়ে সেটাকেও পূরণ করল। সবই ঠিক চলছিল। বাধ সাধল পরানের ওই চোলাইয়ের নেশাটা!
ঘরে ঢুকে ফুলি দেখল ছেলেগুলো এক জামবাটি মুড়ি নিয়ে বসেছে।
----তুদের বাপ ফিরে নাই অ্যাকুনো?
----না ----মাথা নেড়ে ওরা আবার মুড়িতে মন দিল।
কাজে যাবার আগে পরানকে বিকেলে বেরাতে বারণ করেছিল ফুলি। পেটের ব্যাথাটা দুদিন ধরে খুব বেড়েছে। ডাক্তারবাবু সেদিন বলল এক ফোঁটা মদও এখন ওর জন্য বিষ। তাও পরশু রাতে গিলে চলে এসেছিল! সেই রাত থেকেই ব্যাথাটা খুব বেড়ে গেল। ফুলি তাড়াতাড়ি করে রান্নাটা সেরে নিল। ছেলেগুলো বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনা। তাই ওদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর নিজে ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে বসল। চুলে তেল দিয়ে বেণী বাঁধল, বড় করে একটা সিঁদুরের টিপ বানিয়ে একমাথা সিঁদুর পড়ল। আজ উৎসবের দিনটাতে একটু না সাজলে যে পরানের মুখে হাসি ফুটবে না। মানুষটা এমনিতেতো খারাপ নয়!
ছেলেদের পাশে শুয়ে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল ফুলি। পরানের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। দরজা খুলতেই এক তোড়া লাল গোলাপ ফুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে পরান বলল,----লে, আজ উ ভেলোটিন ডে ট বটে, তুর লেগে লিয়ে এলুম।
ফুলির মুখে খুশির বন্যা বয়ে গেল। তাড়াতাড়ি এক বাটি পায়েস নিয়ে এসে পরানের মুখের সামনে ধরে বলল,----তুর লেগে বানাইছি।
পরান পেটটা চেপে ধরে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল।
----আয় ক্যান্নে, তু ও আয়, সঙ্গতে খাবি
----তু এগুতে খা----বলতে বলতে ফুলি পরানের পাশে এসে বসল। পরানও ধীরে ধীরে ফুলির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল
----ফুলি আজ কত্তদিন পরে এমন সাজ্লি
----তুর লেগেই তো সাজ্লুম
----আচ্চা ফুলি, মু মরলে তু আবার ঘর ট বাঁধবি? কুনু মরদের সঙ্গতে?
ফুলি পরানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,----আজ পেত্তম তু মুর লেগে ফুল ট লিয়ে এলি রে
----তু যদি আবার ঘর ট বাঁধিস তবে নুনু গুলানকে ছেড়ে ট দিস না রে! উয়াদিগে সঙ্গতে লিয়ে ট যাবি
----এগুতে তো কুনু দিন তু এমন কলট তে শির ট টিকায়েঁ সুস নাই---
----ফুলি রে, আজ প্যাট ট গেদে বাজচে রে, আর লারচি রে
----এগুতে তো কুনু দিন তু এমন সুহাগ ট করিস নাই
----ফুলি রে, বড বাজচে
----উ বাবুদের ছিলা মিয়া গুলানের থিকে মুদের ভেলোটিন ডে টই ভালো রে পরান
----ফুলি ----
----উয়াদের মতন মুর দশ ট মরদ নাই রে, আর তুর ও দশ টা মিয়াছিলা নাই, তুয়েই মুর আজম্ম কালের সাথী রে পরান! উয়া দের থিকে মুদের টই ভালো
শক্ত করে ফুলির আঁচলের খুঁটটা ধরে থাকা পরানের মুঠোটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল। কোন কথা আর সে শুনতে পাচ্ছে না। ফুলির আজম্ম কালের একমাত্র ভ্যালেন্টাইন চলে গেছে অনেক দূরে.......
