Sunday, 5 February 2017

।। ভূদেবল্যান্ড ।।



জয়দেব গুঁই যেদিন তার বউকে প্রথমবার নগেন মিস্তিরির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সেইদিন থেকেই তার দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে শুরু করেছিল। অঘ্রান মাসের পড়ন্ত বিকেল, নিভু নিভু আলোয় বাঁশের বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল দুজনায়, ঠিক যেন কপোত-কপোতী। জয়দেব অবাক হয়ে দেখলো, লুচ্চা নগাটা তার বৌয়ের হাত ধরে আছে, কিন্তু মানদাও ছাড়িয়ে নেবার সেরকম কোনো চেষ্টাই করছে না। বরং কেমন লজ্জা-লজ্জা মুখ করে ঠোঁট টিপে হাসছে।
   মুখে শ-কার, ব-কারের ফেনা তুলে, ঘুসি পাকিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল জয়দেব। নগা মিস্তিরিও বেগতিক দেখে একখানা আধলা ইঁট তুলে নিয়েছিল, তাই খুনোখুনির বদলে কিছু অপ্রাকৃত শব্দের আদানপ্রদান করেই সেযাত্রায় সন্তুষ্ট থাকতে হল। ঝাল মেটাতে, বৌয়ের পিঠেই দুটো প্রবল কিল বসিয়ে দিয়ে, ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গিয়েছিল জয়দেব।
   বিপদটা টের পাওয়া গেল ভোররাতে বাহ্যে গিয়ে। পুবের লালচে আকাশ পেছনে করে বসতে হয়, অন্যদিন জলছোঁচের আগেই সূয্যিঠাকুর উঠে পড়ে চারপাশটা ফরসা করে দেন। আজ কিন্তু দু'হাত দূরে রাখা গাড়ুটাও কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে! একখাবলা ঝুঁঝকো আঁধার যেন ভারি হয়ে চেপে আছে চোখের ওপর। অজানা ভয়ে বুক দুরদুর করে ওঠে। চেনা রাস্তা, তবুও ফেরার পথে বারকতক হোঁচট খেল জয়দেব।
   বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রথমে গেল চোখ। তারপর, একদিন প্রতিবেশীরাই বাড়ি বয়ে এসে খবর দিলে, নগা মিস্তিরি তার বউকে নিয়ে ভেগেছে।

               দাঁত নড়ে, দাঁত কনকন করে
                  দাঁতে যদি পোকা ধরে
... আসুন বাবু, মাজন লাগবে নাকি?
 
               দাঁত নড়ে, দাঁত কনকন করে
                   দাঁতে যদি পোকা ধরে
               সে দাঁত মুক্তার ন্যায় পরিষ্কার করে
                    দাদাভাই, লাল-কালো ছোপ থাকেনা,
                          থাকেনা-
               জয়দেবের কালো মাজন নিতে ভুলোনা।
...মাজন পছন্দ হল, বাবু?

-কত করে নিচ্ছিস?
এতক্ষণ মাজনের শিশিটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে ভুরুদুটো নির্ঘাত কুঁচকে গেছে সংশয়ে, একটু দোটানায় পড়ে গেছে ছোকরা। ভাবছে বেকার গাঁটগচ্চা দেবে কিনা... ছেলেটার মুখ স্পষ্ট দেখতে পায় না জয়দেব, কেমন যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া! তবুও, আন্দাজে চেনা ছকটা ধরে ফেলতে অসুবিধা হয় না।
-একটা শিশি দশ। আপনি দুটো ন্যান, নাহয় পনেরো দেবেন।
-"নাহ্! একটাই থাক।" দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে পকেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটা। "দে দে, জলদি!"
