Sunday, 19 February 2017

।। এক জীবনে ।।



 আমার ঠাকুর্দা অবিভক্ত বাংলার বরিশাল শহরে জিলা স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাবাও একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে সেই সময়ের শিক্ষার গুনে বা দোষে একই সঙ্গে অংক ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। পরিবারটির বিত্ত ছিল না বিদ্যা ছিল। ’আগে জান পরে ধান’ কিংবা ‘বিষয় আষয় হগলি থুইয়া ল পালাইয়া ইন্ডিয়া’ স্বার্থাণ্বেষী মহলের এইসব বিভ্রান্তিকর রটনায় ১৯৫১ সালে ভিটামাটি ছেড়ে লক্ষলক্ষ শরণার্থী  পশ্চিমবাংলায় প্রবেশ করেন। এক প্রতারক দালালের হাতে পড়ে একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি বরিশাল শহরে দশ কাঠার উপর ভিটেবাড়ি এই বিষয়আষয়ে অনভিজ্ঞ বিদ্যা সর্বস্ব পরিবারটির হাতছাড়া হয়।
 নিঃসম্বল অবস্থায় ঐ বছর মার্চে সীমান্ত পেরিয়ে নানা ঘাটে ভীড়তে ভীড়তে আমার পরিবারটি  ঠাকুরদার এক প্রাক্তন ছাত্রের সহৃদয়তায় ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে  ব্যারাকপুর গঙ্গা পারে গড়ে ওঠা হরিহর উদ্বাস্তু কলোনীতে রাস্তাসংলগ্ন একটি চারকাঠা প্লটের দখল পায়।
 দেশবিভাগের তীব্র দহনজ্বালা অর্ধাহার এবং তৎকালীন কলোনী জীবনের গ্লানি ও সংগ্রাম সহ্য করতে না পেরে ১৯৫৩র নভেম্বরে আমার ঠাকুরদা মারা যান। তার আগে ঐ কলোনীতেই  হরিহর উদ্বাস্তু আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যান। এই বিদ্যালয়েই আমার বাবা এরপরে একটানা বছর সতের শিক্ষকতা করেন।  ১৯৫৩ সালে আমাদের পরিবারে মৃত্যু ওইখানেই থেমে থাকে নি। ঠাকুরদার মৃত্যুর দশদিন পরে আমার একমাত্র কাকাটিও তিনদিনের এক অজানা জ্বরে মারা যান এবং এই পরিবারটিতে ১৯৫৩ র ২৭এ ডিসেম্বর একটি যুগপত্ জন্ম ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আমার সর্বংসহা জননী তাঁর একমাত্র সন্তানের জন্মের সময়ের ধকল এবং অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে বাড়িতেই সন্তান প্রসবের কয়েক ঘণ্টা পর  রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়ে সব সহ্যসীমাই অতিক্রম করেন এবং ভালো করে সাধের সন্তানের মুখ দেখার আগেই চলে যান। জন্মদুঃখী আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ায় আমার নাম রাখা হয় জীবন -জীবনরতন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ঠিক অলৌকিক ভাবে নয় জ্নমের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার জীবনে আবির্ভাব হয় এক গৃহী বেশ্যার যার কিছু মামুলি কেচ্ছাই এই লেখাটির মূল স্রোতস্বিণী।