(সমাপ্ত)
____________________________
© মমতা সিনহা
----পরানদা ও পরানদা--- শোনো--বিকেলে একটু সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তোমার রিক্সাটা চাই।
----আচ্চা দীপদাদা তুমার গরে টিক পাঁচডার সময় পইচে যাবো।
----না না, ঘরে এসো না। আমি এই মোড়ের মাথাতেই দাঁড়াবো। তুমি থেকো।
----আচ্চা তাই হবে গো
----আর শোনো, ওই প্লাস্টিকের ঢাকনাটা রেখো কিন্তু যেটা বর্ষায় লাগাও।
----এঁজ্ঞে, রাকবো গো
ঠিক পাঁচটার মধ্যে পরান রিক্সা নিয়ে হাজির হয়ে গেল পাড়ার মোড়ে। দীপদাদাটা অনেক সময়ই তাকে সাহায্য করে টাকা পয়সা ধার দিয়ে। তাই ওর কথা কাটতে পারেনা পরান। পৌনে ছটা নাগাদ দীপ এল।
----শোনো পরানদা এমন কোন রাস্তা আছে যেখানে লোকজন একটু কম থাকে, মানে সন্ধ্যের দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকা থাকে আর কি; জানো?
---এঁজ্ঞে দীপদাদা ওই ডাগদারদের পাড়াডার পেচন দিগটা সনদেবেলা এগদম ফাঁকা থাকে গো
----বা বা, বেশ বেশ, ওদিকটাতেই চলো। শোনো তার আগে আরেকজনকে তুলব চলো।
পরান রিক্সা ছোটালো। দুটো পাড়া পরেই রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিলো স্নিগ্ধা। তাকে দেখেই দীপ বলল,----পরানদা দাঁড়াও।
হাতের ইশারায় স্নিগ্ধাকে ডেকে রিক্সায় উঠিয়ে নিল দীপ। পরান আবার রিক্সা ছোটালো।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। ডক্টরস কলোনিটা ফাঁকা থাকে বলেছিল বটে পরান কিন্তু এতটা ফাঁকা হবে দীপ ভাবতে পারেনি। হালকা শীতের আমেজ এখনো রয়েছে। তাই প্রতিটা বাড়িরই দরজা জানালা সব বন্ধ। দেখে খুব খুশি হয়ে গেল দীপ। বাহ্! মোক্ষম জায়গা বাতলেছে পরানটা! রিক্সাটা ধীরে চালাতে বলে প্লাস্টিকের ঝাঁপটা নামিয়ে দিল দীপ। জামার ভেতর থেকে একটা লাল গোলাপ বের করে স্নিগ্ধাকে দিয়ে বলল,----হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস ডে।
----তোমাকেও -----বলে স্নিগ্ধা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বের করে দীপকে দিল। দীপ চকলেট সমেত স্নিগ্ধার হাতটা ধরে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে ওর ঠোঁটে ডুব দিলো।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে পরান টুকটুক করে শুধু দুটো পাড়ার মধ্যেই রিক্সাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন সময় দীপ ঝাঁপটা তুলে বলল,-----পরানদা এবার বাড়ির দিকে চলো।
স্নিগ্ধাকে নামিয়ে পাড়ায় ঢুকতে গিয়ে দীপ হঠাৎ বলে উঠল,------একটু দাঁড়াওতো পরানদা। এই মৌ, মৌ, এখানে কি করছিস?
----তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি দীপদা।----হাতে একটা প্লাস্টিকের থলে নিয়ে সবুজ শালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েটা রিক্সার কাছে এগিয়ে এল।
----আমার জন্য? কেনো রে? কিছু দরকার আছে?
----আমার তোমার সঙ্গে কটা কথা ছিল দীপদা।
----তা বল না
----এখানে? একটু অন্য কোথাও যাওয়া যায় না? মানে একটু নিরিবিলি....