-"আপনেই তুলে ন্যান, বাবু! আমি তো...বড়-ছোট তফাত হয়না ঠিক!" জয়দেব একটা অসহায় হাসি হাসে। "আর পয়সাটা উদিকে-"
-"অ! মালটা আবার কানার হদ্দ! হিহি..." খদ্দেরের রসিকতা আচমকাই উথলে ওঠে, জয়দেবের ঘোলাটে দৃষ্টির সামনে দুলতে থাকে তার দু'হাতের  মধ্যমা। "অ্যাই! কটা আঙুল বল তো? হিহি..."
   পাশ থেকে হাঁসের ডিমওয়ালী লতা এবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "শিবিক হয়েচিস বলে মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি র‍্যা? কানা মানুষটার সনে মস্করা কত্তে বাধছে না? দে তো, দশটা টাকা ইদিকে দে! এট্টা শিশিই নিলি তো, নাকি? যা, এবার ভাগ একেন থেকে..."
   ছোকরা সিভিক পুলিশ যেতে যেতে খর চোখে জয়দেবকে একবার মেপে নেয়। "শোন বে, কানা বেগুন! দাঁতের ছোপ যদি না ওঠে... হুড়কো তো খাওনি শ্লা! তোমার ব্যবসা আমি ঘুচিয়ে দেব, বলে দিলাম।"
-"বোওওলে দিলাম!" লতা মুখ বিকৃত করে সিভিককে ভ্যাঙায়, "যেতে দাও গুঁই, যেতে দাও। গায়ে মেখোনি।"
-বিষ্টু ঘোষের ব্যাটাটা, না রে? গলা শুনেই চিনেচি।
-"বড়টা।" উত্তর দেয় লতা। "সবুজ-জামা পুলিশ হয়েচে না! রোয়াবে মটমট কচ্চে। শুনলে না, রিস্কাটার গায়ে কেমন লাঠি ঠকঠক করে গেল? তা হ্যাঁগো, ভোঁদা এলোনা একনো?"
-আসবে 'খন। ইস্কুল ফুরোলে তবে তো!
-কী জানি বাপু! অত লেকাপড়া শিকে হবে টা কী? ভোঁদাটার গলাখান মিষ্টি, তোমার সনে বসালেই তো পারো! তোমার ওই কেশো গলার গান শুইন্যে আর কটা খদ্দের ধরবে, বলো?
-"তবু তো ইস্কুলে চাড্ডি খেতে পায়। আরেকবেলা তো..." জয়দেবের চিনচিনে বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। "বিষ্টি আসবে নাকি রে? মেঘ গুড়গুড় শুনচি যেন!"
-হুম! বড্ড ঘোর করে এয়েচে গো... গুঁই! তুমি বসো, আমায় তো অতটা পত ফিরতি হবে, জল নাবলে আর রক্ষে নেই! তোমার টাকাকড়ি রাখো, আমি উঠলুম।
   লতার অপসৃয়মান পদধ্বনি অনুসরণ করে মাথা তোলে জয়দেব। এই চলে যাবার দৃশ্যটি বড়ই মনোহর। চোখ থাকতে জয়দেবও ফিরে ফিরে দেখত। এখন ঘোলা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা তেতো হয়ে যায়।
   জয়দেব গুঁই এককালে ট্রেনে-বাসে চড়ে মাজন ফেরি করত। এদিকে চুঁচড়ো, ওদিকে কাটোয়া পর্যন্ত পাল্লা টানত জয়দেবের কালো মাজন। ঘরে বৌ ছিল, গেঁয়ো বদ্যির বেটি মানদা অনেকরকম শেকড়-বাকড়ের গুণাগুণ জানত। জয়দেবের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে, চৌপরদিন শোনা যেত খল-নুড়িতে ঠোকাঠুকির ঠুংঠাং।
   বাপের কাছেই এই মাজন তৈরি শিখেছিল মানদা। নিমডাল, হরতুকী, বয়রা আরও কত কী যে মেশাতে হত! এই এটা-ওটা থেঁতো করছে, আবার পরক্ষণেই বড় উনুনটায় কীসব ফোটাচ্ছে- বৌয়ের কর্মকান্ড মুগ্ধ হয়ে দেখত জয়দেব।
   জয়দেব গুঁই গান গাইতে জানত, কাঁধের ঝোলাটায় মাজন ভরতি করে পাড়ি দিত লম্বা-লম্বা, কিন্তু মাজন বানানোর বিদ্যা তার করায়ত্ত হয়নি। মিস্তিরির পো সবদিক থেকে তাকে পথে বসিয়ে গেছে। এখন বাজার-চলতি পাঁচরকম মাজন কিনে মিশিয়ে নেয় জয়দেব। চোখে ভালো দেখে না বলে, দূরে যেতে ভরসা পায় না। গঞ্জের বাজারে চট ভাড়া করে মাজন সাজিয়ে বসে।
   বৃষ্টি নামল। টিপটাপ ফোঁটাগুলো আসতে আসতে বড় হচ্ছে। জয়দেব এবার একটু অসহায় বোধ করে।
-ভোঁদা এলি নাকি?