আমার পাশের বাড়ির রাণী কাকিমার বিতর্কিত(অবৈধও পড়তে পারেন)সন্তানটি আমার জন্মের দুদিন আগে জন্মগ্রহন করে এবং খুব ছেলেবেলায় বোকাসোকা ছিল জন্য তার ডাক নাম রাখা হয় বুকু। এই বুকুর মাতৃস্তন্যের আমি ভাগীদার হয়ে পড়ি। রাণী কাকিমা বুকুর মুখে একটি স্তন্য ও আমার মুখে একটি স্তন্য গুঁজে দেন। এ আমার ও বুকুর প্রায় দু বছর বয়স পর্যন্তই চলে।
 রাণী কাকিমার স্বামী বঙ্কিম সান্যাল আসামে একটি চা বাগানের কর্মচারী ছিলেন, সেখানে তার খাসিয়া পত্নীর গর্ভে দুটি সন্তান থাকা সত্বেও এই সৎ ব্রাহ্মনটি একটি খাটি ব্রাহ্মন কন্যার গর্ভে খাটি ব্রাহ্মণ সন্তানের পিতা হওয়ার লোভে আগের বিবাহাদির কথা পুরোপুরি গোপন করে কপর্দকশূন্য পরিবারের মেয়ে রাণী গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন এবং এই সময়ই বিটিরোডের উপর একটি চা মিষ্টি সিঙাড়ার দোকান চালু করেন যাতে আর খাসিয়া বৌসন্তানদের কাছে না ফিরতে হয়। কিন্তু  বাতাসে ভেসে কাকিমার কানে আসে স্বামীর নষ্টামি ভ্রষ্টাচারের খবর। প্রবল তেজস্বীনী কাকিমা যখন ঝগড়া থেকে সদ্য বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন সান্যাল মশাই তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে সর্বসমক্ষে পরিত্যক্ত ঘোষনা করে প্রথম স্ত্রীর সাজানো সংসারে ফিরে যান।
এইসময়ই কাকীমার নিজের মাসতুতো দাদা খগেন চক্রবর্তী মালদা থেকে কাকীমার কাছে আসেন আশ্রয়ের খোঁজে। স্রোতে ভাসতে থাকা কাকীমা তাঁর এই দাদাটিকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেন।
 খগেন ছিল অতি খলিফা ব্যক্তি।  মাসতুতো বোনের কাছ থেকে শুধু চায়ের দোকানের অধিকার না তাঁর শরীরেরও উপর অধিকার কায়েম করে। স্বামীর ত্যাজ্য হওয়া  এবং খগেনের আবির্ভাব একই সময়ে ঘটে এবং এর ঠিক এক বছরের মাথায় আমি যার প্রাপ্য স্তন্যের ভাগীদার হই সেই বুকু কাকীমার কোলে আসে।
তৎকালীন প্রবল প্রতাপান্বিত কলোনী কমিটি যখন কাকীমাকে ডেকে পাঠায় তখন জেরার মুখে তিনি বলেন আসামে ফিরে যাওয়ার মাসখানেক বাদে একদিন গভীর রাতে বঙ্কিম সান্যাল খাসিয়া বৌকে খুন করে পুলিসের ভয়ে পালিয়ে এসে প্রথমে কাকুতিমিনতি পরে ছোরা দেখিয়ে তিন রাতের জন্য আশ্রয় নেয় এবং পুলিসের ভয়ে অন্ধকারেই পালিয়ে যায়। কাকিমার বয়ান অনুযায়ী বুকু বঙ্কিমের ঔরসজাত সন্তান।
এই গল্প অতি নাটকীয় বলে কলোনী কমিটি বাতিল করে এবং  প্রায় প্রকাশ্যেই বুকু তার মামা খগেনের সন্তান বলে চিহ্নিত হয়।  বুকুর জন্মের পরপরই মিষ্টির দোকানের দখল পুরোপুরি হাতে আসার পর খগেন পাশের গান্ধীকলোনীর  মা বাবার একমাত্র সন্তান একটি মেয়েকে বিয়ে করে ও শ্বশুরবাড়িতেই থিতু হয়।
