Thursday, 2 February 2017

।। মন খারাপের গল্প ।।

বয়স বাড়লে মানুষ বুড়ো হয়,গালে ভাজ পরে,চুলে পাক ধরে,ব্যাক্তিত্বে গাম্ভীর্য আসে।শৈশবের কোমলতা মাখা হাত পায়ের তালুতে কড়া পরে।উর্ধমূখী চিনি যুক্ত রক্তচাপ আর গ্যাস ভর্তী পাকস্থলী নিয়ে নুহ্য কাঠামোত বয়ে বেরানোটাই একসময় স্বাভাবিক দৃশ্য হয়ে যায়।
কিন্তু সময়ের তালে বয়স বেড়ে যাচ্ছে অথচ কচি একটা ভাব নিয়ে বসে আছে এমন মানুষ বরাবরই বিরক্তিকর।
এই মুহূর্তে আমার বিরক্তি শেষ সীমায় পৌছে গেছে।
আমার সামনে নাতাশার ফুফু বসে আছেন।মাঘ মাসের বাঘ কাপানো শীতে তিনি সিফনের পাতলা একটা ম্যাজেন্টা কালের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছেন।বেগুনী রঙা বয়কাট করা ছোটো চুলে বিশাল সাইজের লাল একটা কসমস কোনো এক ব্লাক ম্যাজিকের গুণেই হয়তোবা সেট করে রেখেছেন।
উৎকট মেকাপে তার  বয়স লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা প্রকট আকারে প্রকাশ পেয়েছে।
আর একটু পর পর মাধ্যমিকের "পাপা'স প্রিন্সেস " গলায় তিন আলিফ টানে "এয়্য্য...ই পাভেল" বলে আমাকে ডেকে উঠছেন।
কেউ দেখে বলবে না যে এই মহিলার পদার্থ বিদ্যার মতো একটা সিরিয়াস সাব্জেক্টে Phd ডিগ্রী আছে।
-এ্যই তুমি কি খুব কম কথা বল..
-জ্বি
-গুড, বেশী কথা বলা ছেলেদের আমার একদম পছন্দ না...কাজের বেলায় ঠনাঠন শুধু ভ্যাজর ভ্যাজর করে ঘিলুর পোকা নাড়িয়ে দিতে ওস্তাদ একেক্টা...কি ব্যাপার তুমি তো কিছুই খাচ্ছোনা, কফিটাও তো ঠান্ডা হয়ে গেছে মনে হয়..
-আমি কফি খাই না
-কফি খাও না।OMG! আমার তো কফি ছাড়া চলেই না,একবার কি হয়েছে শোনো, আমি তখন সবে মাত্র হাভার্ডে গিয়েছি.....
এই মহিলার সব গল্পই কুমিরের খাঁজকাটা লেজ নিয়ে লেখা গরুর রচনার মতোই "হাভার্ড কেন্দ্রিক"।সত্য মিথ্যা যাচাই করার অবকাশ নেই।সলিড সত্য বা মিথ্যা ধরে ফেলা যায়। কিন্তু গল্প বলায় ভয়াবহ রকমের পারদর্শীতা সম্পন্না এই মহিলা সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে এমন সব গল্প তৈরী করেন যা সলিডিটি ধরার  ক্ষমতা অনেক ক্রাইম স্পেশালিষ্টদের ধারণার বাইরে।
-কি..তুমি শুনছো তো...?
-জ্বি
-মুখের উপর চুল দাড়ি চাষ করে এ কি অদ্ভুত চেহারা বানিয়েছো!!খাওয়া দাওয়াতেও তো মনে হচ্ছে অনিয়ম করা হয়।ব্যাড, ভেরী ব্যাড।তুমি আয়না দেখোনা?আজ অবশ্যই তুমি সেলুনে যাবে..
-জ্বি যাবো
-কি সেই কখন থেকে শুধু "জ্বি" "হু" করে যাচ্ছ....
-আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি কিনা,তাই আপনার ইন্টেরেস্টিং গল্পের মধ্যে কথা বলে আপনার কন্সেট্রেশান নষ্ট করতে চাইছি না
-ওওও...হাউ সুইট ইউ আর।এই তুমি আমাকে ফুপু বলে ডাকতে পারো
-জ্বি ডাকবো
-এখন তোমার কথা বল শুনী, তারপর..কি করছো...আই মিন জব টব..?
-বেকার
-বেকার!!
-জ্বি বেকার