----অন্য কোথাও? আচ্ছা, আয়, উঠে আয় রিক্সায়। পরানদা----
----এঁজ্ঞে দীপদাদা ---
পরান আবার রিক্সাটা ঘুরিয়ে ডক্টরস কলোনির দিকে চলল। এতক্ষণ ধরে একটানা রিক্সা চালিয়ে খুবই হাঁপিয়ে গেছে সে। পেটের ব্যাথাটাও চিনচিন করে বাড়ছে। তবু দীপের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না।
ডক্টরস কলোনিতে ঢুকে দীপ বলল,----বল, কি বলবি বলছিলি?
----বলছি, আগে এটা নাও---- বলে মৌ প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে একটা লাল গোলাপের তোড়া বের করে দীপের হাতে দিলো।
----এটা কি?
----আচ্ছা দীপদা, তুমি কি কোনদিন বুঝতে পারোনি আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি?
----কি বলছিস?
----হ্যাঁ গো! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো তোমাকে ছাড়া!
----তুই আগে কেনো বলিস নি রে যে আমাকে এত ভালোবাসিস?
----এখন তো বললাম, এখন আমাকে তোমার করে নাও।-----বলে হাতদুটো বাড়িয়ে দিল মৌ।
দীপ সেই হাত ধরে মৌ কে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো।
অন্ধকার রাস্তাটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল পরান। আর টানতে পারছে না রিক্সাটা।দীপদাদা নিশ্চয় বকবে এই ভেবে পেছন ফিরে তাকাতেই থ হয়ে গেল। মৌকে কোলে বসিয়ে গভীর চুম্বনে ব্যস্ত দীপ। তার একটা হাত মৌ কে পেঁচিয়ে ধরে রয়েছে; আর একটা হাত চলে গেছে ওর বুকে। আগেরবার তবু ঝাঁপটা টেনে দিয়েছিল। এবারে সেই সবুরটুকুও সয় নি। পরান ধীরে ধীরে রিক্সা থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
মিনিট পনেরো পরে দীপ ডেকে বলল,----পরানদা, এবার চলো।
পাড়ার মোড়ে মৌকে নামিয়ে দেওয়ার পর পরান জিগ্গেস করল,----আচ্চা দীপদাদা, তবে কি ওই আগের দিদিমণিট তুমার বৌ হবেক নাই?
----কি বললি? রিক্সা থামা, থামা বলছি!----রেগে লাল হয়ে গেল দীপ -----শালা ছোটলোক! দুটো ভালো করে কথা বলেছি তো মাথায় চাপতে চাইছে! এই নে তোর টাকা। ভাগ শালা!-----বলে দীপ একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে পরানের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল। পরান কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে টাকাটা কুড়িয়ে পকেটে পুরল। রিক্সাটা ঘোরাতে গিয়ে দেখল লাল গোলাপের তোড়াটা রাগের মাথায় দীপ রিক্সাতেই ফেলে গেছে। অত সুন্দর অতগুলো ফুল ফেলে দিতে মন চাইল না। সিটের নিচে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখল। ফুলিটাকে দিলে খুশি হয়ে যাবে। আর আজকে ভাড়া চালাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। পেটের ব্যাথাটাও বেড়েই চলেছে।
(২)
এই সকালবেলাটায় ফুলির খুব তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। ভোর থেকে উঠে অবধি ঘর, বাসন, কাপড়; তারপর চান করে রান্না বসায়। তারপর ছেলেদুটোকে ঘুম থেকে টেনে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করা। ছেলেদুটো যতক্ষণে বইখাতা গুছাতে থাকে ততক্ষণে চাট্টি আলুভাতে-ভাত মেখে নিজেই খাইয়ে দেয় ওদেরকে। দুপুরের খাবারটা স্কুলেই পাওয়া যায়। তাই খানিকটা নিশ্চিন্তি। ওদেরকে পlঠিয়েই স্বামীর জন্যেও ভাত বেড়ে দেয়। সেও তো বেরাবে কাজে! তারপর নাকে মুখে চাট্টি গুঁজে নিজেও বেরিয়ে যায়। এই এত কিছু ফুলিকে করতে হয় সকাল ন'টার মধ্যে। ন' টার মধ্যে না পৌঁছালে বৌদিমণি খুব রাগ করে, চেঁচামেচি করে। আজ তো খুব দেরি হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়েইছে ন'টার পর। আজ কপালে ঝামেলা লিখেছে!