ব্রাহ্মনকন্যা রাণী কাকীমা বাঁচার তাগিদে বাড়িবাড়ি ঠিকে ঝিয়ের কাজ নেন। কিন্তু তৎকালীন কলোনীর লোকেদের ঠিকা ঝি পোষা বিলাসিতারই নামান্তর । মাসের শেষে বাড়িপ্রতি ৫টাকা , ৭টাকা  ১০টাকা নিয়মিত মায়না আদায় করা এক বিড়ম্বনাই ছিল কাকীমার পক্ষে। একটা সন্তানকে বড় করা নিজের ভাতকাপড়। সন্তানের ক্ষুধার্ত চীৎকার নিজের ক্ষুধার কামড়ের থেকেও মর্মান্তিক। পরণের বস্ত্র শতচ্ছিন্ন হয়ে এমনিই লজ্জা ঢাকতে পারছিল না। কাকীমা মাসে একআধ সন্ধ্যা বিটি রোডের আলোআঁধারিতে গিয়ে দাঁড়াতেন,নিজের ও সন্তানেরপেটের ভাত জোগাড় করতেন খরিদ্দার বাড়িতে বসিয়ে। রাণী কাকীমার নাম চালু হয়ে যায় খানকি রাণী বলে। আরো শিক্ষিত রসিক লোকের  মুখে গৃহীবেশ্যা।
             ১৯৭০ সালটি আমার জীবনের একটি মোচড়। ঐবছর আমার হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষার ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের দিন আমার বাবা স্কুলেই ক্লাস নিতে নিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এবং আমি গুরুদশা অবস্থায় পরীক্ষা শেষ করে আমার বাপ ঠাকুরদার 'হরিহর উদ্বাস্তু আদর্শ বিদ্যালয়ের ' থেকে হায়ার সেকেণ্ডারিতে সপ্তমস্থান অধিকার করি।
সেইসময় ছোটখাট স্কুলগুলোর শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ বিশেষ করে আমার বাবার মত যারা নীতিগতভাবে প্রাইভেট টিউশান দিতেন না। ফলে পারিবারিক সূত্রে মেধা, সুপুরুষচেহারা এবং কলোনীতে গঙ্গাপারে রাস্তা সংলগ্নচারকাঠা জমির উপর একটি বেড়া ও টালির ঘর এই নিয়ে গুরুদশা কাটতে না কাটতেই রাস্তায় দাঁড়ানোর পরিবর্তে প্রাইভেট টিউশান পড়ানো শুরু করি। রেজাল্ট বেরোতে আমার বাবার স্বপ্ন সার্থক করতে এই টিউশানের ভরসাতেই  প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিকসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হই।
১৯৭০ সালের প্রেসিডেন্সি নকশাল আন্দোলনের প্রসব গৃহ। পিছুটানহীন সহায়সম্বলহীন আমার এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না।আমি অন্তরালে চলে যাইএবং পার্টির নির্দেশে উত্তর কোলকাতা ও বেলঘরিয়া অঞ্চলের অ্যাকশান স্কোয়াডের সদস্য হই।
এইসময় ১৯৭১ এর বসন্তে একদিন সোদপুর লেবেল ক্রসিংএ পুলিস ও সিআরপিরযৌথ বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময়ে ক্রমশঃ পিছু হটতে হটতে প্রাণ বাঁচাতে পিস্তল সহ আমার বাড়িতে ঢুকে পড়ি এবং ভূল করেছি বুঝতে পেরে মেঝেতে পাতা কাচা ইট সরিয়ে দরমার বেড়ার তলা দিয়ে শুয়েশুয়ে বেরিয়ে বাড়ির পিছনে রাণী কাকীমাদের কুয়োতলার পাশেই টিন দিয়ে ঘেরা গলা সমান উচু ছাদহীন চানঘরে পালাতে যাই। রাণী কাকীমা ভিতরে স্নান করছিলেন। শব্দ পেয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করে আমাকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় দেখে এই প্রখর বুদ্ধিমতী মহিলা আমার প্রাণশংসয় বুঝে গেলেন এবং হাত ধরে টেনে আমায় ভিতরে ঢুকিয়ে কোনোমতে  গামছা জড়িয়ে গামলা তার উপর বালতি তার উপর আবার বালতি চড়িয়ে আমায় তার আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন। বাইরে তখন