~এক~
হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিল সে। হাঁটা না বলে, প্রায় দৌড়ানোই বলা উচিত। নটা পাঁচের লোকালটা ধরতেই হবে। না হলে মিস হয়ে যাবে ইন্টার্ভিউটা। সাধারণ গ্র্যাজুয়েটদের কপালে এমনিতেই ইন্টার্ভিউের সুযোগ বেশি আসে না। তার ওপর, তার কোন অভিজ্ঞতা নেই এবং বয়সটাও তিরিশ ছাড়িয়েছে বেশ কয়েক বছর হল। সুতরাং, এই ইন্টার্ভিউটা সে কিছুতেই মিস করতে পারবে না। কয়েক বছর আগেও, বাংলা ছবিতে এই রকম বেকার ছেলের পরিবারে অবসরপ্রাপ্ত বাবা এবং বিবাহযোগ্যা বোন থাকত। এরও আছে। বাবার পেনসন আর নিজের টিউশনের টাকায় সংসার এখনো কোনোমতে চলে যায়। কিন্তু সে বেশ বুঝতে পারে, দারিদ্রের থাবাটা ক্রমশ আরও বড় হচ্ছে। সংসারের প্রাণচাঞ্চল্য, খুশি, হাসি সবই দুর্লভ হয়ে উঠছে, রেসনের কেরোসিনের মত। মোটা কাঁচের চশমার পেছনে বাবার চোখদুটো কেমন যেন মরা মাছের চোখের মতো লাগে। মা সারাক্ষণ কি যেন ভেবেই চলে। বান্ধবীগুলোর বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকে বোনটা নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। বয়সের চেয়েও বুড়ি লাগে ওকে।
তাই তার চাকরীটা শুধুমাত্র সংসারের আর্থিক স্বাছন্দের নয়, সুখের ঘরের চাবিকাঠি। মুক্তির বাতাস। তাই সে হাঁটা থামিয়ে একটা রিকশা নেয়। বলে, “একটু তাড়াতাড়ি ভাই। ট্রেনটা মিস হয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
বয়স পঁচিশ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, সুশ্রী, ঘরোয়া, গৃহকর্ম নিপুণা, সঙ্গীতজ্ঞা অবসরপ্রাপ্ত পিতার একমাত্র কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্র চাই। একমাত্র ভ্রাতা বেঃ সঃ চাকুরে।
বেশ কয়েক বছর ধরে, মাঝে মাঝেই রবিবারের কাগজে বিজ্ঞাপনটা দেয় বাবা। সে অনেকবার বারন করেছে। বাবা শোনেনি। তবে, এবার সম্ভবত শুনতে হবে। এই বিজ্ঞাপনের খরচ টানা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে বাবাকে এর জন্য জমা টাকায় হাত দিতে হয়। সেই বা আর কত আছে! এক যদি দাদার চাকরীটা হয়ে যায়, তাহলে অন্য কথা। গত কয়েক বছর ধরে, এই বিজ্ঞাপনের বয়ানের কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিছু কিছু একই আছে। আবার কিছু ইচ্ছাকৃত ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মিথ্যে বলা হয়েছে। যেমন, বয়সটা একই আছে। সঙ্গীতের জ্ঞান যে পাড়ার মাস্টারের কাছ থেকে অর্জিত এবং সেটাও ক্লাস এইটের পর থেকে আর হয়নি, সেটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। গৃহকর্ম নিপুণা, এটা সত্য কথা। দাদার চাকরীটা নির্জলা মিথ্যে। আর আগে পাত্র নিয়ে যে চাহিদাগুলো ছিল, যেমন - সরকারি চাকুরে, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, ব্যাঙ্ক কর্মী, নিজ বাড়ি, কলকাতা নিবাসী ইত্যাদি, সেগুলো বর্জিত হয়ে শুধুমাত্র উপযুক্ততে এসে ঠেকেছে।