ঠিক তাই! ঢোকার সাথে সাথে বৌদিমণি শুরু হয়ে গেল-----ফুলি, তুমি আজ আবার দেরি করলে? ওটির দিনগুলোতেই তোমার দেরি করা পায় না?
----মরদটর শরীলডা ভালো নাই গো বৌদিমণি, প্যাটট মেলায় বাজছে গো!
----এই তুমি চুপ কর তো! তোমার ওই রোজকার প্যানপ্যানানি আর ভালো লাগে না। তোমার বরের লিভারটা পচে গেছে শোন। যা গেলে দিনরাত! ওসব ছাড়ো। আমাদের বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। টিয়ার আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হবে। আড়াইটার সময় আসবে। খাবার টাবার গরম করে দিও। আমাদের আজ অনেকগুলো ওটি আছে। ফিরতে সন্ধ্যে হবে।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বৌদিমণি ভেতরে চলে গেল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার। একই নার্সিংহোমে আছে। তাই রোজ একসঙ্গেই যাওয়া আসা করে। ওরা বেরিয়ে গেলে ফুলি নিজের মত করে ঘরের কাজকর্মে মন দেয়। রান্নাটা অবিশ্যি করতে হয় না। ওটার জন্যে অন্য একটি লোক আছে। সকালে একবার আর রাতে একবার এসে করে দেয়। ফুলির কাজ হল সংসারটাকে গুছিয়ে রাখা। বাসন, কাপড়, ঘর সবকিছুই তার দায়িত্ব। তারপর চারটে নাগাদ টিয়া দিদিমণি আসলে তাকে খাবার খাইয়ে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তার ছুটি হয়। আজ আবার টিয়া দিদিমণি তাড়াতাড়ি ফিরবে! ফুলি আর দেরি না করে লেগে পড়ল।
ঘরে ঢুকেই দুম করে বইএর ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে টিয়া চিৎকার শুরু করল,----ফুলি, ও ফুলি, এক গ্লাস জল দাও না গো।
----এই যে দিদিমণি
এক চুমুকে জলটা শেষ করে টিয়া বলল,----শোন, একটু পরে আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে। কোল্ড ড্রিংকটা ফ্রিজ থেকে বের করে রাখো। ওরা এলে স্ন্যাকস আর ড্রিংকটা দেবে কেমন ?
ফুলি মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
মিনিট পনেরো পরেই ডোরবেল বাজল। ফুলি গিয়ে দরজা খুলে দিল। দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, টিয়ারই বয়সী হবে, হাতে লাল গোলাপ চকলেট এই সব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদেরকে ভেতরে নিয়ে এসে টিয়ার ঘরে বসাল ফুলি। টিয়াও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসে গেছে।
----এসে গেছিস? ফুলি ------
----আনচি গো
একটা ট্রে তে কোল্ড ড্রিংকস আর চিপস নিয়ে এসে টি টেবিলটাতে রাখল ফুলি।
----এবার তুমি যাও ফুলি, আর যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাও।
নিজের মনে কাজই করছিল ফুলি। হঠাৎ দিদিমণির ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে চোখ পড়তেই চমকে গেল। ঘরের ভেতরে দুটি ছেলে দুটি মেয়েকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে! কতই বা বয়েস হবে দিদিমণির? ষোল-সতের বড়জোর! বিহ্বল হয়ে এই কাণ্ড দেখতে দেখতে ভুল করে দরজায় হাত পড়ে গেল। দরজাটা একটু শব্দ করে খুলে গেল। ফুলি চট করে সরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে টিয়া দেখে ফেলেছে!
----ফুলি, কি করছ তুমি এখানে? নজর রাখছো আমার ওপর?
----না, না গো দিদিমণি
----না গো মানে? আমি পরিষ্কার দেখলাম!