উত্তর আসে না। বেহারীদের তৈরি বজরংবলীর মন্দিরে কীসের যেন পুজো চড়েছে! বাঙালী-বেহারীতে মিলেমিশে জগাখিচুড়ি পুজো। একটু আগে বক্সে হিন্দি গানের সঙ্গে ঢাক বাজছিল, এখন কাঁসর-ঘন্টার শব্দ ভেসে আসে:
      কাঁইনানা-কাঁইনানা-তুমকানানা
-"শালা! কানা তোর বাপ!" হঠাৎ রেগে যায় জয়দেব। ঘড়ঘড়ে কাশির সঙ্গে থকথকে কফ উঠে এসেছিল, মন্দিরের দিকে মুখ করে ফেলতে গিয়েও সামলে নেয়, বদলে কান খাড়া করে শোনে-
   শিল পড়ছে! বেশ বড় বড় শিল! দোকানদারদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, সবাই পসরা গুটিয়ে পালাতে ব্যস্ত। ছেলেছোকরারা এরই মধ্যে শিল কুড়োতে নেমে পড়েছে।
-ভোঁদা! এলি রে? ও বাবা ভোঁ-
গলাটা একটু কেঁপে উঠেছিল, হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড শিল আছড়ে পড়ে হাতখানেক তফাতে। এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় জয়দেব। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে:
-ভোঁদা! ও ভোঁদা! কোথায় গেলি, বাপ? ভোঁদা রে...


রাত কত হল? খুব বেশি হবে কি? না, পেঁচোদের বাড়ির হল্লা এখনও শুরু হয়নি। তার মানে, পেঁচোর বাপ, রিক্সাওলা হাবুল এখনও ফেরেনি। লাস্ট ট্রেনের সওয়ারি সেরে, মালিকের কাছে রিক্সা জমা করে ফিরতে ফিরতে হাবুলের রোজই একটা-দেড়টা বেজে যায়। ফেরার পথে একবাট্টি ধেনোর ঠেকটাও ছুঁয়ে আসতে হয়। প্রথমে একজোড়া টলমলে পায়ের শব্দ, তারপর জড়ানো গলায় হাবলার চিৎকার: "পেঁচো! তোর মা'রে ভাত লাগাতে বল।" "আবার আলুছোকা করছিস! লাথ মেরে দূর করি দিব হারামজাদী!"- রোজ রাতে এসব না শুনলে, শালার ঘুমও এখন আর  আসতে চায় না।
    বাদলার ঠান্ডা হাওয়া ছেড়েছে আজ, বস্তির ঘরে ঘরে শালারা সব ঘুমিয়ে কাদা। রাত গভীর নয়, অথচ এরই মধ্যে চারপাশটা কেমন থমথম করছে। মাঝেমধ্যে ভরত ঘোষের বৌটার নাক ডেকে ওঠে, হাঁকডাক শুরু হয় মোড়ের সাট্টার আসরে। টিনের চাল থেকে জল ঝরে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়, শব্দ হয়: টুপ... টাপ... টুপ। নির্ঘুম জয়দেব গুঁই কান পেতে শোনে। শোনে, আর শব্দভেদী হাত নেড়ে নেড়ে মশা তাড়ায় ছেলের গায়ের ওপর।
   ভোঁদাটাও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কাশি ধরবার পর ক্ষয়ে গেছে জয়দেবের শরীর, তবুও ভোঁদার ছোট্ট মুখটা অনায়াসে লুকিয়ে পড়ে বাপের বুকে। শীর্ণ পাঁজরে ছেলের উষ্ণ নিঃশ্বাস উপভোগ করে জয়দেব। কাশির দমক সামলে আলতো স্বরে ডাক দেয়:
-ভোঁদা।
-
-ও ভোঁদা, শুনছিস?
