এই যে দাদারা বৌদিরা দিদিরা ভাইয়েরা বোনেরা... আপনারা যারা এই বাসে দাঁড়িয়ে বসে চলেছেন....আপনারা যাঁরা লোহা চিবিয়ে খেয়েও হজম করতে পারেন....যাঁদের পেটে জল পড়লেও অ্যাসিড হয়ে যায়, চোঁয়া ঢেঁকুর ওঠে... গলা বুক জ্বালা করে... তাঁদের সবার জন্য এনেছি রূপমতী হাজমা চূর্ণ...
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁপাতে থাকে সত্যেন।
আজ তেত্রিশ বছর হল এই কাজ করেই চলেছে ও। ওর বাবাও লোকাল ট্রেনে এরকম হাজমা চূর্ণ বিক্রি করতেন। অসাবধানে রানিংয়ে নামতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। সত্যেন তখন পাঁচ। ছোট্ট পা দুটো বাবার ছেড়ে যাওয়া জুতোয় তখনই গলানো। লোকাল ট্রেন দিয়ে শুরু। তারপর ট্রাম কোম্পানী যবে থেকে বাস চালাতে শুরু করল, তবে থেকে বাসেই। শহরের শিক্ষিত লোকের
হাতে টাকা বেশি। তারা পঞ্চাশ টাকার বড় ফাইল কিনতে দু বার ভাবে না। এই করেই তো কমলাকে বিয়ে করল। এই করেই ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করল। নেহাৎ কপাল মন্দ তাই ফরসা টুকটুকে ছেলেটা....
এ সব কথা ভুলে থাকতে চায় সত্যেন।তাই একটু দম নিয়ে জোর গলায় ফের শুরু করল -
... আপনারা যারা রোজ এই বাসে যাতায়াত করেন, তাঁদের আর নতুন করে বলবার মত কিছু নেই.... এই চূর্ণ অ্যাসিডিটি গলা বুক জ্বালা ভালো করে, লিভার সুস্থ ও সবল রাখে, পেটে গ্যাস হতে দেয় না....স্যাম্পেল ফাইল খোলাই আছে, যাঁরা যাঁরা টেস্ট করতে চান, একটু কষ্ট করে হাতটা বাড়ান....আজ আর মাত্র কয়েকটা বড় ফাইলই আছে....
আজ ভাগ্য খুব সদয়। দিনটাও ভাল। একে সরস্বতী পুজো, তায় বাইপাসের ধারে বইমেলা শুরু হয়েছে। সারাদিন ধরে দু ব্যাগ ভর্তি সব ছোট বড় ফাইল বিক্রি হয়ে গেছে। শেষ তিনটে ছিল। হলদে শাড়ি পরা তিনটে ছোট্ট মেয়ের বায়নায় তাদের বাবারা কিনে নিল।
" ও চাচা, আমাকে একটা দশ টাকার পাউচ দাও তো"
চেনা গলা শুনে পেছনের সিটের দিকে ফিরে তাকায় সত্যেন। কি ব্যাপার? মনিরুল বাসে চ্যবনপ্রাশ-লজেন্স না বেচে বাবুদের ঘরের ছেলের মত সিটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কেন! অন্য দিন তো দু জনে এক বাসে উঠলে পুঁচকে ছেলেটা হাঁকডাক করে ওকে বাস থেকে নামিয়ে ছাড়ে। আর দুজনে একসঙ্গে থাকলে মনির চ্যবনপ্রাশই বিক্রি হয়। আট বছরের বাচ্চার কাছে বরাবরই হার মানে সত্যেন।
" দশ টাকার পাউচ শেষ হয়ে গেছে, বাবু। পরদিন যখন দেখা হবে ঠিক দেবো। আজ সব ফাইল শেষ হয়ে গেছে।" ছেলেটার ওপরে জমে থাকা যাবতীয় বিরক্তি যাত্রীদের কাছে লুকিয়ে যথেষ্ট ভদ্রভাবে বলার চেষ্টা করল সত্যেন।
" আজ দিনটা বহুৎ ভালো আছে চাচা। আমারও সব প্রোডাক্ট বিক্রি হয়ে গেছে। তাই ভাবলাম এক পাউচ হজমি কিনে খাই।"খুশিতে উচ্ছল হয়ে বলল মনি। " আজ বাসে ভাড়াও দিয়েছি। কন্ডাক্টরকাকু নিতে চাইছিল না, তা ও।"
মনির পাশের সিট খালি হতে বসে পড়ল সত্যেন। কন্ডাক্টরের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ভাড়া দিল সে ও। এই বাসের স্ট্যান্ডে নেমে একই অটোয় শেষ পর্যন্ত গিয়ে মনি আর সত্যেন আলাদা আলাদা ভ্যানে বাড়ি চলে যেতে পারে। যে দিন বিক্রি ভাল হয় না, এতটা পথ হেঁটে ফিরতে হয়। আজ অবশ্য হাতে অনেক টাকা। মনির সঙ্গে একই ভ্যানে উঠবে সত্যেন। ময়নার ঘরে যাবে মস্তি করতে।
"সাহেব আজ স্কুলে যাওয়া হয়েছিল? আপনাদের মাথাভাঙা ইস্কুলে তো সরস্বতীপুজো হয়। খিচুড়ি ও খাওয়ায় না কি?" আলাপের ছলে মনিকে জিগ্যেস করল সত্যেন।
" খিচুড়ি হলে আর খেয়ে আসা হত না চাচা। পুজোর পর মিষ্টির প্যাকেট দিল সেই নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। এখানকার কটা স্কুলের সামনে বসলাম তো চ্যবনপ্রাশ লজেন্সের ভালো সেল হল। " খুশিমনে বলল মনি।
" বাই দ্য ওয়ে, আমার স্কুলের নাম মাথাভাঙা জি.এস.এফ.পি স্কুল। গভমেন্ট স্পনসর্ড ফ্রি প্রাইমারি। বুঝলে?"