----মাপ কদ্দাও গো দিদিমণি। ঝাঁট দিতে দিতে হয়ে গেচে গো
----মিথ্যা কথা বলছ? দাঁড়াও আজ বাপি মামনি আসুক! তোমার হচ্ছে!
একটু পরেই ছেলেমেয়েগুলি চলে গেল। টিয়াও ফোনটা নিয়ে সোফায় বসে কার সঙ্গে জানি কথা বলতে শুরু করল।
----মেজাজটা খিঁচড়ে গেল রে! কাজের মেয়েটা এমন বজ্জাত! আয় না একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার খুব।
তার আবেদনে যে উল্টোপক্ষ সাড়া দিয়েছে একটু পরেই তা বোঝা গেল।
ছেলেটি ঘরে ঢুকতেই টিয়া তাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে দরজায় খিল দিল। এবারে আর সে মেজাজ খারাপ করতে চায় না।
দরজার ওপার থেকে মনিবের মেয়ের শীৎকার শুনে ফুলির গা শিরশির করে উঠল। দুটি ছেলের মা হলেও যৌবনটা তো তার এখনো শেষ হয়ে যায় নি! পরানটা তো তাকে কোনদিন ভালো করে চেয়ে দেখলই না। আর এখন আবার শরীরে রোগ ধরেছে!
(৩)
বাড়ি ফেরার সময় আজ একটু গন্ধ চাল আর দুধ কিনে নিয়ে ফিরল ফুলি। দুর্গাপূজোর অষ্টমীর দিনে মনিবের ঘর থেকে নিয়ে আসা ভোগের পায়েসটা খেয়ে অবধি ছেলে দুটো আর পরানটা যা বায়না জুড়েছিল! এখনো দু-চারদিন ছাড়া ছাড়াই হিড়িকটা চাগিয়ে ওঠে। তাই আজ ভাবল একটু বানিয়েই দেবে ওদেরকে। মনটা আজ বড় ফুরফুরে লাগছে। দিদিমণির কাছে বকাঝকা খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য একটু খারাপ লাগছিল বটে, কিন্তু এখন আবার বেশ লাগছে। কে জানে হয়ত ওই বাবুদের ছেলেমেয়েগুলোর উৎসব, কি যেন বলছিল---- হ্যাঁ ভেলোটিন ডে না কি, হয়ত তার জন্যই হবে! দুগ্গাপুজোর সময় যেমন বাতাসে একটা ফুর্তি মিশে থাকে, নতুন শাড়ি না জুটলেও যেমন আনন্দে টইটই করতে ইচ্ছে করে, আজ ঠিক সেরকমই হচ্ছিল ফুলির। এ এক নতুন পুজো এসেছে বটে! গাঁয়ে থাকতে তো এই ভেলোটিন পুজোর নামও কখনো শোনেনি সে। অবিশ্যি গাঁয়ে থাকতে পুজো আচ্চা পালন করার মত সংস্থানই বা তাদের ছিল কোথায়? পিঁপড়ের ডিম আর ঘাসের বীজ খেয়ে খেয়ে পিলে ঠিকরে শরীর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়! সেসব দিনের কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। তারপর একদিন সব পিছুটান ফেলে, ছেলে দুটোর একটাকে কোলে আর একটাকে পেটে নিয়ে দুটি ভাতের আশায় ওরা দুটিতে চলে এসেছিল এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। সম্বল বা সহায় বলতে ছিল একমাত্র গাঁয়ের মধুদাদা; যে কয়েক বছর আগেই চলে এসেছিল গাঁ ছেড়ে। মধুদাদা সেইদিনই পরানকে নিয়ে গিয়ে তার মালিককে ধরে একটা ভাড়া রিক্সার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সে আজ কতদিন আগেকার কথা! তা বছর আষ্টেক তো হবেই। বছর খানেক পরে ফুলির এই ঠিকা কাজটাও জুটে গেল।ধীরে ধীরে নিজের সংসার গুছালো সে।ছেলেদুটোকে ইস্কুলে পড়াবার যে সুপ্ত ইচ্ছাটা ছিল, খেয়ে না খেয়ে সেটাকেও পূরণ করল। সবই ঠিক চলছিল। বাধ সাধল পরানের ওই চোলাইয়ের নেশাটা!