ভোঁদা সাড়া দেয় না। তার একটা হাত এতক্ষণ বাপের কাঁধের কাছে পড়েছিল আলগোছে, এবার গলা জড়িয়ে ধরে। পাটা আরও একটু তুলে দেয় কোলে। জাগাতে মায়া হয় জয়দেবের, তবুও জিজ্ঞেস করে, "ভোঁদা রে! ঘুমুলি নাকি?"
-উম... হুম।
-হ্যাঁ রে, নিতাই মাস্টারটা তোকে খুব ঠেঙিয়েছে না?
-হুঁ...
-খুব লেগেছে, না রে?
-উঁ... পিঠে।
-শাল্লা! আমার ছেলের গায়ে হাত তোলা! জানে না তো, আমার নাম জয়দেব গুঁই। দেখবি, দেখবি ভোঁদা! তোর ওই মাস্টারকে একদিন তুলে আছাড় দেব। দেখে নিস তুই! আরে, নিতাই মাস্টার কোন ছাড়, সেবার বাগেরহাটে দু-দুটো ডাকাতকে একাহাতে ঠান্ডা করে দিইনি! তোর মনে আছে তো গপ্পটা, কি রে?
   এই গল্প ভোঁদা বহুবার শুনেছে। তাও প্রতিবার চোখ বড়বড় করে জিজ্ঞেস করে, "দু-দুটো ডাকাত, বাবা?"
-নয়তো কী? ডাকাতদুটো আমায় ঘিরে ধরেছিল, বুঝলি? দুজনের হাতেই বন্দুক। কিন্তু আমি ঘাবড়াইনি... হুঁহুঁ বাবা! আমি হলুম জয়দেব গুঁই, আমার সঙ্গে চালাকি...
   এতটুকু বয়স থেকে এই গল্প শুনে আসছে ভোঁদা। কখনও ডাকাতের সংখ্যা দুই, কখনও চার। কখনও তাদের হাতে বন্দুকের বদলে ছুরি। বাগেরহাট হয়ে যায় নবীগঞ্জ। ভোঁদা খেয়াল করে, কিন্তু বাবার বীরত্বে গর্বিত হতে ভোলে না।
   এবার কিন্তু ব্যতিক্রম হল। শরীরটা ঝাঁকি মেরে তুলে সরাসরি বাপের মুখের দিকে তাকায় ভোঁদা।
-বাবা, আমাকে একটা নতুন ভূগোল বই কিনে দেবে?
-নতুন বই! নতুন কী হবে রে, ক্ষ্যাপা? তোর তো আছে একটা... সেই যে, অঘোর সামন্তর ছেলের কাছ থেকে চেয়ে আনলুম...
-ওই বইটার তো চারটে পাতা ছেঁড়া! এশিয়ার শেষে আর আফ্রিকার শুরুতে। নিতাইবাবু দেখে খুব রাগ করলেন। ভাবলেন আমি ইচ্ছে করে ছিঁড়েছি। তাই, স্কেলে করে... বাবা, ও বাবা! নতুন একটা বই কিনে দাও না!
