Thursday, 2 February 2017

।। জন্মদিনে ।।



আজ আঠারোতে পা দিতে চলেছে পিয়ালী। দেখতে দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেলো,কতগুলো বসন্ত হারিয়ে গেলো ওর জীবন থেকে। যখন ছোটো ছিল মায়ের কোলে বসে ভাবতো কবে বড় হবে.....! ভাবতে ভাবতে কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় সে।
হ্যাঁ,সেই সেদিনের ছোট্ট পিয়ালী আজ আঠারোতে। কদিন ধরে খুব ব্যস্ততায় কেটেছে জন্মদিনের নিমন্ত্রণ,কেনাকাটায়। এবার কতো বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন আসবে। জন্মদিনের শুভাঙ্গন ভরে উঠবে শুভ আলোকে। বাবা অবিনাশবাবু ও আজকের দিনটিতে অফিস ছুটি নিয়েছেন-একমাত্র মেয়ের জন্মদিন বলে কথা....।
এত আনন্দের মধ্যেও মনটা ভালো লাগছিল না পিয়ালীর। ওর প্রিয় বান্ধবী মৌমিতা এবার আসতে পারবে না। এই বয়সেই ওর দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। আজকের এই দিনে যার প্রাণোচ্ছলতা জন্মদিনটিকে রঙিন করে তুলতো,ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শেষ প্রহরের অপেক্ষায় দিন গুনছে ! মনের জানালায় ভেসে ওঠে মৌ এর প্রাণচঞ্চল মুখখানি। বুকের ভেতরে কেমন একটা ব্যথা অনুভব করে সে। আগের বার ও-ই তো বলেছিল ,”দেখিস পিয়ালী তোর আঠারোতম জন্মদিনটা কিভাবে সেলিব্রেট করি।” যদি আসতে পারতো.....।
এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠতে চমকে উঠল সে।
হ্যালো, “দীপান্বিতা বলছি ।
আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেছি,তুই চলে আয়”।
সবাইকে নিয়ে গল্পগুজব করতে করতে বেশ দ্রুতগতিতে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছিল ওদের গাড়ি। হঠাৎই এক দুর্ঘটনা । একটি লরির সাথে ওদের গাড়ির মুখোমুখি ধাক্কায় সাজানো স্বপ্নতরী একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। জন্মদিনের আনন্দক্ষেত্র ভেঙে পরিণত হল এক বেদনার বালুচরে। সমস্ত পরিবারে নেমে এল বিষাদের কালো ছায়া ।
সত্যিই জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। আমরা ভাবি এক,হয় আর এক। মনে মনে বুনে যাই স্বপ্নের রঙিন জাল,কিন্তু কোনো এক সময় এক অদৃশ্য ,অজানা শক্তি এসে ছিঁড়ে দিয়ে যায় স্বপ্নবিনুনি,সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে আবার হারিয়ে যায় চোরাস্রোতের অতল গহ্বরে.....।
এমনি করে কয়েকদিন কেটে গেলো। ধীরে ধীরে সবাই স্বাভাবিক ও সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেও ,ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে,পিয়ালীর অবস্থার কোনো উন্নতি দেখা গেল না।
দিন-দুয়েক পরে বাবা-মা,আত্মীয়-স্বজনের সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা,স্নেহবন্ধন ছিন্ন করে সে চলে গেল বহুদূরে । মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাতের কারণে “ব্রেন ডেথ” হয়ে গেছে তার।
মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে বাবা-মা পুরোপুরি নির্বাক। হঠাৎ অবিনাশবাবুর মনে পড়ে গেলো মৌমিতার কথা—তাঁর মেয়ের বান্ধবী । সেও তো তাঁর মেয়ের মতই—কতোবার পিয়ালীর সাথে তাঁর বাড়িতে এসেছে। ছোটোবেলায় কাকু কাকু বলে সারা বাড়ি ভরিয়ে তুলতো। সেই মিষ্টি মেয়েটাও কিছুদিন পরে হয়তো ওর বাবা-মায়ের কোল শূন্য করে চলে যাবে। আর সন্তান হারানোর বেদনা যে কি সন্তানহারা বাবা-মা ছাড়া আর বোধ হয় কেউ এতটা অনুভব করতে পারে না। নিয়তির কাছে পরাজিত হয়ে ভাবেন,হয়তো এই ছিল নিয়তিতে। মৌমিতার বাবা-মাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া যায় না??? ওকে বাঁচানো যায় না কোনোভাবে ????
মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন অবিনাশবাবু। মেয়ের দেহ দান করে দিলেন হাসপাতালে। চোখের জলে শেষবারের মতো বিদায় জানালেন তাঁদের জীবনের অনন্য সম্পদ পিয়ালীকে।
তাঁর মেয়ের কিডনি নিয়ে বেঁচে থাকুক মৌমিতা,বেঁচে থাকুক আরো কয়েকটি প্রাণ। পাড়ার মেয়ে রণিতা পৃথিবীর আলো দেখুক,সৌন্দর্য্য উপভোগ করুক তাঁরই মেয়ের চোখ দিয়ে।
মনটা একটু হালকা হয়ে গেলো তাঁর। যেন পিয়ালীর এক প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন মৌমিতা,রণিতা-দের মাঝে।
______________________________
© অপূর্ব প্রধান

No comments:

Post a Comment