পুলিস সিআরপি পৌঁছে গেছে। কাকীমা বুটের আওয়াজ পেয়েই গলা বারিয়ে চীৎকার করে উঠলেন,“কে কে? বাড়িতে আমি একা। চান সারি। পুলিশের আইজকাইল ন্যাংঠা মাইয়াছেলের নাওন দেহনের কাম পড়ে না কি? ভালোয় ভালোয় যান সব। নয়লে আমি কিন্তু সরকারে জবরদস্তি আমার নাওনের সময় ছানঘরে জবরদস্তি ঢোকনের নালিশ দিমু। “ লোকাল থানার ওসি খানিকক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে দলবল নিয়ে ফিরে গেলেন। আমার স্তন্যদায়িনী দ্বিতীয় মা আমার প্রাণ বাঁচালেন।      
 ১৯৭২ এর শেষের দিকে নকশাল আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে গেলে আমি ১৯৭৩ এর গোড়ায় মূলস্রোতে ফিরে আসি,নতুন করে জয়পুরিয়া কলেজ থেকে পরীক্ষা দেই এবং ফার্স্ট ক্লাসও পাই। এম এস সিতে স্ট্যান্ড করার পর অ্যামেরিকায় বার্কলেতে ডক্টরেটের স্কলারশিপ পেতে কোনো অসুবিধা হয় নি।১৯৭৮এ দেশ ছাড়ার আগে আমার চারকাঠা বর্গাকার জমিটির দলিল রাণী কাকীমার হেফাজতে রেখে আসি।
দেশ ছাড়ার কিছু  আগের থেকেই আমি কলোনীগুলোর বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন কিছু পরিবর্তন নজর করি। অধিকাংশ লোকের সৎ অসৎ নানা ভাবেই রোজগারের রাস্তা খুলে যায়। অজস্র  পাকাবাড়ি উঠতে থাকে রাস্তাঘাট ভালো হয়,পানীয় জলও তূলনামূলকভাবে সহজ লভ্য হয়। আমার ঠাকুরদা প্রতিষ্ঠিত  আদর্শ বিদ্যালয়টি জেলার অন্যতম নামী বিদ্যালয় হয়ে ওঠে।
 অন্যদিকে 'রাজনৈতিক শক্তিই প্রধান শক্তি' এই চেতনায় প্রলুব্ধ হয়ে মানুষে মানুষে সৌহার্দ ভালোবাসা স্নেহ শ্রদ্ধা নষ্ট হয়।  রাণী কাকীমার পেটের ছেলে বুকুর মধ্যেও পরিবর্তন দেখতে পাই। সে আর বোকাসোকা ছিল না।সোদপুর বাজারে সেএকটি  মাংসের দোকানের মালিক হয়।  ক্রমশঃ ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে গুণ্ডা হিসাবে তার কুখ্যাতি ছড়াতে থাকে।                                

আমি ডঃ জীবনরতন বন্দ্যোপাধ্যায় অালট্রা ইয়োলো
 রে র জনক।   কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় আমার জীবনের একমেবিদ্বিতীয়ম প্রেমটি আসে ১৯৮৫সালে। ক্রিয়েটিভ আর্ট বিভাগের রিসার্চ স্কলার একটি মেয়ে অ্যানিটা মিটার যার পূর্ব পুরুষ হুগলী জেলা থেকে১০০বছর আগে অ্যামেরিকায় সেটল করে সে বোধহয় আমার সুপুরষ চেহারা দেখেএবং মেধার গল্প শুনে( আলট্রা ইয়োলো রে আবিষ্কারের সঙ্গেসঙ্গে আমার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমি প্রথম শ্রেণীর আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি পাই)আমার প্রেমে পড়েন। দু বছর রোমান্সের পর আমরা ১৯৮৫র মার্চে বিয়ে করি।