   একটু দোটানায় পড়ে যায় জয়দেব। নতুন বই, মানে অনেকগুলো টাকা। বইপত্তরের যা দাম হয়েছে আজকাল! আষাঢ় মাস পড়ে গেল, এখন প্রায়দিন ব্যবসা মার যাবে। আজ মাজন বিক্কিরি হয়েছে কুল্যে তিনটি! মুদীর দোকানে ধার জমেছে কিছু... বাজার সমিতির চাঁদাও বাকি পড়ে আছে দু'মাস। হরেনদা একবার ঠারেঠোরে শাসিয়ে গেছে, এমাসেও দিতে না পারলে...
-"ছেঁড়া, তা'তে কী?" একটু জোর করেই হাসে জয়দেব, "ধর, তোর বাপের যদি হাত-পা কেটে-ছড়ে যায়... তাই বলে কি ফেলে দিয়ে নতুন বাপ আনবি? আরে, চাট্টে তো মোটে পাতা, নাকি?"
-হুঁ!
-চাট্টেই তো? ব্যাস! ও তো মুখে-মুখে বানিয়ে নিলেই হল। কি রে, পারবি না?
   ভোঁদা চুপ করে থাকে। নিজের প্রতিভার ওপর এতখানি আস্থা তার নেই।
-ওই দ্যাকো! গোটা গোটা বই দুলে দুলে মুখস্থ করলেই বুঝি বিদ্যেধর হওয়া যায়? ওরে, অমন কল্লে সেরেফ গাধা হয়েই থাকবি! বাকি বইখানা তো তুই পড়েইছিস, নাকি? তা, চাট্টে পাতা...উঁ...মানে, আর একখানা দেশ। ওই এশিয়া আর আম্রিগার মাঝে।
-আফ্রিকা।
-ওই হল! তা সেটুকু তো বানানোই যায়। আরে, তোর বাপ, এইট পাশ হলে কী হবে? মুখে-মুখে এককালে কত গান বাঁধতো, তা জানিস? ওই যে গানটা শুনিস, 'দাঁত নড়ে, দাঁত কনকন করে...' সেও তো আমারই বাঁধা, নাকি? আর, তুই আমার ছেলে হয়ে চার পাতা ভূগোল বানাতে পারবি না? একটা তো মোটে দেশ!
-
-পারবি না, ভোঁদা?
জয়দেবের কন্ঠস্বর এবার মিনতির সীমানা ছুঁয়ে যায়। ভোঁদা আর আপত্তি করতে পারে না, "উঁ... কিন্তু, দেশ কী করে বানায়, বাবা?"
   কী করে বানায় দেশ? এইট পাশ বাবা সহসা কোনও উত্তর খুঁজে পায় না, তবুও মরিয়া চেষ্টা করে:
-উম... তা ধর, পেথ্থমে দেশটার একখান নাম দিতে লাগে, জবরদস্ত একটা নাম।
-'মানদাদেশ' কেমন হয়, বাবা? যেমন বাংলাদেশ, তেমন মানদাদেশ।
   বুকের কাছে একটা চাপ ধরা ভাব অনুভব করে জয়দেব। ছোঁড়াটা এখনও মায়ের কথা ভাবে? শালী ডাইনি! ছেলে-সোমসার সব ভাসিয়েই তো নাঙের হাত ধরে ভেগেছিস, এখনও  পুরোপুরি গেলিনা? ঘাপটি মেরে রয়েছিস ছেলেটার মনে! জয়দেবের গলায় এবার একটু অবাঞ্ছিত রূঢ়তা ফুটে ওঠে, "খবরদার ভোঁদা! নাম করবি না ওই শালীর!... উঁহু! ওসব নয়। বরং তোর নামে নাম রাখ।
   ঝাপসা চোখে ছেলের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে না। নইলে, ভোঁদার মুখের ঔজ্জ্বল্য দেখে জয়দেব খুশিই হত।
-তাহলে 'ভূদেবল্যান্ড?'
