Saturday, 11 February 2017

।। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ।।



রবিবার দিন নীলু সক্কাল সক্কাল আমার বাড়ি এসে হাজির। এসে সোজা আমার মাকে   বলে ওকে যেতে হবে কাশিপুর এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু পড়ার নোট আনতে ।  তাই আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে। নীলুর হাবভাব এমন যে আমার মাকে  বলা মানেই যেন আমি যেতে বাধ্য।   চেয়ে দেখি নীলু যাওয়ার জন্য কোনো সাজগোজ করে আসেনি।  অবশ্য কাছে পিঠে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার জন্য কে বা আর বেশি সাজগোজ করে। তখন নীলু সামনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।  তাই বেশ কদিন আমি ওর সঙ্গে দেখা করিনি।  অবশ্য সেটা ওকে বলেই আমি দেখা করা বন্ধ করেছিলাম।

নীলু অবশ্য বেশি সাজগোজ না করলেই ওকে বেশি স্মার্ট দেখায়।  আসলে নীলুর  সাজগোজ করার অভ্যাস নেই , সে একটু সাজগোজ করলে কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়। যাই হোক দেখি নীলুর ছিপছিপে শরীরে প্যান্ট আর কুর্তা পরাতে  বেশ ঝকঝকে লাগছিলো।  রবিবার কিছু করার নেই।  তাই আমিও রাজি হয়েগেলাম নীলুর সঙ্গে ওর বন্ধুর বাড়ি যেতে।

পাড়ার মোড়ে  এসেই নীলু বলে চলো রিক্সায় স্টেশন যাই।  কাশিপুর যেতে হলে আমার বাড়ি থেকে বাসে যাওয়াটাই সুবিধা। আমি বলি, ' তুই ট্রেনে করে কাশিপুর কি করে যাবি ?' নীলু বলে বসে , ' আমাকে কাশিপুর যেতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। ' আমি বলি, 'এইযে তুই বললি , নোট আনতে যাচ্ছিস কাশিপুরে তোর বন্ধুর বাড়ি। ' নীলু বলে , ' তখন ছিল কাশিপুর যাওয়ার প্ল্যান।  এখন প্ল্যান পালটে ফেলেছি।  গত কয়েকদিন পড়ে পড়ে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে।  তাই আজকে তোমার সঙ্গে স্বপ্নযাত্রা করতে  যাবো। '  আমি বলি , ' স্বপ্নযাত্রা  সে আবার কি জিনিস ?' নীলু বলে , ' স্বপ্ন কি বলে কয়ে দেখা যায়।  স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কাজেই অপেক্ষা করো , সবুরে মেওয়া ফলবে। '

শিয়ালদা স্টেশনে নেমে নীলুর ইচ্ছে হলো বাবুঘাটে গঙ্গার হওয়া খাবে।  তখন বাজে বেলা এগারোটা।  নেহাত ফেব্রুয়ারি মাস বলে গরম গায়ে লাগছেনা।  তাই দুজনে বাসে  করে হাজির হয়ে যাই বাবুঘাটে।  ওখানে বাস থেকে নেমেই এক ঝালমুড়িওয়ালা থেকে নীলু ঝালমুড়ি নিলো।  দুজনে  ঝালমুড়ি খেতে খেতে বাবু ঘাটের ভিতরে ঢুকি।  আমি নীলুকে বলি , 'তুই ঝালমুড়ি খেতে বাবুঘাটে এলি কেন ?' নীলু বলে আমার  স্বপ্ন তোমাকে বলি।  ভবিষ্যতে  একদিন আমরা প্যারিসে সেন নদীর পাড়ে বসে ফ্রেঞ্চ ওয়াইন  খাবো।  তখন সেন নদীর হওয়া কেমন লাগবে তা আমি গঙ্গার হওয়া দিয়ে তোমাকে ছুইঁয়ে রাখছি। ' বেশ বুঝলাম আজ নীলুকে স্বপ্নতে  পেয়েছে।  নীলু কোনোদিন তার স্বপ্নের কথা বলেনা।  কেবল মাঝে মাঝে বলে. ' আমি জানি আমাদের দুজনের  ভবিষ্যৎ পরিষ্কার সুন্দর।  তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করিনা। '

সেই বাবুঘাটে বসে আছি।  ফুরফুরে হওয়া দিচ্ছে।  নীলু চুপ করে বসে সারা গায়ে যেন হওয়া মাখাচ্ছে।  দেখে মনে হলো ওই আলখেল্লাধারী বুঝি নীলুর জন্য লিখে রেখেছিলেন

" আজ    একেলা বসিয়া , আকাশে চাহিয়া ,
            কী সাধ যেতেছে , মন!
    বেলা চলে যায় — আছিস কোথায় ?
           কোন্‌ স্বপনেতে নিমগন ? "

বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নীলু বলে চলো মিউজিয়াম যাই।  আমি বলি, ' হটাৎ তোর আবার ইতিহাসে যাওয়ার ইচ্ছে হলো কেন ?' নীলু কোনো উত্তর না দিয়ে গেয়ে উঠলো
"স্বপন যদি মধুর এমন,
হোক না মিছে কল্পনা
জাগিও না আমায়, জাগিও না।।"

মিউজিয়ামে টিকিট কেটে ঢুকেই ভিতরে যে টানা বারান্দা আছে , সেখানে পাতা এক বেঞ্চিতে বসে পড়লো।  মাথার উপর ওই অতটা উঁচু সিলিং থেকে যে ফ্যানটা চলছে তার থেকে ঘটর ঘটার শব্দে বেশ হওয়া পাচ্ছি।  ঘড়িতে দেখি প্রায় একটা বাজে।  আমি বলি, ' চল মিউজিয়াম দেখবি যদি , তাড়াতাড়ি দেখে বাইরে কোথাও কিছু খেয়ে নেবো। ' নীলু দেখি কেমন এক ঘোরের  মধ্যে বলছে , ' একদিন লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইজিপ্সিয়ান আর্ট গ্যালারি দেখবো , প্যারিসে লুভরেতে মোনা  লিসাকে দেখতে যাবো।  তখন কি তুমি কেবল খিদে পেয়েছে বলে আমায় তাড়া  দেবে। '  আমি বলি সে যখন আমরা ভবিষ্যতে যাবো তখন ভাববো , এখন শরীরটাকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ ?'  নীলু দেখি আমাকে যেন আস্বস্ত করার জন্য বলে , ' সব হবে , সব হবে।  সাধে কি আর পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন

"অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।"

কলকাতা মিউজিয়াম পুরো দেখতে অনেকটা সময় লাগে।  দুজনে ঘুরে ঘুরে দেখছি , নীলু দেখে আর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে চলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কি কি ও দেখতে চায় , লুভরেতে কোন কোন শিল্পীর আর্ট ওয়ার্ক দেখার প্ল্যান ভবিষ্যতে।   মিউজিয়াম দেখে বেরিয়ে , শেক্সপিয়ার সরণির মুখে , একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে  দুজনে মশলা দোসা আর কফি খেলাম।  ঘড়িতে দেখি পাঁচটা বাজে।  নীলুর সঙ্গে দিনটা কোথা  দিয়ে পার হয়ে গেলো টের পেলামনা।  আমি বলি , ' তোর যদি স্বপ্নযাত্রা শেষ হয়ে থাকে , চল এবার বাড়ি ফিরে যাই। ' নীলু বলে, ' ধুর এখনো পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড ঘোরা  বাকি আছে ।  চলো ভিক্টরিয়াতে  যাই। ' আমি বলি , ' এখন পাঁচটা বাজে।  ভিতরে ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে। ' নীলু উত্তর দেয় , ' ঢুকতে না হয় দেবেনা , কিন্তু ভিক্টরিয়া  মেমোরিয়ালতো আর চাদরে ঢেকে দেয়নি। '

ভিক্টরিয়াতে এসে পৌঁছতেই , নীলু লেগে গেলো ঘোড়ার গাড়ি দেখতে।  বেছে বেছে একটা সাদা ঘোড়ার গাড়ি পছন্দ করলো।  দুজনে ঘোড়ার গাড়িতে বসতেই নীলু গাড়োয়ানকে বলে , ' যতদূর যাওয়া  যায় , আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। ' তারপর আমাকে বলে , ' একদিন এমনি এক সাহেব গাড়োয়ানের ঘোড়ার গাড়ীতে বসে আমরা দুজনে , লেক জেনিভার ধারে ধারে ঘুরতে ঘুরতে সুইস চকোলেট খাবো।  ঘোড়ার গলার ঘন্টি যখন বাজতে থাকবে , তখন আমি তোমার মুখে শুনতে চাইবো  সুনীল গ্যানোপাধ্যায়ের কবিতা

"এই পৃথিবী বিদেশ তোমার
কতদিনের জন্য এলে?
বেড়াতে আসা, তাই তো মুখ অমন সুখ-ছোয়া!
যতি তোমায় বন্দী করি, মুঠোর মধ্যে ভ্রমর ধরি
দেবতা-রোষে হবো ভস্ম ধোঁয়া?"

আমি নিজের ঘড়িতে দেখি সেকেন্ডের কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে, আর ঘড়ির  তারিখ আর মাস দেখাচ্ছে  ১৪ই ফেব্রুয়ারি।
_____________________________________
© সনৎ মিশ্র

No comments:

Post a Comment