 বিবাহোত্তর শয্যামিলনের নিশ্চয়তার প্রশ্রয়ে রোমান্স মরে যায় । হয়তো পারস্পরিক নির্ভরতা মমত্ব স্নেহ বাড়ে। আমাদের ক্ষেত্রে কয়েক মাসেই রোমান্স মরে যায় কিন্তু তেমনভাবে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের রসায়ন পুষ্ট হয় নি।অ্যানিটা নেশাদার এবং পেশাদার অঙ্কনশিল্পী। নগ্ন  পুরুষমানুষের ছবি আঁকে। বহু অ্যামেরিকান পুরুষমেয়েই একগামী।কিন্তু পাবলো পিকাসো যেমন সাধারণতঃ তাঁর সুন্দরী ন্যুড মডেলদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন  না করলে সার্থক সৃষ্টি করতে পারতেন না অ্যানিটারও তাঁর হ্যান্ডসাম পুরুষ মডেলদের যৌন উপভোগের নেশা ছিল। শরীর নিয়ে তাঁর কোনো যেমন ছুৎমার্গ ছিল না  এসবকে সে পাপও মনে করত না। তখনই সে যথেষ্ট নামী অঙ্কনশিল্পী এবং প্রকাশ্যেই বলতো যে কোনো নারীর চরিত্রের বাসস্থান  তাঁর যোনিদ্বার নয়।  শিল্প সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে সে সন্তানের মা ও হয় নি। অথচ বিরাট মনের অধিকারী এই ভদ্রমহিলা নিজের আয় এবং পারিবারিক আয়ের মোটা অংশই দূস্থ  শিল্পীদের পিছনে ব্যয় করে। মানুষের দুঃখে হাউহাউ করে কাঁদে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের পিছনে লাখলাখ টাকা খরচ করে।অন্যদিকে আমিও গুছিয়ে সংসার করা আজন্ম দেখি নি এবং করার জন্য বোধহয় জন্মাই ও নি।
 ফিজিকস , সুপারফিজিকস ই আমার আসল ভালোবাসা। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা  ও সুসম্পর্ক বজায় রেখেই আমরা১৯৯৫র জুলাইতে দুজন দুজনকে মুক্তি  দিলাম।
  এরপর জন্মদুঃখী নিঃসঙ্গ অবহনযোগ্য আমি পাঁচ বছর গবেষণা ও অধ্যাপনায় ডুবে থাকার পর প্রায় ২২বছর পর নিজের হরিহর কলোনীর চারকাঠার বর্গাকার সেই জন্মভিটায় ফেরার আকুতি অনুভব করলাম। কেউই নেই সেখানে পিছন ফিরে দেখার যদি জীবনদায়ীনী  রানী কাকিমা বেঁচে থাকেন এই আশায় তাঁর ঠিকানায় একটা আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম পাঠালাম।            
এয়ারপোর্টের খুব কাছেই হরিহর কলোনীতে পৌঁছানো কোনো সমস্যা ছিল না। তারপরই সব কেমন গুলিয়ে গেল। গঙ্গাসংলগ্ন একদা  উদ্বাস্তুু কলোনী এখন হরিহরনগর। বড়বড় বহুতল শোভিত এলাকার অধিবাসীরা আমায় চিনবে না জানতাম। জিজ্ঞাসা করে আদর্শ বিদ্যালয় খুঁজে বার করে একটি মুদিখানা দোকানে ‘বোকাদের বাড়ি কোনটা?’ জিজ্ঞাসা করায় বিরাট ধমক খেলাম। ‘বোকা কি মশাই?আপনার জন্য আমরা মার খাব নাকি?ওনার ভালোনাম বিক্রম সান্যাল। এই বেলঘরিয়া সোদপুর ব্যারাকপুর এলাকার সবচেয়ে বড় প্রোমোটার। দাপটে বাঘেগরুতে মানে দুটো প্রধান  রাজনৈতিক দল একই বোতলের স্কচ খায়।’  
বুকু  যখন ছেলেবেলায় মায়ের স্বামীর  উপাধি ব্যবহার করতো নিষ্ঠুর লোকজন বলত,‘আচ্ছা বোকা নয় বিরিকরমই হইল। তয় সান্যাল?আরে খগেন চক্বোত্তীর পোলা তুই বিরিকরম চক্কোত্তী। ’বোকাসোকা বুক্কু না বুঝে হি হি করে হাসত। এখন নিজের অর্থবলে বাহুবলে বিক্রম সান্যাল হয়েছে সব নোংরা বিরূপতাকে দমন করে।  