বিজ্ঞের মত মুখ করে বলল মনি।
" আই অ্যাম ইন ক্লাস থ্রি।"
" বাপ রে বাপ। আমি কিছু বুঝি নি আর বুঝতেও চাই না। একেই মাথাভাঙা, তার ওপর এ সব বলতে গিয়ে এই বুড়ো বয়সে দাঁতগুলো ভাঙুক আর কি।" কতকটা পরিহাসের ছলে বলে ওঠে সত্যেন।
মনি পরিহাস বোঝে না। চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে,"লেখাপড়া তো করো নি চাচা। ইস্কুলের নামে তোমার ওই মাথা আর দাঁত ই ভাঙবে। জ্ঞান হচ্ছে আলো। মন দিয়ে লেখাপড়া শিখলে অশিক্ষার সব অন্ধকার দূর হয়ে যায়। জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে।" বোধহয় মাস্টারের শেখানো কথা বলতে বলতে কেমন উদাস হয়ে যায় মনির গলা।" আমার আব্বা, আমার দাদি যদি একটুও লেখাপড়া শিখত, তো আমার আম্মাকে তখন সদর হাসপাতালে নিয়ে যেত। ওই অবস্থায় বাড়িতে থেকে আম্মা আর সবে জন্মানো ছোট্ট বোন দুজনেই ওভাবে মরত না।"
মনির কথায় অজান্তে চোখে জল এসে যায় সত্যেনের। মনে পড়ে যায় কমলার ফ্যাকাশে মুখটার কথা। বিয়ের সময় সাক্ষাৎ কমলাই ছিল সদ্য তরুণী মেয়েটা। অভাবের তাড়নায় বাপ মা মরা মেয়েটার মামা প্রায় হাত পা বেঁধে মেয়েটাকে জলে ফেলে দিয়েছিল সত্যেনের মত কেলেকুচ্ছিৎ মানুষটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে।
তা, বছর ঘুরতে ছেলেটা হয়েছিল কমলার মত ফুটফটে সুন্দর। শখ করে কমলা নাম রেখেছিল সুদর্শন। চার বছরে পারুলডাঙা জি.এস.এফ.পি স্কুলে তাকে ভর্তিও করেছিল সত্যেন। কিন্তু, ভগবানের কি ইচ্ছে, পাঁচ বছর বয়সে ওই স্কুলের মাঠেই প্রার্থনা করতে গিয়ে হঠাৎ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ছোট্ট ছেলে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ।
তারপর থেকে কমলার সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় চুকেবুকে গেছে। হাতে টাকা থাকলে মদের ঠেক কিংবা ময়নার ঘরে গিয়ে বডি ফেলে সত্যেন। কমলা শহরে লোকের বাড়ি আয়াগিরি করে কি ভাবে চালায় ফিরেও দেখতে যায় না। শুধু হাতে টাকা না থাকলে কমলার কাছে যায়। ঘরের কোণে মুখ গোঁজে। কমলার একা একা কি ভাবে দিন কাটে সে জানতেও চায় না।
ভি.আই.পি রোডের ওপর অনেকগুলো শপিং মলের সামনে স্টপেজ। এখানে বাস প্রায় খালি হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াল বাস। সত্যেনের কি মনে হল, মনিকে বলল, " মনি, চল, এখানে নেমে ওই বড় বড় দোকানগুলো একটু দেখে যাই। সবে তো সন্ধে। কিছু কিনি না কিনি, জিনিসপত্তর একটু নেড়েঘেঁটে দেখতে ক্ষতি কি?"
