(এক)
পুকুরপাড়ে বসে বসে ঘাস তুলে চিবোচ্ছিলাম।
চারপাশে প্রচুর লোকজন। কেউ – কুইন ভিক্টোরিয়া অমর রহে - বলে চেঁচাচ্ছে, কেউ সামনের নারকেল গাছটা সাঁতরে উঠবে বলে গত চার বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাগলা গারদে যা হয়, একেবারে চিলুবিলু অবস্থা।
ঘন্টি এসে বসল আমার পাশে, রোজই বসে। ও ফিমেল ওয়ার্ডে থাকে।
ঘন্টির দিকে দুটো ঘাস এগিয়ে দিয়ে বললাম – চিবোবি?
ও হি হি করে হেসে বলল – ধুর শালা, তুই একটা পুরো ক্ষ্যাপা মাইরি…
তাইই হবে। এদিক ওদিক দেখে বললাম – এই ঘন্টি, কেক খাবি?
ঘন্টি উদাস চোখে পুকুরের জলে একটা ফড়িং – এর খেলা দেখতে দেখতে মাথা নাড়ল। আমি সকালবেলা জলখাবারের থেকে বাঁচিয়ে রাখা পাউরুটির টুকরোটা পকেট থেকে বার করে দিলাম।
ঘণ্টি সেটা মুখে দিয়ে আনমনে চিবোতে লাগাল।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম – কি রে কেমন লাগল বললি না?
ও বলল – ভালো, একটু সস হলে আরো জমতো।
আমি বললাম – দূর পাগলি কেক –এ কেউ সস খায় নাকি? একটু সিরাপ দিতে হয়, চকলেট সিরাপ…
– হুঃ তুই সব জানিস!
– আলবাত জানি, আমি অফিসে চাকরি করতাম তো, সেখানে খুব কেক কাটা হতো।
ঘণ্টি বলল – এই দেখ দেখ… ওই জলের ফোঁটাটায় রামধনু দেখা যাচ্ছে…
একটু মুখ ফিরিয়ে দেখলাম। জলের ফোঁটার রামধনু দেখতে পেলাম না, তবে ঘন্টির চোখে…
কেলো সদ্দার এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে, সাথে টিলুরানী।
কেলো বলল – এই যে রাধাকেসটো, চলো এবার চেক আপ হবে।
টিলুরানী হি হি করে হেসে উঠল।
আমি কেলোর সাথে হাঁটা দিলাম, একবার পিছন ফিরে দেখলাম টিলুরানী ঘন্টির হাত ধরে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
(দুই)
ডাক্তারবাবু বললেন – কি রে, আজ তো তোকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে!
মাসখানেকের মধ্যে বাড়ি যেতে পারবি তো?
দেখলাম বাবা মাও এসেছে, ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি হেসে মাথা নাড়লাম। তারপর সবার অলক্ষ্যে আস্তের উপর ডাক্তারবাবুর মোবাইলটা নিজের পাজামার কোমরের কাছে গুঁজে নিলাম। আমার চুরি করার বাতিক আছে, ক্লেপ্টোম্যানিয়া।
ডাক্তারবাবু বললেন – ঠিক আছে যা এখন। তোর বাবা মা কে সামনের মাসে তোকে নিয়ে যেতে বলে দিচ্ছি...
আমি বাবা মার কাছে গেলাম। বাবা আমার মুখে, গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। মা আমার বুকে মাথা রেখে বলল – কত রোগা হয়ে গিয়েছিস সোনা...এবার তোকে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে যাব...
পিছনে শুনলাম ডাক্তারবাবু বলছেন – এই আমার মোবাইলটা... কোথায় গেল? এই তো এখানে ছিল?
কেলো সদ্দার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাঁক করে আমার গলা চেপে ধরে বলল – বার কর , বার কর শয়তান, কোথায় রেখেছিস?
একমিনিটের মধ্যেই মাল বেরোল। মা ডুকরে কেঁদে উঠল, ডাক্তারবাবু বাবার দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়লেন। কেলো হিড়হিড় করে আমায় টানতে টানতে ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে চলল।
আমি একটা অফিসে চাকরি করতাম। সেখানে এমন চুরি চামারি শুরু করেছিলাম যে সবাই মিলে আমায় পুলিশে দিল। কেস হলে দেখা গেল যে আমি নাকি সাধারন অপরাধী না, মানসিক রুগি; তাই এখানে পাঠানো হলো।
এসে আলাপ হলো ঘন্টির সাথে।বাইরে থাকার সময় ওকে নাকি কেউ খুব ঠকিয়েছিল। দেহে, মনে চরম ঘা খেয়ে একসময় ও মানুষের সমাজের উপর বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলে। এখানে এসেও কারুর সাথে কথা বলত না, চার পাঁচবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
একটু সময় লেগেছিল ঠিকই, তবে আজ আমরা বন্ধু।
সুস্থ তো আমি কবেই হয়ে গিয়েছি, কিন্তু এখন আমি চাই একটা জিনিস চুরি করতে, মাত্র আর একটা... সেটা না করে বেরোতে পারব না কোনদিন...
ওয়ার্ডের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম ঘন্টির চোখে লেগে থাকা রামধনুটা আজ বিকেলে দেখব, ঠিক দেখবই...
সমাপ্ত
___________________________
© নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী
No comments:
Post a Comment