-এই তো! বেড়ে হয়েছে!
-জানো বাবা, যেখানে এশিয়া মহাদেশের শেষ আর আফ্রিকার শুরু, সেইখানে ভূদেবল্যান্ড অবস্থিত। এই দেশের দু'দিক ঘেরা বিশাল পাহাড়, একদিকে মরুভূমি আর একদিকে সমুদ্র।
-আর জঙ্গল? জঙ্গল নেই, ভোঁদা?
-আছে তো! তবে সেই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ নেই। হরিণ আছে অনেক, আর পাখি।
-বাহ্! তারপর?
-অনেকগুলো বড় বড় নদী ভূদেবল্যান্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় নদীটির নাম...নাম...
-লতা।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, লতা। আচ্ছা বাবা, লতামাসি খুব ভালো, তাই না?
-হুম... তারপর বল।
-এইদেশের জলবায়ু সত্যিকারের নাতিশীতোষ্ণ। বৃষ্টি হয় মাঝেমাঝে, তবে-
-না না, ওখানে আর বিষ্টি নামাসনি, বাপ! বিষ্টি হলেই ব্যবসা মাটি। ও থাক।
-"আচ্ছা।" ভোঁদা এবার গড়গড় করে বলে যায়, যেন ক্লাসের পড়া মুখস্থ বলছে, "ভূদেবল্যান্ডের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা দাঁতের মাজন তৈরি। নারীরা বাড়িতে বসে মাজন তৈরি করেন। পুরুষরা সেই মাজন বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। প্রচুর।"
-ভোঁদু রে! তোর দেখছি মাথা খুলে গেছে পুরো!
-বিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত শিক্ষাদান করা হয়, কিন্তু ক্লাসে মারধর করা হয় না। ভূদেবল্যান্ডের স্যারেরা সবাই খুউউব ভালো, নিতাইবাবুর মত না...
   শুনতে শুনতে ঢুল এসে যায় জয়দেবের। চমকে ওঠে পাশের বাড়ি থেকে হাঁকডাক শুনে, পেঁচোর মাতাল বাপ চেঁচাচ্ছে: "ভাত দে শিগ্গির!"
-"হ্যাঁ রে, তোর খিদে পায়নি? রাতে তো কিছুই... চাল তো নেই আর, মুড়ি খাবি দুটো?" বলতে বলতে গলার কাছে কী একটা দলা পাকিয়ে ওঠে, স্বর বুজে আসে জয়দেবের।
   ভোঁদা চুপ করে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ নতুন উৎসাহে লাফ দিয়ে ওঠে:
-ও বাবা, তোমাকে তো বলাই হল না... সেখানকার লোকেদের খাদ্যাভ্যাস কীরকম বল তো?
-খাদ... কী বললি?
-খাদ্যাভ্যাস, মানে কী কী খায়। বইতে এসব কথা লেখা থাকে।
-"থাকে বুঝি?" ধূসর অতীতে তলিয়ে যাওয়া নিজের ছাত্রজীবনের কথা স্মরণ করতে পারে না বাবা। "কী খায় রে?"
-ভাত খায়। রোজ রোজ, দু'বেলা। তার সঙ্গে-
-ঘি একদলা। আর চটকে চটকে মাখা আলুসেদ্ধ।
-দারুণ! তারপর ডালও খায়, তাই না, বাবা?
-খায় তো! সোনা মুগের ডাল।
-হ্যাঁ, ছানার ডালনাও খায়। কাতল মাছের পেটি, তারপর গরম জিলিপি। আর, আর...

_______________________________
© সাম্য দত্ত

No comments:

Post a Comment