-বাট হোয়াই!! শুনেছি তুমি অনেক ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলে।একটা ভালো জব ম্যানেজ করা তো তোমার কাছে কঠিন কোনো ব্যাপার না,পারছো না কেনো?
-ঠিক পারছি না যে তা নয়,একটা মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে মাস তিনেক ছিলাম
-ছেড়ে দিলে!!
-জ্বি
-holly cow!!but why!!
-আসলে জয়েন করার প্রথম দিনেই বুঝতে পেড়েছিলাম আমি আসলে কর্পোরেট এলিমেন্ট নই।ওটা আমার ক্ষেত্র নয়।গৎবাধা নিয়মে পিষে যাচ্ছিলাম প্রতিদিন একটু একটু করে
-তোমার এখন চলছে কি করে?
-চলে যাচ্ছে একরকম
-কবিতা লিখে?
-ঠিক তা নয়,আমি ফরমায়েশি লেখক।উঠতি বরলোকদের একটা নতুন ট্রেন্ড চলছে,সাহিত্যমনা ব্যাক্তি হবার ট্রেন্ড, গল্প কবিতা লেখে।
-কি রকম একটু বুঝিয়ে বলতো..
-কয়েক বছর আগেও এরা ড্রইংরুমে ঢাউস সাইজের বেশকয়েকটা বুকসেল্ফ ভর্তী করে বই রেখে নিজেদেরকে রুচীশীল প্রমাণ করতেই ভালোবাসতো,কিন্ত এখন তারা সাহিত্যিক নামে সমাজে পরিচিতি পেতে চায়।কিন্তু হ্রিদ যন্ত্রের পাশে সাইন থিটা কজ থিটা রেখে তো আর তেমন জুতসই সাহিত্য চর্চা চলে না।আমরা তাদের হয়ে গল্প কবিতা লিখে দেই।
-এগুলো বিক্রি হয়?মানুষ কিনে পড়ে!!
-বিক্রি হয় দেদারসে,কয়েকটা তো বেষ্টসেলার হয়ে যায়। তবে পাঠক বলতে যাদের বুঝায়,তাদের ঘর পর্যন্ত পৌছে না এক্টাও।
-বুঝলাম না।
-বই ছাপানোর আগেই ওই সমস্ত ভদ্দরলোকেরা প্রকাশকের সাথে কন্ট্রাকে যায় যে ৭০% কপি তারা নিজেরাই কিনে নিবে।বাকি ৩০% মেলা শেষ হবার আগেই তারা বিক্রির ব্যাবস্থা করে দিবে।ব্যাস হয়ে গেলো বেস্ট সেলার।
-ওতগুলো বই কি কোনোই কাজে লাগে না!
-ওগুলো বছর ব্যাপী তাদের মার্কেটিং এর কাজে লাগে। লিফলেটের মতো বিলি করে ক্লায়েন্টদের মাঝে।
-ওগুলো তো অন্যের জন্য।নিজের জন্য কিছু লেখো?
-একজন লেখকের কাছে প্রতিটা লেখাই কিন্তু  তার সন্তানের মতো।দরিদ্র পিতা মাতা সন্তানের জন্ম দিয়ে হয়তো অভাবের কারণে দত্তক দেয়।কিন্তু বুক জুড়ে সন্তানের জন্য  মমতা  আজীবন পুষে রাখে।
-তা না হয় মেনে নিলাম,কিন্তু ফিউচার প্লান বলেও তো কিছু ব্যাপার থাকে না কি?
-তা অবশ্য থাকে
-so?
-ওভাবে কখোনো চিন্তা করিনি
-তা বললে কি চলে?তোমার সাথে সাম হাও নাতাশা ভূল করে তার জীবন জড়িয়ে ফেলেছে,আর আমি জেনে শুনে তোমার মতো একটা আধা-বাউণ্ডুলে ক্রাপ এলিমেন্টের ভাড়া-খাটা এ্যবসার্ড জীবনের সাথে বাপ মা মরা মেয়েটাকে এক্সেপ্ট করতে পারিনা।এ্যান্ড ইউ নো,ইউ ডোন্ট ডিজার্ব হার।নেভার এভার।
-জ্বি,আপনার উদ্বেক বাস্তব সম্মত,আপনার জায়গায় যে কেউ হলেই এমন ডিসিশনই নিতো
-থ্যানক্স,আমি সামনের মাসে নাতাশাকে সাথে নিয়ে UK ফিরে যাচ্ছি। ওকে বলা হয়েছে দের বছরের একটা কোর্স কম্পলিট করে আবার দেশে ফিরে আসবে।কিন্তু বাস্তবে তা হবে না।ও ওর ক্যারিয়ার UK তেই গঢ়ে নিবে।আর তুমি ওর সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখবে না।ফরগেট হার,লিভ হার এ্যান্ড ডোন্ট ট্রাই টু ডিস্ট্রয় হার।