ঘরে ঢুকে ফুলি দেখল ছেলেগুলো এক জামবাটি মুড়ি নিয়ে বসেছে।
----তুদের বাপ ফিরে নাই অ্যাকুনো?
----না ----মাথা নেড়ে ওরা আবার মুড়িতে মন দিল।
কাজে যাবার আগে পরানকে বিকেলে বেরাতে বারণ করেছিল ফুলি। পেটের ব্যাথাটা দুদিন ধরে খুব বেড়েছে। ডাক্তারবাবু সেদিন বলল এক ফোঁটা মদও এখন ওর জন্য বিষ। তাও পরশু রাতে গিলে চলে এসেছিল! সেই রাত থেকেই ব্যাথাটা খুব বেড়ে গেল। ফুলি তাড়াতাড়ি করে রান্নাটা সেরে নিল। ছেলেগুলো বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনা। তাই ওদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর নিজে ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে বসল। চুলে তেল দিয়ে বেণী বাঁধল, বড় করে একটা সিঁদুরের টিপ বানিয়ে একমাথা সিঁদুর পড়ল। আজ উৎসবের দিনটাতে একটু না সাজলে যে পরানের মুখে হাসি ফুটবে না। মানুষটা এমনিতেতো খারাপ নয়!
ছেলেদের পাশে শুয়ে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল ফুলি। পরানের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। দরজা খুলতেই এক তোড়া লাল গোলাপ ফুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে পরান বলল,----লে, আজ উ ভেলোটিন ডে ট বটে, তুর লেগে লিয়ে এলুম।
ফুলির মুখে খুশির বন্যা বয়ে গেল। তাড়াতাড়ি এক বাটি পায়েস নিয়ে এসে পরানের মুখের সামনে ধরে বলল,----তুর লেগে বানাইছি।
পরান পেটটা চেপে ধরে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল।
----আয় ক্যান্নে, তু ও আয়, সঙ্গতে খাবি
----তু এগুতে খা----বলতে বলতে ফুলি পরানের পাশে এসে বসল। পরানও ধীরে ধীরে ফুলির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল
----ফুলি আজ কত্তদিন পরে এমন সাজ্লি
----তুর লেগেই তো সাজ্লুম
----আচ্চা ফুলি, মু মরলে তু আবার ঘর ট বাঁধবি? কুনু মরদের সঙ্গতে?
ফুলি পরানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,----আজ পেত্তম তু মুর লেগে ফুল ট লিয়ে এলি রে
----তু যদি আবার ঘর ট বাঁধিস তবে নুনু গুলানকে ছেড়ে ট দিস না রে! উয়াদিগে সঙ্গতে লিয়ে ট যাবি
----এগুতে তো কুনু দিন তু এমন কলট তে শির ট টিকায়েঁ সুস নাই---
----ফুলি রে, আজ প্যাট ট গেদে বাজচে রে, আর লারচি রে
----এগুতে তো কুনু দিন তু এমন সুহাগ ট করিস নাই
----ফুলি রে, বড বাজচে
----উ বাবুদের ছিলা মিয়া গুলানের থিকে মুদের ভেলোটিন ডে টই ভালো রে পরান
----ফুলি ----
----উয়াদের মতন মুর দশ ট মরদ নাই রে, আর তুর ও দশ টা মিয়াছিলা নাই, তুয়েই মুর আজম্ম কালের সাথী রে পরান! উয়া দের থিকে মুদের টই ভালো
শক্ত করে ফুলির আঁচলের খুঁটটা ধরে থাকা পরানের মুঠোটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল। কোন কথা আর সে শুনতে পাচ্ছে না। ফুলির আজম্ম কালের একমাত্র ভ্যালেন্টাইন চলে গেছে অনেক দূরে.......
(সমাপ্ত)
____________________________
© মমতা সিনহা
No comments:
Post a Comment