                 পাশাপাশি দুটো প্লট যেমন ১৯৭৮ সালে ছিল প্রায় তেমনই আছে। আমাদের বেড়ার বাড়িটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে । কাকীমার কাছেই উঠলাম।২২বছর পরেও কাকীমা সবই মনে রেখেছেন। আমার জন্য আমার প্রিয় ফুলকপি কইমাছ আর পায়েস করে রেখেছিলেন এই ৭২ বছরের অশক্ত  শরীরের বৃদ্ধা। খেয়ে উঠে জেটল্যাগে ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।   কাকীমা খাটে পাশে এসে বসলেন, কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বোললেন,“মন! ত’র লগে কয়খান কথা আছে। বুকুর থাবার চেয়ে অনেক কষ্টে বাঁচাইয়া রাখছি এই ল ত’র দলিল। আর আমার খানও রাখ। ত’র দুইপাশে দুইখান প্লট কম পয়সায় ভয় দেখাইয়া কিনছে। ত’র ওই চৌকা জমিটার উপরে ওর  নোলা ।তার সঙ্গে অনেক দুঃখের আমারটার ও। ত’র দলিলখান সামনের ঐ ব্যাঙ্কে কিছু টাকা দিয়া একখান ঐ লকার না কি কয় ভাড়া লইয়া ওইখানেই রাখ। এই দুই দলিলের জন্য তিনবার আমার পেটের পোলা আমার গলা টিপ্পা মারতে গেছে। তুই দেওয়াল দিয়া খানদুই ঘর অন্তত কইরা রাইখ্যা যা। আর ঐ পাপরে এই আমার এই জমিও দিম না। ওর হাতে তিন মানুষ মারনের রক্তলাগা। নিজের নামে দুই বউ এর নামে দশদশ খান ফেলাট পাঁচখান বড় গাড়ি আছে। তুই থাকতে থাকতে বন্দোবস্ত কর। আমি এইখানে অনাথ আশ্রম খুলুম। ”    
                  ভেবেছিলাম  আর অ্যামেরিকা ফিরে যাবো না। কিন্তু  তা হয় নি। এখানে আমার স্তন্যদাত্রী জীবন দাত্রী মা আছেন যার কথা২২ বছরে মনে পড়ে নি ।ওখানে কেউই নেই। তবুও কর্ণেলে পদত্যাগ পত্র পাঠাতে পারি নি। কারণ সেই ফিজিক্স অর্থাত্  সুপার ফিজিক্সের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। ফিজিক্স চর্চা ছাড়া আমার বেঁচে থাকার  আর তেমন কোন আকর্ষণও এযাবত্ ছিল না । এবারে আরো একটা আকর্ষণের ক্ষেত্র তৈরী হলো।আমার প্লট কাকিমার প্লট মিলিয়ে আমারই অর্থে কাকিমার নামে অনাথ আশ্রম তৈরি করেছি “রাণীমার রাজপুত্র রাজকন্যারা। ”
যতদিন কাকীমা বাঁচবেন বছরে একবার করে ছুটি নিযে এসে তাঁরই সাথে আশ্রমের এককোনে পড়ে থাকব। তারপর আবার অ্যামেরিকা কর্মস্থলে ফিরেও যাবো  সুপারফিজিক্স চর্চার টানে।
ঈশ্বরে সে ভাবে বিশ্বাস করতে পারি না কিন্তু এই অনাথ আশ্রমই হবে এখন থেকে আমার বাত্সরিক তীর্থস্থান। যতদিন রাণীমা বেঁচে থাকবেন আসবো  তারপরও আমৃত্যু আসব তাঁর রাজপুত্র রাজকন্যাদের দেখাশুনো করতে। রাণীমার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে।

 আমার প্রাক্তন স্ত্রী অ্যানি বলতো কিন্তু তাঁর আচরণের থেকেও অনেক বেশী শিখলাম রানীমার জীবনচর্য্যা থেকে- নারীর চরিত্র তাঁর যৌনজীবনে নয় তাঁর ভিতরের মনুষ্যত্বের শক্তিতে।

( সব চরিত্র কাল্পনিক। )
___________________________
© পৃথ্বী ব্যানার্জী

No comments:

Post a Comment