মাথার উপড় সূর্য ভাদ্র মাসের মতো খা খা রোদ ঢেলে দিচ্ছে।মাঘ মাসের দুপুরে এমন হবার কথা নয়।ব্যাপারটা অতীমাত্রায় "এ্যাবসার্ড"।আমি ৬ নম্বর লোকালের অপেক্ষায় একটা সিগারেট জ্বালাই।শীতের দুপুরে সাধারণত মহাসড়ক গুলো ফাকা থাকে।আজ কিভাবে যেন ডাবল ডেকার মিনিবাস CNG রিক্সার কঠিন গিট্টু লেগে গেছে।তালপাতার সেপাইয়ের মতো ট্রফিক পুলিশ দূর্বল বেগে ভুলভাল হুইসেল ফুঁকছে।এমনটা সচরাচর দেখা যায় না।এ্যাবসার্ড।
আমি  প্রায় ফাকা একটা ৬ নম্বরে গিয়ে উঠলাম।এতো বছরের চেনা এই শহর, এই ৬ নং লোকাল যা কিনা কখনো খালি পেটে থাকেনি, এমন কি বিরোধী দলের তিব্র হরতালেও যার ফলফলান্তি কমেনি আজ তার এই রুপটাও বড় এ্যাবসার্ড লাগছে।
আসলে আমরা বোধয় নিজেদের অজান্তেই দুম করে কোনো একটা না মেনে নিতে পারা এ্যাবসার্ড ঘড়ির কাটায় আটকে গেছি।আর "মাস্টার অব ওয়াচ" ক্লান্তিহীন সেই ঘড়িতে দম দিয়েই চলেছেন।
জন্মগত ভাবেই মানুষের স্বভাব প্রথমে মেনে না নেয়া।জন্মের পর তিব্র আলো দেখে তা মেনে না নিতে পারার আকুতি জানিয়ে শিশুটাও এক সময় তা মেনে নিয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকায়।তেমনি ভাবে সকল এ্যাবসার্ড পরিস্থিতি মেনে নিতে নিতে তা এক দিন স্বাভাবিকতার স্বিকৃতি পায়।
প্রকৃতি নিজে রহস্যময় তাই সে রহস্য পছন্দ করে।
জ্যাম ছেড়ে বাস চলতে শুরু করেছে।ফাকা বাসে নিজেকে বেশ একটা ভী.আই.পি টাইপের  কিছু একটা বলে মনে হচ্ছে।তবে সমস্যা হোলো বাসের চাপা সিটে বসে তাদের মতো করে শহর দেখতে পারছিনা।গাড়ীর রঙিন কাচের ভেতর থেকে শহর কেমন দেখতে লাগে তা একবার দেখে নিতে হবে।সাথে থাকবে এক প্যাকেট সাদা বেনসন।মাঝে মাঝে গাড়ীর গ্লাস নামিয়ে খুব থুথু ছিটানো যাবে শহরটার গায়ে।
নাতাশার ফোন...
-কোথায় তুমি?
-বাসে
-মানে!!ফুপুর তো কথা ছিলো তোমাকে বাসায় নিয়ে আসার।আমরা আজ একসাথে লাঞ্চ করবো বলে আমি নিজের হাতে তোমার পছন্দের তেহারী  করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছি।আর তুমি এখন বলছো তুমি আসবে না...
-উনার কোনো দোষ নেই।আসলে খুব জরুরী একটা কাজ পরে গেলো হঠাৎ করে।
-আর আমি যে হাত পুড়িয়ে তোমার জন্য রান্না করলাম।তার কি হবে।
-সব ঠিক হয়ে যাবে।সময় সবচেয়ে বড় ঔষধ।সময় ঠিকই সব ক্ষত সারিয়ে দেয়।
-তোমার কি হয়েছে?ইজ এনিথিং রঙ?
-নাহ, সব ঠিক আছে।
-কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে।কি হয়েছে,বল আমাকে।
-নাতাশা উপহার পাওয়ার জন্য প্রিয় হতে হয়। অপ্রিয়রা অভাগা। তাদের ভাগ্যে উপহাস আছে, উপহার নেই। উপহার যাই হোক, উপহার বিষয়টাই দামী।
-তোমার কথা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।তুমি এমন করে বলছো কেনো?তুমি এমন করে বলবে না প্লিজ।আমার মনটাই খারাপ করে দিলে
-স্যারি নাতাশা.....

মন খারাপ মানুষের স্বাভাবিক অসুখ।শরীর খারাপের ঔষধ  বাসার নীচে ফার্মেসিতেই আছে।যদি শরীর খারাপের মাত্রা গুরুতর না হয় তাহলে কিছু একটা গিলে মোটামুটি আয়ত্তে আনা যায়।মন খারাপ হলে,মন খারাপ ভালো করার কোন ফার্মাসি নেই।মন যখন খারাপ হয় এমনিতে হয়, ভালো হওয়ার হলে এমনিতে ভালো হয়ে যায়। মন খারাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নেই। মন খারাপ হলে মনের কাছে চুপচাপ বসে থাকতে হয় আর মনের কপালে হাত দিয়ে বুঝে নিতে হয় জ্বরের মাত্রা কেমন। সামান্য? না ভয়ংকর?

__________________________
© মোহাম্মাদ সামি

No comments:

Post a Comment