যাইহোক, আজ পাত্রপক্ষের আসার কথা আছে। এদিকে আজকেই দাদার ইন্টার্ভিউ। তাই তারা দিনটা চেঞ্জ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা রাজি হয়নি। আগে মেয়ে দেখতে এলে বাড়ীতে বিশাল হইচই পড়ে যেত। এখন আর সেরকম হয় না। বরং বাড়তি খরচের কথা ভেবে চিন্তাই হয়। আগে পাত্রপক্ষ না বলে দিলে, তার বিশাল মন খারাপ হত, লজ্জা লাগত, নিজেকে দোষী মনে হত। এখন তার অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে আজকের ব্যাপারটা একটু আলাদা। পাত্র বিপত্নীক, বয়স একটু বেশির দিকে এবং ব্যবসায়ি। তাই মনে একটা আশা জেগেছে। মনে মনে একটা গানও বেছে রেখেছে, শোনাবে বলে। ঠিক করে রেখেছে, বিকেলে ওরা আসার আগে ফেস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধোবে।
তার বিয়েটা যদি হয়ে যায়, তাহলে শুধু সে নয়, এই পরিবারটাও বেঁচে যাবে। তাই আজ সবকিছু করতে রাজি সে, শুধু পাত্রপক্ষের মুখে হ্যাঁ টুকু শোনার জন্যে।
ছেলেটার এখনো কোন একটা হিল্লে হলনা। ভেবেছিলাম, রিটায়ারমেণ্টের আগেই ও যা হোক কিছু একটা জুটিয়ে নেবে। কিন্তু কিছুই হলনা। ছেলেটা কোনদিনই পড়াশোনায় বিশেষ ভাল ছিলনা। আর প্রাইভেট ফার্মে কেরানীর চাকরি করে ওর পেছনে বেশি খরচ করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তারপর মেয়ের বিয়ের জন্যও কিছু রাখতে হত। যখন চাকরি ছিল তখন সংসারটা তবু একরকম চলে যেত। এখন সংসারটা যেন গিলতে আসে। অসুখবিসুখের জন্য জমান টাকাতেও হাত দিতে হয়েছে। আর পেরে উঠছি না। তবে, আজকের দিনটা একটু অন্য। ছেলেটা একটা চাকরির খোঁজ পেয়েছে। মেয়েটাকেও দেখতে আসছে বিকেল বেলা। একটা ব্যাপারে মনটা খচখচ করছে। আদরের মেয়েটার জন্য শেষে বিপত্নীক পাত্র! বয়সটাও বেশি। মেয়ে অবশ্য কিছুই বলেনি। মেয়ের মাও নয়। ছেলেটাই যা একটু গজগজ করছিল। সে করুক গে। বিয়েটা হয়ে গেলে মেয়েটার ভালই হবে। দিনকে দিন ও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটাও। বড় ভয় করে।
আজ সকাল সকাল উঠেই, রান্নাঘরে ঢুকতে হয়েছে। ছেলেটার চাকরির পরীক্ষা আছে আজ। তাড়াতাড়ি বেরুবে। যদি চাট্টি ভাত মুখে দিয়ে বেরোয়, তাহলে মনে একটু শান্তি থাকে। সারাদিন কি খেল, কোথায় খেল ভাবতে হয়না। এদিকে আজকেই ছেলের বাড়ী থেকে আসছে, মেয়েটাকে দেখতে। তাদের জন্যও একটু বিশেষ আয়োজন করতে হবে। ঘরদোর গোছাতে হবে। অন্যান্য দিন মেয়েটা হাতে হাত লাগায়। কিন্তু আজ আর সে মেয়েটাকে রান্নাবান্নায় ঢুকতে দেয়নি। বলা তো যায়না, যদি কিছু ঘটে যায়। ছেলেটির বয়েস বেশি। দোজবরে। তাই প্রথমে কেমন কেমন লাগছিল। পরে মনকে বুঝিয়েছি, পাত্র যেমনই হোক, বিয়েটা জরুরি। আর মেয়েকে একেবারে জলে ফেলে দেয়াও তো হচ্ছেনা। তাদের মেয়েও তো আর ডানাকাটা পরী নয়। বরং দেখতে গেলে, এদের পছন্দ হতে পারে। মন বলছে কিছু একটা হবে। হরির লুট দেব ঠাকুর।
রাতে খেতে বসেছে চারজন। রাতের খাওয়াটা ওরা এক সাথেই সারে। বেশ হাসিখুশি সকলেই। না, ভাল কিছু ঘটেনি এদের কপালে। ছেলেটি ইন্টার্ভিউ দিতে পারেনি, চাকরির দাবিতে অবরোধের জন্য। মেয়ে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু পাত্রপক্ষ যে দাবি করেছে, সেটা মেটাবার ক্ষমতা বাবার নেই। তারচেয়েও বড় ব্যাপার, বাড়ীওলা গুন্ডা নিয়ে এসে বাড়ী ছাড়ার হুমকি দিয়ে গেছে। তবুও ওরা হাসছে। ছেলেটা হেসে হেসে বলছে অবরোধের কথা। সবাই কেমন অবরোধের নিন্দা করছিল, কিন্তু কেউই এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করছিল না। সে যখন প্রতিবাদ করে মার খাচ্ছিল, তখন সবাই কেমন উদাস হয়ে আকাশ দেখছিল। মেয়েটা হলেও হতে পারত বরের চেহারার সাথে মোষের চেহারার সাদৃশ্য বোঝাচ্ছিল। "মোষেও আজকাল বিয়ের সময় টাকা চায়", মা বলে মুচকি হেসে। বাবা বাড়ীওলা আনিত গুণ্ডাগুলোর সাথে ফড়িঙের একটা তুলনামুলক আলোচনায় ব্যস্ত ছিল।
"আমাদের আমলের গুন্ডারা কেমন চেকনাই ছিল বলো তো?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমাদের সময়ের তেল ঘি থেকে গুন্ডা পর্যন্ত সব খাঁটি ছিল", মেয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। যদিও সে ঝাঁঝের মধ্যেও একটা মিষ্টি ব্যাপার ছিল।
সবাই খুব কথা বলছিল আর হাসছিল।
তারপর হটাত করে সবাই চুপ হয়ে যায়। চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে ঢুকে যায় যে যার ঘরে। আলো নিভে যায়। পড়ে থাকে এঁটো বাসনগুলো। ঘড়িটা শুধু বিরামহীন টিকটিক শব্দে এগিয়ে চলে।
পরের দিন সকালে, কাগজের প্রথম পাতায় বেরোয় খবরটা-- সপরিবারে আত্মহত্যা।
~দুই~
পূর্ণিমার রাত। রুপালি সোনা গলে গলে পড়ছে সমুদ্রের বুকে। জোয়ারের টানে সাগর এখন উদ্দাম, উচ্ছল, মোহময়ী। বড় বড় ঢেউগুলো না জানি কিসের আমন্ত্রন জানাচ্ছে।
নিজের ঘর থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন তিনি। খালি গা। প্রেমাশ্রুতে ভরা দু চোখ। সিক্ত কপোল। আলিঙ্গনলিপ্সু দু হাতে মিলন বাসনা। হৃদয়ে বিরহ বেদনা। মুখে শুধু তাঁর নাম। আজই সেই পরম ক্ষণ। সময় হয়েছে সেই পরম মিলনের। যাঁর ধেয়ানে এই পথ চলা, আজ লীন হবেন তাঁর মাঝে। উদ্বাহু হয়ে ছুটে চললেন তিনি। সাগরের জল ধুইয়ে দিল তার চরণদুটি। প্রেম সাগরে ডুব দিলেন সেই মহামানব।।
____________________________
© শোভন বাগ
No comments:
Post a Comment