" বেশ, চল" বলে মনি সত্যেনের সঙ্গে নেমে পড়ল।
ডিপ সবুজ রঙয়ের প্যারাসুট কাপড়ের টুপিওয়ালা জামাটা বেশ পছন্দ হল সত্যেনের। ঠান্ডায় উইন্ড চিটারের কাজ করবে। আবার গরমকালেও বেশ আরাম দেবে। মাত্র তিনশো।
" দেখ তো মনি, এই জামাটা কেমন? তোর পছন্দ হয়?" ট্রায়াল রুমে মনির গায়ে পরিয়ে মনির মূল্যবান মতামত জানতে চায় সত্যেন।
" ওয়াও। সো কিউট।" উজ্জ্বল মুখে বলে ওঠে মনি।
" কার জন্যে, চাচা?"
" ধর তোর জন্যই।" উত্তর দেয় সত্যেন।
" এ মা না না। তুমি আমার জন্য মেলা খরচ করতে যাবে কেন চাচা? আমাকে তো স্কুল থেকে এই নীল সোয়েটারটা দিয়েছে।" প্রবল আপত্তি জানায় মনি।
" আর আমি তো ময়লা। ওই জামাটা তোমার ছেলে সুদর্শন বেঁচে থাকত তো তাকে মানাতো।"
" আমিও তো তোর মতই ময়লা। তুই এটা পরলে আমার ছেলেকে উৎসবের দিনে নতুন জামা কিনে দিতে পেরেছি ভেবে আমি শান্তি পাবো।" সত্যেনের এই কথার পর মনি জামাটা নিয়ে নেয়।
অটো থেকে নেমে সত্যেন ভেবেছিল মনির সঙ্গে একই ভ্যানে উঠে ময়নার কাছে যাবে। কিন্তু সে আর হল কই?
" চাচা, তুমি কি এখন বাড়ি ফিরবে? তাহলে আর আমাকে তোমার ওদিকে যেতে হত না। চাচিকে এটা দিতে হবে।" কাঁধের ঝোলার মধ্যে থেকে একটা প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিল মনি। প্যাকেটের মধ্যে এক শিশি দামী টনিক।
" তোকে আনতে বলেছে?" জানতে চায় সত্যেন।
" না না। শি ইজ আ গুড গার্ল।" শালা দু দিন স্কুলে পড়ে সবসময় ইনজিরি আওড়ায়। দু দিনের যোগী ভাতকে বলে অন্ন।
" আজ কি না বচ্ছরকার দিন। জমানো টাকা থেকে কিছু নিয়ে বেরিয়েছিলাম। বাকি টাকা রোজগার হল। তাই দিয়ে চাচীর জন্য কিনলাম। শি ইজ প্রেগন্যান্ট। দেয়ারফোর শি নিড ইট।"
প্রেগন্যান্ট কথার মানে জানা আছে সত্যেনের। কিন্তু সে কি? ও জানে না ওর ঘরের খবর বেপাড়ার ছেলেটা জানে!
" তুই জানলি কি করে?"
এই বিরাট প্রশ্নটার প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে মনি।
" আমাদের পাড়ার সবাই জানে। আমাদের পাড়ার কুমকুমদির তো তোমাদের ওদিকে বিয়ে হয়েছে। ওর সঙ্গে চাচি ওর বাপের বাড়ি এসেছিল। তখনই ওরা আলোচনা করছিল, আমি শুনেছি। কি না কি তিন মাস।"
"তা তুই এই পুঁচকে ছেলে তুই কি করে জানলি এ সময় এইসবের দরকার?" চোখ ছানাবড়া করে জানতে চায় সত্যেন।
" আমাদের স্কুলে তো গত মাস থেকে আয়রন পিল খাওয়ানো শুরু হয়েছে। প্রথম দিন একজন ডাক্তার গার্জেন্স মিটিং করে সব বোঝালেন। আমরাও ছিলাম। আর আমার আম্মা যখন মরল, সবাই বলল গায়ে একটুও রক্ত নেই। একটা টনিক খেতে পারলে বেঁচে যেত।" উত্তর দিল মনি।
" এটাই সেই টনিক তোকে কে বলল?"
" কে আবার বলবে? টিভিতেই তো অ্যাড দেয়। আমি দেখেছি।" খুব সহজভাবে সত্যেনের কথার উত্তর দিল মনি।
" কিন্তু কথাটা একটু ভুল বলা হল বুঝলে? দাঁড়াও কারেকশন করি।
শি ইজ প্রেগন্যান্ট। দেয়ারফোর শি নিডস ইট।"
________________________
© শর্মিষ্ঠা নাহা
No comments:
Post a Comment