Sunday, 5 February 2017

।। সোনার মেয়ে ।।



শীতের দুপুর।  বইমেলায় ঘুরছি নীলুর সঙ্গে।  কত লোক্যে মেলায় আসে।  কোনো কিছু না কিনে , মেলার এক কোনে  বসে থাকলে , যত লোক দেখা যায় তা মনে হয় বই পড়লে টোটো লোককে জানা যায়না।  তখন ময়দানে মেলা হতো।  মাঝখানে অনেক খানি সবুজ ঘাসের দেখা পাওয়া যেত।  দিব্যি সেই ঘাসে বসে রোদে পিঠ লাগিয়ে দিন কাটিয়ে দেওয়া যেত।  নীলু আর আমি দু একটা বইর দোকানে বই ঘাঁটা ঘাঁটি করে   চলেছি সবুজ ঘাসের  সন্ধানে।  উদ্দেশ্য বসে গল্প করা। আসলে নীলু বলে বইর দোকানে ভিড় দেখে মনে হয় বইর পাতা কাটার জন্য পোকারা সব ভিড় লাগিয়েছে। সেই পোকার কামড় থেকে বাঁচার জন্য সবুজ দ্বীপের খোঁজ চলছে।  তখন শুনতে পেলাম সুপ্রিয়াদির গলা , ' তোরা সব কি বইমেলায় প্রেম করতে আসিস। ' সুপ্রিয়াদি পাড়ার এক বন্ধুর দিদি।  বেশ হাসি খুশির চেহারা , গোলগাল দেখতে।  সুপ্রিয়াদি তাঁর এক বান্ধবীর  সঙ্গে মেলায় এসেছেন।

সুপ্রিয়াদির এবার নীলুকে দেখে বলেন , ' তুমিতো আমাদের পাশের পাড়ায় থাকো। প্রেমে পড়ার জন্য এতো দূরে আসতে হয় বুঝি। ' দেখি নীলু চটপট জবাব দেয় , ' তা নয় , প্রেমে পড়লে লোকে দূরে দূরেই যায়। ' এরপর সুপ্রিয়াদি ওখান থেকে  কেটে পড়েন । এরপর আমরা দুজনে সবুজ ঘাসের উপর বসে আড্ডা মারতে থাকি। দুজনেই কেন কি জানি চুপ করে থাকি।  হটাৎ নীলু জিজ্ঞেস করে , ' আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে তোমার কেন ভালো লাগে ?'  আমি কিছু ভেবে না পেয়ে বলি , ' তুই নীলু বলেই হয়তো তোর সঙ্গে আড্ডা মারতে ভালো লাগে।  তুই যদি অন্য কেউ হতি , তাইলে কি ভালো লাগতো ? মনে তো হয়না। ' তখন শুনি মাইকে আমার নাম ঘোষণা হচ্ছে।  আমার জন্য এক ভদ্রমহিলা বুক পাবলিশার্স গিল্ডের অফিসে অপেক্ষা করছেন।  নীলু আমার দিকে তাকিয়ে বলে , ' তুমি আবার আমার সতীন পাকড়ালে কবে ?’

যাই হোক নীলুর সঙ্গে গেলাম গিল্ডের অফিসে।  গিয়ে দেখি সুপ্রিয়াদি আর তাঁর বান্ধবী  চেয়ারে বসা।  পাশে রাখা একটা বড় কাপড়ের ব্যাগ , তাতে বই ভর্তি। আমাকে দেখেই বললেন , ' তুই কখন বাড়ি ফিরবি ?' আমি উত্তর দেওয়ার আগেই নীলু প্রশ্ন করে , ' কেন ?' দেখি সুপ্রিয়াদি একটু ভুরু কুঁচকে জবাব দিলেন , ' ওতো আমাদের পাড়ার ছেলে।  আমরা একটু বালিগঞ্জ যাবো।  তাই ভাবছিলাম ওর হাত দিয়ে বইগুলো পাঠিয়ে দি। ' আমি ওই বড় বইর ব্যাগ দেখে আঁতকে উঠি।  রীতিমতো ভারী।  তা ছাড়া কে ওই  মুটের বোঝা বইবে।  নীলু আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।  নীলু বলে , ' আমরা এখান  থেকে ট্যাংরায় যাবো চাইনিজ খেতে।  আমার এক চাইনিজ বন্ধু ওর নতুন দোকান খুলেছে ওখানে।  তাই আমাদের নিমন্ত্রণ ওখানে খাওয়ার।  '  আমি নীলুর মুখে ট্যাংরা , নীলুর চাইনিজ বন্ধু , তার আবার খাবার দোকানে নিমন্ত্রণ - সব শুনে ভিরমি খাবার জোগাড়।  দেখি সুপ্রিয়াদি কেমন একটা সন্দেহের চোখে একবার নীলুকে একবার আমাকে দেখছেন।  তারপর একটা বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলেন , ' এখন আমাদের সোজা বাড়িতেই ফিরতে হবে। '

গিল্ডের অফিস থেকে বেরিয়েই আমি জিজ্ঞেস করি ,' সুপ্রিয়াদিকে তুই এমন গুল মারলি কেন ?" নীলু বলে ,' গুল কোথায় , আমরা সত্যি সত্যি এখান থেকে ট্যাংরা যাবো চাইনিজ খেতে। '  আমি বলি, ' সে কি রে এলাম বইমেলায় , আর এখন ট্যাংরা যাওয়ার ইচ্ছে হলো কেন ?' নীলু বলে , ' আমার কি কোনো ইচ্ছে হতে পারেনা ?' আমি বলি , ' ঠিক আছে , চল তবে। ' নীলু কেমন হেয়াঁলি  করে বলে , ' যাবো সময় হলে। চলো মেলায় আর একটু ঘুরপাক খাই। '

বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে একটা চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি , দেখি সুপ্রিয়াদি তার বান্ধবীকে নিয়ে হাজির।  আমাদের দেখেই সুপ্রিয়াদি বলেন , ' কি ব্যাপার তোমরা ট্যাংরা গেলেনা ? ' নীলু উল্টে জিজ্ঞাসা করে , ' আপনার বইর  ব্যাগ কোথায় গেলো ?' সুপ্রিয়াদি , ' ওই বইর  ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে যেতে হবে।  তাই  রুপার  স্টলে  ওটা জমা রেখে , একটু ঘুরে দেখছি। ' চা খেয়ে নীলু আরো কিছু বইর  দোকান ঘুরে দুটো টিনটিন কিনলো।  তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।  নীলু বলে চলো গিয়ে ট্যাক্সি ধরে ট্যাংরা যাই।

দুজনে হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে আসি।  দেখি ওখানে বেশ ভিড়।  আশেপাশে কোনো ট্যাক্সির দেখা নেই। আমি বলি , ' ধুর , ট্যাক্সি পাওয়া যাবেনা চল বাড়ি ফিরে  চল। ' নীলু বলে , ' তোমরা ছেলেরা একটুতেই অধৈর্য্য হয়ে পড়ো।  একটু দাঁড়াও ট্যাক্সি পেয়ে যাবো। ' তখন দেখি সুপ্রিয়াদি আর ওই বান্ধবী ওই বড় বইর  ব্যাগ দুপাশ থেকে হ্যান্ডেল ধরে ধীরে ধীরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে আসছে।  দেখি দুজনে হাঁফাতে হাঁফাতে আমাদের কাছে আসে।  নীলুকে দেখে সুপ্রিয়াদি আবার জিজ্ঞেষ করেন , ' তোমরা এখনো যাওনি ?' নীলু বেশ জোরের সঙ্গে বলে , ' ট্যাক্সি ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ' তারপর দেখি নীলু সুপ্রিয়াদির সঙ্গে কথা বলে চলেছে।  ওদের দুজনের কথা শুনে বুঝলাম , সুপ্রিয়াদি ওদের স্কুলের লাইব্রেরির দায়িত্বে আছেন।  এই মেলা থেকে কিনলে কিছু কনসেশন পাওয়া যাবে।  তাতে দুটো বই বেশি কিনতে পারবেন বলে বই মেলায় এসে ওই বড় ব্যাগ ভর্তি বই কিনেছেন। ' আমি দেখি সুপ্রিয়াদির কথা শুনতে শুনতে নীলু কেমন বিভোর হয়ে গেছে।  এদিকে না আসছে কোনো খালি বাস যাতে ওই বড় ব্যাগ নিয়ে সুপ্রিয়াদি শিয়ালদা যেতে পারেন।  এদিকে আমাদের ট্যাক্সির নাম নেই।  আমাদের মতন বেশ কিছু লোক ট্যাক্সির অপেক্ষা করছে।

হটাৎ দেখি নীলু একটা দৌড় লাগলো যেদিক থেকে ট্যাক্সি বা বাস আমাদের দিকে আসবে।  আমি অবাক হয়ে দেখি আমাদের দিকেই একটা ট্যাক্সি আসছে।  নীলু সেই ট্যাক্সি  ধরার জন্য আগে দৌড়ে গেছে।  দেখি নীলু  অনেক খানি এগিয়ে গিয়ে ট্যাক্সি থামালো।  ট্যাক্সি থামতেই এক ঝটকায় ট্যাক্সির দরজা খুলে বসে পড়ে , ট্যাক্সীটা নিয়ে ঠিক আমাদের সামনে এসে থামলো।  আমি ট্যাক্সিতে ওঠার জন্য পিছনের দরজা খুলতে যাচ্ছি , নীলু বলে , ' তুমি সামনে ড্রাইভারের পাশে বসো। ' তারপর দেখি নীলু ডাকছে সুপ্রিয়াদি ও তাঁর বান্ধবীকে ট্যাক্সিতে উঠে বাড়ি যাওয়ার  জন্য।  ট্যাক্সির ডিকিতে বইর  ব্যাগ রেখে , ওরা  দুজনে পিছনের সিটে  উঠে বসলো। ট্যাক্সিতে বসেই সুপ্রিয়াদি বলেন , ' কি হলো , তোমরা ট্যাংরা যাবে না। ' নীলু দিব্যি বলে ,'   বাড়ির দিকেই যাওয়াই আমাদের প্ল্যান  । ট্যাংরা যাওয়াটা  আমরা রবিবারের জন্য পিছিয়ে দিয়েছি । '  আমি ঠিক বুঝতে পারি সুপ্রিয়াদিকে হেল্প করার জন্য নীলু ওর ট্যাংরা যাওয়ার প্ল্যান ক্যানসেল  করেছে। তখন শুনি পিছন থেকে সুপ্রিয়াদি আমাকে বলছেন , ' তোর কপালে আমাদের এই সোনার মেয়েটা জুটলো কি করে ?'
__________________________
© সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment